ভূতের মায়া

ভূতের মায়া

রমিজের বয়স ২২ বৎসর। শক্ত পোক্ত শরীর। শ্যামবর্ণ, মাথা ভরা ঝাঁকড়া চুল। রিকসা চালালে, ঘামে মুখ তেলতেলে হয়ে যায়। তবুও সবসময় হাসি লেগে থাকে তার চোখে-মুখে। আজ দুই বছর হলো ঢাকা শহরে এসেছে রমিজ। থাকে বাওনিয়া বস্তিতে। তার বউ বেজায় মুখরা। সব সময় ঘ্যান ঘ্যান করতেই থাকে। ছোট ছেলেমেয়েরা ঘুমাইলেই আরো প্যান-প্যানানি বেড়ে যায়। তাই বাধ্য হয়ে অনেকটা মনের সুখে মাঝরাতে রিকসা চালায় সে। ঠিক রাত বারোটায় রিকসা নিয়ে রাস্তায় নামে। সকাল সাতটায় বন্ধ। সকাল সাড়ে সাতটায় বাড়ি ফেরে সে। তারপর বউ গার্মেন্টসে যায়। বাচ্চাগুলো যায় স্কুলে। আরামে চার-পাঁচ ঘণ্টা ঘুমাতে পারে রমিজ। সবসময় বস্তির মানুষের চিল্লাচিল্লি ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকে। আসলে রাতের ঘুম, রাতের ঘুমই। স্রষ্টার অফুরন্ত রহমত। দিনে সারাদিন ঘুমালেও শরীর মনের ক্লান্তি যায় না।

রাতের ঢাকা; বড় বিচিত্র শহর। গ্রাম থেকে লোকজন ফিরে আসে অনেক রাতে। গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালী বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত রিকসা নিয়ে চলে যায় সে। অনেক সময় জরুরী রোগী নিয়ে যেতে হয় হাসপাতালে। অনেক যাত্রীর আবার জরুরী থানা পুলিশ এর কাছে দৌঁড়াতে হয় মাঝরাতে। চোর-ডাকাত, বেশ্যাদের আনাগোনাও বেড়ে যায়। অনেক ভবঘুরে, ফকির, সন্ন্যাসীরও দেখা মেলে মাঝরাতে। ঢাকায় সবচেয়ে বড় পাইকারী বাজার শুরু হয় মধ্যরাতে থেকে। সেখানকার বেশিরভাগ যাত্রী মূলত কারওয়ান বাজারের সবজি, মাছ বা মুরগির পাইকারি ক্রেতা।

কালশি রোডে দ্রুত রিকসা চালাচ্ছে রমিজ। আজ প্রচণ্ড গরম। সামান্য মৃদু মন্দ বাতাস। তবুও লক্ষ্য করলো কবরস্থানের গেটের উপর টাঙানো কাপড়ের ব্যানারটা খুব জোড়ে-জোড়ে নড়ছে। হঠাৎ কিছুটা ভয় পেলো রমিজ। যদিও প্রচন্ড সাহসী সে। তবুও অজানা-অচেনাকে ভয় হয় তার। ব্যানারটা খুলো নিচে পড়লো । এক সাথে চারটা দড়ি যেন কেটে দিলো কেউ।

ও, ওই যে পাগলটার কাজ। তার সারা শরীরে মাটিমাখা। চাদরের মতো করে গায়ে পড়ছে ব্যানারটা। ধীরে রিকসা থামালো রমিজ। একটা কুকুর মাথা নিচু করে হাঁটছে লোকটার পাশ দিয়ে।

— সেলামালাইকুম, বাবা। শ্রদ্ধার সথে বললো রমিজ।

হঠাৎ মানুষের গলার শব্দ শুনে তার দিকে ঘুরে তাকালো পাগলটা। ভালো করে লোকটাকে দেখলো রমিজ। পরনে সাদা কাফনের কাপড়ের মতো লুঙ্গি, ব্যানারটা শীতের চাদরের মত করে গায়ে জড়ানো। মুখের মধ্যে একটা ক্ষত। সেখানে কালো কালশিটে রক্ত জমে আছে। চোখের মনি দুটো সম্পূর্ণ কালো।

— বাবা আমি পীর, ফকির, মুরিদ, মুর্শিদ মানি। আপনার কোনো উপকার লাগলে বলেন। বিনীতভাবে বললো রমিজ। রমিজের দিকে সরাসরি তাকালো লোকটা। তার অদ্ভুত গা, শীরশীরে তাকানোর ভঙ্গি। অনেকটা চেনা চেনা লাগছে লোকটাকে। ও হ্যা! সেদিন রাত ২টার দিকে একটা দশ-বারো বছরের মেয়ে দৌঁড়ে দৌঁড়ে ডাকছিলো। ‘এই রিকসা, এই রিকসা। যাবেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন?’ রাত তখন দুইটা হবে।

— কে যাবে?

— আমার আব্বা, আমি, মা। চলেন না। খুব কাতর ছিলো কিশোরীটির কণ্ঠ।

এতরাতে মেয়েটিকে রাস্তায় একা দেখে অবাক হয়েছিলো রমিজ। ঠিক এই পাগলের মতো দেখতে ছিলো মেয়েটির অসুস্থ বাবা। মাথা অর্ধেকটা টাক। মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি। মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছিলো তার। হার্ট-এ্যাটাক হয়েছিলো। মেয়েটি আর তার মা মিলে টেনে দাঁড় করাতে পারছিলো না লোকটাকে। রমিজ পাঁজা কোলে তুলে রিকসায় বসালো তাকে। পাশে উঠে বসে, মেয়েটি আর তার মা দাঁড়িয়ে ধরে বসে থাকলো লোকটাকে।

চারদিকে অদ্ভুত কিছু একটা মনে হলো রমিজের। লোকটার গা থেকে আতরের গন্ধ আসছে। নাকের ছিদ্র দুটো সাদা তুলো দিয়ে বন্ধ।

— কী রে ভালো মানুষ ক্যামন আছিস? জিজ্ঞাসা করলো লোকটা।

— ভাল, কোথায় যাবেন?

— বাসায়।

— কোন জায়গায়?

— তুই তো চিনিস আমার বাড়ী।

রমিজ বুঝলো এই লোকটা সেই অসুস্থ রোগীটা। রিকসায় উঠে বসলো লোকটা। তার শরীরের তেমন কোনো ওজন নেই লক্ষ্য করলো রমিজ।

— ভাইয়ের এর কী মৃগী রোগ না জ্বীন-টিনের আচড় আছে? রিকসা চালাতে চালাতে জিজ্ঞাসা করলো রমিজ।

— না রে ভাই, বেজী কামড় দিছে। কবরস্থানে অনেক বেজী। সোজা গর্ত খুড়েঁ কবরে চলে যায়। তারপর কামড়ায়।

— ও, রাতে কবরস্থানে ঘুম খুব ভালো হয়। আমিও অনেক ঘুমাইছি, বললো রমিজ।

— আমি… বলে থেমে গেলো লোকটি। পাশেই আস্তে আস্তে চলছে পুলিশের গাড়ি। সেটা পার হলে আবার কথা বললো লোকটি— ভাই আপনি রাতে রিকসা চালান কেন?

— বাসায় মুখরা বউ, খালি হুদাই ঝগড়া করে। পোলাপানগুলোরে বকে। ঘুমের মধ্যেও ঘ্যান ঘ্যান করে। দিনে গার্মেন্টসে যায়। একা একা পোলাপানগুলো নিয়া আরামে ঘুমাই। খাওয়াই, গোসল করাই। বললো রমিজ।

— এত দু:খ করিস নারে ভাই। মৃত্যুর পরে ওই মুখরা বউ আর পোলাপানের জন্য কাঁদবী সারাক্ষণ।

— বউ এর লাইগা কান্দুম না ভাই। বহুত জ্বালায়।

— বাদ দে! জানি ওসব, এখন বুঝি সবকিছু। আমারে দ্যাখ, বদমেজাজী বউ আর আমার আদরের মেয়েটার জন্য কেমনে সাড়ে তিন হাত মাটি খামছাইয়া উইঠা আইছি।

— কি বললেন ভাই!

— হ রে ভাই, বেজীগুলো আর কুকুরটা মুখের কাছে মাটিটা আলগা করছিল। সাধের পৃথিবীটা দেখে বড় মায়া হলো। মৃত্যুর পর মেয়েটা আর বউটার বুকফাটা কান্নার কথা মনে হলো, বুকটা হু, হু করতেছিল। আইসা পড়লাম ওদের দেখতে।

শুনে ভয়ে জ্ঞান হারানোর অবস্থা রমিজের।

সেই লোকটি বলে চললো, রিকসাওয়ালা ভাই, দু:খিত আপনার নাম জানা হয় নাই। থাক পিছনে তাকিয়েন না। অযথা ভয় পাবেন। আসলে আমি আপনার একটা উপকার করতে আসছি। আপনি মহৎ মানুষ। বিপদে আমাদের সাহায্য করেছেন। ভাই, মৃত্যুর পর বুঝতে পারলাম, আসলে পৃথিবীর জীবন কত দামি। কত সামান্য ব্যাপারে আমরা দু:খিত হই, রাগ করি, ঝগড়া করি। মৃত্যুর পর এই অপ্রিয় মানুষগুলোকেই সারাক্ষণ মনে হবে। স্রষ্টার কাছে বেহেশত চাইতে ইচ্ছে করবে না। মনে হবে, পুনরায় পৃথিবীতে মানুষ রূপে ফিরে যাই। সব ভুলত্রুটি সংশোধন করে এবার হাসি আনন্দে জীবনটা উপভোগ করি। একটু থামলো লোকটা। সে সময় পেছন ফিরে তাকালো রমিজ।

‘যাই ভাই, বউ আর মেয়েটাকে একটু দেখে আসি।’ বলেই হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলো লোকটি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত