মৃত্যুবিলাস

মৃত্যুবিলাস

মিজান সাহেব আমার হাতে হাত রেখে বললেন এতদিন পর যে আবার দেখা হবে ভাবিনি। গত বছরই তো আমরা একসাথে মারা গেছিলাম। কি বলেন?

আমার মনে পড়ল, হ্যাঁ গত বছরই তো আমাদের একসাথে মৃত্যু ঘটেছিল। সাথে আরও দুজন ছিল। কমলাপুরের মানিক ড্রাইভার আর রসুলগঞ্জের আদম ব্যাপারি। তাদের মুখটা কয়েক সেকেণ্ডের জন্য চোখের সামনে ভেসে উঠল। রসুলগঞ্জের আদম ব্যাপারির কি কাকুতি মিনতি। বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা। ভাইজান আমারে শেষ রক্ষা করেন। আমি বাঁচতে চাই ভাইজান। আমি বাঁচতে চাই। ওরে মাগো, ওরে বাবাগো, আমি মইরা গেলাম গো। তখন ইচ্ছে হচ্ছিল ব্যাটার শূন্যে তুলে আরেক আছাড় দিই। কিন্তু দিতে পারিনি কারণ সবার আগে আমার মৃত্যু হয়েছে।

আমি শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাহাকার দেখেছি। চিৎকার শুনেছি। আর মনে মনে মৃত্যু কামনা করেছি। ব্যাটারা মরে না ক্যান? দেশের যা অবস্থা তাতে আর বেঁচে থেকে লাভ কি? ইচ্ছে হচ্ছিল আদম ব্যাপারির গলা টিপে ধরি। ব্যাটা এখনও মরেনি। শুধু চিৎকার চেচামেচি করে। ওদিকে মিজান সাহেবও প্রায় আধমরা। তার সারা শরীরে রক্ত। বেহুশ। ভাঙা গাড়িটা পড়ে আছে একটু দূরে। ভেঙে তছনছ। মানিক ড্রাইভার ইতোমধ্যে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। তাকে জিজ্ঞেস করি। কতক্ষণ আগে মরেছ? সোজা উত্তর এক্ষুনি, শুধু শুধু বাঁইচা থাইকা লাভ কি ভাইজান। দেখতেছেন না জনসংখ্যা কী হারে বাড়তেছে। ভাইজান আমরা মারা গেলে দেশে কত উপকার হইবো একবারও কি ভাবছেন?

ভাবার সময় কই? মেজাজটা খিটখিটে। ও ব্যাটাদের না নিয়ে আমি কোথাও যাব না। শালারা কি এখনও বুঝতে পারছে না, বেঁচে থাকাতে দেশের কত বড় ক্ষতি হচ্ছে? কিছুক্ষণ পরেই আমাদের সাথে মিজান সাহেব এসে যোগ দিলেন। তিনি শিক্ষিত লোক। তাছাড়া তিনি দেশের একজন বিশিষ্ট মন্ত্রীর বড় জামাই। এটা কি যা-তা ব্যাপার! নেতার জামাই হওয়া চারটে খানিক কথা না। এদেশের কত টাকা থাকলে একজন মন্ত্রী হওয়া যায় আর কত টাকা থাকলে একজন নেতার জামাই হওয়া যায়, ভাবার বিষয়। যাই হোক তিনি এসে যোগ দিয়েছেন আমাদের সাথে। তিনিও ঐ একই কথা বললেন। ভাই আমি মন্ত্রীর জামাই তো, তাই দেশের একটু উপকার করে আসলাম। বোঝেন না আমি না মরলে দেশের উপকার হয় নাকি? মন্ত্রীর জামাই বলে তো কথা ! আমারই উচিৎ ছিল সবার আগে মারা যাওয়া। কি বলেন?

আমার মেজাজটা আরও খারাপ হয়ে গেল। ব্যাটা বার বার পরিচয় দেয় মন্ত্রীর জামাই ! ইচ্ছে হচ্ছে টেনে একটা চড় বসাই গালে। তুই ব্যাটা মরেছিস, তুই কারো জামাই টামাই না। এখানে কেউ কারো জামাই হয় না। আমরা সবাই সমান।

আমার মুখে শুষ্ক হাসি। কিন্তু রসুলগঞ্জের আদম ব্যাপারি তো মরে না! ঐ শালার দেখছি কই মাছের প্রাণ। তুই মর। শ্রীঘই মর। দেশের উপকার কর। তোর পায়ে ধরি ভাই, তুই তাড়াতাড়ি মর।

মিজান সাহেব বললেন, আমাদের মরার ব্যবস্থা কে করেছে জানেন?

– কে আবার? আমরা তো এন্মি এন্মি এক্সিডেন্টে মরছি। ঐ শালা মানিক ড্রাইভার, শালা হেলপার হয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়ে উল্টাপাল্টা গাড়ি চালাইছে।

– ওর দোষ দিবেন না ভাইজান। সব দোষ আমার শ্বশুরের। জানেন না, আমার শ্বশুর একজন মন্ত্রী। আমার শ্বশুরই তো ঐ ব্যাটাদের ডাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার পারমিশন দিছে। আর রাস্তা ঘাটের অবস্থা দেখেছেন ভাইজান, ভাঙ্গাচোরা। বড় বড় গর্ত। অবশ্য আমার শ্বশুর সেদিকে ডোনটকেয়ার। তিনি জনগনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এক বছরের মধ্যে জনসংখ্যা কমিয়ে আনবেন। দেখছেন না তার কার্যক্রম কেমন চলছে।

মনে মনে ভাবি তিনি তো চমৎকার আইডিয়ার মানুষ। কত সুন্দর করে জনসংখ্যা কমাচ্ছেন। তিনিও তো আমাদের মতোই সমাজ সেবা করছেন।

মানিক ড্রাইভার বললেন ভাইজান আপনি তো সমাজ সেবা নিয়া আছেন, আমার তো বাড়ি যাওন লাগবো। বউ পোলাপান না খাইয়া আছে। বাড়িতে একটা পয়সাও নাই। এখন কি করমু? তাকে ধমকের সুরে বলি, চুপ কর ব্যাটা। কিসের এত বউ বউ করিস। মিজান সাহেব যদি মন্ত্রীর মেয়েকে রেখে আমাদের সাথে সমাজ সেবাই আসতে পারে, তুই পারবি না কেন?

আমার কথাই সম্পূর্ণ শান্ত মানিক ড্রাইভার। তারপরও তার মুখ থেকে অস্থিরতার ছাপ এখনও মুছে যায়নি।

প্রায় মধ্যরাত। রসুল গঞ্জের আদম ব্যাপারি আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে। সে আমাকে এখানকার বড় নেতা মনে করেছে। বস সারা জনম লোকের টাকা মাইরা খাইছি। এখন আপনাগো লগে সমাজ সেবাই আইসা বুঝছি, কত শান্তি। কোনোদিন কারো উপকার করি নাই। মইরা এখন সারা দেশের উপকার করছি– এর চেয়ে বড় আর কী হইতে পারে?

আমরা চারজন এখন বন্ধু। আমাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। চার জন এদিক ওদিক ঘুরি। রাত প্রায় শেষের দিকে। সকালে মিজান সাহেবের ছবি দেখি পেপারে। বড় ছবি। বড় বড় লেখা। তাজা খবর। মন্ত্রীর জামাই রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। আমাদের ছবি নাই। হতাশ আমি। মিজান রোড এক্সিডেন্টে মরছে আর আমরা শালার নদীর জলে ভেসে মরছি। আমরা যে আগে আগে মরলাম এর কোনো নাম গন্ধ নেই। এ শালা স্বার্থপরের দেশ। এ দেশেই আর থাকা চলে না।

দেখতে দেখতে এক বছর কেটে গেল। আমি তো আবাক। আমাদের মতো সমাজ সেবকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। গর্বে আমার মাথা উঁচু হয়ে যায়। এ দেশে এতো মানুষ সমাজ সেবা করে! বাপরে বাপ!

কত নতুন মুখ! এত নতুন মুখ দেখে আমার মনটা আনন্দের জোয়ারে ভাসতে থাকে। কিছুক্ষণ পর দেখি এক চলচ্চিত্র নির্মাতা। আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। আরে আজকাল দেশের চলচিত্র নির্মাতারাও এভাবে দেশের সেবা করে! দেশের সর্বস্তরের মানুষ এখন সজাগ। সবাই দেশের সেবাই নিজেকে আত্মত্যাগ করছে। বাহ! এভাবে যদি চলতে থাকে নিশ্চয় এক সময় জনসংখ্যা কমবেই, কমবে। হঠাৎ মিজান সাহেব উপস্থিত। আরে ভাইজান যে, আমার দেশ দিন দিন উন্নতি করছে ভাইজান। সব আমার শ্বশুরের অবদান। কে তোমার শ্বশুর? বারবার সেই একই পরিচয়। তোমার কি নিজের কোনো পরিচয় নাই?

আচ্ছা ও সব বাদ দেন। তার চেয়ে বরং চলেন দেশান্তর হই।

দেশান্তর হওয়ার দরকার নেই। আমরা এখন অদৃশ্য জগতে। এখানে দেশান্তর হতে হয় না। দেশান্তর হওয়া বোকামী। আমরা দেশ সেবা করছি কী দেশ থেকে পালানোর জন্য? তার চেয়ে বরং এখানেই একটা সুন্দর সমাজ গড়ি। এখানে স্বার্থপরতা, মারামারি হানাহানির কোনো স্থান হবে না। চলো আমরা কাজে লেগে যাই।

চলেন ভাইজান। দু’জনেই ধীরে ধীরে এগুতে থাকে নতুন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে। সমাজ গড়ার চিন্তা তাদের মধ্যে ঐ জগতে না থাকলেও এই জগতে আছে। ঐ সমাজে পিছু পা থাকতে পারে; এখানে নেই। এখানে বড়-ছোট সবাই সমান। মিজান সাহেব বললেন, আমি মন্ত্রীর জামাই তো সবার আগে আগে যাই, চলেন।

এ ব্যাটার মুদ্রা দোষ তো ছাড়ে না। বার বার শুধু একই পরিচয় দেয়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত