লোভাতুর দুপুরটা যখন এক গ্লাস কাঁচা লেবুর সরবতের শুভেচ্ছা দিয়ে শুরু হয় তখনি মনে পড়ে যায় দুবছর আগের চৈত্র মাসের কোন এক দুপুরের কথা।
সেদিন পিপাসায় পথিকের ছাতি ফেটে যাওয়ার মতো রোদের ঝলক অসম্ভব গতিতে সূর্য থেকে মেঘ ভেদ করে নেমে আসতেছে। মাঠে মাঠে দু চারজন কৃষক মাথায় ঘাসের বস্তা চেপে ছুটে চলেছে নিদান কালের সাক্ষী কোন এক মস্ত বটগাছের দিকে। ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে বট গাছ। বটগাছের তলায় কুঁড়ি আশিজন মানুষ ঠাসাঠাসি করে বসে আছে। এমনতাবস্থায় শরদিন্দু বাবুর ব্যোমকেশ বক্সির মতো গোয়েন্দা ভাব নিয়ে তাদের সামনে গিয়ে হাজির হই। লিকলিকে গোঁফের তলায় দুপাটি দাঁত বের করে একজন বলে ফেললেন, কোন গায়ের লোক হে? আইয়েন, একটু জিরান। এমনিতে নাচুনি বুড়ি তার উপরে ঢোলের বারি। তাদের সাথে বসে না হয় নিজের কেরামতির একটু পায়তারা করা যাক।
একজন কোমলমতি সরলা নিম্নলোচনে বটের শিকড়ের আসন ছেড়ে আমাকে বসতে দিলো। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা ভাব নিয়ে কিছু না ভেবে বসে পড়ি। খোলা তরবারির মতো ভ্রু কুঁচকে তেলতেলে কালো চেহারার একজন মেজিবাবু বলে দিলো, ভায়া, যদি আপনার পরিচয় দেন তবে কথা বলতে পারি। ভাবলেশহীন এমন প্রশ্নে বিমোহিত, সুরভিত, সুমোহিত হয়ে বেচারা মেজিবাবুকে ফস করে বলে ফেললাম আমি গোয়েন্দা। দু চার হাতের মধ্যে যাদের কান পরিষ্কার ছিলো তারা কথাটা শুনে হকচকিয়ে উঠে আমার দিকে কুম্ভকর্ণের ছোটভাই বিভীষণ ভেবে তাকিয়ে আছে। আমি তাদের চোখে চোখাচোখি না করে অনবরত বলেই চলছি, আমি গোয়েন্দা। পাশের গায়ের রতন বাবুর বাড়িতে যাব ইনভেস্টিগেশন করার জন্য। শুনেছি বেচারা রতন বাবুর মেজো ছেলে নাকি লেবুর সরবত গিলে খেয়ে গলার মাঝে বিষ আটকে মারা গেছে। মেজিবাবু পাশে থেকে চটাং করে দাঁড়িয়ে বলে দিলো, মরবে না কেনো, ও বেটা দুপরবেলা একটু জিরিয়ে নিয়ে সরবতটা খেতে পারতো। তা না করে সোজা ঢক ঢক করে সাড়ে চার গ্লাস একাই খেয়ে ফেললো!
সরবতে যে হাসিপাতির নজর ছিলে তা তো খেয়ালে নেয় নাই৷ আমি মেজিবাবুর কথার আগা মাথা বুঝতে না পেরে কানকাটা বেয়ারার মত প্রশ্ন করলাম হাসিপাতি কি জিনিস। ওমা, আপনি হাসিপাতি চিনেন না? তাহলে তো গেছেন। নতুন লোক এ গায়ে আসলে তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে অন্য গায়ে নিয়ে যায় বা নদীতে নিয়ে চুবিয়ে মারে। আর গায়ের লোক হলে তাদের সাথে সাথে বাড়িতে যায়। তাদের খাবারে নজর দেয়। আর একবার নজর দিলেই কেল্লা ফতে। মেজিবাবুর কথার সাতপাঁচের প্যাঁচে পড়ে মাথাটা একটু ভারী হয়ে এলো।
হঠাৎ হাসিপাতি নিজের কেরামতির খেল দেখালে আমি কেরামত আলী কিসের কেরামতি করতে আসছি। না হয় হাসিপাতি আছে। কিন্তু ভিনগায়ের লোক তার কি চরম ক্ষতি করে সরম দিলো যে এভাবে তাকে শাস্তি দিবে। আমি তড়াং করে উঠে হাঁটা শুরু করি। আর মনে মনে হাসিপাতির কেরামতি গুনতে থাকি। একটু পর দুপরের সূর্য পশ্চিমে বেকে গিয়ে হিহি করে আমায় দেখে হেসে উঠলো। খুব তৃষ্ণা পেয়েছে দেখে পাশের এক বাড়িতে গলা বাড়িয়ে ডাক ছেড়ে দেখলাম কর্তা বাসায় আছে কিনা। তকতকে লকলকে এনি সাপের মতো চেহারা অসম্ভব রকমের সুন্দরী শুটকি গঠনের চেহারার একটি মেয়ে আলতো ঘোমটা টেনে বেরিয়ে এলো। তাকে বললাম এক গেলাস পানির কথা। সে বেচারি অপরূপ রূপে রূপবতী, পাশাপাশি গুনবতী। সে দৌড়ে গিয়ে এক গেলাস কাঁচা লেবুর সরবত এনে দিলো। মনের সুখে সাত পাঁচ না ভেবে ঢকঢক করে খেয়ে ফেলি আস্ত এক গেলাস লেবুর সরবত। কিছুক্ষণ পর আমার ঘুম আসে। পাশেই পড়ে থাকা একটা চারপেয়ির উপর নিজেকে এলিয়ে দেই।
যখন টের পেলাম তখন সবে সন্ধ্যা শুরু হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, আমি ইট পাটকেলের দেয়াল ঘেরা একটা রুমে শুয়ে আছি। দেখে মনে হলো উচ্চ কক্ষের কোনো হাসপাতাল। বন্ধু অমলেশ এসে বললো, আমি নাকি সাতদিন আগে কোন এক বাঁশ ঝাড়ে পড়ে ছিলাম। এলাকার লোকজন তুলে এনে শহরের হাসপাতালে ভর্তি করে। আর পকেটে থাকা ঠিকানায় সবাইকে খবর দেয়। তারা নাকি বলে গেছে, হাসিপাতির দয়ায় এখনো বেঁচে আছো। নয়তো সেদিনে তোমায় মেরে ফেলতো।