– চাচা মিয়া, পার্থ কই আছে জানেন?
– না তো বাবাজী। পার্থ নামের কাউকে তো চিনি না। কেনো? কী সমস্যা?
পার্থ এই এলাকায় পুলিশের খোচর। এমনিতে সে একজন ছিঁচকে চোর। তবে পুলিশের কাছে শহরের অপরাধজগতের যে কোনো তথ্য পাওয়ার জন্য বিশ্বস্ত নাম পার্থ। আদিত্য বাবু অনেকদিন ধরেই তাকে খুঁজছেন। কিন্তু, পাচ্ছেন না। কাজের সময় এই লাইনে কাজ করা লোকদের খুঁজে পাওয়া যায় না। বৃদ্ধের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক্সেলেটরে হাত চালিয়ে সামনে এগোন আদিত্য নারায়ণ সরকার। জেলা পুলিশের তদন্ত শাখার একজন উপপরিদর্শক হিসেবে কাজ করছেন নেত্রকোণা জেলায়। মগড়াপাড়ের শান্ত এই জনপদে টুকিটাকি চুরি, ডাকাতি ছাড়া তেমন কোনো অপরাধ ঘটে না। মোটামুটি শান্ত একটি মফস্বল শহর নেত্রকোণা। কিন্তু গত ২ মাসে ৮ জন খুন হয়েছেন ছোট্ট এই জেলা শহরে। সবাই বিশ থেকে পঁচিশ বছরের ভেতর। সবাই এলাকার লাফাঙ্গা শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত ছিলো। নেশা করে এলাকায় বিশৃঙ্খলা করে বেড়াতো। সবগুলো খুনই হয়েছে রাত ১২ টা থেকে ১ টার ভেতর। গলিতে গলিতে টহল ভ্যান পাঠিয়েও এই সমস্যার কোনো সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না৷ শেষ খুনটা হয়েছে গতকাল রাতে। বলাইনগুয়া এলাকার বঙ্গবন্ধু মোড়ে ইজিবাইক চালক ইদ্রিস মিয়াকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে। হাতের সবগুলো আঙ্গুল কেটে ফেলা হয়েছে। কেটে ফেলা হয়েছে গোপনাঙ্গ। অবিকল আগের ঘটনাগুলোর মতো।
– শালা বেজন্মা!
সার্কিট হাউজের মোড়টা ঘুরতে ঘুরতে হত্যাকারীকে উদ্দ্যেশ্য করে আরও কয়েকটি বিচ্ছিরি গালি দেন আদিত্য নারায়ণ বাবু। তার গত এক দশকের কর্মজীবনে এরকম বিকৃত মস্তিষ্কের কোনো আসামীর দেখা তিনি পাননি। সেটা নিয়ে অবশ্য তার আফসোস ছিলো। কিন্তু এখন আফসোস মিটে গেছে। ৮টি খুনের ৭টি-ই হয়েছে তার এলাকায়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের খিস্তি শুনতে শুনতে তার প্রাণ এখন ওষ্ঠাগত। পুলিশ সুপার তাকে দিনে ৩ বার করে তার অফিসে ডেকে পাঠান। এবার অফিস ভিজিটে এসে ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজিও তাকে এক হাত নিয়েছেন৷
পুলিশ লাইন পেরিয়ে গ্যাস অফিসের সামনে আসতেই ঘরঘর আওয়াজ তুলে বাইকটা থেমে যায়। বিরক্ত হয়ে ফুয়েল মিটারের দিকে তাকান আদিত্যবাবু। তেল তো আছেই, তাহলে স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেলো কেনো! দশ পনেরো বার কিক করে হাপিয়ে ওঠেন তিনি। ‘*লের গাড়ি আমার’ বলতে বলতে যান্ত্রিক যন্ত্রণাটিকে ১০ গজ সামনের একটা গ্যারেজে ঠেলে নিয়ে যেতে থাকেন। গাড়ি সাড়াতে দিয়ে গ্যারেজের লাগোয়া চা স্টল থেকে এক কাপ চা আর এক প্যাকেট সিগারেট কিনে নিয়ে এসে আবার গ্যারেজের সামনে পেতে রাখা বেঞ্চিতে বসেন। সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে দেখেন, পকেটের দেয়াশলাইটা কোথায় যেনো ফেলে রেখে এসেছেন। গ্যারেজের ছোট ছেলেটির দিকে তাকান একবার। পাকা হাতে ইঞ্জিনবক্স খুলছে।
– ওই ছেড়া, লাইটার আছে?
– না সাব। আমার মালিকের আছে। আমি ওইসব বিজিনিস খাই না। চওগুলাইন খাওন ভালা না। কইলজা অঙ্গার হইয়া যায়৷
– ওই বেটা, কাম কর। এতো পটরপটর করস কেন?
গ্যারেজের ছেলেটাকে বকতে বকতে আবার সেই চা স্টলে আসেন আদিত্যবাবু৷ সিগারেট জ্বালিয়ে লম্বা এক টানে এক গন্ডুষ নিকোটিন বুকের ভেতর নিয়ে নেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চায়ের কাপে একটা চুমুক দেন। আবার সিগারেট মুখে নেবেন এমন সময়ে খেয়াল করেন তার হাঁটুতে কে যেনো একটা লাঠি দিয়ে গুতোচ্ছে। মাথা উপরে তুলে লাফিয়ে দূরে সরে যান আদিত্যবাবু। এরকম দাড়িগোঁফের জঙ্গলে ঢাকা মুখ অনেকদিন দেখেননি তিনি। অনেক আগে তাদের গ্রামের বাড়িতে এরকম চেহারার লোকেরা কীর্তন করতে আসতো। হরিনাম তুলে তারা যখন আকাশ বাতাস কাঁপাতো, আদিত্যবাবু তখন বাড়ির বৈঠকঘরের পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকতেন।
– ওই বেডা, টেকা দে। বিড়ি খামু।
কোনো কথা না বলে দ্রুত পকেটে হাত চালান আদিত্যবাবু। মানিব্যাগ থেকে দশ টাকার একটা নোট বের করে তার দিকে এগিয়ে দেন তিনি। তার চোখেমুখে এখনও ভয় লেগে আছে। পাগলটা দশ টাকার নোট দেখে আরও ক্ষেপে যায়।
– আমারে কি ফকিন্নি পাইসস? ১০ টাকা তুই আমার কাছ থাইকাই নে। আর ২ টাকা লাগায়া একটা ভালা বিড়ি খাইস হারামি।
হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকেন আদিত্যবাবু। আজ হচ্ছেটা কি তার সাথে!
– ওই! আহম্মকের মতোন চায়া আছস কেন? লাঠি দিয়া দিমুনি এক বাড়ি কাল্লাডার মাঝে? আরও ২ টেকা দে। দাম বাড়ছে জানস না?
মানিব্যাগ খুঁজে ২ টাকার নোট না পেয়ে ৫ টাকার একটা নোট এগিয়ে দেন আদিত্যবাবু। হাত থেকে ছোঁ মেরে সেটা কেড়ে নিয়ে হাতের লাঠিটা ঘুরাতে ঘুরাতে চলে যায় পাগলটা। হাফ ছেড়ে বাঁচেন আদিত্যবাবু। ঠান্ডা চায়ের কাপে মুখ দিয়ে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যায় তার। চায়ের টঙের দোকানের ছেলেটাকে ডেকে আরও এক কাপ চা দিতে বলেন।
আজ তদন্ত শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান মোর্শেদের কক্ষে একটি সালিশ বসেছে। তার কমান্ডের একজন জুনিয়র অফিসার রেগুলার পেট্রোলিং ফোর্সের একজন কনস্টেবলের নামে একটি অভিযোগ করেছেন। অপরাধ তেমন গুরুতর নয়। কনস্টেবল নুরু মিয়া সেই অফিসারকে ছদ্মবেশে হেনস্তা করেছেন। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে অপরাধ সামান্য হলেও পুলিশ রুলস এ্যান্ড রেগুলেশন্সে এটি শাস্তিযোগ্য একটি অপরাধ। সিনিয়র অফিসারের সাথে এরকম নিম্নমানের বালখিল্যতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অভিযুক্ত নুরু মিয়া হাসি হাসি মুখে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাজিবুল ইসলামও এখানে আছেন৷ তিনি একের পর এক বেনসন এন্ড হেজেস টেনে যাচ্ছেন৷
– নুরু মিয়া, হাসবা না। হাসি তোমার ওইখান দিয়া ঢুকায় দিবো।
টেবিলে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট নিতে নিতে নুরু মিয়াকে শাসান শাহজাহান মোর্শেদ। রাজিবুল ইসলাম কোনো কথা বলেন না। চাবি দিয়ে কান খোঁচাতে খোঁচাতে শুধু একবার অস্ফুট একটি শব্দ করেন।
– স্যার, বিচার শালিস খতম হইলে আমারে বিদায় দেন। কাম আছে।
বলেই ধাম করে স্যালুট করে বেরিয়ে যায় নুরু মিয়া। উবু হয়ে বের হতে গিয়েও দেয়ালে মাথা ঠুকে যায় নুরু মিয়ার। একবার দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আবার হনহন করে হাঁটা শুরু করে। শাহজাহান মোর্শেদ অবাক হয়ে নুরু মিয়ার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তার দীর্ঘ কর্মজীবনে আজ পর্যন্ত এরকম বিচিত্র কর্মচারীর দেখা তিনি পানননি। হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন আদিত্য নারায়ণ সরকার৷ রাগে তার দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। সদর থানার ওসির দিকে একবার তাকান আদিত্যবাবু। তিনি আপাতত নাকের লোম পাকিয়ে ছেঁড়ার চেষ্টা করছেন।
– ভাইজান, আসমু?
– কে?
– আমি ভাইজান। সেলিম। নাস্তা লইয়া আইছিলাম।
– আসো সেলিম। এখানটায় রাখো।
সেলিম কাজ করে মোড়ের হোটেলটাতে। তার কাজ প্রতিদিন সকালে গাছ বেয়ে এই ছোট খুপড়িটাতে ওঠা আর নাস্তা রেখে যাওয়া। হোটেল মালিকের সাথে ভদ্রলোকের চুক্তি করা আছে। মাসশেষে সে একবারে বিল পরিশোধ করে। বিচিত্র এই মানুষটা নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে কেনো গাছের ওপর থাকেন সেটা সেলিমের ছোট মনের বড় একটি প্রশ্ন। গত একমাসে কোনোভাবেই এই প্রশ্নের কোনো উত্তর সে বের করতে পারছে না।
একটা মোড়ার ওপর রুটি আর ডালের প্যাকেটটা রেখে আবার রুম থেকে বের হয়ে আসে সেলিম। সোজা হয়ে বসে নীল। বালিশের নিচে হাতড়ে হাতঘড়িটা বের করে নীল। আশ্চর্য বিষয়। ঘড়িতে দুপুর তিনটে বাজে। যদি তাই হয় তাহলে সেলিমের আরও আগেই দুপুরের খাবার দিয়ে যাওয়ার কথা। প্যাকেট থেকে রুটি উঁকি দিচ্ছে, অর্থাৎ সকালের নাস্তা। লুঙ্গির গিটটা শক্ত করে বেধে স্লিপিং ব্যাগে থেকে বের হয়ে আসে ও। এবার টেবিলঘড়িটার দিকে চোখ যায় তার। নয়টা বাজে।
হাতঘড়িটা ভুল রিডিং দিচ্ছে।
– ভাইসাব, এই ঘড়ি আর কয়বার ঠিক করবেন? এইটা তো এখন জিন্দা লাশ৷ এইটারে এখন মুক্তি দেন। আরেকটা ঘড়ি লন।
উত্তরে মুচকি হাসে নীল৷ শান্ত গলায় আবার বলে, এটা ঠিক করে দেন ভাই। দেখেন কি সমস্যা।
হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন দোকানদার৷ এই ভদ্রলোক গত ২ বছরে ডজনখানেক বার এসে ঘড়িটা সাড়িয়ে নিয়ে গেছেন৷ অথচ ঘড়িটা তেমন একটা দামি না। ঢাকায় ফার্মগেট বা গুলিস্তানে এসব ঘড়ি হকাররা ৩০০ টাকায় ডেকে ডেকে বিক্রি করেন। মফস্বল শহরে দাম কিছুটা বাড়ে, কিন্তু ৫০০’র ঘর ছাড়ায় না৷
ঘড়িটা ঠিক করে হাতে পড়ে তৃপ্তির একটা শব্দ করে নীল। হাটতে হাটতে চলে যায় খালপাড়৷ এই এলাকাটা ওর খুবই প্রিয়। এক পাশে লিজ নেয়া পুকুরগুলোতে মাছ চাষ করা হয়। আর অন্যপাশে কিছু আবাদি জমি। মাঝখানে সরু রাস্তা। তার মাঝখান দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলেছে পায়ে হাঁটার পথ। মানু্ষের পায়ের ঘষায় সবুজ ঘাস উঠে গিয়ে মাটি বের হয়ে এসেছে।
একটা আমগাছের নিচে বসে পড়ে নীল। এ জায়গাটা ওর খুবই প্রিয়। প্রায়ই হাঁটতে হাঁটতে এখানে চলে আসে ও। বছরের বেশির ভাগ সময়ই জনমানবশূন্য থাকে এই জায়গাটা৷ ধান কাটার মৌসুমে এখানটাতেও উৎসবের আমেজ আসে৷ নতুন ধান আর উড়ো বনের গন্ধে বাতাস ম ম করে৷ তখন এদিকটায় আসে না ও। বুনোট গন্ধ ও সহ্য করতে পারে না। শুধু বুনোট গন্ধই না, কোনো গন্ধই ও সহ্য করতে পারে না। অসহ্য ঠেকে। মাথা জ্বালা করে।
ধনী বাবার একমাত্র ছেলে নীল। বছরখানেক আগেও তাদের খুব সুন্দর একটি পরিবার ছিলো। বাবা এলাকার শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী, মা পাশের এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। দুই বোনের একজন তার চেয়ে বড়৷ সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষ করে দুর্গাপূজার ছুটিতে বাড়ি এসেছিলো। আরেকটি বোন তার চেয়ে এক বছর ছোট। সেদিন বারহাট্টা অফিসের কর্মচারীদের একটি গন্ডগোল মিটিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন নীলের বাবা মুহিবুর রেজা। আসার পথে গাড়ি থামিয়ে বড় মেয়ের বান্ধবীর বাড়ি থেকে বড় মেয়ে ও মেয়ের মাকে গাড়িতে তুলে নেন তিনি। বলাইনগুয়া মোড়ে পৌঁছানোর পর হঠাৎ একটি একটি কুকুর এসে পড়ে গাড়ির সামনে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়ি পড়ে যায় রাস্তার পাশের গভীর খাদে৷
নীলের ছোটবোন অংকিতা বাড়িতে ওর সাথে শুয়েই ঘুমোচ্ছিলো। মাইগ্রেনের ব্যথার কারণে বোন আর মায়ের সাথে অনুদিদিদের বাসায় যায়নি ও। এমন সময় নীলের ফোনটা বেজে ওঠে। ঘুমঘুম চোখে কলটা তুলে ফোন কানে নেয় নীল।
– হ্যালো, নীল বলছো?
– জ্বি। আপনি কে বলছেন?
– আমি মডেল থানা থেকে এএসপি আওলাদ হোসেন বলছি। তুমি তোমার বাড়ির বড় কাউকে নিয়ে একবার থানায় এসো।
– কিন্তু মা বাবা তো বাইরে। আমি একা আসলে হবে না?
ওপাশে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সদর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আওলাদ হোসেন। ধরা কন্ঠে বলেন– আসো। তুমি একাই আসো। পারলে কাউকে সাথে নিয়ে এসো৷
বিছানায় ঘুমন্ত বোনের দিকে তাকায় নীল। ওকে ডাক দেবার সাহস করে উঠতে পারেনা। ‘অঙ্কিতাটা খুবই বদমেজাজী। কাঁচা ঘুম ভাঙালে কি না কি করে বসবে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। তার চেয়ে বরং ওকে না ঘাঁটানোই ভালো’– ভাবতে ভাবতে বাড়ির দরজাটা লক করে বের হয়ে আসে নীল। থানার গেটের সামনে এসে তার প্রথমবার মনে ভয়ভয় করতে শুরু করে। ‘অঙ্কিতাকে নিয়ে আসার দরকার ছিলো’– ভাবতে ভাবতে ওসি’র রুমের দিকে তাকায়। ভারী পর্দা সড়িয়ে রুমে ঢোকে। সামনে রাখা একটি চেয়ার টেনে বসে৷
– আপনি কি নীল?
– জ্বি। আমি নীল। আশিকুর রেজা নীল।
– চলুন।
– কোথায়?
নীলের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গাড়িতে উঠে বসেন এএসপি আওলাদ হোসেন। ইশারায় নীলকেও গাড়িতে উঠতে বলেন।
সেদিন ছিলো ভাইফোঁটার দিন। প্রতি বছর এই দিনে তাদের বাড়িতে আয়োজন করে দুই বোন নীলকে ফোঁটা দিয়ে দিতো৷ নীলরা মুসলমান। কিন্তু, সনাতন ধর্মের এই আচারটির চর্চা তাদের বাসায় হতো৷ এলাকার লোকেরা নীলদের আড়ালে তাদের ‘মালোয়ান’ বলে গালি দিতো৷ কেউ কেউ তাদের মুসলমানিত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলতো। সেদিন হাসপাতালের মর্গের টেবিলে সাদা কাপড়ে ঢেকে রাখা তিনটি লাশ নীলের বাবা মা আর বড়বোনের ছিলো। সবে একুশে পা দিয়েছে। নাগরিক হওয়ায় সে প্রথম যে সুবিধাটি পেয়েছিলো সেটি হচ্ছে কোনো আইনি জটিলতার মোকাবিলা না করে নিজের পরিবারের সদস্যদের লাশ নিজে সংগ্রহ করতে পারা। লাশগুলো নিয়ে বাড়িতে যাওয়ার পর সেদিন রাতে আরও একবার থানায় আসতে হয়েছিলো তাকে। ততক্ষণে আত্মীয়স্বজন সবাই প্রায় বিদায় নিয়েছে। ছোটখালা আর তার স্বামী সে রাতটা নীলের সাথে থেকে গিয়েছিলেন। অঙ্কিতাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। নীলরা ভেবেছিলো হয়তোবা শোকের ধাক্কায় ও ঘাবড়ে গেছে। কোনো বান্ধবীর বাসায় আছে হয়তো। সেদিন রাতেই হাসপাতালের মর্গের কোনার দিকের টেবিলটায় নীল যখন অঙ্কিতার লাশ আবিষ্কার করে, তখন একটা অস্থির উন্মাদনা তার ওপর ভর করেছিলো। ওর চারপাশের পৃথিবীটা ছোট হতে হতে একটা বিন্দুতে পরিণত ছিলো। সেই বিন্দু যেনো ভয়ঙ্কর এক গুপ্ত বিস্ফোরক-সময় গুনছে কখন ফাটবে।
পরদিন অঙ্কিতার লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। রিপোর্টে ডাক্তার মৃত্যুর আগে অঙ্কিতার সাথে জোরপূর্বক যৌন সঙ্গম এবং তার পর হত্যার কথা উল্লেখ করেন। অঙ্কিতাকে গণধর্ষণ করা হয়েছিলো। তারপর রাত ১২ টা থেকে ১ টা নাগাদ তাকে মেরে ফেলা হয়েছিলো।
অঙ্কিতার লাশের ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে ভড়কে উঠেছিলো ডোম দিলীপ বাস্পোর। তার ডোমজীবনে এতো সুন্দর মেয়ের লাশ সে দেখেনি। ফর্সা গোলগাল তার মুখ, চিবুকের নিচে দুটো তিল। কানের নিচে আরেকটা। মেয়েটার লাশের দিকে তাকিয়ে তার নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ে যায়৷ তার দীপার বয়স সবে তিনমাস। দীপার মুখেও দুটো তিল। আর একটি তিল কানের নিচে। লাশের অবস্থা দেখে চোখে পানি চলে আসে দিলীপ বাস্পোরের। কি বিশ্রীভাবে মেয়েটিকে হত্যা করা হয়েছে। প্রথমে গলায় ছুরি চালিয়ে গলা কেটে ফেলা হয়েছে। তারপর আঙ্গুলগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে। ধারালো ছুরি দিয়ে যোনীতে খোঁচানো হয়েছে। ফর্সা উরু আর থাইয়ে এখানে ওখানে বিষাক্ত নখরের কালশিটে পড়ে গিয়েছিলো। উত্তরপাড়ার রবি সাহা, আকাশ, নিলয়, কৌশিক, সাতপাইয়ের মাইনুদ্দীন, ফয়সাল, মদনপুরের ইজিবাইক চালক ইদ্রিস মিয়া, ইজিবাইক গ্যারেজের মালিক হারুনুর রশিদ ও স্থানীয় থানার পুলিশ কন্সটেবল নুরু মিয়া সেদিন সেই দলে ছিলো। নীল বাড়ি থেকে বের হয়ে থানায় চলে আসার পর ঘুমন্ত অঙ্কিতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো আকাশ আর নিলয়। পরে অবশ্য তাদের দল ভারী হয়। কাঠগুদামের ভেতর ছোট একটা চালাঘরে মাটিতে ফেলে অঙ্কিতার চার হাত পা খাম্বার সাথে বেঁধে ফেলা হয়েছিলো।
শহরের কবি মামার চা স্টলের কোনার দিকের একটি টেহিলে বসে আছেন আদিত্য নারায়ণ বাবু। তার সামনে ধোঁয়া ওঠা কফির মগ। যেসকল দোকানে ক্যাপুচিনো মেশিন থাকে সে দোকানগুলোর কফিই সাধারণত খেতে ভালো হয়। আদিত্য বাবুও ভেবেছিলেন এই কফিটা ক্যাপুচিনো মেশিনে ব্লেন্ড করা। কিন্তু একটু আগে খেয়াল করে দেখলেন কবি মামা ফল জুস করার একটি ব্লেন্ডারে গরম পানির মধ্যে কফি দিয়ে ব্লেন্ড করছেন। নিঃসন্দেহে মেধাবী উদ্ভাবন।
আদিত্যবাবু বসে আছেন পার্থর অপেক্ষায়। ওই খুনের কেসটার ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে-এমনটা জানিয়ে পার্থ বিকালের দিকে ফোন করেছিলো। আদিত্যবাবু হাতঘড়ির দিকে তাকান। ৭ টা ৪৫ বাজে। পার্থ বলেছিলো সে সাতটায় আসবে। বিরক্তির সাথে আরেক চুমুক কফি গেলেন আদিত্যবাবু। পকেটের সিগারেটের প্যাকেটটা থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরিয়ে লম্বা একটা টান দেন। হিস হিস শব্দ হয়, আস্তে আস্তে ধোঁয়া ছাড়েন। সামনের টেবিলে একটা যুগল বসে ছিলো। খুব সম্ভবত নববিবাহিত। মেয়েটা কাশছে। লজ্জিত বোধ করেন আদিত্যবাবু। কফির মগ হাতে নিয়ে দোকানের সামনের রাস্তায় এসে দাঁড়ান।
– স্যার, সালাম। কিরাম আছেন?
পেছন ফিরে তাকান আদিত্যবাবু। চিনতে পারেন না। মুখের সামনে জড়ানো মাফলার সরিয়ে হলুদ দাঁতগুলো বের করে একটা একটি হাসি দেয় পার্থ।
– আমি স্যার, আমারে আফনে তলব দিছিলেন।
– না রে ভাই, এই কথা বলিস না। তোরে তলব করার সামর্থ্য আমার বাপেরও নাই। তোরা হইতেছিস জমিদার মানুষ। তোগোর দেখা পাইলেই পরবর্তী সাত জনম ধন্য।
সিগারেট পিষতে পিষতে ক্ষোভ ছাড়েন আদিত্যবাবু। লম্বা একটা দম নিয়ে আবার তাকান পার্থর দিকে।
– কি জানি বলবি বলছিলি। তাড়াতাড়ি বল।
পেছনের পকেট থেকে একটা দুমড়ানো মুচড়ানো ছবি বের করে আদিত্যবাবুর হাতে দেয় পার্থ। পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠানে তোলা একটি ছবি।
– এই ছবিতে একজন পাবলিকই জিন্দা আছেন। আর সবাইরে তুইল্লা নিছেগা।
– কে তুলে নিছে? চোখ তুলে পার্থর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন আদিত্যবাবু।
আকাশের দিকে তাকিয়ে শিস দেয়ার মত শব্দ করে পার্থ।
– কি জানি। মনে হয় আমার আল্লাহ আর আফনের ভগবান।
– পার্থ, ফাইজলামি করবি না। তোদের কাছে ধরনা দেই ইনফরমেশন নেয়ার জন্য। পরে এমন ব্যবস্থা করবো যে আমাদের কাছে ধরনা দিতে দিতে জীবন বরবাদ হয়ে যাবে। সময় এখন খুব ভালো। দুইটা পোটলা ধরায়া দিয়া মডেল থানায় দিয়া আসবো। দুই তিন বছর বইসা খাইতে পারবি।
থতমত খেয়ে যায় পার্থ। তার বুকপকেটে এখনও তিন পোটলা সিন্নি। কুষ্টিয়ার মাজারের জিনিস। ফি দিন এক পোটলা করে খেলেও দুনিয়াদারির হুঁশ থাকে না।
– স্যার, চেতেন কেন? কইতাসি তো।
– হুম, বল।
পকেট থেকে নোটখাতা বের করেন আদিত্যবাবু।
৪ বছর আগের ভাইফোঁটায় অঙ্কিতার দেয়া ঘড়িটা হাতে পড়তে পড়তে সময় দেখে নেয় নীল। রাত ১২ টা ১০ মিনিট। ব্যাকপ্যাকে ধারালো কাটারি আর কয়েকটি পলিথিনের ঠোঙ্গা নিয়ে দরজা লক করে বের হয়ে আসে। রাত ৯ টার দিকে দুই গাড়ি পুলিশ এসে পুরো বাসা খুঁজেও তাকে পায়নি। সে ওইসময় তার গাছঘরে বসে উপর থেকে সব দেখছিলো। পেটমোটা একজন গোঁফওয়ালা অফিসার ফোনে পার্থ নামের কাকে যেনো বকাবকি করছিলেন। সাথের কনস্টেবলগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিলো কাঁধে ঝোলানো রাইফেলের ভারে যেকোনো সময় পড়ে যাবে। ঘন্টাখানেক তল্লাশি করে ওরা চলে গেলে গাছঘরের সামনে মোটা একটা ডালে পা ঝুলিয়ে বসে নীল। ঝাপসা চোখে আকাশের তাঁরা আর চাদের মিটিমিটি আলো খেতে খেতে হালকা তদ্রা চলে এসেছিলো। এলার্মঘড়ির শব্দে ঘুম ভাঙলে হাতমুখ ধুয়ে দড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। গ্যারেজের পেছন থেকে সাইকেলটা বের করে তাতে চড়ে বসে। প্যাডেল বাইতে বাইতে মোক্তারপাড়ার ব্রিজটা পার হয়। নিয়ন আলোর ঝলসানিতে তার মুখে একটা হাসি ফুটে ওঠে।
নেত্রকোণা মডেল থানার ওসি রাজিবুল ইসলাম ভীত চোখে তার টেবিলে রাখা দুটো পলিথিনের প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে আছেন৷ তার ঢুলুঢুলে চোখের ঘুম কর্পূরের মতো উবে গেছে৷ সামনে রাখা প্যাকেট থেকে প্রাপ্তবয়স্ক কোনো পুরুষ মানুষের নখযুক্ত আঙ্গুল উঁকি দিচ্ছে। সে নখে নীলা পাথরের একটি আংটি চকচক করছে। একটু আগে একটি ছেলে বাজারের ব্যাগে করে এসব থানায় তার কেবিনে নিয়ে আসে। উবু হয়ে ঝুকে ব্যাগটা তুলে তার টেবিলের ওপর উপুড় করে ফেলে দেয়।
নীল নামের ছেলেটাকে লকাপে পুরে রাজিবুল ইসলাম। রওনা হন হাসপাতালের দিকে। একটু আগে হাসপাতাল থেকে জেলা পুলিশের তদন্ত শাখার এএসআই আদিত্য নারায়ণ সরকার ফোন করেছিলেন। অন ডিউটি একজন সিনিয়র কনস্টেবল নুরু মিয়ার লাশ হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে।