আপন-পর

আপন-পর

আজ আমার মায়ের বিয়ে। সারা বাড়ির সবাই খুব ব্যাস্ত । মামার বাড়ির সামনের উঠানে বরপক্ষের খাবার দাবার হচ্ছে।মা’ লাল রঙের একটি শাড়ি পরে মুখ গোমড়া করে বসে আছে। আমি দুই বার করে লুকিয়ে মায়ের কাছে যেতে গিয়ে মেঝ মামির কাছে ধরা খেয়েছি । মেঝ মামি ঠাস করে আমার গালে চড় দিয়ে মুখ খিঁচিয়ে বললেন এই তোকে না নিষেধ করেছি তোর মায়ের কাছে যেতে? খবরদার আর যদি তোর মায়ের কাছে যেতে চাস তাহলে তোর মা চলে গেলে তোকে কিন্তু এই বাড়িতে আর থাকতে দিবো না। আমি ভয়ে ভয়ে রান্নাঘরের পিছনে গিয়ে কাঁদতে লাগলাম। আমি খাবার চাইতে মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিলাম, মা ছাড়া এই বাড়িতে কেউ আমাকে খেতে দেয় না। আমার খুব ক্ষিদে পায়।

আমি আর মা তিন বেলা এক প্লেটে করে খাবার খেতাম, বিনিময়ে মা আমার মামিদের সব কাজ করে দিতেন তারপরেও কিছু হলেই মামিরা আমার মাকে নানান কথা শুনাতেন। মা মাঝে মাঝে আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদতেন আর বলতেন তোর বাবা আর নানা-নানি যদি বেঁচে থাকতো তাহলে আমাদের এতো কষ্ট হতোনা রে, তোর বাবার বাড়িতে খাবারের কোন অভাব ছিল না, দুইটা কাজের মেয়ে ছিল ঘরে আর মাঠে কাজ করতো জনা তিনেক কামলা । এই সবই আমি মায়ের কাছে প্রায়ই শুনি কিন্তু আমার এই সব কিছুই মনে পড়েনা । আমার সাড়ে তিন বছর বয়সে আমার বাবা মারা যান, বাবা মারা যাবার পরে পাঁচ মাস আমরা ঐ বাড়িতে ছিলাম তারপরেই আমার চাচারা আমাকে আর মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। আমার মামারা অনেক সালিশ দরবার করেও নাকি ঐ বাড়িতে আমাদের থাকার ব্যাবস্থা করতে পারেননি ।

সেই থেকে আমি আর মা এই চার বছর থেকে মামার বাড়িতে পড়ে আছি। গত বছর আমার বয়স ছয় হবার পরে মা আমাকে স্কুলে দিতে চেয়েছিলেন সেই কথা শুনে আমার তিন মামিই মায়ের উপরে এক সাথে ঝাপিয়ে পড়ে এমন কথা শুনিয়েছে যে, মা সারাদিন কোন কিছু খেতে পারেন নি শুধু আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুচেছেন ।এর আগেও আমার মামারা মায়ের জন্য ছেলে ঠিক করেছেন কিন্তু যখনি ছেলেপক্ষ শুনে মেয়ের একটি ছেলে আছে তখনই বিয়ে ভেঙ্গে যায়। তাই এইবার বড় মামা সবাইকে ডেকে বললেন বকুলের জন্য খুবই পয়সায়ালা একটি ছেলের খোঁজ পেয়েছি, এই ছেলেকে কোন মতেই হাত ছাড়া করা যাবেনা । অপুর কথা কোন মতেই যেন ছেলেরা জানতে না পারে, বড় মামি বললেন ঐ ছেলেকে কি তাহলে আমরা পালবো নাকি? মা আর ছেলে দুইজনকেই এক সাথে বিদেয় করলে বাঁচতাম ।

বড় মামা ধমকে উঠে বললেন আহ্ বুঝনা কেন এই ছেলের কাছে বকুল কে বিয়ে দিতে পারলে আমরাও লাভবান হবো ছেলের অনেক পয়সা। জানইতো ছেলে আছে শুনলে কেউ বিয়েতে রাজি হচ্ছেনা । তারপরেই মায়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো মা যতই বলে আমাকে ছাড়া কোথাও যাবেনা সবাই মিলে ততই মায়ের দিকে তেড়ে আসে । কিছুতেই মা রাজি হচ্ছে না দেখে বড় মামা মা কে বললেন তুই অপুর জন্য চিন্তা করিস না আমি নিজে অপুকে দেখে রাখব কিন্তু তুই যদি এই বিয়ে না করিস তাহলে কিন্তু তোদের দুইজনের খবর আমরা জানি না। এই বাড়িতে তোদের জায়গা হবেনা। নিরুপায় হয়ে মা রাজি হলেন, আমাকে কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন আব্বা আমি কয়েক দিন গেলেই তোমাকে ঐ বাড়িতে নিয়ে যাবো তুমি কিন্তু সবার কথা শুনে থাকবে ওরা যেই যেই কাজ করতে বলবে করে দিও তা না হলে ওরা তোমাকে খেতে দিবেনা ।

আমি রান্নাঘরের পিছন থেকে সামনের উঠানের দিকে তাকিয়ে আছি লম্বা মত পাঞ্জাবি পরা একটি লোক আমার মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে কি সুন্দর চেহারা এই লোকের। মামিরা বলা-বলি করছিলেন এই লোকের আগের বউ মারা যাবার পরে আর বিয়ে করেনি । লোকটি দেখতে সুন্দর হলেও আমার কাছে ভালো লাগলো না । এই লোকের কারনেই আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে । রাগে আমার সারা শরীর জ্বলতে লাগলো । মা ঘর থেকে বের হবার পরেই এদিক-ওদিক বার বার তাকাচ্ছেন বুঝতে পারলাম আমাকেই খুঁজছেন কিন্তু মামা- মামিদের ভয়ে আমি মায়ের কাছে যেতে পারলাম না । কিছুক্ষন পরে ওরা আমার মাকে নিয়ে চলে গেলো । আমি মাটিতে পড়ে হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলাম।

সাতদিন হয়ে গেলো মা আমাকে রেখে চলে গেছেন।আজকে নাকি মা আসবে তাই বড় মামা আমাকে সকাল বেলা ডেকে নিয়ে বললেন অপু তুই কিন্তু তোর নতুন বাপের সামনে যাবি না। সারাদিন ক্ষেতে থাকবি গরু নিয়া। আমি মায়ের সাথে অনেক রাগ করেছি মা’ আমাকে বলেছিল কয়েকদিন পরে নিয়ে যাবে কিন্তু এতদিনেও মা আমাকে নিয়ে যায়নি । মামিরা মা, যাবার পর থেকে আমাকে সকালে এক মুঠ ভাত দেয়, আমার পেট ভরেনা সারাদিন গরুর কাজ করতে হয় কোন কোন দিন দুপুরে ভাত দেয়না । আমি সারাদিন গরু নিয়ে মাঠে ছিলাম ,বিকালে বাড়িতে ঢুকতেই দেখি উঠানে একটা রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে তারমানে মা এসেছে, আমি আস্তে আস্তে গরুটাকে গোয়ালে বেধে গোয়াল ঘরের পিছনে পেয়ারা গাছের উপরে উঠে বসে থাকলাম। এইখান থেকে ভিতর বাড়ি দেখা যায় । আমি দেখলাম মা নতুন শাড়ি পরে বার বার এদিক ওদিক ছুটছেন নিশ্চিই আমাকে খুঁজছেন, একবার ভাবলাম যাই মা’কে জড়িয়ে ধরি পরে সেই চিন্তা বাদ দিয়ে গাছে বসে থাকলাম।

হটাৎ করে দেখি মায়ের বর ঠিক পেয়ারা গাছের নীচে এসে একটি সিগারেট ধরালেন, বুঝতে পারলাম বাড়িতে কেউ দেখবে তাই লুকানোর জন্য এইখানে এসেছেন। আমার ইচ্ছা করলো লোকটির মাথায় গাছের ডাল ছুড়ে মারি কিন্তু সেটা করলে কপালে খারাপি আছে তাই চুপ করে বসে থাকলাম।কিছুক্ষন পরে কি মনে করে লোকটি উপরের দিকে তাকিয়ে আমাকে দেখে চমকে উঠলেন, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন এই ছেলে তুমি গাছের এতো উপরে উঠেছ কেন! পড়ে যাবে তো নামো আমি মাথা নেড়ে জানালাম নামবো না লোকটি এইবার একটি লাঠি নিয়ে বললেন নামো বলছি না হলে আমি মেরে তোমাকে নামাবো, ভয়ে আমি নিচে নেমে আসলাম মনে মনে ভাবতে লাগলাম মামারা তাদের মতোই এক বদের কাছে মা’কে বিয়ে দিয়েছে

-তোমার গায়ে এতো ময়লা কেন? তুমি কি এই বাড়িতেই থাক?আমি অন্য দিকে তাকিয়ে বললাম হুম এই বাড়িতেই থাকি

– কি নাম তোমার? আমি এইবারও অন্য দিকে তাকিয়ে বললাম আপনাকে আমি আমার নাম বলবনা। লোকটি খুবই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন কেন?

-কারন আপনি আমার কাছ থেকে আমার মাকে নিয়ে গেছেন তাই, বলেই বুঝতে পারলাম এই কথা বলা ভুল হয়ে গেছে

-কি বলছ এই সব!আমি তোমার মাকে নিয়ে গেছি মানে কি? কে তোমার মা? আমি নিচের দিকে তাকিয়ে পা দিয়ে মাটি ঘষতে লাগলাম, উত্তর দিচ্ছি না দেখে তিনি আমার হাত ধরে টেনে আমাকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে আসলেন উঠানে এসেই মায়ের নাম ধরে ডাকতে লাগলেন মা দৌড়ে এসে আমাকে উনার সাথে দেখে থমকে গেলেন। – এইটা কি তোমার ছেলে বকুল? মা আতংকিত চোখে উনার দিকে তাকিয়ে বললেন হুম

-তোমার বড় ভাই আমাকে বলেছেন তোমার একটি ছেলে আছে সে নাকি তার দাদার বাড়িতে থাকে , আর এই কয় দিনে তুমিও তো একবারের জন্য ও ওর কথা বললে না! কেন? এইবার মা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন ভাইরা মানা করছিল। বলছে আপনি জানলে বিয়ে ভেঙ্গে যাবে । লোকটি কিছুক্ষন কি যেন ভাবলেন । এতক্ষনে বাড়ির সবাই চলে আসছে বড় মামি এসেই আমাকে উনার সামনে ঠাস করে এক থাপ্পড় দিলেন সাথে সাথে লোকটি বড় মামিকে এক ধাক্কা দিয়ে আমাকে মাটি কাঁদা সহ কোলে তুলে নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন বকুল তুমি এতো সুন্দর এই ছোট বাচ্চাটাকে এই জালিমদের কাছে রেখে কিভাবে গেলে? আর এই যে বড় ভাবি আপনি কোন সাহসে আমার সামনে আমার ছেলেকে মারলেন? বড় মামি মুখ ভেংছিয়ে বলে উঠলেন উঃ কি আমার দরদরে! তা এতই যদি আদর হয় তাহলে সাথে নিয়ে গেলেই হয়।

– হুম নিয়ে যাবো তো আপনাদের কাছে কোন মানুষ থাকবে নাকি ছিঃ ছিঃ ছয়-সাত বছরের একটি বাচ্চা ছেলের সাথে আপনারা এমন ব্যাবহার করেন,আমার দিকে ঘুরে বললেন বাবু তুমি হাত মুখ ধুয়ে এসো আমরা এখনি আমাদের বাড়িতে যাবো । বকুল তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে না কেঁদে বাবুকে রেডি করে আনো । মা আমাকে কোলে নিয়ে রিক্সায় বসলেন মা এখনো আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন , লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন এইবার তো আমি তোমার মায়ের সাথে তোমাকে ও নিয়ে যাচ্ছি এখনো কি তুমি আমার সাথে রাগ করে আছ? আমি মাথা নেড়ে না বললাম

-তাহলে তোমার নাম বল , আমি আস্তে করে বললাম আমার নাম অপু । বাহ্ খুব সুন্দর নাম তোমার ।অপু তুমি এখন থেকে আমাকে বাবা বলে ডাকবে আর আমাকে কখনো ভয় পাবেনা যা লাগবে আমাকে বলবে । কিন্তু একটি কথা আমার রাখতে হবে তুমি মন দিয়ে লিখা পড়া করবে। তা না হলে কিন্তু আমি তোমাকে বকা দিবো কি আমার কথায় রাজি তো? বলেই আমাকে মায়ের কোল থেকে নিজের কোলে নিয়ে নিলেন ।আমার বাবার কথা আমার মনে নেই তাই উনি আমাকে বাবা বলে ডাকতে বলাতে আমি উনাকে বাবা বলে জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগলাম । মা ও আমার সাথে কাঁদতে লাগলেন। বাবা ধরা গলায় বললেন কি করছ বকুল রাস্তার মানুষ সব আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন তো । আমি বুঝতে পারলাম আমাদের সাথে আমার বাবাও নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছেন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত