নুন বাংলোর রাত

নুন বাংলোর রাত

আকাশে মেঘ সাজছিল অনেকক্ষণ ধরে। বড় রাস্তা ছেড়ে সমুদ্র সৈকতের রাস্তায় পড়তেই মুষলধারে বৃষ্টি নেমে গেল। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া আর উপর্যুপরি বজ্রপাত। প্রকৃতি যেন তাণ্ডবনৃত্য করছে! মাইলফলকে দেখলাম বাঁকিপুট এখনও দশ কিলোমিটার। রাস্তায় দু’দিকে দিগন্তবিস্তৃত চাষের জমি। মাঝে-মাঝে মাছের ভেড়ি। দুর্যোগ থেকে বাঁচতে কোথাও যে আশ্রয় নেব তেমন জায়গা চোখে পড়ল না। কালকে রাতে টিভির খবরে দেখেছিলাম দক্ষিণবঙ্গের উপর গভীর নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে। সতর্কতা ছিল ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণের। কিন্তু সে সতর্কবাণী আমাদের উৎসাহে জল ঢালতে পারেনি। কাজের চাপে মাসতিনেক দু’জনে একেবারেই বেরতে পারিনি। অভি একটা কলেজে ইতিহাস পড়ায়। হঠাৎ কী কারণে সামনের ক’দিন কলেজ ছুটি থাকায় ফোনে বলল, “তোর ভূত ধরা বন্ধ রেখে চল, এই উইক এন্ডে একটা নতুন জায়গায় ঘুরে আসি।”

আমি একজন সংবাদিক। জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ‘পাঁচফোড়ন’-এর সহকারী সম্পাদক। আমি প্রধানত অতিপ্রাকৃতিক রহস্য বিষয়ের প্রতিবেদক। এই অ্যাসাইনমেন্টের সূত্রে আমাকে যে কত শিহরন জাগানো ঘটনার মধ্যে পড়তে হয় তার ইয়ত্তা নেই। তবে ব্যাপারটা আমি বেশ উপভোগই করি। আমার ভৌতিক প্রতিবেদনগুলো পাঠকমহলে খুবই জনপ্রিয়, পত্রিকার কাটতিও বেশ বাড়ছে। জিজ্ঞেস করলাম, “জায়গাটা কোথায়?” “বাঁকিপুট। দারুণ বিচ। বাঙালি টুরিস্ট এখনও সে জায়গার সন্ধান পায়নি।” মজা করে বললাম, “তুই পেলি কী করে?”

“ওখানে আমার এক কোলিগের পারিবারিক বিষয়সম্পত্তি রয়েছে। সমুদ্রের ধারেই ওদের কটেজ। সেখানেই থাকব। একদম ফ্রি।” “বাঃ, অতি উত্তম ব্যবস্থা! তা যাবি কীসে? অমন জায়গায় বাস-ফাস নিশ্চয়ই চলে না।” “বাইকে। নেক্সট শুক্রবার সকাল ন’টায় তোকে বাড়ি থেকে তুলছি।” “ও কে বন্ধু।” সৈকতের রাস্তা মোটামুটি চলার মতো হলেও ঝড়ের দাপটে বাইক সামলানো দায়। আড়াইশো সিসির বাইকও হাওয়ার ঝাপটায় দুলে যাচ্ছে! বৃষ্টির তোড়ে চারিদিক একেবারে সাদা। দশহাত দূরের জিনিসও ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। “এভাবে চালানো খুব রিস্কি!” বলল অভি। “তা হলে দাঁড়িয়ে যা।” “কোথায় দাঁড়াব? কিছুই তো দেখছি না। যা বাজ পড়ছে, বড় গাছের নীচে দাঁড়ানো উচিত হবে না।” তা হলে সাবধানে এগো। যদি কোনও শেডটেড চোখে পড়ে…” আরও মিনিট দু’-তিন পর রাস্তার ডানদিকে কিছুটা দূরে বালিয়াড়ির উপর একটা বাড়ি চোখে পড়ল। অভিকে বললাম, “চল। একটা আশ্রয় নিশ্চই পাওয়া যাবে।”

অভি রাস্তা থেকে নামিয়ে মাঠের উপর দিয়ে বাইক ছোটাল। উঁচুনিচু ঢেউখেলানো জমিতে ইতিমধ্যেই বেশ জল। বেলেমাটি বলে কাদা হয়নি। অভি বাড়িটার বারান্দার সিঁড়ির সামনে গিয়ে বাইক দাঁড় করাল। আমরা দৌড়ে বারান্দায় উঠলাম। রুমাল বের করে ভিজে মাথা মুখ যতটা সম্ভব মুছে ফেললাম। এরকমভাবে বেশিক্ষণ থাকলে ঠাণ্ডা লেগে যাচ্ছেতাই কাণ্ড হবে। ইতিমধ্যে আকাশ বেশ অন্ধকার করে এসেছে। অভি চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, “বাড়িটা মনে হচ্ছে অনেক পুরনো। ব্রিটিশ আমলেরও হতে পারে।” “তাই তো মনে হচ্ছে।” বারান্দায় পরপর চওড়া থাম। থামের মাথায় আর্চ। দেওয়ালের পলেস্তারা জায়গায় জায়গায় খসে গিয়ে ইঁট বেরিয়ে পড়েছে। পুরনো আমলের পাতলা ইঁট, চুন-সুরকি দিয়ে গাঁথা। দরজা-জানলা সব বন্ধ। কোথাও কোনও আলো দেখা যাচ্ছে না।

বিদ্যুতের আলোয় হঠাৎ খেয়াল করলাম পেল্লায় সদর দরজার কাঠের পাল্লার উপর খোদাই করে লেখা ‘ডিপার্টমেন্ট অফ সল্ট’। এমন সময় কানে এল যেন ঘরের মধ্যে সুর করে কেউ কিছু একটা পড়ছে। কিন্তু ঝড়ের প্রচণ্ড গর্জনে কিছুই ভাল করে শুনতে পেলাম না। যাক, মানুষ আছে। মনে-মনে আশ্বস্ত হলাম। দরজার কড়াটা নাড়লাম। ভিতরে পড়ার শব্দ থেমে গেল। মোলায়েম কণ্ঠস্বরে কেউ জিজ্ঞেস করল, “কওন?” আমি গলা তুলে বললাম, “টুরিস্ট। ঝড়বৃষ্টিতে ফেঁসে গিয়েছি। দরজাটা দয়া করে খুলুন।” “ঠহরিয়ে।” হঠাৎ দরজার ফাঁক দিয়ে একটা আলো এসে চোখে পড়ল! এতক্ষণ উকিঝুঁকি মারার সময় তো কোনও আলো চোখে পড়েনি! লোকটা কি তা হলে অন্ধকারে পড়ছিল নাকি! অদ্ভুত! হুড়কো খোলার শব্দ হল। তারপর বিশ্রী ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল! মনে হল যেন বহুকাল পরে খুলল!

দরজা খুললেন দেহাতি চেহারার একজন মানুষ। বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ। মাথায় কদমছাঁট চুল। পরনে হাঁটু অবধি ধুতি। গায়ে সাদা ফতুয়া। লোকটার চোখদুটো অদ্ভুত স্বপ্নালু। দেখে মনে হয় যেন কোনও ঘোরের মধ্যে রয়েছেন। লোকটি হাতের লণ্ঠনটি তুলে বললেন, “আসেন বাবুজিরা, অন্দর আসেন।” চৌকাঠ ডিঙোতেই গায়ে মুখে মাকড়সার জাল জড়িয়ে গেল। এ কী রে বাবা! যেখানে মানুষ থাকে, সেখানে এরকম হয় কী করে! ঘরের মধ্যেও কেমন যেন একটা ভ্যাপসা গন্ধ! অনেকদিন বন্ধ থাকলে যেমন হয়। মানুষটি মনে হয় আমাদের মনের কথা বুঝতে পেরেছিলেন। বললেন, “আমি একা আদমি, কত আর সাফ-সুতরা রাখতে পারি বাবুজি!”

লণ্ঠনের ঘোলাটে আলোয় দেখলাম ঘরটি বেশ বড়। তবে অবস্থা বিশেষ ভাল নয়। সিলিংয়ের পলস্তারা অনেক জায়গাতেই খসে পড়েছে। কড়ি-বরগার গায়ে উইয়ের বসতি। বট অশ্বথের শিকড় ডাইনির লিকলিকে আঙুলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে নোনাধরা দেওয়াল জুড়ে। হাওয়ার দাপটে খড়খড়ি লাগানো জীর্ণ জানালাগুলো খট্খট্ শব্দে কাঁপছে।

ঘরের আসবাবপত্রও মান্ধাতার আমলের। বড়-বড় কাঠের আলমারি, দু-তিনটে চেয়ার, টেবিল, চৌকি। দেওয়ালে আঁটা সার সার তাকের উপর থরেথরে রাখা দলিল-দস্তাবেজ। লোকটি টেবিলের উপর একটা ঝাড়ু বুলিয়ে বললেন, “সামান ইখানে রাখুন বাবুজিরা। হামি টাওয়েল এনে দিচ্ছি।”

আসবাবপত্র, মেঝে, সবকিছুর উপরেই বালির পুরু আস্তরণ। সমুদ্রের কাছে বলেই মনে হয় এমন দশা। আমার আশ্চর্য লাগল এই ভেবে যে লোকটা এর মধ্যে থাকে কী করে! রুকস্যাকগুলো পিঠ থেকে টেবিলের উপর নামিয়ে জামাকাপড় ছাড়তে লাগলাম। সারা শরীর থেকে জল ঝরছে। লোকটি কোথা থেকে দুটো তোয়ালে এনে আমাদের হাতে দিলেন। তোয়ালে হাতে নিয়ে বেশ অবাক হলাম, একেবারে নিষ্কলঙ্ক সাদা! মনে হয় আগে কোনও দিনও ব্যবহার হয়নি। তোয়ালেটির স্পর্শও বেশ আরামদায়ক! দামি জিনিস, সন্দেহ নেই।

গা মাথা মুছতে-মুছতে হঠাৎই চোখ আটকে গেল তোয়ালেটার এক কোণে লাগানো ট্যাগটার দিকে – এরিকসন কটন মিল, ম্যাঞ্চেস্টার। অবাক লাগল। অভিকে ট্যাগটা দেখিয়ে বললাম, “এমন খাঁটি বিলিতি জিনিস আগে কখনও ব্যবহারের সৌভাগ্য হয়েছে?” ট্যাগ দেখে অভিরও চক্ষু চড়কগাছ। ও লোকটিকে প্রশ্ন করল, “এমন বিলিতি তোয়ালে কোথায় পেলেন?” “সব গরমিন্ট সাপলাই বাবুজি।” “গভমেন্ট সাপ্লাই! আপনি…” অভির কথা শেষ হওয়ার আগেই মানুষটি বললেন, “জি বান্দা হরিহর পাঁড়ে। এই নিমক গোলার মুন্সি।” “পাঁড়েজি, আমি অভিনব চট্টোপাধ্যায় আর ও হল আমার বন্ধু তিমির মিত্র,” আমাকে দেখিয়ে বলল অভি, “কলকাতা থেকে আসছি।” “জি বহুত আচ্ছা।” “তা পাঁড়েজি, এখানে এখনও নুন তৈরি হয় নাকি?”

হরিহর পাণ্ডে ধীরে-ধীরে দু’দিকে মাথা নাড়লেন, “নেহি বাবুজি। সে সব কারোবার বন্ধ হয়ে গেছে বহুত সাল হোয়ে গেলো।” “তা হলে আপনি এখানে কী করেন?” পাঁড়েজি তাকে রাখা দলিল-দস্তাবেজগুলোর দিকে দু’হাত তুলে বললেন, ‘গরমিন্ট রেকর্ড দেখভাল করতে হবে না। কখন কোনটার দরকার পড়ে।” “ও। এখানে আর কোনও স্টাফ নেই?” “জি নেহি। হামি আলো আদমি।” “আপনি এখানে কতদিন আছেন?” পাঁড়েজি একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন, “জি বহুত সাল হোয়ে গেলো।” আমি অভিকে বললাম, “এই প্রত্যন্ত এলাকায় যে এরকম একটা সরকারি অফিস আজও আছে, সত্যিই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার?”

অভি বলল, “রীতিমত হেরিটেজ আইটেম।” তারপর দলিল দস্তাবেজগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “ওগুলো ঘাঁটলে ইতিহাসের অনেক নতুন তথ্য পাওয়া যেতে পারে।” আমি ওকে একটু আওয়াজ দিয়ে বললাম, “ইতিহাসের অধ্যাপক একদম ঠিক জায়গায় এসে পড়েছে বল?” “যা বলেছিস। আমার ডক্টরাল টপিকও তো ছিল লবণ সত্যাগ্রহ।” পাঁড়েজি বললেন, “জি আপনারা আরাম কোরেন। হামি রাত কা খানার ইন্তেজাম করি। খিচড়ি চলবে তো বাবুজিরা?” এমন বৃষ্টির রাতে খিচুড়ি! অভি পাঁড়েজিকে বলল, “দেখুন তো, আমাদের জন্য আপনাকে কত ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে।”

“এতে ঝামেলার কী আছে বাবুজি? অতিথি নারায়ণ। থোড়া চাউল অউর ডাল উবলিয়ে নিতে কোনও তকলিফ নেই।” পাঁড়েজি খুশি মনে ঘাড় নাড়তে-নাড়তে চলে গেলেন। শুকনো জামাকাপড় পরে আমরা আরাম করে চৌকির উপর বসলাম। ঝড়বৃষ্টি থামার কোনও লক্ষণ নেই। জানালার উপরের রঙিন কাচের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে বিদ্যুতের তীব্র ঝলক। টেবিলের উপর রাখা লণ্ঠনের টিমটিমে আলোয় ঘরে আলো আঁধারির রহস্য। হঠাৎ নাকে এল কফির মনমাতানো সুবাস। ট্রেতে দু’টি কাপ নিয়ে ঘরে ঢুকলেন পাঁড়েজি। “পি লিজিয়ে। তাকত মিলেগা।”

আমাদের চোখ কপালে ওঠার জোগাড়! কফি! এই পাণ্ডববর্জিত দেশে! পাঁড়েজি আমাদের জন্য কি না করছেন! দুজনেই বেশ কুণ্ঠিত বোধ করি। ধোঁয়া ওঠা কফিতে চুমুক দিতেই শরীর চনমন করে উঠল। “আহ অসাধারণ! পাঁড়েজি, কোথায় পেলেন এমন দুর্ধর্ষ জিনিস?” বলল অভি। “এ ভি গরমিন্ট সাপলাই আছে বাবুজি।” “বলেন কী! সোজা হয়ে বসল অভি। “হাঁ বাবুজি।” আমি হেসে বললাম, “বুঝলে প্রফেসর, এ হল কলোনিয়াল হ্যাংওভার!” পাঁড়েজি বললেন, “ইয়ে কফি ভি বিলায়েত সে আতা হ্যায়।” অভি একটা ছদ্ম-বিস্ময়ের ভাব দেখিয়ে বলল, “অ্যাঁ, কফি ভি বিলায়েতি! কফির প্যাকেটটা আছে পাঁড়েজি?” “হাঁ, হ্যায় না। দেখবেন?” “হ্যাঁ। নিয়ে আসুন।”

পাঁড়েজি একটা টিনের কৌটো হাতে ফিরে এলেন, “এই দেখেন বাবুজি।” কৌটোর গায়ের লেখা পড়ে তো আমাদের আবার ভিরমি খাওয়ার জোগাড়! খাঁটি ব্রাজিলের জিনিস! প্যাকেজিংয়ের তারিখ ১৯৪৪ সালের! কৌটোর মুখ খুলতেই কফির তাজা গন্ধ! এত বছরের পুরনো হলেও কফির গুঁড়ো সামান্য দলা পর্যন্ত পাকায়নি! পাঁড়েজি বললেন, “কলকাত্তাসে সাহেব লোগ ইনসপিকশনে আসেন। ওঁদের তো এই কফি ছাড়া চলে না।” আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “বলিহারি সব সাহেব বাবা?”

“হাঁ, হাঁ, বাবুজি, জবরদস্ত সব সাহেব!” চোখ বড়-বড় করে বললেন হরিহর পাণ্ডে। অভি বাঁকা হাসি হেসে বলল, “কাপের তলাটা দেখ, ওটাও খাঁটি বিলিতি?” কাপটা তুলে দেখলাম তলায় নীল রংয়ের গোল ছাপ মারা রয়েছে, মেড ইন ইংল্যান্ড! পাঁড়েজি বললেন, “আপনারা কফি পিয়ে লিন, আমি রসুই ঘরে আছি।” অভি বলল, “একটা কথা পাঁড়েজি, আমরা কি বাংলোটা একটু ঘুরে দেখতে পারি?” “হাঁ, হাঁ, কিউ নেহি বাবুজি। আমি খিচড়ি চাপিয়ে দিয়েই আসছি, সব ঘুরিয়ে দেখাব।” “ও কে।” খিচুড়ি চাপিয়ে মিনিট দশেকের মধ্যেই ফিরে এলেন হরিহর পাঁড়ে, “চোলেন বাবুজিরা।”

পাঁড়েজি হাতে লণ্ঠন ঝুলিয়ে আগে-আগে চললেন। পিছনে আমি আর অভি। বাংলোটা বিশেষ বড় নয়। আমরা যে ঘরটিতে আশ্রয় নিয়েছি সেটিই সদর ঘর। তার পিছনে সরু করিডরের দু’দিকে দুটি করে ঘর। ডানদিকের একটি ঘরের মেহগনি রংয়ের দরজার উপর কালচে হয়ে যাওয়া পিতলের ফলকে লেখা ‘ইনসপেক্টর অফ সল্ট’। দরজাটা দেখে মনে হল যেন বহুদিন বন্ধ রয়েছে। দরজার উপর মাকড়সার জাল। খাঁজে-খাঁজে পুরু ধুলো। পাঁড়েজি জোরে চাপ দিতে ক্যাঁচ শব্দ করে পাল্লাদুটো সামান্য ফাঁক হল। বহুদিনের বদ্ধ বাতাসের চাপা গন্ধ এসে লাগল নাকে।

“থোড়া ঠহরিয়ে,” দরজাটা পুরো খুলে দিলেন পাঁড়েজি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বাতাস একটু হালকা হলে ঘরের ভিতরে পা বাড়ালেন তিনি, “আইয়ে বাবুজিরা।”

ঘরে ঢুকতেই ডানা ঝাপটানোর ফড়ফড় শব্দ। কড়িকাঠ থেকে সার-সার ঝুলে আছে বাদুড়ের দল! লণ্ঠনের আলোয় বিরক্ত হয়ে তাদেরই কয়েকটা ডানা ঝাপটাচ্ছে। অবাক হয়ে দেখলাম ছাদ থেকে ঝুলে আছে একটা হাতে টানা পাখা! এ ঘরটাও বেশ বড়। ঘরের মাঝামাঝি প্রমাণ সাইজের সেক্রেটারিয়েট টেবিল। সবুজ ভেলভেটের উপর পুরু কাচ। টেবিলের উপর কলমদান, দোয়াত, ব্লটিং পেপার, পিন কুশন, পেপার ওয়েট সব গুছিয়ে রাখা। যেন এক্ষুনি এসে কেউ কাজ করতে বসবে। কিন্তু টেবিলের যা দেখে চরম অবাক হলাম, সেটি হল পিতলের স্ট্যান্ডে লাগানো একটি ইউনিয়ন জ্যাক! স্বাধীনতার এত বছর পরে এ কী করে সম্ভব? তাও আবার একটা সরকারি অফিসে!

“ওই ছবিটা খেয়াল করেছিস?” টেবিলের পিছনে দেওয়ালে ঝোলানো ছবিটার দিকে তাকাল অভি। চওড়া ফ্রেমে বাঁধানো একটি তৈলচিত্র। একেবারে কালো হয়ে গিয়েছে। লণ্ঠনের আলোয় যতদূর বুঝলাম সেটা কোনও ব্রিটিশ রাজপুরুষের ছবি! বললাম, “এসব কী কিছুই তো বুঝছি না?” অভি বলল, “আমিও না।” ঘরের বাঁদিকের দেওয়ালে ঝোলানো লম্বা একটা কাঠের বোর্ডে পরপর নুন বাংলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত ইন্সপেক্টরদের নাম লেখা রয়েছে। শেষ যে নামটি রয়েছে তিনি দায়িত্বে এসেছিলেন ১৯৪৫ সালের ১৬ই জুন। সব দেখে মনে হচ্ছে যেন বাংলোটিকে ঘিরে সময় সেই ১৯৪৫-এই আটকে আছে। ঘরে বড়-বড় তিনটি কাঠের আলমারি রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ফাইল রেজিস্টার নানা কাগজপত্র ঠাসা। অভি পাঁড়েজিকে বলল, “এই ঘরটার ছবি নিতে পারি পাঁড়েজি?” পাঁড়েজি বললেন, “হাঁ হাঁ, কিঁউ নেহি।”

অভি মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করে ঘরটার কয়েকটা ছবি নিল। পাঁড়েজিকে মাঝখানে রেখে দুই বন্ধু গ্রুপফিও তুলে ফেললাম। সে ঘর থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম পিছনের বারান্দায়। সারা বারান্দা জল থইথই। চারিদিকে চাপ-চাপ অন্ধকার। তীব্র হাওয়ার ঝাপটা। পাঁড়েজি অন্ধকারে একদিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, “ওইখানে নিমকের গোডাউন।” হঠাৎ আকাশ জুড়ে ছুটে গেল বিদ্যুতের একটি তীব্র রেখা। মুহুর্তের জন্য চারিদিক সাদা হয়ে গেল। ক্ষণিকের জন্য চোখে পড়ল। প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর কঙ্কালের মতো নুনের গোডাউনের ভগ্নাবশেষ! অভি বলল, “বৃষ্টি না থাকলে একবার ঘুরে দেখা যেত।”

“কী আর দেখবেন বাবুজি!” হতাশ গলায় বলে ওঠেন হরিহর পাণ্ডে, “সে এক দিন ছিল! সর্দার-কুলি-কামিনে এ নিমকগোলা সবসময় গমগম করত। সারাদিন কত কাম। নহর সে সুমুন্দরের পানি আসত। সেই পানি শুকিয়ে নিমক বানানো, নিমক বস্তায় পোরা-কত কাজ। নিমকের বস্তা বয়েল গাড়ি চাপিয়ে স্টিমার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হত। সিখান থেকে কলকাত্তা। সারাদিন এসবেরই হিসাব করতে কেটে যেত।” বাংলোর দু’টি ঘরের ছাদ একেবারে ভেঙে পড়ছে। সেগুলো বাসযোগ্য নেই। অবশিষ্ট ঘরটি পাঁড়েজির রসুইখানা। সেখানে কাঠের উনুনে খিচুড়ি ফুটছে। টুকিটাকি কিছু বাসনপত্র এবং রান্নার সরঞ্জাম মেঝের উপর ছড়ানো।

পাঁড়েজির মুখে নুন বাংলোর গল্প শুনতে-শুনতে রাত সাড়ে নটা বাজল। বৃষ্টির তোড় কমলেও থামার লক্ষণ নেই। আমরা আর দেরি না করে রসুইঘরে গিয়ে খেতে বসলাম। এই বর্ষার রাতে খিচুড়ি আর আলুভাজা দারুণ জমে গেল। পাঁড়েজি রান্নাও করেছেন অপূর্ব। তবে খিচুড়িতে নুনটা যেন একটু কম-কম লাগল। পাঁড়েজিকে বলতে তিনি লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি পাতের কোণে একটু করে নুন দিলেন। নুন একেবারে ডেলা পাকিয়ে গেছে। বহুদিন পড়ে থাকলে যেমন হয়। লণ্ঠনের আলোয় মনে হল রংও ঠিক সাদা নয়। ফিকে হলুদ। আমার আর অভির চোখাচোখি হল। এই নুনও ব্রিটিশ আমলের কিনা কে জানে! অভি চোখের ইশারায় আমাকে আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শেষ করতে বলল। খাওয়াদাওয়ার পর আরও কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে আমরা শুয়ে পড়লাম। আমাদের কারণে উদ্বাস্তু পাঁড়েজি রসুইঘরে শুতে চলে গেলেন। বৃষ্টির রিমঝিম শব্দে কখন যে চোখ বুজে এসেছিল জানতেই পারিনি।

হঠাৎ বিকট দুমদুম শব্দে ঘুম ভেঙে গেল! কে যেন সদর দরজায় জোরে-জোরে ধাক্কা মারছে! আওয়াজের চোটে অভিও ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে। বাইরে আলো ফুটেছে। হাতঘড়ি বলছে সাড়ে পাঁচটা। আমি গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কে?” উত্তর এল, “আমি প্রদীপ। দাদাবাবুদের কটেজের কেয়ারটেকার। আপনারাই কি কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছেন?” আমি উঠে গিয়ে দরজা খুললাম। অল্পবয়সি একটি ছেলে দরজায় দাঁড়িয়ে। চোখেমুখে কেমন যেন একটা ভয়ের ছাপ। বললাম, “হ্যাঁ, আমরাই বেড়াতে এসেছি। কিন্তু কাল রাতে ঝড়বৃষ্টির কারণে পৌঁছতে পারিনি।” ছেলেটা আতঙ্কের সুরে বলল, “তা বলে এখানে উঠবেন! একটা ফোন তো”।

“আরে মোবাইলে তো টাওয়ার নেই! ফোন কী করব! আর এখানে অসুবিধের কী আছে?” ছেলেটা চোখ গোল-গোল করে বলল, “অসুবিধের কী আছে মানে? রাম রাম রাম! দাদাবাবু আপনাদের খোঁজ না পেয়ে আমাকে ফোন করেছিলেন। বললেন, সকাল হলেই যেন আমি আপনাদের খুঁজতে বেরই। তারপর এই বাংলোর সামনে বাইকটা দেখেই বুঝলাম আপনারা কী বিপদে পড়েছেন?” অভি এসে পিছনে দাঁড়িয়েছিল। ও বলল, “বিপদ? আমরা তো কোনও বিপদে পড়িনি।” ছেলেটা অবাক গলায় বলল, “পড়েননি? তা হলে খুব বেঁচে গিয়েছেন। এখন তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলুন।”

অভি একটু মেজাজ দেখিয়ে বলল, “দাঁড়াও ভাই, তোমার কথাবার্তা আমরা কিছুই বুঝছি না। মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে তবে তো বেরব।” ছেলেটা উত্তেজিতভাবে বলল, “সে আপনার মর্জি স্যার। আমি চললাম।” দৌড়ে বারান্দা থেকে নেমে ছেলেটা সাইকেলে গিয়ে উঠল। প্যাডেলে চাপ দিয়ে বলল, “সোজা রাস্তা। যখন ইচ্ছে চলে আসবেন।” তারপর ঊর্ধ্বশ্বাসে সাইকেল চালিয়ে নিমেষে ঝাউবনের আড়ালে মিলিয়ে গেল। অভি বলল, “কী ব্যাপার বল তো? ছেলেটা কী বিপদের কথা বলছিল? আর ওরকম ভয় পেয়ে পালালই বা কেন?”

“কী জানি, কিছুই তো বুঝলাম না?” অভি হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল, “আর শুয়ে কাজ নেই। চল ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ি।” “হুঁ, তাই চল।” মুখ ধোয়ার জলের খোঁজ করতে গিয়ে দেখি কেউ কোথাও নেই! পাঁড়েজির নাম ধরে অনেকবার ডাকলাম। কিন্তু কোনও সাড়া নেই। রসুইঘরে ঢুকে তো আমরা হাঁ! এটাই কি সেই ঘর, যেখানে বসে কাল রাতে আমরা খিচুড়ি খেয়েছিলাম? এ যে এক অন্ধকার খণ্ডহর! কোথায় উনুন? কোথায় বাসনপত্র? ইট কাঠ। জঞ্জালে ঢাকা ভাঙাচোরা মেঝে! দেওয়াল পুরু শ্যাওলায় ঢাকা। অভি বলল, “ঘরের এ দশা হল কী করে!” “কী জানি, কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না!” “পাঁড়েজিই বা কোথায়?” “হয়তো বাইরে গিয়েছেন।”

দু’জনে তন্নতন্ন করে বাংলোর চারপাশটা খুঁজলাম। কিন্তু কোথাও হরিহর পাণ্ডের কোনও অস্তিত্ব নেই! দু’জনেই চিৎকার করে কয়েকবার তাঁর নাম ধরে ডাকলাম। কেউ সাড়া দিল না। লোকটা যেন ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছে! আমি বললাম, “হয়তো দূরে কোথাও গিয়েছেন।” “দূরে! কোথায়? কত দূরে! এত জোরে চিৎকার করলাম। অবশ্যই শুনতে পাওয়া উচিত।” “সে যাই হোক। আমাদের তো অপেক্ষা করতেই হবে।” “হুঁ, তা তো করতেই হবে।” অপেক্ষা করতে-করতে ঘড়ির কাঁটা সাড়ে সাতটা ছুঁল। কিন্তু পাঁড়েজির কোনও দেখা নেই! অগত্যা বেরিয়েই পড়লাম। ঠিক করলাম ফেরার দিন পাঁড়েজির সঙ্গে দেখা করে যাব।

কটেজে পৌঁছতে দশমিনিটও লাগল না। বাইকের আওয়াজ শুনে কেয়ারটেকার ছেলেটি বেরিয়ে এসেছিল। আমরা গিয়ে কটেজের সামনে দাঁড়াতেই সে যেন হাঁফ ছেড়ে বলল, “ও! বাঁচালেন?” আমি সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “কী ব্যাপার বলো তো? কী নিয়ে এত ভয়?” ছেলেটি যেন আমার কথা শুনেও শুনল না। আমাদের রুকস্যাকগুলো তুলতে-তুলতে বলল, “লুচি আলুরদম করা আছে। খেয়ে নিন।” আমরাও আর কথা না বাড়িয়ে মুখ-হাত ধুয়ে খেতে বসে পড়লাম। কেয়ারটেকার ছেলেটির নাম সুকুমার। সুকুমারের লুচি আলুরদমের সত্যিই কোনও জবাব নেই।

কয়েকটা দিন খেয়েদেয়ে ঘুরে বেশ নির্ভাবনায় কেটে গেল। কিন্তু সুকুমারকে যতবারই ওই ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করেছি ও ততবারই এড়িয়ে গিয়েছে। ফেরার দিন সকালে জলখাবার খেতেখেতে সুকুমারকে চেপে ধরলাম, “কী ব্যাপার বলো তো, তুমি পাঁড়েজির ব্যাপারটা বারবার এড়িয়ে যাচ্ছ কেন?” সুকুমার আমতা আমতা করে বলল, “আপনারা ভয় পাবেন বলেই বলিনি স্যার।” বললাম, “সেই দিন থেকে তো ভয়ের কথাই শুনছি। কিন্ত কীসের ভয়?” সুকুমার চোখ নামিয়ে কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল, “স্যার, নুন বাংলোয় ভূত আছে!” “হ্যাঁ স্যার। রাত্রিবেলা ওই বাড়ির পাশে গেলে শোনা যায় কে যেন গুনগুন করে গান গাইছে!” আমি হেসে বললাম, “আরে ধুস, উনিই তো। হরিহর পাণ্ডে, নুন বাংলোর মুন্সি।” “ও নামে স্যার এ অঞ্চলে কেউ নেই। আর ওটা তো পোড়ো বাড়ি। কেউ থাকে না।” রাতের বেলা ওই পোড়ো বাংলো থেকে কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়! একসঙ্গে অনেক মানুষের কান্না, বুক ফাটা চিৎকার!” অভি বলল, “কই আমরা তো কিছু শুনিনি।” “কান্না বছরে একদিনই মাত্র শোনা যায়।” তবে চৈত্র মাসে।”

আমি মুচকি হেসে বললাম, “গাজনের সময় তো, তাই মনে হয় ভূতের উপদ্রব বাড়ে!” এমন সময় একটি বাইক এসে কটেজের সামনে দাঁড়াল। বাইক চালিয়ে এল একটি অল্পবয়সি ছেলে। পিছনে এক পক্ককেশ বৃদ্ধ। চোখে চশমা। দীর্ঘ অভিজাত চেহারা। সুকুমার হাসি মুখে বলল, “বাবু এসেছেন।” বৃদ্ধ বারান্দায় সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বুকের কাছে হাত দুটি জড়ো করে বললেন, “নমস্কার। আমি নিশিকান্ত মহাপাত্র, প্রদীপের বাবা। তোমরা তো শুনলাম আজই ফিরে যাচ্ছ। তা এখানে কোনও অসুবিধে হয়নি তো?” অভি বলল, “অসুবিধে কী বলছেন কাকু! একেবারে রাজার হালে ছিলাম।” “যাক, ভাল। আসার দিন নাকি সমস্যা হয়েছিল? তোমাদের ট্রেস করা যাচ্ছিল না?”

“আর বলবেন না জেঠু যা বৃষ্টি শুরু হল, কোথাও যে একটু দাঁড়াব তেমন জায়গাই চোখে পড়ছিল না। শেষে ওই যে নুন বাংলো রয়েছে, ওখানেই আশ্রয় নিয়েছিলাম।” অভির কথায় ভদ্রলোক গম্ভীর হয়ে গেলেন। অভি বলল, “মোবাইলে টাওয়ার ছিল না বলে সে রাতে যোগাযোগও করতে পারিনি।” ভদ্রলোক তীক্ষ দৃষ্টিতে অভির দিকে তাকিয়ে বললেন, “রাতে কোনও অসুবিধে হয়নি?”

আমরা তখন সে রাতের সমস্ত ঘটনা ওঁকে খুলে বললাম। হরিহর পাণ্ডের সঙ্গে পরিচয়, তাঁর ব্রাজিলিয়ান কফির আপ্যায়ন, খিচুড়ি বেঁধে খাওয়ানো, সব কিছু। লক্ষ করছিলাম আমাদের কথা শুনতে-শুনতে ভদ্রলোকের দৃষ্টিতে ক্রমশ ফুটে উঠছিল এক চরম অবিশ্বাসের ভাব। আমাদের কথা শেষ হলে তিনি কয়েক মুহুর্ত নিস্তব্ধ থেকে বললেন, “এ অসম্ভব কথা বলছ তোমরা! এ হতে পারে না!” “কেন জেঠু?” জিজ্ঞেস করল অভি। “কারণ হরিহর পাঁড়ে ইংরেজদের গুলিতে শহিদ হয়েছেন আজ থেকে বহু বছর আগে, সেই ১৯৩০ সালে!” “অ্যাঁ! কী বলছেন জেঠু!” আমরা চমকে উঠেছি।

বৃদ্ধ চিন্তিত মুখে স্বগতোক্তি করলেন, “তা হলে এলাকার মানুষ যা বলে সেটাই কি ঠিক? নুন বাংলোয় নাকি প্রেতের বসবাস!” অভি বিস্ময়ের ভাবটা কাটিয়ে হঠাৎ বলল, “হতেই পারে না জেঠু। আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ প্রমাণ আছে।” “কী প্রমাণ?” অভি পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল। কিন্তু এ কী! এ কী করে হয়! ছবিতে আমাদের দুজনের মাঝে কেবল একটা সূক্ষ্ম ছায়া! একটা সিল্যুট! অফিসঘরের ছবিগুলোরও একই দশা! কেবল চাপ চাপ অন্ধকার ছাড়া সেগুলোতে আর কিছুই নেই! আমরা দুজনেই হতবাক! বৃদ্ধ উদাস গলায় বললেন, “এমন পুণ্যাত্মা মানুষের যে এমন গতি হয় কী করে বুঝি না!”

অভি চরম বিস্মিত স্বরে বলল, “ব্যাপারটা আমাদের একটু খুলে বলবেন জেঠু।” নিশিকান্ত মহাপাত্র ধুতির খুঁটে চশমাটা মুছতে মুছতে বললেন, “বলছি। সবই বাপ-ঠাকুরদার মুখে শোনা। কারণ, তখন আমার জন্ম হয়নি। ১৯৩০-এ গাঁধীজি আইন অমান্যের ডাক দিয়ে সবরমতী আশ্রম থেকে ডান্ডি অভিযান শুরু করলেন। সেটা ১২ মার্চের ঘটনা। দেশজুড়ে সেই উত্তাল আন্দোলনের ঢেউ নুন বাংলোর সামান্য কেরানি হরিহর পাণ্ডেকেও ছুঁয়ে গিয়েছিল। সরকারি কর্মচারী হয়েও তিনি নুনের গোলার কুলি-মজুরদের মধ্যে গাঁধীজির ভাবাদর্শ প্রচার করতে শুরু করেন। সারাদিন নুন বাংলোর হিসাব-কিতাব আর সন্ধে হলে তুলসীদাসী রামায়ণপাঠ। এই ছিল তাঁর দৈনন্দিন কাজ। মানুষটি ছিলেন মৈথিলী ব্রাহ্মণ।

স্বপাক খেতেন। শুদ্ধাচারী জীবনযাত্রার কারণে সকলের অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন তিনি। কিন্তু সেই মানুষটির মধ্যেই যে ওরকম আগুন লুকিয়ে রয়েছে তা আগে কেউ বুঝতে পারেনি। সে সময় এ অঞ্চল বাইরের পৃথিবী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্নই ছিল। নুনের কনসাইনমেন্ট শহরে নিয়ে যেতে সপ্তাহখানেক ছাড়া ছাড়া যে স্টিমার আসত তাতেই মাঝে মাঝে দু-একখানা খবরের কাগজও আসত। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে এই ছিল তাঁর যোগাযোগ। গাঁধীজির লবণ আইন ভঙ্গের ডাক তাঁকে এতটাই উদ্বুদ্ধ করেছিল। যে তিনিও নুনের গোলায় সেই আন্দোলন শুরু করবেন বলে মনস্থির করেন। ৬ই এপ্রিল সকালে ডান্ডির সমুদ্র উপকূলে গাঁধীজি জল ফুটিয়ে নুন বানিয়ে লবণ আইন ভঙ্গ করেন।

সেই খবর দাবানলের মতো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং তা পৌঁছেছিল এই পাণ্ডববর্জিত দেশেও। এই খবরে উৎসাহিত হয়ে তিনি গোলার কুলি-মজুরদের নিয়ে ঠিক করলেন যে পরের দিন সকালে তাঁরাও সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে জল ফুটিয়ে নুন বানিয়ে লবণ আইন ভঙ্গ করবেন। কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের এমন বেয়াদপির খবর ইংরেজ সরকারের কাছে পৌঁছতে বিলম্ব হল না। কার্যক্রমের দিন সকালে হরিহর পাণ্ডের নেতৃত্বে নুন গোলার কর্মচারীরা যখন মিছিল করে সমুদ্রের দিকে এগোচ্ছেন তখন তাদের রাস্তা আটকে দাঁড়াল দারোগা মনোহর চাটুজ্যের বাহিনী! আইন অমান্যকারীরা পুলিশের বাধা ভেঙে এগনোর চেষ্টা করতেই শুরু হল নির্বিচারে গুলিবর্ষণ! হরিহর পাণ্ডে ছিলেন মিছিলের একদম সামনে। পুলিশের গুলিতে তার শরীর একদম ঝাঁঝরা হয়ে যায়।

মিছিলে অংশগ্রহণকারী কাউকেই পুলিশ রেয়াত করেনি। অনেকেই ঘটনাস্থলে মারা যান। বাকি প্রায় সকলেই গুলিতে জখম হন। এই ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ নুন বাংলোর কাছেই বিশাল গর্ত খুঁড়ে আহত-নিহত সকলকে একসঙ্গে কবর দিয়ে দেয়! ভারতমাতার অসমসাহসী এই সন্তানদের আত্মবলিদানের কথা কোনও দিন পৌঁছোয়নি বাইরের পৃথিবীর কাছে।…এরপর থেকেই নুন বাংলো সম্বন্ধে নানা কথা রটতে শুরু করে। অনেকেই নাকি দেখেছে সাদা ধুতি আর ফতুয়া পরনে হরিহর পাণ্ডের প্রেতাত্মা নিশুতি রাতে নুন বাংলোর চারপাশে টহল দিচ্ছে। কেউবা দেখেছে কালো-কালো ছায়া ভেসে বেড়াচ্ছে নুন বাংলোয়।” অভি জিজ্ঞেস করল, “সুকুমার বলছিল। চৈত্রমাসের একটি দিনে নাকি বাংলো থেকে অনেক মানুষের কান্নার আওয়াজ শোনা যায়?”

নিশিকান্ত মহাপাত্র ঘাড় নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ। ৯ই এপ্রিল ঘটেছিল সেই বীভৎস হত্যালীলা। সেটা চৈত্রমাসই হয়। প্রতি বছর সে ঘটনা ফিরে ফিরে আসে। এই কারণে এরপর নুন বাংলোয় কোনও কর্মচারীই টিকত না। ইংরেজ সরকার নেটিভ কর্মচারীদের এসব অভিযোগ পাত্তা না দিয়ে বহুদিন নুন বাংলো চালু রেখেছিল।” অভি দুঃখিত গলায় বলল, “লবণ সত্যাগ্রহ ছিল আমার গবেষণার বিষয়। সেই নিয়ে আমাকে অনেক বইপত্র ঘাঁটতে হয়েছে। কিন্তু কোথাও আমি এই ঘটনার উল্লেখ দেখিনি।”

বৃদ্ধ মানুষটি বললেন, “সেটাই স্বাভাবিক। কারণ এ ঘটনা কাগজে-কলমে কোনও দিন নথিবদ্ধই হয়নি। এ ঘটনা কেবল বেঁচে আছে স্থানীয় জনশ্রুতিতে। তাই কোনও গবেষকেরও তা দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি।” অভি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথাটা নিচু করল। বৃদ্ধ স্বগতোক্তি করেন, “অবহেলিত ইতিহাসই কি ফিরে আসে প্রেত হয়ে? কে জানে!”

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত