পরিশোধ

পরিশোধ

মঞ্জিরার সঙ্গে এখানে এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবতেই পারেনি দীপ। দেওয়ালঘড়ির টিকটিক শুনতে-শুনতে প্রায় দু’ সপ্তাহ এই হাসপাতালে কেটে গেল তার। আরও কতদিন থাকতে হবে সে জানে না। প্রথম ক’দিন, সেরে ওঠার এই দীর্ঘ অনিশ্চিত অপেক্ষা তার অসহ্য লাগত। মনে হত, এর চেয়ে ভাল ছিল মরে যাওয়া! কেন সে বেঁচে রইল! অনেক বছর আগে যখন মঞ্জিরা তাকে ছেড়ে গিয়েছিল, তার এইরকম লাগত!

এক সুগভীর, অনির্দিষ্ট ভাল না লাগার বোধ। মনে হত, পৃথিবীর আলো মরে এসেছে, আকাশ প্রাণহীন, ম্যাড়মেড়ে রং নিয়ে গতানুগতিক অনিচ্ছাকৃত কিছু ফুল ফুটে উঠছে, দিনের পর দিন। এই সমস্তই তার লাগত নিরর্থক। তখন সে মৃত্যুর কথা ভাবত। চোখের তলায় গাঢ় কালি, মুখে নিরুচ্ছাস বিষাদময়তা। সে অভ্যেসে খেত, অভ্যেসে ঘুমোত, অভ্যস্তভাবে বাসের ভিড় ঠেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসত। তার প্রথম বর্ষের প্রথমদিকের পড়া। খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ সে মনোনিবেশ করতে পারত না! কান্নার অকরুণ পিণ্ড তার গলার ভিতরটা কামড়ে ঝুলে থাকত সারাক্ষণ। সারাক্ষণ সে ভাবত, কেন মঞ্জিরা, কেন?

এই হাসপাতালেও তার একই কথা মনে হয়। কেন? কেন তারই হল এমন অসুখ? এই সময়? মঞ্জিরা তাকে ছেড়ে গিয়েছিল, যখন সে স্নাতক স্তরে অভাবিত ফল করে খুশি ছিল। এই রোগ তাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য শায়ী করে তুলল, যখন বিষাদের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে সে প্রায় জয়ী হয়েছে, তার আকাঙ্ক্ষিত কর্মজগতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠছে আনন্দের সঙ্গে। কেন জীবন বারবার তার সঙ্গে এই প্রতিকূল ব্যবহার করছে! এ কোন ইঙ্গিত! জীবনদেবতা তার প্রাণের নিবেদন চান? তার মৃত্যুতে এ জগৎ তৃপ্ত? কিন্তু কীভাবে সে মরে? এই কথা ভাবতে-ভাবতে হাসপাতালের বিছানায় তার রাত ভোর হয়ে গিয়েছে প্রথম দিকে। ইচ্ছেমতো মৃত্যুর পথ নির্বাচন করার ক্ষমতাও তার নেই। কোমর থেকে পদতল পর্যন্ত অবশ। স্নায়ুবৈকল্যে তার শরীরের নিম্নদেশ শত্রু হয়ে বসে আছে। যে নিজে পাশ ফিরে শুতে পর্যন্ত পারে না, তার জীবন-মৃত্যু কোনও কিছুরই প্রতি অধিকার নেই। ক্লীবের নিষ্ক্রিয়তাই তার নিয়তি।

তাকে যে ওষুধ দেওয়া হয়, তাতে ঘুম পায়। এক ভোরের বেলায়, তখনও বাইরে আলো ফোটেনি ভাল করে, হাসপাতালের এই ঘরের কোণে ছোট গানবাক্সে নিচু শব্দে বেজে উঠেছে কোনও ভোরের রাগিণী, কোন অলক্ষ্য থেকে কে যেন নিয়ম করে সারাদিন তা বাজিয়ে চলে, বাইরে গাছে-গাছে পাখিরা আধফোটা স্বরে কেবল শুরু করেছে ডাকাডাকি, অনেকটা শঙ্খনাদের গাম্ভীর্যে বেজে ওঠা সেই রাগিণীর ধ্বনি দীপের ঘুমঘোর টুটিয়ে তার জাগরণকে বিষাদময় করে তুলল।

সে চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগল, কেন তার এমন হল? কেন তার ঘুম ভাঙল? চিরনিদ্রা তাকে অধিকার করল না কেন? সে যে বেঁচে আছে, তার জন্য কাউকেই সে ধন্যবাদ দিতে পারছিল না। তার দু’চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল, সে না চাওয়া সত্ত্বেও। সে কাঁদতে চায় না। মঞ্জিরা যখন তাকে ছেড়ে যায়, সে সমস্ত কান্না অবরুদ্ধ রেখেছিল। এখন তার সেই শক্তি ছিল না। অশ্রুর বেগ তার ধারণক্ষমতাকে পরাস্ত করেছিল। তার শরীরের সক্রিয় উর্বভাগ কেঁপে-কেঁপে উঠছিল আবেগে। তখনই কপালে নরম শীতল স্পর্শে সে চোখ খোলে। আবছায়া আঁধারে দেখে এক মেয়ে, বড় কাছে, বড় ঝুঁকে-পড়া মুখ তার। নার্স মেয়েরা কখনওই আসবে না এত কাছে, এই নিবিড়তায়! সে বিস্ময়বিহুলতায় বলে উঠল, “কে?” “আমি।” আমি! কে আমি! দীপের বুকের মধ্যে ধকধক করে উঠল। সেই কণ্ঠস্বর! সেই! একসময় যা একদিনও না শুনতে পেলে তার মন সারাক্ষণ দুঃখে ভরে থাকত! কিন্তু এ কী করে সম্ভব! এইসময়, মঞ্জিরা কেমন করে আসবে! কেন আসবে? তার মনে হল, সে এখনও ঘুমিয়ে আছে। সে খোলা চোখ বন্ধ করেছে ফের।

“কেঁদো না দীপ, আমি মঞ্জিরা। চোখ খোলো।” দীপ চুপ করে রইল। হয়তো এ সমস্তই ওষুধের ঘোর। মায়াকণ্ঠস্বর। হাসপাতালের বিছানায় তার অসহায় দশায় মঞ্জিরার দেওয়া আঘাতের কথা সে যত ভেবেছে, তেমন আর কিছু নয়। মঞ্জিরার প্রতি তার প্রেমে ফাঁকি ছিল না! আবার তার চোখ থেকে জল পড়তে লাগল। কিন্তু সে চোখ খুলল না। ওই মায়াস্পৰ্শ মায়াস্বর সে হারাতে চাইছিল না। যদি চোখ খুলেই দ্যাখে, কিছু নেই, কেউ নেই, তার চেয়ে ভাল এই ঘুমের মধ্যে জাগরণের বায়বীয়তা, সে ভাবছিল। আহ কতদিন পর মঞ্জিরা! কতদিন পর তার ছোঁয়া! তার কণ্ঠস্বর!

একবার তার মনে হল, আসলে সে মরে যাচ্ছে কি না, মঞ্জিরা তার প্রিয়তমা, এত ভাল সে আর কাউকে বাসেনি, তাই হয়তো মরণকাল তাকে অন্তরতম অনুভবের প্রগাঢ়তায় নিয়ে চলেছে… তখন তার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মঞ্জিরা বলেছিল, “রাগ করে আছ এখনও? চোখ খুলবে না?” সে ধীরে-ধীরে চোখ মেলল তখন। না, স্বপ্ন নয়। মায়াঘোর নয়। সত্যিই মঞ্জিরা এসে বসেছে তার শয্যার কিনারায়। তার পাশ ঘেঁষে। এভাবেই সে বসত কোনও-কোনও দুপুরের নির্জনতায়, দীপের ঘরে। এভাবেই দীপের চুলে সঞ্চালিত করে দিত তার সরু লম্বা নরম আঙুলগুলি!

তারপর কপালে চুমু খেত। দীপ দু’হাতে জড়িয়ে ধরত তাকে। তার সমস্ত শরীর অপরূপ পুলকে, অসহ্য সুখের উষ্ণতায় উপচে উঠত। আজ তার শরীর সক্রিয়তা ও নিস্ক্রিয়তায় ভাগাভাগি হয়ে আছে। আজ, কত বছরের অভিমান ও বেদনার পথ পার হয়ে সে মঞ্জিরার সান্নিধ্যে অতি অপ্রত্যাশিতভাবে! সে বিহ্বল হয়ে উঠল। কণ্ঠ রুদ্ধ হল আবেগে। মঞ্জিরা উঠে জানালার পরদা সরিয়ে দিয়ে হাসল এমন, যেন এখানে এভাবেই থাকার কথা তার। যেন সে কোনওদিন দুঃখ দেয়নি দীপকে, কোনওদিন ছেড়ে যায়নি। যেন এমন করেই প্রতিদিন তাদের দেখা হয়! সে বলল, “দ্যাখো, কী সুন্দর ভোর হচ্ছে! বাঁশিতে যে সুর বাজছে, তার নাম ললিত। এমন সময় তুমি কেঁদো না দীপ।”

দীপ তাকিয়ে ছিল মঞ্জিরার দিকে। কী অসম্ভব মুহূর্ত! কী অভাবনীয় সকাল! সে বলল, “তুমি এখানে কী করে এলে!” মঞ্জিরা এগিয়ে এসেছিল। বসেছিল আবার। বলেছিল, “তুমি চাও না আমি আসি? থাকি তোমার কাছে?” “আমার চাওয়ায় কী এসে যায় মঞ্জিরা?” দীপ অভিমান ভরে বলল। মঞ্জিরা দীপের ডান হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে চুমু খেল। বলল, “আমাকে ক্ষমা করো। বোকার মতো কত কী-ই যে করলাম আমি!” এমন শান্ত অনুতাপ তার স্বরে, দীপের বুকের মধ্যে কীরকম করে উঠল!

সে ভেবেছিল, মঞ্জিরাকে ভুলে যাবে। নতুন কাজে যোগ দিয়ে সে মগ্ন হয়েছিল। এমন একটি দিনও যায়নি, যেদিন মঞ্জিরাকে তার মনে পড়েনি। সে চেয়েছিল, কর্মজীবনের নিরন্তর ব্যস্ততার ভিতর জীবনের প্রথম প্রেম এবং বিচ্ছেদজনিত আঘাত সে মুছে ফেলবে। পারেনি। হয়তো পারত। কিন্তু এই অসুখ তাকে পুনর্বার মঞ্জিরার প্রদত্ত আঘাত এবং শূন্যতার মধ্যে ঠেলে দিল। এ কি জীবনদেবতার কোনও নবতর রহস্য? মঞ্জিরাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই এই আয়োজন? সে বলল, “ক্ষমা কীসের? এভাবে বোলো না! আমি, আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না তুমি এসেছ!” মঞ্জিরা বলল, “মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছ। না?” “হ্যাঁ, মঞ্জিরা।”

সে চুপ করে রইল। কী বলবে ভেবে পেল না। যে মেয়ে তাকে অকারণে ছেড়ে গিয়েছিল, চূড়ান্ত হতাশা এবং জীবনবিমুখতায় ঠেলে নিষ্ঠুরের মতো হারিয়ে গিয়েছিল, জীবননাট্যের এক নির্মম অধ্যায়ে সে যদি সমস্ত আন্তরিকতা সমেত বিনা বিজ্ঞপ্তিতে ফিরে আসে, তা হলে, তখনই তাকে আগের মতো আপনবোধে, অনায়াসে গ্রহণ করা যায় না, দীপ বুঝতে পারছিল। যতই সেই মেয়ে তার হৃদয়েশ্বরী থাকুক। কল্পনার অবয়ব আর বাস্তবের সন্নিধানের ব্যবধান, ঘোচাতে সময় লাগে। মঞ্জিরা আবার দীপের চুলে আঙুল চালিয়ে দিতে দিতে বলল, “স্বপ্ন নয়, সত্যি। দীপ, তুমি ভাল হয়ে যাবে, ডাক্তাররা এই কথাই বলেছেন তো?” দীপ বলে, “জানি না কবে ভাল হব। অনির্দিষ্টকাল চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।”

“হবে না। তোমার ব্যাপারে ডাক্তারদের মতামত আমি শুনেছি। বয়স কম থাকলে এ ধরনের স্নায়ুরোগ আকস্মিকভাবেও সেরে উঠতে পারে। মনে জোর রাখো। মনে করো, তোমাকে সেরে উঠতেই হবে। চলতেই হবে। আমি তোমাকে ঠিক সারিয়ে তুলব।” “তুমি?” “ঠিক পারব। দ্যাখো। আমিই পারি দীপ, তোমাকে অসুস্থ-অসুখী করে তুলতে। আমিই পারি তোমাকে সুস্থ-স্বাভাবিক করে দিতে। তুমি তো আমারই, বলো? আমি জানি তুমি আর কাউকে ভালবাসতে পারনি। ইশশশ! তোমার চুলগুলো একেবারে আঠা হয়ে আছে। এসো আজ আমি তোমাকে স্নান করিয়ে দেব।”

এতক্ষণ পর, এই প্রথম, মঞ্জিরার কোলে হাত রাখল দীপ। বলল, “আর কিছুক্ষণ পরেই আয়ামাসি চলে আসবেন। তিনিই আমাকে সাফসুতরো করবেন। আমাকে তো সবকিছুই বিছানায় সারতে হয়। সেসব তোমার কাজ নয়। তুমি এখন এখানে থাকো মঞ্জিরা। কতদিন পর তোমাকে দেখছি।” “পাগল! আমি কি ইচ্ছে করলেই সারাক্ষণ থাকতে পারি নাকি?” “এই হাসপাতালে আছি জানলে কী করে?” “কাল এই ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখলাম তোমাকে। তোমার সব কাগজপত্র আমি পড়ে নিয়েছি। মাত্র চারটে ঘর পরেই আমি আছি তো!” “তুমি! তুমি এখানে ভর্তি আছ!” “হুঁ!” “কী হয়েছে তোমার!”

“সেরকম কিছু না। ভয় পেয়ো না। এখন অসুখের কথা রাখো। আমার মাথায় ব্যথা হচ্ছিল। অনেক পরীক্ষা করেও কিছু বোঝা যায়নি। তাই পর্যবেক্ষণে আছি। আর দশদিন বা পনেরো দিন।” “ওহ!” “তার মধ্যেই তুমি সেরে উঠবে। দেখে নিয়ো। এখানে তুমি এসেছ মাত্র তিনদিন হল। আমি যাওয়ার আগেই তুমি সেরে উঠবে। তারপর “তারপর কী? মঞ্জিরা?” “অ্যাই, আর কথা নয়। সাতটা বাজলেই আমি চলে যাব। শোনো, তুমি কিন্তু কাউকে বলবে না আমি এসেছিলাম। বললে আর একদিনও আমি আসতে পারব না। রোজ ঠিক তিনটে থেকে চারটেয় আসব। সাতটায় চলে যাব। কথা দাও, তুমি সারাদিন ভাল মনে থাকবে। মৃত্যুর কথা ভাববে না।”

মঞ্জিরার হাতখানি নিজের বুকের উপর রাখল দীপ। দেওয়াল ঘড়িতে রিংলিং টিংলিং মধুর শব্দে পাঁচটা বাজল। সবুজ ডাঁটিওয়ালা হলুদ ফুলের গুচ্ছ যে ছবিতে, তার উপর ভোরের আলো এসে পড়ল। দীপ বলল, “মৃত্যুকে আমি স্বেচ্ছায় ডাকিনি কখনও মঞ্জিরা। জীবন নিজেই আমাকে বারবার নিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর কাছে। তুমি যেদিন ছেড়ে গিয়েছিলে, আমার কাছে জীবন আর মৃত্যুর কোনও তফাত ছিল না। আমি বেঁচে থেকেও মরে ছিলাম। তারপর ধীরে-ধীরে আমি সেরে উঠলাম। জীবন আবার আমাকে মৃতবৎ করে তুলল। এভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করে বলো?” মঞ্জিরা আস্তে-আস্তে মুখ নামিয়ে এনেছিল। দীপের গালে গাল রেখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে-দিতে বলেছিল, “তুমি বাঁচবে। আমি তোমাকে বাঁচাব। আর কোনও কথা নয়। আমি তোমাকে স্নান করিয়ে দেব।

আয়ামাসিরা মোটেই ভাল স্নান করায় না। তুমি একটুও লজ্জা করবে না। আমার কাছে তোমার কীসের লজ্জা? তা ছাড়া আমি পারি। আমি তোমার কাজ করে দিয়ে যাব। তারপর আমি তোমার মাথায় কয়েকটি সংবাহন ক্রিয়া প্রয়োগ করব। চাপচিকিৎসা। সেগুলি তোমার স্নায়ু উজ্জীবিত করবে। তারপর তোমাকে দাঁড়াতে শেখাব আমি।” মৃদু মিষ্টি গন্ধ মঞ্জিরার গায়ে। দীপের মস্তিষ্কের ঘ্রাণকোষে তা যেন চিরকালের জন্য মুদ্রিত হয়ে রইল।

সেদিন, দীপকে আধশোয়া দশায় রেখে তার চুলে শ্যাম্পু করল মঞ্জিরা। দীপ যখন ছোট ছিল, তার জ্বর হলে, তার মা তাকে ঈষদুষ্ণ জলে চোবানো তোয়ালে দিয়ে ঘষে পরিষ্কার করে তুলতেন। মঞ্জিরাও, তেমনই যত্নে তেমনই মমতায়, ঘষে-ঘষে ঝরঝরে করে তুলল তাকে। তার পোশাক পালটে দিল এমন অনায়াস দক্ষতায়, যেন একাজ সে রোজ করছে! দীপের বিস্ময় গোপন থাকছিল না। সে অপ্রস্তুত দশার লজ্জায় বারবার হেসে ফেলছিল। অবশেষে দীপ বলেছিল, “আয়ামাসি এসে আমাকে দেখে অবাক হয়ে যাবে।” মঞ্জিরা বলল, “তুমি বলবে, আর একজন এসে করে দিয়ে গিয়েছে। মিনামাসি এলে বলবে কাজলিমাসির নাম, লক্ষ্মীমাসি এলে বলবে মন্দারমাসির নাম। ব্যস, কোনও গোলমাল হবে না। দেখি, চুলটা আঁচড়ে দিই। এ মাঃ! এই পাউডারটা ভাল না। বলবে, একটা ল্যাভেন্ডার আনতে। আমার প্রিয়।”

আঙুলের ডগা দিয়ে দীপের মাথার বিভিন্ন জায়গায় চাপ দিতে থাকল সে। তারপর হাতের তালুতে প্রত্যেক চূড়ায়। আঙুলের ডগায়। পায়ের তলায়। হাতের এক একটি জায়গায় প্রচণ্ড লাগছিল দীপের। সে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছিল। মঞ্জিরা উল্লসিত হয়ে বলছিল, “এখানে বেশি লাগছে? খুব ভাল! এখানে? এখানে?” প্রথম ক’দিন পায়ে কোনও অনুভব ছিল না তার। দিন পাঁচেক পর, পায়ের তলায় যখন হাতের তালুর মতোই তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করে কঁকিয়ে উঠল সে, আনন্দে মঞ্জিরা তার পায়ে মুখ ঘষতে ঘষতে কাঁদতে লাগল। বলল, “ঠিক হয়েছে দীপ। আমার প্রচেষ্টার ফল ফলেছে। তোমাকে সুস্থ না করে আমার মুক্তি নেই।” তারপর থেকে অতি দ্রুত কেটে যাচ্ছে দিন।

সারাটি দিবসে, যখন মঞ্জিরাকে কাছে পাওয়ার উপায় নেই, তবু তাকেই ভাবতে-ভাবতে সময় যায়। তার গায়ে মঞ্জিরার মিষ্টি গন্ধ লেগে থাকে। এত স্পষ্ট সেই ঘ্রাণ যে, মনে হয় সে কাছেই আছে, আনমনে তাকে ছোঁয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয় দীপ। মনে হয়, এই সে হেঁটে গেল লঘু পায়ে। এই হেসে উঠল। এখন এই বিভ্রম, এই মায়া তাকে আনন্দ দেয়। সে জানে, কাউকে সারাক্ষণ গভীরভাবে ভাবলে, তাকে আকঙক্ষা করলে, তার নিরবয়ব উপস্থিতি মায়া রচনা করে। সে অবাক হয়ে ভাবতে থাকে, মঞ্জিরার অপরূপ সেবাময়ী মূর্তি সে দেখতে পাচ্ছে এখন। ছাত্রজীবনের সেইসব দিনে, যখন মঞ্জিরা তার প্রেমিকা ছিল, তারা অজস্র কথা বলত, তর্ক করত, পরীক্ষার সময় ভাগাভাগি করে নিত। উদ্বেগ, তারপর কোনও ছায়াছবি দেখতে গিয়ে, প্রায়ান্ধকার প্রেক্ষাগৃহে হাতে হাত জড়িয়ে বসে থাকা ছিল অতি প্রিয়! সেইসব দিনে, দীপ কল্পনাও করতে পারত না, মঞ্জিরা অকারণে তাকে ছেড়ে যাবে। এই কল্পনাও সে করতে পারেনি, জীবনের অন্যতম অসহায় দশায় মঞ্জিরা তাকে শুশ্রষা করে সুস্থতার দিকে নিয়ে যাবে। চিকিৎসকেরা তার অভাবনীয় উন্নতিতে মুগ্ধ। আর দু’সপ্তাহের মধ্যেই তাকে অবলম্বনের সাহায্যে চলন অভ্যেস করানো হবে। এখন, ওষুধ খেয়েও তার নিদ্রাদশা সজাগ।

বিকেলে তার আত্মীয়, বন্ধু, সহকর্মীরা কেউ না কেউ আসেই। সেদিন প্রিয় বন্ধু সৌম্য বলল, “লোকে হাসপাতালে থাকলে তিতিবিরক্ত হয়ে ওঠে। চোখেমুখে কালি পড়ে যায়। তুই তো দেখছি বেশ খোশমেজাজে আছিস। ব্যাপারটা কী? কোনও ডাক্তারনী বা নার্সের প্রেমে পড়েছিস নাকি?” দীপ সৌম্যকে বলেছিল, “প্রেমে পড়লে তো পাগলের দশা হয় রে সৌম্য। যাকে ভালবাসিস, তার নাগাল না পাওয়া পর্যন্ত মন ভবাপাগলার মতো উন্মাদ।”

সৌম্য বলে, “তুই ভাল জানবি। আমার তো ভাই তোকে দেখেই প্রেমের শখ মিটে গিয়েছিল। ঠিকই করেছি, একেবারে বউয়ের সঙ্গে প্রেম করব। তা, এখানে তো প্রথম দিকে একেবারে বিষণ্ণ হয়ে থাকতিস, আমার ভয় করছিল যে আবার হয়তো তোর সৌম্য কথা শেষ করেনি। মঞ্জিরা যখন দীপকে ছেড়ে যায়, সেইসময় দীপের ভূতগ্রস্ত অবসাদের দশার প্রত্যক্ষদর্শী সে। দীপ সৌম্যর দিকে তাকিয়ে বলল, “জানিস, মঞ্জিরার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। মানে, দেখা হয়।”

“মঞ্জিরা?” সৌম্য তিক্তভাবে বলেছিল, “কোখেকে উদয় হল? কী দেখতে এসেছিল? কতটা খারাপ আছিস তুই! কতটা ক্ষতি ও করতে পেরেছে তোর?” “না-না সৌম্য, সেরকম নয়। আসলে ও-ও এই হাসপাতালে ভর্তি আছে। ওর মাথায় কিছু হয়েছে যা ডাক্তাররা ধরতে পারছেন না। “কারও পক্ষেই ধরা সম্ভব নয়।” “যাঃ! এভাবে বলিস না!” “যেই ওকে দেখলি, অমনই গলে গেলি! ব্যাটা আক্কুটে হ্যাংলা। ওর লজ্জা করল না তোর সামনে আসতে? তোর ওকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করল না?” “দেখা করবি, সৌম্য? যা না। এখান থেকে চারটে ঘর পরেই।”

“না। দীপ, আমি তোর কষ্ট আর দেখতে চাই না। এখনও ওর ভূত তোর ঘাড়ে চেপে আছে আমি জানি। দীপ, যে একবার বিশ্বাস ভাঙে তাকে আবার বিশ্বাস করলে ঠকতে হয়। ও তোর প্রেমিকা ছিল, এখন নেই, এটা মেনে নেওয়াই ভাল।” “এত স্বাভাবিক ও, যেন মনে হয় ও কোনওদিন চলে যায়নি।” “দীপ, তোর শরীর সারাতে হবে। এর মধ্যে নতুন করে মানসিক অবসাদ তোর ক্ষতি করতে পারে। ডাক্তাররা তাকে নিয়ে আশাবাদী যে, তুই খুব দ্রুত উন্নতি করছিস। এর মধ্যে মঞ্জিরার সঙ্গে নতুন করে জড়িয়ে পড়া আমার ভাল লাগছে না।”

দীপের ভারী ইচ্ছে হয়েছিল, সৌম্যকে জানায়, মঞ্জিরা ভোররাতে এসে কীভাবে তাকে সারিয়ে তুলছে। কিন্তু লজ্জার নিষেধ তাকে সংযত করে তুলল। সে বলল, “একবার দেখা কর, তোরও ওকে আগের মঞ্জিরাই মনে হবে।” সৌম্য বলেছিল, “না, বললাম তো। প্রচণ্ড রাগ আমার ওর উপর। ওকে আমি খুনও করে ফেলতে পারি।” “যা-তা বকছিস।” “যা-তা বকছি? ও তোকে কেন ছেড়ে গিয়েছিল, বলেছে? কোন মতলবে তোর কাছে আসছে আবার? দীপ, আমি কাল অসলো চলে যাচ্ছি। খুব চিন্তা থাকবে তোর জন্য। ভাল থাকিস ভাই। আমি দেশে ফিরেই তোর কাছে আসব। এসে যেন না শুনি, কেউ তোকে দুঃখ দিয়ে গিয়েছে।”

সৌম্য এখন দেশের বাইরে। দীপ ইদানীং সোজা হয়ে বসে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করতে পারছে। নার্স মেয়েরা শয্যার হাতল ঘুরিয়ে সেটি উঁচু করে তাকে বসিয়ে দেয়। একটি সেতুর মতো টেব্ল দেয় কোল বরাবর। তার তলা দিয়ে দীপের অসাড় কোমর থেকে পদতল অবধি ঘুমন্ত পড়ে থাকে চাদর ঢাকা দিয়ে। এইভাবে সে কাজ করে। বই পড়ে। আর দেওয়াল ঘড়ির দিকে বারংবার তাকায়। রাত সাড়ে আটটায় রাতের খাবার এবং ওষুধ খাইয়ে তাকে শুইয়ে দিয়ে যায় নার্স মেয়েটি।

হাসপাতালের হাঁকডাক থেমে আসে। অন্ধকার ঘরে পরদার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ে বাইরের আলো। নানারকম যন্ত্রপাতি চলার শব্দ বেড়ে ওঠে বাইরের নৈঃশব্দের বিপরীতে। আর। দেওয়াল ঘড়ির টিকটিক। যত তন্দ্রা ঘনায় দীপের চোখে, তত তার অপেক্ষাজনিত উদ্বেগ প্রবলতর হয়। আসতে পারবে তো মঞ্জিরা? তাকে যে চুপি-চুপি আসতে হয়। গভীর রাতে এক রোগিণী অভিসারে চলেছে এক রোগীর কক্ষে! জানাজানি হলে কৌতুকপ্রদ হয়ে উঠবে। এমনিতেও, যতক্ষণ মঞ্জিরা তার কাছে থাকে, সে ভয়ে-ভয়ে থাকে, এই বুঝি কেউ চলে এল! মঞ্জিরা তাকে আশ্বস্ত করে, “কেউ আসবে না। এলে আমি লুকিয়ে পড়ব। বাথরুমে ঢুকে পড়ব।”

মঞ্জিরার উপর দীপের কোনও রাগ নেই। কখনও ছিল না। সৌম্যর মতো তার কখনও মঞ্জিরাকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছে হয়নি। সে শুধু অনন্ত অসীম কষ্ট পেয়েছে এই ভেবে যে, বিনা কারণে মঞ্জিরা তাকে ছেড়ে গেল! সৌম্য সেইসময় তাকে বলেছিল, বিনা কারণে কিছু হয় না। এক রাতে, আলো-আঁধারির ফাঁকে ঘড়ির টিকটিক শব্দ বাজছে তো বাজছেই। ঘুমের মধ্যে অপেক্ষা করতে-করতে অতি ভোরে ললিতধ্বনি বেজে উঠল যখন, পাখির আধফোটা কূজন ভেসে এল অল্প-অল্প, দীপ চোখ মেলে দেখল, প্রাক ঊষার কূলে পৌঁছেছে রাতের তরণী! এ কি!

মঞ্জিরা আসেনি কেন! এই এতদিন সে যে প্রতি ভোরের বেলা এসেছিল। প্রতি ভোরে পরম ভালবাসায় সারিয়ে তুলছিল দীপকে। শুশ্রুষা করেছিল। সেই তাদের দু’জনের একান্ত ঘনিষ্ঠ সময়, পৃথিবীর আর কেউ তার সন্ধান জানে না, জানে না কতখানি ভালবাসা দিয়ে এক মেয়ে আর এক যুবক এমন অনন্য গোপন ভুবন গড়ে তুলতে পারে!

দীপের ভয় করে উঠল। প্রবল শীতার্ত বোধ। করল সে। কিছু হল না তো মঞ্জিরার? গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ল কি সে? যে-রোগের কুলকিনারা পাওয়া যায়নি, তা যে অনেক বেশি ভয়াবহ, অনেক গুণ অনিশ্চয়! দীপের মনে হতে লাগল, মঞ্জিরার খবর তার আরও বেশি করে জানা উচিত ছিল। অপ্রত্যাশিত অভিসারের উল্লাসে সে তার কর্তব্য ভুলে বসে আছে! মঞ্জিরা! মঞ্জিরা! দু’বার ডাকল সে। সর্বগ্রাসী আশঙ্কায় তার কণ্ঠমণি পর্যন্ত কান্নায় ব্যথা করে উঠল। সে জানল না, সে শরীর টেনে-টেনে উঠে বসছে। উঠে বসতে পারছে কারও সাহায্য ছাড়াই! মঞ্জিরা বলেছিল, এই চিকিৎসা পদ্ধতির নাম ‘আকুচাপ।’

এই দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। এসব কিছুই দীপের মনে রইল না। মঞ্জিরার অনুপস্থিতি তাকে অস্থির করে তুলল। দু’হাতে মুখ ঢেকে একাকী অন্ধকারে সে ক্রন্দনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে লাগল জোরে-জোরে শ্বাস টেনে। আর তখন, সেই পরিচিত গন্ধ, সেই হৃদয় আকুল করা পেলবতা তাকে জড়িয়ে ধরল। মুহূর্তে দীপও জড়িয়ে ধরল মঞ্জিরাকে। কাতর স্বরে বলল, “মঞ্জিরা! আজ এত দেরি কেন? কী হয়েছিল?” দীপের মাথা বুকে চেপে মঞ্জিরা ফিসফিস করে বলল, “আজ আমার ছুটি।” “ছুটি!” দীপ মঞ্জিরার বুকের থেকে মাথা তুলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আর্তনাদের মতো করে বলল, “আজই ছুটি! কই, কাল তো বলোনি কিছু।” “জানতাম না যে দীপ।” “কিন্তু তোমার অসুখটা কি ধরা গেল?” “না দীপ। আর বোধ হয় ধরা যাবে না।” “কেন যাবে না? আমি ভাল হয়ে উঠলেই তোমাকে আরও বড় ডাক্তার দেখাব। ঠিক সারিয়ে তুলব তোমাকে।” “আচ্ছা, সেসব পরে হবে। এখন দ্যাখো দীপ, তুমি নিজে উঠে বসতে পেরেছ। এটা কি কম কথা? খুব শিগগির তুমি হাঁটতে পারবে।”

“এইসব তোমার জন্য হয়েছে মঞ্জিরা। তুমি অসাধ্য সাধন করেছ। কিন্তু তুমি আবার আসবে তো? রোজ আসবে তো?” “বিকেলে দেখা করার সময় যে অন্যরা থাকবে!” “তাতে কী মঞ্জিরা! তুমি আসবে। তোমাকে না দেখে থাকতে পারব না আমি।” “সকলের সামনে তোমার কাছে আসার আর উপায় রাখিনি আমি দীপ।” “মঞ্জিরা, আমার তোমার উপর কোনও রাগ নেই। একটা সম্পর্ক অনেক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যায়। ভাল লাগা বা না লাগা, সাময়িক বিচ্ছেদ, এ সমস্তই সম্পর্কের অনুষঙ্গ। আমি যদি তোমার উপর রাগ না করি, অন্যরাও করবে না। তুমি নিঃসঙ্কোচে এসো। তুমি না এলে আমার কষ্ট হবে। আমার আকুচাপ চিকিৎসাই বা কেমন করে চলবে!”

“তোমার ওই দেরাজে একটি বই রেখেছি। আকুচাপ সংক্রান্ত। ওই বই তুমি পড়বে আর ওতে যোগাযোগের ঠিকানা আছে। জেং শাও শেন একজন আকুচাপ বিশেষজ্ঞ। আমি তাঁর প্রিয় ছিলাম। অনেক শিখেছি তাঁর কাছে। তুমি যেয়ো। আর সৌম্যকে বোলো, আমাকে যেন ক্ষমা করে।” আকাশে আলো ভরে উঠেছে। পাখিরা খোলা গলায় ডাকাডাকি করছে। ললিতের সুর শেষ হয়ে কখন যেন শুরু হয়েছে ভৈরবীর ধুন। মঞ্জিরা ও দীপ বসেছে মুখোমুখি। কাছাকাছি। দীপ বলছে, “আর আসবে না তুমি?” মঞ্জিরা বলল, “আসব। কবে, তা জানি না।”

“তোমার সম্পর্কে যে কিছুই জানা হল না আমার। আমার কাছে আসতে কেউ কি বাধা দেবে তোমাকে?” “দীপ, এবার আমাকে যেতে হবে।” “মঞ্জিরা, কেন আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে? আজই বা কেন ছেড়ে যাচ্ছ?” “আমি যে নিজেই জানি না দীপ! আমার ভিতরটা বড় অস্থির। জানো, আজ, এই ভোরে, চলে যাওয়ার ডাক এসেছে যখন, আমি বুঝতে পারছি, আমি কত বড় দুর্ভাগিনী! তোমার অত গভীর ভালবাসা আমি সহ্য করতে পারিনি।”

“এখন তো পারছ। আগে যা হয়েছে তা হয়েছে। মঞ্জিরা, আমরা আবার এক হতে পারি না?” “নিয়তি তার অন্তরায় দীপ৷” “আর কাউকে ভালবেসেছ? বিয়ে করেছ?” দীপের হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মঞ্জিরা। দীপ দেখল, মঞ্জিরার চোখের কোলে দুঃখের প্রগাঢ় কালিমা। মুখ ফ্যাকাশে। তার দুই চোখে টলটল করছে যন্ত্রণাকাতর অশ্রুবিন্দু। দীপ বুঝতে পারছে, ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট মঞ্জিরাকে আচ্ছন্ন করেছে কতখানি! তার মনে হল, মঞ্জিরা তার বর্তমান সম্পর্কে বিশদে বলতে চায় না। বুকের মধ্যে চাপ হয়ে ওঠা শ্বাস উগরে দিল সে।। মঞ্জিরা বলল, “যাই দীপ। আমাকে কথা দাও ভাল থাকবে।”

“থাকব।” “আজ তোমাকে যত্ন করতে পারলাম না।” “যা করেছ, তাই যে আমার সারা জীবনের সম্পদ। আজ কখন ছুটি তোমার?” “ছুটি হয়ে গিয়েছে। বেরতে-বেরতে দশটা।” “আজ সৌম্যর আসার কথা সকালের দিকে।” “যাক। ভাল হল।” দীপের কপালে চুমু খেল মঞ্জিরা। চলে গেল। অবসাদ ও শূন্যতা আচ্ছন্ন করে ফেলল দীপকে। যন্ত্রণা, কষ্ট সমস্ত ছাপিয়ে এক অসহায় উদাসী অনুভব। সেই আচ্ছন্নতার মধ্যেই সকালবেলার কাজগুলি সেরে নিল সে। কাজলিমাসি এসেছিল। তাকে উঠে বসতে দেখে খুব খুশি। সে বলল, “এখান থেকে চারটে ঘর পরে কত নম্বর?”

কাজলিমাসি বলল, “তিনশো চোদ্দো। কেন?” “ওখানে তোমার কাজ পড়ে না?” “না গো। ও হল সি সি ইউ।” “সি সি ইউ?” “ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট। ওখানে সব বিশেষ প্রশিক্ষণ নেওয়া নার্স। রোজই কেউ না কেউ ওখানে মরে। আজও মরেছে ভোরবেলায়। একটা মেয়ে!” “মেয়ে? কী নাম তার? কত বয়স?” “অত শত কি আর জানি বাপু? কাজ শেষ করতে প্রাণান্ত!” দীপের কষ্ট হতে লাগল। মৃত্যুর খবর, সে চেনাঅচেনা যারই হোক, ভাল নয়। তার মনখারাপ হয়ে যায়। মঞ্জিরা কী জানে, আজ একটা মেয়ে ভোরবেলায় মারা গিয়েছে! না জানাই ভাল। আজকের ভোর এমনিই বিশ্রী। বিস্বাদ। নিরানন্দ।

সকাল নটা থেকে দশটা পর্যন্ত রোগীর আত্মীয়পরিজন দেখা করে যেতে পারে। এবেলা দীপের কাছে সাধারণত কেউ আসে না। আজ সৌম্য এল। দীপকে দেখে বলল, “কী হল? এত শুকনো লাগছে কেন তোকে?” দীপ তাকাল, যেমন করে সে তাকিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়ার সময়। ভাষাহীন, অশ্রুময়, ব্যথিত চাহনি। সৌম্য বলল, “আবার দাগা খেয়েছিস? তোকে সাবধান করেছিলাম।” দীপ বলল, “ও আজ চলে যাচ্ছে।” “কোথায়?” “ওর ছুটি হয়ে গিয়েছে।” “বাঁচা গিয়েছে।” “তোর কাছে ক্ষমা চেয়ে গিয়েছে। দশটায় বেরবে। যা না, একবার দেখা করে আয়। আর… আর… একবার আসতে বলবি? বলবি এক মিনিটের জন্য খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।” “তোকে নিয়ে ঝামেলার শেষ নেই দীপ।” “জানিস, ও রোজ ভোরবেলা লুকিয়ে চলে আসত। আজ আমি নিজে নিজে উঠে বসেছি ওরই জন্য। দ্যাখ, ওই দেরাজে একটা বই আছে। আকুচাপ বিষয়ে। ও রেখে গিয়েছে। ও ওটা প্রয়োগ করত আমার উপর। ও আজও আমাকে ভালবাসে রে। ও অনুতপ্ত!”

“তবে আর কী! পরমানন্দে বুলবুলভাজা খা। ঠিক আছে। কত নম্বর? যাচ্ছি।” “তিনশো তেরো বোধ হয়। তিনশো চোদ্দো তো সিসিইউ।” “আমি জেনে নিচ্ছি।” সৌম্য ফিরে এল মাত্র পনেরো মিনিট পর। একা। বসল দীপের শয্যাপার্শ্বে, কেদারায়। এই পনেরো মিনিটেই তার অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে। তার ভুরু কুঞ্চিত, সে গম্ভীর। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। সে দীপের হাত নিজের হাতে নিল। সৌম্যর করতল ঘামছিল। সে। রুমালে মুখ মুছে, ভাঙা কণ্ঠে বলল, “শোন। ভাল করে শোন। তুই যেদিন ভর্তি হলি তার ঠিক তিনদিন পর মঞ্জিরা তিনশো চোদ্দোর চার নম্বর শয্যায় ভর্তি হয়।”

“তিনশো চোদ্দো?” “হ্যাঁ। সিসিইউ-তে। চার নম্বর বিছানায়।” দীপ কিছু না বুঝেই বলে, “ও।” সৌম্য বলে চলে, “প্রথম দিন থেকেই অবস্থা খারাপ ছিল। আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। মরেনি। কিন্তু চেতনাও ছিল না। এতদিন একটানা ভেন্টিলেশনে ছিল। ওই কৃত্রিম উপায় ছাড়া বাঁচিয়ে রাখার অন্য উপায় কিছু ছিল না।”“অসম্ভব! তা কী করে হয়? ও রোজ নিজে হেঁটে আসত। তুই অন্য কোনও মেয়ের কথা শুনেছিস। আজ সিসিইউ-তে একজন মারা গিয়েছে। মঞ্জিরা শয্যাশায়ী ছিল না রে।”

“আমিও তাই ভেবেছিলাম। সেটা হলেই আমার সবচেয়ে ভাল লাগত। বিশ্বাস কর। আমি নিজে দেখে এসেছি ওর… ওর… ইয়ে, মানে ওকে। আজ ভোর চারটেয় মঞ্জিরার মৃত্যু হয়েছে। আসলে মারা ও সেদিনই গিয়েছিল। পুরোপুরি কোমায় ছিল। কোনওরকমে কৃত্রিমভাবে টিকিয়ে রাখা হয়েছিল আর কী!” “তা হলে?” “আমি জানি না রে!” “ও আসত। রোজ আসত। আজও এসেছে। দেরাজে বইটাও আছে, তুই দ্যাখ। বিশ্বাস করছিস না? ও রোজ আসত।”

“আমি তোকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি দীপ।” দুই বন্ধু বোবা চোখে তাকিয়ে রইল পরস্পরের দিকে। ঘরের মধ্যে তখনও মঞ্জিরার গায়ের মিঠে গন্ধ লেগে ছিল। দেওয়াল ঘড়ির দিকে চোখ গেল দীপের। পাঁচটা চুয়ান্ন। ঘড়িটা বন্ধ। ঠিক ওইসময় মঞ্জিরা দীপের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গিয়েছিল। সৌম্য দেরাজ খুলল। দমকা হাওয়ায় বইয়ের পাতাগুলি উড়তে লাগল। দীপ চোখ বন্ধ করল। মঞ্জিরার শরীর যখন ভেন্টিলেশনের সাহায্যে বেঁচে থাকছিল, তার আত্মা সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিল দীপের সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে। প্রেমের পরিশোধ এর চেয়ে মহৎ আর কী দিতে পারত মঞ্জিরা!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত