চাকরিজীবি ছেলে

চাকরিজীবি ছেলে

শিপনের বাবা তার জন্মের 1 বছর পরে মারা যায়! শিপনের দুইটি বোন।আর সে একা ছেলে! মায়ের মানিক রতন!তার মা মিনারা খাতুন অসহায় হয়ে যান,,স্বামী মৃত্যুর পর! ছেলেটা ছিলো সবার ছোট।

তার মা তাকে অনেক বেশি আদর করতো,, যেটার অর্ধেক ও তার 2 বোনকে করতো না! সব দিক থেকেই শিপনকে তার সামর্থ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যত্ন করতেন! বোনদের থেকে তাকে বেশি পরিপাটি করে রাখতো! এমনিতে ও সবাই বলে মায়েদের নাকি ছেলে সন্তানের প্রতি ভালবাসা বেশি থাকে,,সেটা আর কেউ না উনার টা দেখে বুঝেছি! ওদের বাবা মারা যাবার পর,,খুব কষ্টে সংসার চালাচ্ছিলেন মিনারা খাতুন! মেয়ে গুলো ও বড় ছিলো,, তাদের কাউকে ই মিনারা খাতুন লেখাপড়া শিখান নি,,অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন! আর ছেলেটাকে তিনি মসজিদে কুরআন শিক্ষা দিয়ে,,স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন!

খুব মেধাবী ছিল শিপন! সে প্রাইমারি স্কুলে প্রথম থাকতো সবকিছুতে,,,যেখানে তাকে কোনো শিক্ষক রেখে পড়ানো হতো না,,নিজের চেষ্টায় আর স্কুলের শিক্ষকদের সহায়তায় সে বৃত্তি পায়! ছেলের এতো ভালো সফলতায় মায়ের মন ভরে যায়! আর ছেলেকে উচ্চ শিক্ষিত বানানোর আকাংকা বেড়ে উঠে! মা ছেলেকে ভর্তি করিয়ে দেয় হাই স্কুলে! এদিকে মিনারা খাতুন ছেলের পড়ালেখার অল্প খরচ দিতে ও হিমসিম খাচ্ছিলেন! তিনি হাঁস মুরগি এসব পালন করে ডিম বিক্রি করে এসব এর খরচ দেন! এমনিতেই ভালো খেতে পরতে পারেন না ওরা,,ছেলে ও সন্তুষ্ট সবকিছুতেই! ওর মায়ের কষ্টের টাকায় বানিয়ে দেওয়া একটা শার্ট দিয়ে ই স্কুলে জীবন পার করে দিয়েছে,,

আর সে মাধ্যমিক পরিক্ষায় উপজেলার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে! সেদিন তার মায়ের দুচোখ গর্বে ছলছল করে উঠে! সেদিন হয়তো সপ্ন দেখেছিলেন, যে তার ছেলে ও একদিন অনেক বড় হবে,,সে ভালো একটা চাকরি করবে,, তখন তাদের আর অভাব থাকবে না, মা তার ছেলেকে ভালো করে পড়াতে উনার বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া সম্পদটুকু বিক্রি করে দেন! তিনি সপ্ন দেখেন,,তার শিপন যখন বড় চাকরি পাবে তখন আর কোনো কষ্ট থাকবে না! শিপন উচ্চ মাধ্যমিকে ও ভালো রেজাল্ট করে সে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে রসায়ন নিয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে যায়! তার মা উনার সর্বস্ব দিয়ে ছেলেকে ঢাকা শহরে পাঠান!

হুম ছেলে এখন শহরের থাকে! যখন টাকার দরকার হয়,,পাশের বাড়ির আব্দুল চাচাকে ফোন দিয়ে বলে তার মাকে টাকা পাঠাতে বলতে! মা টাকা তার শেষ সম্বল টুকু তার ছেলেকে দিয়ে দেয়! শিপন এখন শহরের অনেক কিছুই চিনে,,টিউশনি করে সে এখন নিজের খরচ চালাতে পারে,,সেটা তার মা শুনে খুব খুশি!কারণ ছেলেকে আর কি দিবেন সে নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলেন! কারণ তার যে আর কিছুই নাই,সব শেষ! নিজের জন্য চিন্তা করে না মিনারা খাতুন,, কারণ কারো না কারো কাছে গিয়ে দু মুটো ভাতের জোগার করে নিবেন উনি! না হলে কারো টুকটাক কাজ করে পেট চালিয়ে নিবেন,,,

আর এর মাঝে ও তার দুই চোখে সপ্ন জেগে উঠে তার ছেলে চাকরি পেলে ছেলের সাথে শহরে চলে যাবে আর সেখানে তিনি ভালো শাড়ি পরবেন হাতে চুরি পরবেন,,কানে ঝুমকা লাগাবেন,,,কারণ মিনারা খাতুন দেখেছে,, আব্বাসের মা তার ছেলের চাকরি পাওয়ার পর কতো শখ ই না করে,,,সে তো দরিদ্রতার জন্য জীবনে কিছুই করতে পারে নাই!তাই সেটা তিনি তার ছেলের চাকরির পরে করবেন! শিপন অনার্স মাস্টার্স শেষ করে বিসিএস পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে অনেক বড় সরকারি অফিসে চাকরি পেয়ে যায়! আর এর ভেতর শিপনের এক বিরাট বড়লোক মেয়ের সাথে গড়ে উঠে সম্পর্ক! সে ভুলে যায় তার গরিব মা কে! ভুলে যায় অতিত! ওর চাকরি পাওয়ার সাথে সাথেই সে বিয়ে করে ফেলে মেয়েকে! আর এদিকে মিনারা খাতুন অনেকদিন পর খবর পেলো তার ছেলের সরকারি চাকরি হয়ছে! সেদিন ও মিনারা খাতুন খুব খুশি ছিলেন,,, তিনি খুব কষ্টের কয়টা টাকা দিয়ে গ্রামের পিচ্চি ছেলেমেয়েদের খিচুরি রান্না করে খাওয়ান!!

আর সবার কাছে গিয়ে গিয়ে তার ছেলের সরকারি চাকরি পেয়েছে সেটা বলেন! কিন্তু যখন কেউ মিনারা খাতুনকে জিজ্ঞাসা করে,,তাইলে আপনি এখানে এতো কষ্ট করে পড়ে আছেন কেন আপনার ছেলেকে নিয়ে যেতে বলুন তার সাথে! এসব শুনে মিনারা খাতুন স্তব্ধ হয়ে যান,,কারণ আব্দুল চাচার কাছে এই খবর টা শুনেছেন,,,ছেলে যে তার মাকে নিজে এত বড় সংবাদ টা দেয় নাই,, আর আজ অনেক দিন সে গ্রামে আসে ই না! মা ভাবে ছেলে কাজ নিয়ে খুব চাপে তাই হয়তো আসতে পারে না!

মিনারা খাতুন আব্দুলকে গিয়ে ধরে তার ছেলের কাছে নিয়ে যেতে! আর যাওয়ার মতো গাড়ির ভাড়াটাও নাই মায়ের কাছে! তাই আব্দুল কে ধরে তার থেকে খরচ দিয়ে নিয়ে যেতে! মিনারা খাতুন বলে আমার ছেলের কাছে গেলে দেখবে সে তোমার খরচ থেকে তোমাকে আরো বাড়িয়ে টাকা দিবে! এসব আকুতি মিনতি শুনে আব্দুল না গিয়ে পারলো না,,মিনারা খাতুন ছেলের সাথে দেখা করতে শহরে যাবেন,, সেই খুশিতে তিনি আত্বহারা,,পাশের বাড়ি থেকে ধার করে একটা লাল শাড়ি এনেছেন,, সুন্দর এক পাটি জুতা পরেছেন উঁচুমুড়ো!তিনি জানেন না শহরের মানুষরা কিভাবে থাকে,,কি পরে,,,কিন্তু খুব সুন্দর করে নিজেকে সাজিয়ে চলেছেন ছেলের সাথে শহরে দেখা করবেন বলে,,, তার ছেলে যে এখন মস্ত বড় চাকরি করে!! তার বুকে খুশির আহাজারি! আর সারাজীবন কষ্টে সার্থকতা!

আব্দুল চাচা নিজে ও শিপনের নতুন ঠিকানা জানে না,,, এর আগে উনি টাকা দিতে এসেছিলেন সেখানে একটা বন্ধুর থেকে পরিচয় নিয়ে তারা পৌঁছালেন সেই বাড়িতে,, যেটা শিপনের শশুর বাড়ি,,,বিরাট সে বাড়ি! মিনারা খাতুন সেই বাড়িতে গিয়ে ছেলেকে ডাকছেন,, খোকা তুই কই,,বাপজান কতো দিন দেখি না তকে,,,আয় বাবা আমার বুকে আয়! এমনি ভেতর থেকে কাজের মহিলা বের হয়ে বলল কে আপনি কাকে বলে ভেতরে প্রবেশ করেছেন? এমনি শিপন রেডি হয়ে রুম থেকে বের হয় অফিসের উদ্দেশ্যে,,ছেলে ক্ব দেখে খুশিতে যেন পাগল হয়ে যাবে মিনারা খাতুন,,, দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ছেলেকে,,যেন আকাশের চাঁদটা কে কাছে পেয়েছেন তিনি! কিন্তু একি,,শিপন তার মা কে ছাড়িয়ে ধমকের সুরে বললো কে এখানে তোমায় নিয়ে আসছে,? আর তোমার শরীরে ময়লা,,,আমার সাদা শার্ট নোংরা হয়ে যাবে!

মা কিছু বলতে পারলো না ছেড়ে দিলো ছেলেটাকে,,, কেদে ফেললো,, আর বলল বাবা আমি ভালো কাপড় পরে আসছি এইটাতে ময়লা নেই বাবা,,আর আমার ভুল হয়ে গেছে,, আমার মনে ছিলো না তুই এখন আর আমার সেই আ গের খোকা নাই,,,যে কিনা আমার ময়লা কাপড়ের নিচে চুপটি করে ঘুমিয়ে পরতো,,আর আমাকে সান্ত্বনা দিতো,,, আর বলতো মা সব ঠিক হয়ে যাবে,,, আল্লাহ তোমার সব কষ্ট একদিন দূর করে দিবে!!!,তুই তো এখন অনেক বড় সাহেব হয়ে গেছিস রে!!এখন কি আর মা কে মনে আছে তর?? এমনি ভেতর থেকে শিপনের বউ এসে জিজ্ঞাসা করলো,,কে উনি?? শিপন উত্তর দিলো উনি আমার গ্রামের বাড়ির সারভেন্ট ছিলেন,, মুর্খ মা এর মানে বুঝলেন না! শুধু শব্দটা মুখস্ত করলেন,,মিনারা খাতুন বুঝে গেছেন তিনি এতো বড় পরিবেশে থাকতে পারবেন না!

শিপনের স্ত্রী বলল যে উনাকে বলো আমাদের এখানে থাকতে আমাদের এতে অনেক ভালো হবে! মা চিনলেন না কে এই মেয়ে,,, ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন,,আর তার দু চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু পড়তে লাগলো,,বুঝতে পারলেন ছেলে তার বিয়ে ও করে ফেলেছে না জানিয়ে! কতো সপ্ন ছিলো মায়ের,,, তার ছেলের বিয়ে নিজের পছন্দে করাবেন,,সবাইকে দাওয়াত দিবেন,,,অনেক আনন্দ করবেন! কিন্তু আজ যেন সব কিছু তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে,,, শিপন আর কিছু না বলে চলে গেলেন অফিসে! এদিকে আব্দুল চাচা ও মিনারা খাতুন বসলেন,,সেখানে শিপনের স্ত্রী ও বসলো,,মিনারা খাতুন বললেন মা সারভেন্ট মানে কি?

বউ বলল কেন,, আপনি জানেন না,,,সারাবছর ওদের বাড়িতে যে কাজ করেছেন সেটা কি মনে নাই?? শিপন সেটাই তো বলল,,ওদের বাসায় যে কাজ করতেন,,মানে এর অর্থ চাকর! মিনারা খাতুন কিচ্ছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন,,তার বুকের মধ্যে একটা কঠিন ব্যাথা অনুভব করলেন,,উনার মনে হচ্ছে উনার বুকের পাজর গুলো ধুমরে মুছরে যাচ্ছে,,, তিনি আর সহ্য করতে পারছিলেন না! তার ছেলেকে নিয়ে দেখা তার এতো সপ্ন,,তার এতো ইচ্ছে,,, তার জমানো আকাঙ্ক্ষা,,, কতোই না সপ্ন দেখতেন একদিন সে ছেলের সাথে শহরে এসে একটা বড় বাড়িতে থাকবেন,,,আজ যে সবই আছে,,,শুধু নেই উনার ঠাই!

এসব ভাবতে ভাবতেই নিচে পড়ে গেলেন মিনারা খাতুন,,, শেষ হয়তো বলতে চেয়েছিলেন খোকা একবার মা বলে ডাক না আমায়!! হয়তো বলতে চেয়েছিলো খোকা তুই আজ অনেক বড় চাকরিজীবি,, আজ আমি সার্থক রে!! আমি কতোই না সপ্ন পুষে রেখেছিলাম এই দিনের জন্য! হয়তো সেটা ও বলতে চেয়েছিলেন,, বাবা তুই শিক্ষিত হয়ে মা কে ভুলে যাবি জানলে আমি কখনোই এসব সপ্ন দেখতাম না,, পড়ে থাকতাম সেই পরিত্যক্ত কুটিরেই!! আমার কতো আশা ছিলো ছেলে চাকরি করলে আমি ভালো মন্দ রান্না করবো,,

তুই না মায়ের হাতের বিরিয়ানি পছন্দ করতিস,,তখন তো অভাবের জন্য তেমন রান্না করতে পারি নি,, তাই তুই যখন রুজিরোজগার করবি তখন রান্না করে খাওয়াবো ভেবেছিলাম,,, হয়তো সেদিন তুই আমাকে বলবি মা তোমাকে কষ্ট করে এসব করতে হবে না,, তুমি তো সারাজীবন ই কষ্ট করে আসছো,, এইসব তোমার ছেলের বউ করবে,,আর তুমি রাজরানির মতো থাকবে! নাহহ সে কথা গুলো অস্ফুটে রয়ে গেলো,,, হাজার সপ্ন চাপা দিয়ে সেখানেই লুটিয়ে পরলো মিনারা খাতুনের নিতর দেহখানি!! তার শেষ নিশ্বাসটা ত্যাগ করার সময় ও হয়তো ছেলের মুখখানি দেখতে চেয়েছিলেন,,,কিন্তু পাষান ছেলে যে আজ অনেক বড় চাকরিজীবি!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত