আমি সে আর কয়েকটা ইঁদুর

আমি সে আর কয়েকটা ইঁদুর

লোড-শেডিং চলছে। ওড়না ফেলে রিল্যাক্সে বসে আছি। গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। হঠাৎ মেজাজটা বিগড়ে গেলো। কে যেন দরোজায় টোকা মারছে। কলিং বেল আছে। তবু টোকা মারা হচ্ছে। এই কাজ করার মত একজন পাবলিকই আছে এই বিল্ডিঙয়ে। এখন দরজা খুলতে যাওয়া মানে আবারও ওড়না শরীরে প্যাঁচাও। মরার যন্ত্রণা! দরজা খোলা হলো। যা ভেবেছিলাম তা-ই। মিঃ বিন দাঁড়িয়ে আছে। সে কামারের দোকানে থাকা হাপরের মত ভোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বলল, “তাসনু, তোমাদের ঘরে কি উন্নতমানের বিষ আছে?

ইন্দুর মারা বিষ?” মাথায় আগুণ ধরে গেলো আমার। ব্যাচেলর পুলাপাইন শুনছি পাশের বাসায় চিনি-চাপাতা চাইতে গিয়ে ভাব জমায়। আর ইনি আসছে ইন্দুর মারা বিষ চাইতে। মেজাজ যথা সম্ভব চেক দিয়ে বললাম, “মিঃ বিন ভাই! ইন্দুরেরটা নাই। মানুষ মারার বিষ আছে। লাগলে আওয়াজ দিয়েন।” মিঃ বিন আমার দিকে কিছুক্ষণ পিটপিটানি চাহনি দিয়ে জ্ঞানী-গুণীদের বানী শোনালো, “মানুষের নাম নিয়া মস্করা ঠিক না। নামের মধ্যে মানুষের প্রাথমিক স্বীকৃতি লুকায়ে থাকে।” “হুম, প্রাথমিক স্বীকৃতি বুঝলাম। এখন মাধ্যমিকটা বলেন। পরেরদিন উচ্চমাধ্যমিক শিখাবেন। ঠিক কইছি না মিঃ বিন ভাই?”

“তুমি ছোট মানুষ। এইসব বুঝার বয়স তোমার হয় নাই। ইন্দুরের বিষ দিয়া আর কাম নাই, আমি যাই।”
মিঃ বিন কিছু একটা বিড়বিড় করতে করতে বিদায় নিলো। ওহ ভাল কথা, এই ফাঁকে মিঃ বিনের ব্যাপারে কিছু কনফিডেনসিয়াল তথ্য দিয়ে ফেলি কী বলেন? উনার আসল নাম বেশ সেকেলে টাইপের। মবিনুল হোসেন মবিন। আমি ম-টাকে ছেঁটে দিয়েছি। মবিন-এর ম নাই। এখন আছে শুধু বিন। শুধু বিন তো আর ডাকা যায় না। তাই নামের আগে মিঃ জুড়ে দিলাম। এখন হইছে মিঃ বিন। সুন্দর না নামটা? প্লিজ, এজন্য কেউ আমাকে মনে মনে বকা দিবেন না। তার আগে আসুন তার নামের কেরামতি দেখে আসি। যেমন ধরুন, সেদিনের ঘটনা। আমরা মশা মারতে কামান দাগানোর কথা শুনেছি। কিন্তু ইঁদুর মারতে দা-বটি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া কি শুনেছেন কখনও? শোনেননি তো! তবে শক্ত হয়ে বসুন। বলছি!

ভর দুপুরে ছাঁদে যাচ্ছিলাম কাপড় নেড়ে দিতে। মবিন ভাইয়ের ঘরের দরোজা হাট করে খুলে রাখা। উঁকি মারতেই বুকটা কেঁপে উঠলো। মবিন ভাই প্রায় নগ্ন বলা চলে। এত বড় শরীরে একখানা মাত্র গামছা জড়ানো। হাতে ধারালো বিরাট বটি। বটি নিয়ে সে হৈহৈ রব তুলে এঘর-ওঘর দৌড়াচ্ছে। কারণ ইঁদুর মারার জন্য তাৎক্ষণিক ভাবে হাতের কাছে বটি ছাড়া আর কিছু ছিল না। অদ্ভুত দৃশ্য। উনার ঘরে নাকি ইঁদুরের উপদ্রব বেড়ে গেছে। ইঁদুর সংখ্যায় মাত্র দুইটা। ইতিমধ্যে বাজার থেকে র‍্যাটম বিষ এনে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কাজ হয়নি। এরা সবকিছু খায়, র‍্যাটম খায় না। শুকে চলে যায়। মহাজ্ঞানী ইঁদুর! মহাগাধার ফ্লাটে মহাজ্ঞানী ইঁদুর কোত্থেকে আসলো আমার মাথায় ধরে না !
এবার গাধাটার পরিচয় দেয়া যাক। আমাদের পুরো বাড়িটা তিনতলা। উপরে একটা ছোট্ট চিলেকোঠার মত। মবিন ভাইয়ের বড় বোনের নাম মলি আপু।

তিনি তিন তলার ডান পাশের ফ্লাট টা কিনে নিয়েছেন বছর সাতেক আগে। স্বামী নিয়ে থাকেন পোল্যান্ডের সস্নোউইচ-এ। মবিন ভাইয়ের ভবিষ্যতের এখনও কোন কূলকিনারা হয়নি। চাকরী একটা করে ঠিকই, তাও আবার ফুল টাইম না। চাকরী-বাকরি না কি তার ভাল লাগে না। কয়েকদিন উঠে পড়ে লেগেছিল ভ্রাম্যমাণ চটপটির দোকান দেবে সে। তিনটা ভ্যান কিনে তিনজনকে দেয়া হবে। তারপর আর খবর নাই। লোক মুখে শুনেছি, দুইজনকে না কি ভ্যান কিনে দেয়া হয়েছিলো। তারা ভ্যান নিয়ে গায়েব হয়ে গেছে। মবিন সাহেব আপাতত বোনের ফ্লাটে আশ্রিত হয়ে আছে। উনার বাবা রিটায়ার করার পর উনার মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ীতে থাকেন। মাঝেমধ্যে আসেন। পানসে মুখে ঘোরেন-ফিরেন আবার চলে যান। ওরে বাবা! অনেক কথা বলে ফেললাম। আসল কথায় ফিরে যাই। এবার আসুন, তার প্রেমময় উপাখ্যানের কথা বলি।

এই পাবলিক কিন্তু প্রেমও করতো! ইদানীং কীসের না কি ঝামেলা চলছে। সম্পর্কটা আরেক আপুর সাথে। আরেক আপু মানে অরিন আপুর সাথে। যেমন তেমন সম্পর্ক না – উথালপাথাল সম্পর্ক। দুজনে রিকশায় বসলে সুপার-গ্লুর মত আঁটকে থাকে। আমাকে দেখে লজ্জা পাওয়া দূরের কথা, একটু সরেও বসে না। উলটো আমারই লজ্জা লাগে। আমি এই গা জ্বলে যাওয়া দৃশ্য দিনের পর দিন হজম করে যাই। অনেকটা জেনে শুনে বিষ করেছি পান টাইপের। সব জেনে শুনেও সিনেমার সাইড নায়িকার রোল আমার। নীরব ভালববাসা যাকে বলে। এই রে! নিজের কথাও বলে ফেললাম। থাক, বললে বলছি। হিহিহি। এই বিবেচনায় আমি নিজেও গাধা। না ভুল বলছি। আমি গাধা না – গাধী। পঞ্চান্ন কেজি ওজনের মস্ত বড় গাধী!

আমার এই চলমান গাধামি নিয়ে খুব যে খারাপ আছি তা বলা যায় না। কারণ ভালোবাসার মানুষটা আমার চোখের সামনেই থাকে। ইচ্ছে হলেই দেখতে পারি। শুধু ছুঁতে পারি না। মাঝেমধ্যে কল্পনাতে ছুঁই। ছোঁয়ার কাজটা কল্পনাতে হলেও কোন এক আজগুবি কারণে আমার নাক-কান দিয়ে গরম ভাপ বের হতে শুরু করে। আচ্ছা, সব নারী-ই কি কাঙ্ক্ষিত পুরুষের প্রথম স্পর্শে নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে যায়? ভীষণ জানতে ইচ্ছা করে! হুট-হাট জানার সুযোগ মিলেও যায়। কিন্তু ভাগ্য ফেরে না। কলেজ থেকে ফিরেছি। ড্রেস চেঞ্জ না করেই খাটের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছি। আমার অবস্থা তখন, ওগো সোনার পালঙ্ক, আজ তুমি আমার, আমি তোমার! শরীরটা ঘুমে অবশ হয়ে আসছিলো। এমন সময় ভাইব্রেশানে রাখা মোবাইল ভ্রট-ভ্রট শব্দ শুরু করলো। আমার অবশ শরীর সবস হয়ে গেলো। ফোন কানের কাছে ধরতেই ওপাশে শুরু হলো মরা কান্না। ক্রন্দসী আমাদের তিন তলার মহা গাধা মবিন ভাইয়ের বড় বোন।

“বইন রে! আমার ভাইটার কী হইছে কিছু জানো?” – আমি মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রেখে উত্তর দিলাম,
“উঁহু জানি না। কেন, কিছু হওয়ার কথা না কি?”
“এইটা কেমন কথা? ওর আবার কী হওয়ার কথা থাকবে?”
“তাইলে সমস্যা কী?”
“সে গত তিনদিন কারও ফোন ধরে না।

আজ দুপুরে আমারে বলল- আপু অপরাধ থাকলে মাফ দিও। হঠাৎ ঘুমের মধ্যে স্ট্রোক-মেস্ট্রোক করতে পারি। আর কিছু বলে না। তুমি একটু খেয়াল রাখো। আমার ফ্লাইট বুকিং কমপ্লিট। প্লিজ বইন! এক পাতা ঘুমের ওষুধের ছবিও পাঠাইছে মেসেঞ্জারে। এই সবের মানে কী?” “যথেষ্ট মানে আছে। উনাকে পশ্চাতে চিকণ কঞ্চী থেরাপি দিতে হবে।”

“সেইটা কী জিনিষ?”
“এইটা অন্য জিনিষ। টেনশান নিয়েন না আপু। আমি দেখতেছি।”

ফোনে, আমি দেখতেছি বললেও, কী যে দেখবো মাথায় আসলো না। গতকাল সন্ধ্যায় কোচিং থেকে ফেরার পথে এই আজব চিড়িয়াকে লিটনের চা-এর দোকানে দেখেছি। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে হৈ হুল্লোড় করছে। সে উপস্থিত জনতার সামনে পাঁচশো টাকার বাজী ধরেছে। পাঁচ সেকেন্ডে এক কাপ গরম চা খাওয়ার বাজী। ঘটনার মিনিট বিশেক পর আমাদের বাসার ফ্রিজ থেকে তিন চারটা বরফ টুকরা নিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় আলুবুলু ভাষায় বলেছে, লিটন একটা বিরাট হারামজাদা। এত কইরা কইলাম চা-এর পানি কুসুম গরম রাখিস। আমার কপাল খারাপ এই গাধাটারেই আমি ভালোবাসি। তাও আবার মূল নায়িকা না। সাইড নায়িকা! হিহিহি। ব্যাকরণ ছাড়া ভালোবাসা হলে যা হয় আর কী! উঁহু, ব্যাকরণ ছাড়া না। কারণ অবশ্য কিছু আছে। এতে আমার সচেতন মন দায়ী না। দায়ী আমার অবচেতনে আগ-পিছ না ভাবা বেহায়া মন। এক পিচ এক্সাম্পল দিয়েই ফেলি।

বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার সময়ের কথা। মহাসমারোহে ঘরের সবাই মিলে খেলা উপভোগ করি। পরিবারের সবাই বলতে আব্বু-আম্মু, আমি আর বড় আপু। বড় আপু সন্তান সম্ভবা। মাস দুয়েক হলো আমাদের বাসায়। খেলা চলাকালীন সময়ে আমাদের সাথে মবিন ভাইও থাকে। তার ঘরের টিভি আকারে ছোট। আব্বু-ই তাকে রোজ দাওয়াত করে নিয়ে আসে। সে সোফার এক কোণায় বসে হা করে খেলা দেখে। অতি অদ্ভুত কারণে সে আব্বুর অতিশয় পছন্দের মানুষ। তাঁর নিজের ছেলে নেই। এটাও একটা কারণ হতে পারে। যা হোক, হঠাৎ একদিন আব্বা হুজুর ঘোষণা দিয়ে বসলেন, খেলা দেখা বন্ধ। আসল টীম সব বাদ পড়েছে। মরিচ, পিরিচ দের খেলা দেখার জন্য রাত জাগার প্রশ্নই ওঠে না।

মবিন ভাই বাবাকে চেপে ধরলো, চাচাজান মরিচ, পিরিচ না। নামটা হবে মডরিচ, পেরেসিচ! এরা খেলে ভাল! দয়া করেন। টিভি ছাড়েন।” “নো মানে নো। নো খেলা দেখা-দেখি!” মবিন ভাই মন খারাপ করে চলে গেলো। ফাইনাল ম্যাচের দিন সন্ধ্যায় মবিন ভাইকে ডেকে বললাম, দরজার সিটকিনি লাগায়েন না মিঃ বিন ভাই। রাইতে আমি আসব। স্ক্রিন ছোট হলেও সমস্যা নাই। আপনি আর আমি। ফাঁকা ঘর। খেলা ফাইনাল, ব্যাপার আছে নাহ! হিহিহি! মবিন ভাই আনন্দে খাবি খেলো মনে হয়। বলল, ঠিকই কইছ। একা খেলা দেইখা মজা নাই। আমি বড় আপুকে জানিয়ে চুপি-চুপি গভীর রাতে মিঃ বিনের ঘরে। আপু মেসেজ পাঠাল, তাসনু আমি পাশেই আছি। মুহাহাহাহা!

আপু পাশে থেকে লাভ হলো না। দুই দলের ন্যাশনাল এনথেম হচ্ছে। এসেছিলাম এক্সপেরিমেন্ট করতে। নিজে বোকা বনে গেলাম। উৎসব করতে করতে বাসার সবাই এসে উপস্থিত মিঃ বিনের ঘরে। মবিন ভাই না কি তাঁদেরকেও ছোট পর্দার দাওয়াত দিয়ে রেখেছিলো আমার সাথে কথা হওয়ার পর। এমন উৎসবে মবিন ভাই আনন্দ-যজ্ঞে বাঁধা পড়লেও আমি বন্দি পড়ে গেলাম অপার্থিব কোন বিশ্বস্ত মোহে! দিন এসেছে রাত চলে গেছে। এমন হাজারও মোহে আবিষ্ট করেছে এই গাধা শ্রেণীর সৎ মানসিকতার লোকটা। এ মোহ থেকে আমার মুক্তি নেই। আজন্মকাল নারী চায় একটা বিশ্বস্ত চওড়া বুক। সেই বুক পেয়েও কে হারাতে চায়, আপনারাই বলুন! আফসোস, সাইড নায়িকার কপালে এই বুক জোটে না। দাঁড়ান, এক চোট হেসে নেই। কষ্টকে হাসি দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতাকে ছোট করে দেখার কিছু নেই। হিহিহি।

যা হোক, বলছিলাম মলি আপুর ফোন দেয়ার কথা। ফোন পেয়ে আমার অবাক হওয়া ছাড়া গতি থাকে না। আধ-দামড়া হয়ে দিব্যি গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরছে যে মানুষটা। আড্ডা মারছে। দুদিন পরপর বিচিত্র সব বাজী ধরে হারছে। এই চিজের মাথায় আবার স্ট্রোক করার চিন্তা আসে কীভাবে কে জানে! ঘোর লাগা সন্ধ্যায় পা টিপে-টিপে মবিন ভাইয়ের ঘরের দরোজায় এসে দাঁড়ালাম। আজও দরোজা খোলা। ভেতরে অন্ধকার। সম্ভবত লাইট অফ করে রাখা হয়েছে। আমাকে দেখতে পেয়ে মবিন ভাই ভেতর থেকে সাড়া দিলো, “কাউরে খুঁজো?” “হুম, বাঁইচা আছেন না মরছেন দেখতে আসছি। ঘুমের ওষুধ নিয়া ঘুরতাছেন শুনলাম। তা মরার দিন-তারিখ কি ঠিক করছেন?”

“ঐগুলা ফ্রেঞ্জিট, ব্রেইন রিল্যাক্সের ওষুধ। মরতে যাব কোন দুঃখে?” মবিন ভাই উঠে লাইট জ্বালিয়ে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসলো। আমি জানতে চাইলাম,

“আপনার জন্য অনেকগুলো দুর্ঘটনা একসাথে আসলো, তাই না?”
“হুম।”
“ভ্যান দুইটা কি পাওয়া গেছে?”

মবিন ভাই হ্যাঁ-না কিছু বলল না। অরিন আপুর সাথে আজ কলেজে যাওয়ার সময় দেখা হয়েছিলো আমার। সে মেয়েলী টাইপের বেশ নাদুসনুদুস এক যুবককে নিয়ে মহা আনন্দে শপিং করতে বেরিয়েছে। আমাকে দেখে গলা নামিয়ে জানতে চাইলো, ইন্দুর-বান্দর টাইপের মানুষ থেকে দূরে থাইকো। জীবনে সুখি হবা। সামাজিক স্ট্যাটাস অন্য জিনিষ!

ভেবেছিলাম সবাইকে শুনিয়ে চিল্লায়ে বলি, তোমাদের মত টিপিক্যাল মানুষদের জন্যই একটা পবিত্র সম্পর্ক থেকে সবার বিশ্বাস জিনিষটা উঠে যায়। এতই যদি স্ট্যাটাস বোঝো, স্ট্যাটাস বিহীন মানুষ নিয়া টানাটানির কী দরকার ছিল। তুমি তোমার তেলকুমার নিয়েই থাকো। যা ভাবলাম তাঁর কিছুই বলতে পারলাম না। আমাকে সবাই যথেষ্ট ডেয়ারিং মেয়ে বলেই জানে। তবু কিছু কিছু ডেয়ার-গেম আমি অন্য ভাবে খেলি। ভাবছি মবিন ভাইকে এই মুহূর্তে বলি কথাটা। সে আমার দিকে নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে। আমি একটু মন খারাপের ভঙ্গীতে জিজ্ঞেস করলাম, “অরিন আপুর বিয়েটা কি তাহলে হয়েই গেলো?” “হাহাহা স্বামী বিসিএস ক্যাডার। বত্রিশতম। আর আমি হইলাম দেউলিয়া মবিন। শুরুতেই যার ভ্যান নিয়া গায়েব হয়ে যায় মানুষ! অরিনের কোন দোষ নাই। পাত্র ভাল, এমন সুযোগ হাত ছাড়া করা ঠিক না।“ “আপনার কষ্ট হয় না?”

মবিন ভাই ঢোক গিল্লেন। হেসে বললেন, “আরে নাহ! নিজের ভালোটা বাইছা নেয়ার অধিকার সবার আছে। তোমাকে আরেকটা জিনিষ দেখাই তাসনু, ওয়েট।” মবিন ভাই কোনা খাওয়া র‍্যাটমের একটা প্যাকেট এনে সামনে রাখলো। তার ঘরের ইঁদুর অবশেষে মারা পড়ছে। এটাই না কি তার মন খারাপের কারণ। বিষয়টা সে মেনে নিতে পারছে না। অরিন আপু বিহীন জীবনে ইঁদুরের সাথে রোজ গোল্লাছুট খেলে তার সময়টা ভালোই কাটতো। নির্মল কিছু বিনোদন পাওয়া যেত। এজন্য মিশন বাদ দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু আফসোস! ছড়ানো বিষ না খেয়ে তারা র‍্যাটমের প্যাকেট কেটে খেয়ে মরেছে। জীবনে এই প্রথম মনে হলো, এই গাধার কপালে অরিন আপু কেন, কোন আপুই টিকবে না। এরে তিন বেলা ইন্দুরের বিষ খাওয়াইয়া মারা দরকার!

মবিন ভাইয়ের ঘর থেকে বের হলাম। সে পেছনে-পেছনে সিঁড়ি পর্যন্ত আসলো। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, “তখন তুমারে মিথ্যা বলছি, তাসনু। কষ্ট লাগে, ভীষণ কষ্ট! চাকরীটা হাঁফ টাইম থেইকা ফুল টাইমে নিছি। কত আশা। সংসার করবো। আদরে-শাসনে আমারও একজন মানুষ থাকবে। কিন্তু কী থেইকা কী হয়া গেলো, বুঝে আসে না!”
খাইছে আমারে! আমি এ কী শুনছি! মিঃ বিন তো দেখি ভালোই কথা জানে! কেন জানি না এই লোকের সাথে মুখ গোমড়া করে থাকাটা মোটেই যায় না। আমি মুখে ফিকে হাসি এনে বললাম, “বিয়ে করে ফেলেন।” “তৈরি বউ কই পামু। হাহাহা, তুমি করবা আমারে?” “আমার ঠেকায় পড়ছে জোকার বিয়া করার।” ক্যামেরা থাকলে মিঃ বিনের চেহারার একটা ছবি তুলে রাখতাম। আমার দৌড়ানি খেয়ে তার এক্সপ্রেশানটা যা হয়েছিলো। হিহিহি।

ঘোমটা ফেলে ক্যাজুয়ালি বসে আছি। আব্বু পাশ ঘেঁষে বসলো। মন খারাপ ভাব নিয়ে বলল, “গাধা ডা কই? আইজ রাইতেও কি কোন জায়গায় বাজীর খেলা খেলতাছে না কি?” আব্বুর কথায় আমার চোখ ভরে জল চলে আসলো। আব্বু বুঝতে পেরে হেসে ফেলে বললেন, “আইচ্ছা আর গাধা বলবো না। তবে কাজটা ঠিক করলি না। তোদের আমি কোনদিন উহ শব্দ করতে দেই নাই। কিন্তু আবেগ দিয়া তো জীবন চলে না। জীবন বড় কঠিন জায়গা মা।” আব্বুর হাত কাঁপছে। কেঁদে-টেদে ফেলবে কি না বোঝা যাচ্ছে না। একটু পরপর হাসের মত গলা টান দিচ্ছে। আমি তাঁর কম্পিত হাত ধরে বললাম, “খবরদার কান্দাকাটি বন্ধ!” “কান্দুম ক্যান? কোন দুঃখে!” – আব্বু কথা শেষ করতে পারলো না। বাসা ভর্তি মেহমান। মলি আপু তাঁর ছানাপোনা নিয়ে পোল্যান্ড থেকে চলে এসেছে। সবার সামনেই আব্বুর হেঁচকি উঠে গেলো!

আমি আব্বুর বুকে মাথা রাখলাম। বললাম, “আগামী মাসের পয়লা তারিখ থেকে ঐ চিলেকোঠার ঘরে থাকব আমরা। আমার মোটেও অসুবিধা হবে না আব্বু। তোমার কি কিছু ছিল একসময়? কই, আম্মু তো তোমার হাত কখনও ছাড়ার চিন্তা করেনি। কেবল শান-শওকতের নিক্তি মাপা রোবটের জীবন আমি চাইনি আব্বু। আমার জন্য শুধু দোয়া দিও। ও মানুষটা সহজ-সরল, কিন্তু খারাপ না।” ইয়ে মানে আমাকে কেউ আবার ইঁচড়ে পাকা জ্ঞানী টাইপের কিছু ভেবে বসবেন না। বাবা-মা’র জাতটাই তো এমন হয়, তাই না? প্রিয় কন্যাকে স্বর্গে রেখে এলেও আয়োজন করে ভাবতে বসেন, কন্যার সব আবদার কি যথাযথ পূরণ হচ্ছে? আমরা তো চোখে দেখতাছি না!

ওহ হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি। ওর স্বল্প বেতনের চাকরীর পাশাপাশি দুজন মিলে একটা স্ন্যাক্সের দোকান করেছি। সেখানে তাজা ফলের জুস পাওয়া যায়। ও ছুটির দিনে মফস্বল ঘুরে ঘুরে ফর্মালিন মুক্ত ফল কিনে আনে। দোকানের নাম দিয়েছি “বরফ কুঁচি”। সুন্দর হয়েছে না নামটা? কারেক্ট রাত একটায় আমার মহা গাধা স্বামী রুমে উঁকি মারলো। দাঁত বের করে বলল, “তাসনু, তোমার কি কিছু লাগবে। লাগলে আওয়াজ দিও, আমি ছাদে আছি। বন্ধুরা মিলা একটা খেলায় বাজী ধরছি। আমাদের প্রথম সন্তান পুলা না কি মাইয়া, সেই বাজী!”

আমি কোমরে শাড়ি গুঁজে নিলাম। ঠাণ্ডা মাথায় উঠে গিয়ে কলার চেপে ধরে সুড়সুড় করে গাধাকে রুমে টেনে এনে বললাম, “জনাব বিন সাহেব, পুলা-মাইয়া ছাদের বন্ধুগো সাথে বাজীতে হয় না। এই বাজী অন্য জায়গায় ধরতে হয়। পা নাড়াইছো কি সোজা ঠ্যাং ভাইঙ্গা খাটে শুয়ায়া রাখমু! কথা ক্লিয়ার?” প্রাণনাথ কথা না বাড়িয়ে খাটে পা ঝুলিয়ে বসলো। চোখ বড় বড় করে বলল, আমাদের মিশন শুরু করার আগে তুমারে একটা জিনিষ দেখানোর আছে, তাসনু। ওয়েট! আমি আগ্রহ নিয়ে বসে আছি। দু’মিনিট বাদে উনি ফিরে আসলেন। হাতে একটা ভাঙ্গাচোরা কার্টন। কার্টনের মধ্যে ল্যাদা টাইপের চারটা ইঁদুরের বাচ্চা। মিঃ বিন বাচ্চাগুলির দিকে মায়া ভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে আর বলছে, আমি ভুল কইরা তোদের বাবা-মারে মারছি, কিন্তু তোদের মারব না। তোরা সবাই বড় হবি। বড় হয়া সব কিছু কাইটা শেষ করবি। আমি কিচ্ছু বলবো না। হাহাহা…তাসনু, তুমি কি জানো এরা কী খায়?

একবার মনে হলো, ইঁদুরের বাচ্চাগুলোকে ওর মুখে ভরে দেই। পারলাম না। অনিষ্টকর একটা ইতর প্রাণীর জন্যও যে মানুষটা এতটা মমতা পুষে রাখে, তাকে আঘাত করার ক্ষমতা ঈশ্বর আমাকে দেননি। আমার স্বামী মিটমিটিয়ে হাসছে। আমি ওর হাসি-মুখ অবাক হয়ে দেখছি। আমার গভীর থেকে কে যেন ফিসফিসিয়ে বলছে, ধন্যবাদ অরিন আপু! আমার গাধাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেবার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ! আমি ঠিকই সুখি হবো। তুমি দেখে নিও। পৃথিবীর লক্ষ-কোটি মধ্যবিত্তের স্ত্রীদের একজন হয়ে এ আমার চ্যালেঞ্জ!

আমি আলগোছে কার্টনটা এক পাশে সরিয়ে রাখলাম। ও আমার দু কাঁধে হাত রেখে কপালে নাক ঘষে দিলো। ওকে ছুঁয়ে দেখার প্রাণান্ত চেষ্টায় মাথা ঝুঁকিয়ে আমি ওর পা স্পর্শ করলাম। আমার প্রথম স্পর্শ! কেন জানি না চোখ ভরে এত মেঘের আনাগোনা! মন চায় এই মেঘকে জল বানিয়ে আমি আমার পরম আরাধ্যের পা-যুগল আজ ধুয়ে দেই!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত