বউ এর হাতের থাপ্পর

বউ এর হাতের থাপ্পর

স্বামী হিসেবে আমি একটু লুতুপুতু টাইপের। আর তাই বউ এর মুখের উপরে তেমন কিছু বলা হয় না। বিয়ে করেছি প্রায় দুই বছর হতে চলোও। নাহ প্রেমের বিয়ে না। বিশাল ছ্যাকা খাওয়ায় নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে বাপ-মা এ কথায় জোর করেই বিয়ে করিয়ে দিলো।

বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বউ এর সাথে সম্পর্কটা বেশ গভীর হলো। ভেতর থেকে কেমন জানি একটা টান অনুভব করি। বাসর রাতেই বউ এর প্রথম কথা ছিলো বিয়ের আগে যা করেছেন তা নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই। এখন থেকে আমরা বিবাহিত। সতরাং ভবিষ্যৎ এ যা করবেন ভেবে চিন্তা করবেন। এমন কোন কাজ করবে না যাতে আমার কাছে আপনার কৈফিয়ত দিতে না হয়। আমিও বউ এর সেই মহান বাণী মেনে চলতাম। বিয়ের পর থেকে অন্য কোন মেয়ের সাথে কথা বলাতো দূরের কথা একবার তাকানোর পর আর দ্বিতীয় বার তাকাইনি।

সারাদিন গরু খাটনি খাটার পর রাতে বাসায় ফিরে বউ এর সাথে তেমন কথা বলা হয় না। ছুঁটির দিনে টুকটাক যা একটু কথা হয়। এতে অবশ্য বউ এর কোন অভিযোগ নাই। বউ আমার সব দিক থেকেই ভালও, শুধু চোখ এর দিকে তাকালেই ঘন ঘন বাথরুমের বেগ পায় এই আর কি। বউ এর কোন খারাপ দিক থাকলেও তা জনসম্মুখে বলার মত স্বামী আমি নই।

বউ আজ তারাতারি ঘুমিয়ে গেছে। তাই মশারি আমাকেই টানাতে হবে। মশারিটাও বেশ পুরোন। কয়েকটা জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই দেখি বউ সুঁই সুতা দিয়ে সেলাই করে। প্রায় রাতেই আমরা দু’জন মশার খাদ্য হই। মাঝ রাতে ঘুম থেকে উঠে মশা মারতে মারতে ভোর হয়ে যায়।

ক্লান্ত শরীর বিছানায় মেলে দিতেই ঘুমের সাগরে ডুবে গেলাম। ঘুমের মাঝে অনুভব করছি আমি যেন কোথায় বসে আছি। চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম এটা একটা রেইল ইস্টেশন, বেশ পুরোনও। ভোরের আলো কিছুটা ফুঁটতে শুরু করেছে। খুব ভোর দেখেই হয়ত ইস্টেশনে কোন মানুষ নেই। হঠাৎ কে যেন রেল লাইন ধরে হেঁটে যাচ্ছে। বেশ দূরে থাকায় বুঝে উঠতে পারছি না মানুষটা পুরুষ না মহিলা। আমি ইস্টেশনের শেষ ব্রেন্চ এ বসা। পাশ কাটিয়ে হেঁটে যেতেই আমার মুখ হা হয়ে গেলো। নব বধুর সাঁজে এক সুন্দরী মেয়ে রেল লাইনের সরল পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টি তার ঠিক সোজা সামনের দিকে। এতো সুন্দর একটা মেয়ের মুখে হাসি নেই! এ কেমন কথা। সুন্দর মেয়েরা হাসবে। তাদের হাসি হবে তাদের চেহারার থেকেও সুন্দর। আর তা ছাড়া এই ভোর বেলা নব বধু রেইল ইস্টেশনে কেনো! তার তো থাকার কথা বাসর ঘরে! আবার দেখছি কিছুখন পর পর চোখও মুছতেছে।

নাহ! এই রহস্যের সমাধান করতে হবে। আমি আর বসে না থেকে মেয়েটার পিছু নিলাম। রেল লাইনে বিছানো পাথর এর উপর দিয়ে হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। অথচ মেয়েটা দিবি হেঁটে যাচ্ছে। আমার আর মেয়েটার দূরত্ব দশ থেকে পনেরো হাত। একবার ভাবছি ডাক দেই, সাহস হয়ে উঠছে না। আরেকটু হাঁটি, দেখি কোথায় যায়।

সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। আমি হাঁটছি, মেয়েটাও হাঁটছে। কোন কথা নয়। এ যেনো অনন্তপুরির রাস্তায় ভোরের শীতল বাতাসে গন্তব্যহীন আমরা। আমি যেন আর হাঁটার শক্তি পাচ্ছি না। দু’পা অবস হয়ে আসছে। অথচ মেয়েটি অবিরাম হেঁটেই চলেছে, একটা বারের জন্যও পেছনে তাকায়নি। পানি পিপাসায় আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। নাহ! আর ডাক না দিয়ে উপায় নাই। এই যে শুনছেন! এই যে আপনাকে ডাকছি আমি। একটু শুনুন! কোন সাড়া শব্দ নেই। তবে কি ভূতের পিছু নিয়েছি আজ? না, তা কি করে হয়! ভূত কি দেখতে এতো সুন্দর হয় নাকি! ভূতের হবে ইয়া বড় বড় দাঁত। হাতে থাকবে লম্বা লম্বা নখ। চেহারা হবে খুব বিশ্রী যাতে দেখলেই ভয় হয়। এই মেয়েটা অসম্ভব সুন্দরী। সুন্দরীরা কখনও ভূত পেত্নী হয় না।

আমি আরেকটু কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করলাম। একটু একটু ভয়ও করছে। বুকের বাপ পাশটায় হাত দিতেই বুঝতে পারলাম হার্টবিট অনেক বেরে গেছে। নিঃশ্বাসও বেশ ঘন হয়ে গেছে। আমার আর মেয়েটার মধ্যে এখন দূরত্ব পাঁচ থেকে ছয় হাত। আমি আবার ডাক দিলাম এই যে! একটু থামুন। আপনাকে সেই কখন থেকে ডাকছি। প্লিজ একটু থামুন।

অবশেষে মেয়েটা থেমে গিয়ে চুপকরে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি চোখের পাতা ফেলছি না। বুকের ভিতরের হার্টবিটের আওয়াজটা কান পর্যন্ত চলে এসেছে। পুরো শরীর আমার ঘেমে ভিজে গেছে একাকার। নব বধু আসতে আসতে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এই প্রথম আমরা মুখোমুখি। কি অপরূপ সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি! এ যেন স্রষ্টার নিজের হাতের তৈরি। তার সৌন্দর্যের বর্ননা দিতে গেলে আমার কয়েক যুগ লেগে যাবে। জীবনে এই প্রথম এমন কোন সুন্দরী মেয়ের দেখা পেলাম। কে যেন ভুল করে তাকে স্বর্গ থেকে পৃথিবী নামক নরকে রেখে গেছে। স্বর্গের রাণী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

হঠাৎ চোখে চোখ পরতেই আমার ধ্যান কেটে গেলো। ওমনি কানে ভেসে এলো ট্রেন এর হুইসেল এর আওয়াজ। আমরা দাঁড়িয়ে আছি রেল লাইনের ঠিক মাঝখানে। মেয়েটার পেছন দিয়ে সাইসাই করে ছুঁটে আসছে দূর পাল্লার নাম না জানা এক ট্রেন। একের পর এক হুইসেল এর আওয়াজ কানের পর্দায় চির ধরিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটা এখনও আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি বুঝে উঠতে পারছিনা আমার কি করা উচিত। তবে কি স্বর্গের রাণীর আজ মৃত্যু হবে। আর আমি ইতিহাসের পাতায় সাক্ষী হয়ে থাকবো? নাহ, এ হতে পারে না। আমাকে অবশ্যই তাকে বাঁচাতে হবে। আমি আরো সামনে এগিয়ে গেলাম। আমাদের দূরত্ব মাএ এক হাত। মনে হচ্ছে বুকের ভিতর থেকে হৃদপিন্ডটা বেরিয়ে আসবে। আমার চোখ দু’টো লাল হয়ে গেছে, কান দিয়ে ধোঁয়া বেরুছে। আমি ঢোক গেলার চেষ্টা করছি। এ দিকে হুইসেলের আওয়াজ আরো ঘন হচ্ছে। একের পর এক হুইসেল বেঁজে যাচ্ছে। সরে পরুন! আপনার পেছনে ট্রেন! এই যে প্লিজ তারাতারি সরুন, পেছনে ট্রেন।

একি কান্ড! নব বধু এক চুল পরিমান নরছে না। আমার দিকে সেই যে তাকিয়ে আছে তো আছেই। আর একটু সময় বাকি আছে। এখন যদি না সরে পড়ি তবে দ’জনেই ট্রেনের নিচে চাপা পরবো। আমি আসতে আসতে আমার হাত দিয়ে তার হাত ধরার চেষ্টা করছি। হায় আমি করছি কি! স্বর্গ পরীর হাত ধরার চেষ্টা করছি! পাপ হবে না তো? তা না হয় একটু ধরলাম, জীবনে কখনও পরী দেখিনি। আজ যদি কোন পরীর হাত ধরি এর চেয়ে প্রাপ্তির আর কি আছে জীবনে! আমি স্বর্গের রাণীর জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করছি। পৃথিবীতে এমন কাজ এর আগে কেউ আর করেনি। পুরস্কার সরুপ অবশ্যই স্বর্গের টিকিট পেয়ে যাবো এতে কোন সন্ধেহ নাই।

আমার হাতটা প্রায় তার হাত ছুঁইছুঁই। প্রচন্ড শক্তি প্রয়োগ করায় আমার হাত থরথর করে কাপছে। নিঃশ্বাস নিতে গেলেই বুকের বাপ পাশে চিনচিন করে ব্যথা অনুভব করছি। আমি প্রায় ধরেই ফেলেছি তার হাত, আর একটু বাকি। এক ঝটকা টানে তাকে নিয়ে যখন সরে পরবো ঠিক এমন সময় সজোরে একটা থাপ্পর এসে পড়লো আমার গালে।

চোখ মেলে দেখি বউ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আর আমার বউ দু’জনেই হা করে দু’জন কে দেখছি। আমি একের পর এক নিঃশ্বাস ফেলে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে বউ এর সাথে এই প্রথম আমার দেখা। কেউই কোন কথা বলছি না। হায় আল্লাহ! বউকি তবে সব দেখে ফেলছে ? আমি আরেক মেয়ের হাত ধরতে যাচ্ছিলাম। হায়! সর্বনাশ হয়ে গেলো। থাপ্পর একটা যা খাইছি তা তো খাইছিই। এমন জোরে খাইছি, বাপের জন্মেও এর আগে কখনও খাইনি। ভয়ে আমার মুখ দিয়ে এখনও কোন কথাই বেরুছে না। এখন কি হবে! অবশেষে বউ নিরবতা ভাঙ্গলো।

একটা মশা অনেক বিরক্ত করছিলো। হঠাৎ দেখি তোমার গালে এসে বসলো। তাই আসতে করে মেরেছিলাম। জোরে লেগেছে কি? আমি নিশ্চিত আমার বউ সব কিছু লুকাছে। বউ হয়ে সে স্বামীর গালে সজোরে থাপ্পর মারছে এইটা বলে বেড়ানোর মত কোন কথা না। আর আমিও লজ্জা ভেঙ্গে বউকে জিঙ্গেস করতে পারছি না বউ তুমি কি এতো জোরে আমাকে থাপ্পর মারছো?

সে রাতে আমি আর ঘুমতে পারিনি। মাথার ভিতরে একটাই চিন্তা, এতো জোরে থাপ্পরটা মারলো কে? ওই সুন্দরী নারী এমনিতেই আধ মরা ছিলো। তার গায়ে এতো শক্তি নেই। আমি যে মুহূর্তে মেয়েটির হাত ধরে টান দিবো ঠিক তখনি থাপ্পরটা খাইছি। আবার বউ এদিকে এই কান্ড করে বসছে। টাইমিংটা পুরো পারফেক্ট। তার মানে এটা বউ এর কাজ।

এখনও মাথা থেকে বেপারটা কোন ভাবেই যাচ্ছে না। পাশে বসে বউ টিভি দেখছে আর আমি ভাবছি। আচ্ছা জয়া! তুমি কি সে দিন থাপ্পরটা খুব জোরে মার ছিলা? তোমার হয়েছে কি বলোতে? এই একটা প্রশ্ন কয়েক বার করলা। আচ্ছা তুমিই বলো। তুমি আমার স্বামী, আমি কেনো তোমাকে অতো জোরে থাপ্পর মারতে যাবো? মশা মারার জন্যই আসতে করে হাতটা তোমার গালে রেখে ছিলাম।

আমি চুপ করে থাকি। ভাবার চেষ্টা করি, সেই স্বর্গের পরীর কি হলো? সে কি বেঁচে আছে না মরে গেছে ? হঠাৎ বউ এর ওই থাপ্পর এর কথা মনে পড়তেই ভয়ে ভাবনা চিন্তা সব উড়ে গেলো। সেই থেকে আর কখনও আমি এমন স্বপ্ন দেখিনি আর বাসর রাতে দেয়া বউ এর সেই বাণী মেনে চলার দৃঢ় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত