বিচ্ছেদ

বিচ্ছেদ

আমাদের বিচ্ছেদের কয়েক বছর পরে আমি বৈরুত থেকে পাঠানো একটা চিঠি পেলাম। সেটা পাঠিয়েছিল আমার ভাই মাজিন। তাতে সাদা-কালো ছবি ছাড়া আর তেমন কিছুই ছিল না। মেইলবক্সের পাশে আমার বাড়ির কালো লবির ওপর খামটি পড়েছিল। আমি সেটা খামটি ছিঁড়ে বোঝার চেষ্টা করলাম, কেন মাজিন আমাকে তার এবং তার স্ত্রীর ছবি পাঠিয়েছে? না কোনো মন্তব্য, না কোনো একটা শব্দ, শুধুমাত্র কয়েকটা বিয়ের ছবি। নবদম্পতি চার্চ থেকে বাইরে বের হচ্ছিল। মাজিন দম্পতি ফাদারের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে শুরু করছে। তার পরনে কালো রঙের সুট এবং টাই। মুখে উজ্জ্বল হাসি। চুলে আটকে আছে কয়েকটি শস্যদানা। সে নববধূতে সম্পূর্ণ বুদ হয়ে আছে, নববধূর চুলে গন্ধরাজ ফুল। নববধূর দৃষ্টি সম্পূর্ণ আটকে আছে ক্যামেরাতে। তার আড়চোখ স্পষ্ট প্রচার করছিল, “আমি বিয়ের রাত সম্পূর্ণ তাকে উৎসর্গ করে দিব, তারপর সব শেষ হয়ে যাবে।”

আমরা কী কথা বলতে পারতাম না! আমার মাজিনকে সতর্ক করা উচিৎ ছিল। দশ নরকবর্ষ পরে তাদের বিচ্ছেদ হয়েছে।

সেসময় আমি বুঝতে পারছিলাম না যে, সে আসলে কি করতে চাচ্ছিল? যদি সে যোগাযোগ করতে চাইতো, তবে ছবি পাঠাবে কেন? কেন চিঠি কিংবা ফোনকল নয়? তবে কী সে ভেবেছে এই অর্থহীন কাজটি আমাকে তার ছলনার কথা ভুলিয়ে দেবে? সে সবসময় আমার খুব কাছের বন্ধু; একমাত্র বন্ধু। আমরা দশ বছর ধরে একই বিছানায় একই চাদরের নিচে শুয়ে থেকেছি। এখন সে আমাকে পরিত্যাগ করেছে।

আমি প্রত্যুত্তরে একটা ছবি পাঠালাম। আমার এবং আমার বান্ধবির। সে আর আমি একজন লেসবিয়ানের প্রেমে পড়েছিলাম। ছবিতে তা প্রকাশ পাচ্ছিল। আমরা সেন্ট্রাল পার্কে একে অপরের ওপর শুয়ে ছিলাম। চারিদিকে তখন মহিমান্বিত সূর্যলোক এবং মেঘের কণা দীপ্তি ছড়াচ্ছিল। আমি বড় চুল এবং স্তনের ওপর থাকা ম্যাডোনা টপসের প্রথম অংশ নিয়ে খেলছিলাম।

দশ বছর আগে আমি ইয়েল যাওয়ার জন্য একটা স্কলারশিপ পেয়েছিলাম। খাওয়া, ঘুমানো এবং পড়ালেখাসহ সম্পূর্ণ স্কলারশিপ। যে সম্মান পেয়েছিলাম সেটা আমার পরিবারের কাছ থেকে আশীর্বাদ পাবার জন্য যথেষ্ট ছিল, তারা বলেছিল– যাও, ইশ্বর তোমার সাথে আছে, সাবধানে যাও…; অপরিসীম সম্পদ এবং সংস্কৃতির সমন্বয় করে আমাদের কাছে ফিরে এসো। আমি লেবানন থেকে চলে গিয়ে একটি কলেজে ভর্তি হলাম। সেখানে গিয়ে বিষন্নতা কাটিয়ে ক্রুদ্ধ মানুষে পরিবর্তিত হতে থাকলাম। আমার শৈশবের বিড়ম্বনা, এটা কোরো না, ওই ছেলে– ওটা করো না, তোমার স্বাভাবিক হওয়া উচিৎ, সব ডালপালা একসাথে ধর, তাতে আগুন দাও, আর একটা বড় বিস্ফোরণ করাও– সবকিছুই আমার মনে হতে থাকে। সবকিছু আমার পরিবারের দোষ ছিল। আমার হৃদয়ের ফাটল থেকে নির্গত হওয়া গলিত ক্রোধ আমাকে গ্রাস করতে থাকল। বাড়িতে আমার ফোনকলগুলো ধীরে ধীরে বিরক্তিকর এবং অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছিল। কথোপকথনে আমার কথাগুলো গঠিত হতো অনেকটা এরকম বাক্য দিয়ে,”আমি তোমাদের ভালোবাসি না, আমি তোমাদের ঘৃনা করি, তোমরা কখনো আমাকে সম্মান কর না, কখনো আমাকে বুঝতে চেষ্টা কর না, আমি অসুখী আর তোমরা আমাকে অসুখী করেছ, আমি আমার প্রতি অবিচারের বিচার চাই, আমি তোমাদের অবজ্ঞা করি।” আমার রাগ ছিল আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের সমান, আর অপমান ছিল আমা কণ্ঠস্বরের সমান। আমি বেশ্যালয়ের ফুলের মতো করে আমার ধিক্কার চাষ করছিলাম। একারণে আমার মা বলেছিল, আমি আমার সম্পূর্ণ পরিবারের মুখে কালি লেপন করেছি। আমার জীবন চালনার জন্য যে পথ আমি বেছে নিয়েছি তার জন্য তারা উপহাসের পাত্র হয় প্রতিনিয়ত।

আমি জানি না আমার এর শেষ কোথায়। কবে পরিবর্তিত হবে আমার ব্যবহার অথবা লিঙ্গ। দ্বিতীয় বর্ষের শুরুতে আমি প্রি-মেড থেকে ইংরেজে পরিণত হলাম। চোখে সুরমা এবং ঠোটে লিপস্টিক লাগিয়ে আমি মানুষের মাঝে যেতে শুরু করলাম। আমার মা মেনে নিলেন আমি মারা গেছি। বাড়ির আর কেউ আমার সাথে কথা বলতে চাইতো না। না আমার বাবা, না আমার ভাইবোন।

মাজিন থেকে পাওয়া আঘাত আমাকে খুব একটা কষ্ট দেয়নি। যখন আমি ছোট ছিলাম আমি মাঝে মাঝে অন্ধকারকে ভয় পেতাম। তাই আমাদের ছোট বিছানায় আমি তার খুব কাছে চলে যেতাম। কখনো তাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরতাম। সে আমার কানে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলত, এগুলো সত্য নয়, দুঃস্বপ্ন। এটা কখনো আমাকে কষ্ট দিত না।

তবে আমি নিশ্চিত আমি কখনো তার বিশ্বাসঘাতকতা ভুলে যেতে পারব না।

কিন্তুহা লকা চপেটাঘাতে পানিতে পিছলে গিয়ে ফিরে আসার মতো সেই হীন আচরণ আবার আমার জীবনে ফিরে আসলো। আমরা সাত বছর যাবৎ শুধু ছবি পাঠাতাম। কিন্তু কোনো শব্দ বিনিময় হয়নি। আমাদের সম্পর্ক পরিণত হয় চাক্ষুষ পত্রবিনিময়ে। সেটা শুধুমাত্র চিঠি ছিল যখন সে প্রথমবার এখানে এসেছিল। যেটা থেকে আমি জেনেছিলাম তার মা হেমোকুলাসের নামে শপথ করেছিল যে সে আমাকে কিছু বলতে গেলে যেন তার জিহ্বায় আঘাত পায়। তার আঙুল কেটে যাবে যদি পরিবারের খামখেয়ালিতেও কোন চিঠি লেখে। এ সবের পরিবর্তে সে আমাকে বৈরুত সমুদ্র সৈকত থেকে তোলা তার একটা ছবি পাঠায়। তার মতো স্কার্ট পরা আমার ছবি পাঠালাম। আমি তার সন্তানের একটা স্নাপশট পেলাম এবং তাকে আমার একটা বিড়াল পাঠালাম। আমি আমাদের বিচ্ছেদ প্রত্যাখ্যান করলাম। আমার হৃদয় বিস্তর কঠিন হয়ে পড়লো। আমি খুব শক্তিশালী একজন মানুষে পরিণত হলাম।

যখন আমার প্রথম বই প্রকাশিত হলো, আমি চিন্তা করিনি আমার অভিশপ্ত দেশের বাড়ি থেকে কেউ– ছোট ছাপাখানা, অন্যরকম নাম, কবিতা– এসব লক্ষ করবে। আমি জানি না মাজিন কিভাবে এটা বের করল। আমি তার আরেকটি ছবি পেলাম ছোট সন্তানের সাথে। শান্তশিষ্ট ছেলেটি তার ডানহাতে আর বাম হাতে ধরে ছিল “ইপিসটেলস”, আমার প্রকাশিত গ্রন্থ, আমার মলাটবদ্ধ অহংকার।

সে-ই প্রথমে ভেঙে পড়ল। আমি তার ছেলের রক্তাক্ত নাকসহ একটি ছবি পেলাম, দেখে মনে হবে দ্রুত তোলা, কম আলোতে, সম্ভবত বাথরুমের বালবের আলোতে তোলা। দশ বছর বয়সী মুখচ্ছবি, ঠোঁটের উপরে নাক দিয়ে রক্ত ঝরে চলেছে। ছেলেটির কোন ব্যথা লাগছে না। সে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ক্যামেরার দিকে। সম্ভবত তার বাবার তাড়না দেখে সে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে।

আমি ছবিটি দেখার সময় দুই অথবা তিনবার নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখি। ছবির পেছনে মাজিন লিখেছে, “আমি তোমাকে দেখছি।”

লোহা মরিচা ধরার আগ পর্যন্ত লোহাই থাকে।

যখন আমার বয়স দশ বছর, কিছু গুন্ডা আমাকে দেয়ালে ধাক্কা মেরেছিল। আমার নাক কেটে রক্ত বের হচ্ছিল। মাজিন এগারটার সময় আমাকে টয়লেটে নিয়ে যায় এবং আমার মুখ পরিষ্কার করে দেয়। আমরা সেদিন দুইটা ক্লাস মিস করেছিলাম। সেদিন আয়নাতে নিজের যে প্রতিরূপ দেখেছিলাম সেটা ঠিক এই ছবির বালকটির মতো। মাজিনের পুত্রের চেহারা ওর বাবার থেকে আমার সাথেই বেশি মিল। আমার জবাব কোনো ছবিতে যুক্ত করলাম না। তার অন্য আর সব কথোপকথনগুলোর মতো আমিও একটা বাক্য দিয়ে শুরু করলাম। সাদা কাগজের ঠিক মাঝে আমি লিখলাম,”আমি সবসময় তোমাকে মিস করি।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত