১০০০ টাকা ভাংতি হবে? রিক্সা থেকে নেমেই হাজার টাকার নোটখানা বাড়িয়ে দিলাম রিক্সাওয়ালার দিকে। গত কিছুদিন যাবত এভাবেই চলছে আমার। এতে সুবিধাও আছে বেশ, এদের কাছে সচরাচর এতো টাকার ভাংতি থাকে না। টাকা ভাংতির চেষ্টায় দু-এক দোকান ঘুরে হতাশ হয়ে টাকা ফিরিয়ে দিয়ে বলে,”থাক মামা ভাংতি নাই যহন, রাইখা দেন। আরেকদিন দিয়া দিয়েন”।
কোন কোন রিক্সাওয়ালা আবার বাধ সেধে বসে, তাদের ঝাড়ি দিয়ে থামিয়ে দিতে হয়। আজকের রিক্সাওয়ালা চাচার বয়সী, কিছু বলতে চাইলে একেও ঝাড়ি দিয়ে থামিয়ে দেয়া যাবে। আজকাল ঝাড়ি দেওয়া আমার অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেছে। সেদিন ভুলবশত এলাকার নেতা টাইপের এক বড় ভাইকে ঝাড়ি দিয়ে উনার সশস্ত্র চ্যালাপেলার ব্যাপক কিল-ঘুষি হজম করতে হয়েছে। ব্যাপার না! জীবনে বড় হতে হলে অনেক কিছুই হজম করতে হয়। রিক্সাড্রাইভার হাজার টাকার নোটের দিকে কিছুক্ষন তাঁকিয়ে থাকলেন। তারপর কিছু না বলেই রিক্সা ঘুরিয়ে চলে গেলেন।
আমি তার এমন নীরবতা দেখে অবাক হলাম। হঠাৎ মনে পড়লো, গত পরশু দিন ও এই লোকটার রিক্সায় করে এসেছি, অনেক দোকান ঘুরাঘুরি করে টাকা ভাঙ্গাতে না পেরে তিনিও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সেই হাজার টাকার নোট। কি মনে করে আমি আরেকটা রিক্সা ডেকে চাচার পিছনে ছুটলাম। কিছুদুর যেতেই চাচা রিক্সা থামিয়ে ছোট্ট একটা টং দোকানে ঢুকলেন। দুটো পাউরুটি আর দুটো কলা হাতে নিয়ে কি যেন ভাবলেন। লুঙ্গির কুঁচি থেকে টাকা বের করে দুইবার করে গুনে, একটা পাউরুটি আর একটা কলা রেখে দিলেন। দোকানীর টাকা দিয়ে একটা পাউরুটি আর একটা কলা নিয়েই ছুটলেন তার গন্তব্যে। আমিও ছুটছি পিছন পিছন। বুড়ো লোকটা কেন জানি আমাকে আকর্ষিত করছে। এই আকর্ষণ কিছুতেই অস্বীকার করা যাচ্ছে না। প্রায় এক কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে লোকটা একটা জরাজীর্ণ ঘরের সামনে এসে থামলেন,
– ছমিরের মা, ও ছমিরের মা। এক গেলাস হানি লই আনো তো। বুঝতে পারলাম এটা বুড়ো ড্রাইভারের ঘর। ছমিরের মা নামক মহিলা তার অর্ধাঙ্গিনী। ছমিরের মা লাজুক হাসি আর গ্লাস ভরা পানি হাতে বেরিয়ে এলেন। এই বৃদ্ধ বয়সেও লাজুক হাসিতে তাকে মানিয়েছে বেশ। ছমিরের বাপ পাউরুটি আর কলা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
– জ্বর কমছে নি? ধরেন এগিন খান। খাইলে একটু ভালা লাগবো।
– আন্নে খাইছেন নি?
– হ খাইছি।
– আন্নেও একটু খান না।
– কইছি না খাইছি?
ছমিরের মা ক্ষুধার্ত চোখে খাবারগুলো টেনে নিলেন। আমি রিক্সা ঘুরিয়ে চলে এলাম। এদের এতো ঢং দেখার মত সময় আমার নেই। আগামী কাল ঈদ। দুই একটা শপিং বাকী আছে এখনো। শপিং কমপ্লেক্স এর সামনে এসে, এই ড্রাইভারকেও এক হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিলাম। ভাংতি না পেয়ে তালবাহানা করলেও ঝাড়ি খেয়ে চলে গেছে ব্যাটা। ক্রিং ক্রিং ক্রিং পকেটের সেলফোনটা বেজে উঠলো,
– হ্যালো বাবু?
– ওই কই তুমি?
– আমি তো মার্কেটে আসছিলাম, পাঞ্জাবী নেবো। কি রংয়ের নেবো বাবু?
– রাখ তোর রঙ। তুই আমার গিফট দেছ না কেন? কাল ঈদে আমি কি পড়বো?
– কিনতে আসছি তো বাবু। এখনি কিনবো।
– আল্লাহ সত্যি!! সরি বাবু তোমাকে তুই করে বলছি।
– ইটস ওকে।
– আচ্ছা শুনো। শাড়ি কিন্তু নেভি ব্লু কালারের নিবা, ইয়োলো থেকে। আর প্রাইস ট্যাগ উঠাবা না, আমি দেখবো তুমি কত দিয়া নিছো।
– কি বলো বাবু, আমি তো দামীটাই নেবো। তুমিই তো আমার…
– হইছে আর ঢং করতে হবে না।
আগে আমার শাড়ি কিনবা এক্ষনি। এই মেয়েটা যখনি তুই করে বলে, ইচ্ছা করে সেলফোনটা ওর মুখের ভিতর ঢুকায়ে ভাইব্রেশন দিয়ে রাখি। মাঝে মাঝে ওরে শুন্যে তুইলা আছাড় ও দিতে ইচ্ছা করে, কিন্তু ওর ওয়েটের কথা চিন্তা করে দেই না। ডাক্তার বলছে ভারী জিনিস কম তুলতে, আমার আবার হাঁপানির প্রবলেম। মেয়েটার নাম শ্রাবণী। ওর ব্যবহার মাশাল্লাহ ঠাডা পড়া শ্রাবন মাসের মতই। দেড় বছরের রিলেশনে কত্তবার যে ওরে থাবড়াইতে ইচ্ছা হইছে, কিন্তু সাহস করে দেয়া হয় নি। এদেশে নারী নির্যাতনের বিচার খুবই দ্রুত হয়।
শ্রাবনীর কথামত শপিং ইয়োলো থেকেই করলাম। দুটো একই রকম পাঞ্জাবী, আর একটা নেভি ব্লু শাড়ি। আব্বু আম্মুর শপিং আগেই হয়ে গেছে। প্রতিবছর ঈদের আনন্দটা শপিংয়েই কাটে, পকেটের সব টাকাগুলো দোকানদারদের দিয়েও আমরা হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরি। আর ভাগ্য যখন অসহায় তখন টেইলার্স এ ফিটিং করতে দেয়া সামঞ্জস্যহীন জামাটা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরি। টেইলর তুনে কেয়া কিয়া, শার্ট কো ব্লাউজ বানায়া! আজ ঈদ। ঈদ মানেই খুশি, আর আমি বসে বসে লজেন্স চুষি। ভোর না হতেই ডাইনির কল পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেছে। ডাইনিটার নাম শ্রাবনী,
– হ্যালো!
– তোর হ্যালোর খ্যাতা পুড়ি। আমার শাড়ি কই?
– আজ ঈদের দিন বাবু। বলো “ঈদ মোবারক”।
– শাড়ি কিনছোস কিনা সেটা বল?
– আমার চাইতে তোমার শাড়ি ইম্পরট্যান্ট?
– কিনছোস কিনা জলদি বল।
– হুম কিনছি তো বাবু, নেভি ব্লু। প্রাইস নাইন জিরো ফাইভ জিরো।
– আল্লাহ সত্যি। ঈদ মোবারক বাবু। আমার লক্ষী বাবুটা। দিয়ে যাবা কখন?
– হুম সকাল আটটার আগেই পেয়ে যাবা, আমি তোমার বাসার সামনে আসবো। লজেন্স চোষা শেষ করেই গোসল সেরে নিলাম। আম্মুর হাতের সেমাই, আর নতুন পাঞ্জাবী গায়ে সত্যিই ঈদ ঈদ লাগছে। সালামী হাতে পেয়ে একটা ভ্যাবলা টাইপ হাসি উপহার দিলাম আম্মুকে। হাসতে হাসতেই একটা পাঞ্জাবী আর শাড়ি সমেত শপিং ব্যাগটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। শ্রাবনী বোধহয় বাসার সামনে অপেক্ষা করছে। আম্মু বললেন,
– ব্যাগে কি রে?
– খুশি আম্মু খুশি।
– কিসের খুশি?
– বুঝবেন না। গেলাম আসসালামু আলাইকুম।
– এতো জলদি? নামাজ তো এক ঘন্টা পর।
– কাজ আছে। একটা সেমাইর প্যাকেট দেন তো। আটটার আধ ঘন্টা আগেই যথারীতি কাঙ্ক্ষিত বাসার সামনে পৌছে ডাক দিলাম, “শ্রাবনী এই শ্রাবনী”। নাহ আমি শ্রাবনী বলে ডাকি নি। আমি লজ্জা মাখা স্বরে ডাকলাম,
– “ছমিরের মা, এই ছমিরের মা?” সেই লাজুক হাসিওয়ালা বৃদ্ধা বেরিয়ে এলেন। তার চোখে বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট। একটা অচেনা ছেলে তাকে এভাবে ডাকবে তিনি আশা করেন নি।
– আমি দুঃখিত চাচী আপনার নাম জানা না থাকায় এভাবে ডাকলাম। চাচা বাসায় আছে?
– উনি তো গোসল কইত্তে গেছে। আপনি কে?
– আমি আপনার ছেলের মত। চাচা আমাকে চেনেন। ভিতরে আসি?
– আসেন আসেন ভিতরে আইসা বহেন। আমি ভিতরে গিয়ে সেমাইর প্যাকেটটা চাচীর হাতে ধরিয়ে দিলাম।
– চাচী একটু সেমাই খাওয়াবেন? চাচা সেমাই নিয়ে আসতে বলেছে আমাকে। চাচী সেমাইর প্যাকেট হাতে কিছুটা ইতস্তত করেও চলে গেলেন রান্নাঘরে। উত্তপ্ত চুলোয় সেমাই রান্না হচ্ছে। আর আমি বসে বসে টিনের চালের ছিদ্র গুনছি… এক… দুই… তিন… তিন পর্যন্ত গণনা শেষেই চাচীকে আবার ডাকলাম। আসতেই উনার হাতে নেভি ব্লু শাড়িটা ধরিয়ে দিলাম,
-এটা আপনার জন্য চাচা আনতে বলেছে। তার জমানো টাকায় কিনেছেন, আপনাকে সারপ্রাইজ দিবে বলে। আরো বলেছেন গোসল করে এসে যেন আপনাকে এই শাড়ি পড়া দেখেন।
সারপ্রাইজ এর অর্থ চাচী বুঝলেন কিনা জানি না, তবে এতোটুকু বুঝলেন সারপ্রাইজ পেলে কাঁদতে হয়। তাই তিনি কাঁদছেন, তার চোখ বেয়ে অশ্রুর ঢল নেমেছে। এ ঢল খুশির ঢল, এই ঢল ভালোবাসার ঢল। আমি অবাক হলাম, এই বৃদ্ধা মহিলাকেও কাঁদলে এতো কিউট লাগে। গাল দুটো টেনে দিতে ইচ্ছা করে। আমি গাল টেনে দেওয়ার আগেই তিনি নতুন শাড়িতে মুখ ঢেকে পাশের কক্ষে চলে গেলেন। আমি আবার টিনের চালের ছিদ্র গননায় মন দিলাম। চার… পাঁচ… ছয়… সাত… গোসল শেষে ফিরে এসে সেই বৃদ্ধ চাচা আমাকে দেখে অবাক হলেন। অজানা আশংকায় তার শরীর আড়ষ্ট হয়ে গেলো। আমি এগিয়ে গেলাম,
– আসসালামু আলাইকুম চাচা।
– আপনি এখানে বাজান।
– আপনার কাছে ১ হাজার টাকার ভাংতি হবে?
চাচা আবার ও অবাক হলেন। এই ইদের দিনেও বেয়াদব ছেলেটা চলে এসেছে হাজার টাকার ভাংতি চাইতে। আমি চাচাকে জড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে আসলাম।
– আপনি হয়তো আমাকে ওভাবে চেনেন না, চাচী আমাকে অনেক আগে থেকেই চেনেন। আপনার জন্য সারপ্রাইজ আছে। আমি পাঞ্জাবীটা তার হাতে তুলে দিয়ে বললাম, “চাচী আপনার জন্য আনতে বলেছেন, তার জমানো টাকায় কেনা” চাচা আমার মিথ্যে ধরে ফেললেন।
পাঞ্জাবী আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন,- না বাবা, আমি আপনার এইডা নিতে পারুম না। আমরা গরীব মানুষ, এসব আমাগোরে মানায় না। কি আর করা, ব্যাটাকে ঝাড়ি দিয়েই পড়াতে হলো। আমি আবার ঝাড়িতে এক্সপার্ট। চাচী সেমাই নিয়ে এসেছেন। তার সেই চিরচেনা লাজুক হাসি আর নেভি ব্লু শাড়িতে উনাকে অপরুপ লাগছে। আমি চাচার দিকে তাঁকালাম। চাচা ছলছল চোখে সম্মোহনী দৃষ্টিতে চাচীকে দেখছেন। এই ঘোর লাগা দৃষ্টি সচরাচর দেখা যায় না। হয়তো এই দৃষ্টিতেই মাতাল হয়ে প্রায় দুই যুগ পূর্বে চাচী ভালোবেসে ফেলেছিলেন আজকের এই বৃদ্ধ লোকটাকে।
পৃথিবীর ওপার থেকে কেউ একজন এই ভালোবাসার দৃশ্য উপভোগ করছেন, আর আমি অত্যন্ত মনযোগ দিয়ে সেমাই খাচ্ছি। যদিও সেমাইতে লবন কম হয়েছে। চাচা চাচী সেমাইয়ের প্লেট হাতে নীরবে কেঁদে চলেছেন, হয়তো চোখের পানিতেই সেমাইয়ে লবনের পরিমাণটা বাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা। সেলফোনটা বের করেই শ্রাবণীর পাঠানো একটা মেসেজ পেলাম। তাতে বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি মিলিয়ে ডজনখানেক গালি অত্যন্ত শৈল্পিকভাবে টাইপ করা। আমি গালিগুলো হজম করে ফোন পকেটে রেখে দিলাম। “ব্যাপার না…! জীবনে বড় হতে হলে অনেক কিছুই হজম করতে হয়।