পেত্নীর জামাই

পেত্নীর জামাই

আমি বিয়ে করবো না! কেন করবি না? আমি বিয়ে করবো না। এটাই আমার কথা। তোরে বিয়ে করতেই হবে। এই তোরা ওরে দেখে রাখ। ও যেনো পালাতে না পারে।

সব কিছু ঠিকিই ছিলো। সমস্যাটা বাঁধে গতকাল রাত এ। ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর বিয়ের দাওয়াত খেয়ে বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। কোন কিছু না পেয়ে শেষমেষ হঁটেই বাড়ি ফিরছিলাম। বন্ধু ঘনিষ্ট হওয়ায় বাসরঘর এর যাবার আগে ফোনে কল করে দোয়া চাইতে কথায় কথায় বলে ফেলছিলাম বিয়ে করলে তোদের মত সুন্দরী বিয়ে করবো না। কোন এক পেত্নী দেখে বিয়ে করে ফেলবো। সমস্যাটা বাঁধে এখানেই। বাড়ি গিয়ে ঘুমিয়েছে ঠিকি কিন্তু সকাল এ ঘুৃম থেকে উঠে দেখি আমি আমার ঘরে নাই। আমাকে ঘুমের মধ্যেই তুলে আনা হইছে ভূত জগৎ এ। আমি যখন ফোনে কথা বলছিলাম তখন আমার পাশে বট গাছের উপরে আমার হবু শ্বশুর আব্বা আর শাশুড়ি আম্মা বসা ছিলেন। পরে জানতে পারলাম তারা না কি তাদের মেয়ে পেত্নীর জন্য জামাই খুঁজতে এসে ছিলো। আমি পেত্নী বিয়ে করতে চাই এ কথা শুনে তারা অনেক খুশি হয় আর আমাকে তুলে নিয়ে আসে পেত্নীর সাথে বিয়ে দিবে বলে।

কি অদ্ভত জায়গা! ঘন কালো মেঘে ঢাকা জঙ্গল এর মধ্যে ছোট ছোট হাজার খানিক ঘর। হয়তো এটাই ভূত জগৎ। দিনের আলো নেই বলেই চলে। চারপাশটা মশালের আলোয় আলকিত। না আছে বিদ্যুৎ না আছে অন্য কিছু। পুরোই যেন একটা আদিম সমাজ। আমাকে একটা ঘরের ভিতর আটকে রাখা হয়েছে। ঘরের ভিতরটা দেখার খুব ইচ্ছে। অন্ধকার থাকায় কিছুই চোখে পড়ছে না। একবার শুনেছিলাম আমার এক বন্ধুকে না কি ভূত মাথায় তুলে আছাড় দিয়েছিলো। আমাকে যদিও এখনও দেয়া হয়নি। কিছুখন পর মনে হয় দিবে।

জয়া’র কথা খুব মনে পড়তেছে। এর মধ্যে মনে হয় কয়েক’শ বার ফোন দিয়ে সারছে। আমার মোবাইলটা যে কোথায় তাও জানি না। নিশ্চয়ই আমাকে ফোনে না পেয়ে বিষের বোতলটা হাতে নিয়ে বসে আছে। মেয়েটা বড় অদ্ভুত। কিছু হলেই আত্মহত্যা করতে চায়। এরই মধ্যে হাজার খানিক বার চেষ্ট করেছে কিন্তু পারে নাই। মরতে না কি ভয় পায়। আর সেই ভয়ে আজ পর্যন্ত বিষের বোতল এর মুখটাও খোলা হয়নি। আমি দুষ্টুমি করে বেশ কয়েকবার বলেছিলাম দাও আমার কাছে দাও, আমি বোতলের মুখটা খুলে দেই তুমি এক ঢোকে খেয়ে ফেলো। আমার কথা শুনে ভ্যে ভ্যে করে কেঁদে দেয় আর আমি হাসি। পাগলি মেয়ে। এই ওরে বের করে নিয়ে আয়! না আমি যাবো না। আমি বিয়ে করবো না। তোরে বিয়ে করতেই হবে। দরকার হলে আমি মরে যাবো তাও পেত্নী বিয়ে করবো না।

না না মরা যাবে না। মরলে পরে ভূত হয়ে যাবো। আর ভূত হয়ে গেলে এই ভূত জগৎ এর চিরস্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাব। যে করেই হোক জীবিত অবস্থায় এখান থেকে পালাতে হবে। জয়া যদি শোনে আমি পেত্নী বিয়ে করছি নিরঘাত এবার বিষ খেয়ে ফেলবে। আমাকে টেনেহিঁচড়ে বের করা হলে ঘর থেকে। আমি হা করে সবাই কে দেখছি। আমার বিয়ে উপলক্ষে দেখছি ভাল ভূত দাওয়াত দেয়া হয়েছে। হাজার হাজার ভূত। জানতে ইচ্ছে করছে সব ভূত কি বিয়ের দাওয়াত খেতে এসেছে না কি কেউ বাদ আছে?

হঠাৎ আমাকে মাটি থেকে টেনে তোলা হলো। পড়নের সার্ট খুলে ফেললো। সার্ট খোলার কারনটা বুঝতে পারলাম না। ওহঃ বুঝেছি! মনে হয় বিয়ের পোষাক পড়াবে। একজন এসে এখন আমার প্যান্ট খোলার চেষ্টা করছে। একি সর্বনাশ! এখন কি নেংটা করবে না কি আমাকে! এই যে দেখুন এটা কিন্তু ঠিক না। প্যান্ট খুলবেন না। খুলতে হবে। না খোলা যাবে না। ভাল হচ্ছে না কিন্তু। এই যে দেখুন! আমরা কিন্তু মনুষ্য সমাজে নেংটা হইনা।

ধ্যেততেরি! দিলো প্যান্ট খুলে। ভূতদের লজ্জা শরম বলে হয়তো কিছু নাই। পেত্নী বিয়ে করাবে ভাল কথা তাই বলে ভূত সমাজে সাবার সামনে বিয়ের অনুষ্ঠান এ জামাইকে এ ভাবে নেংটা করা ঠিক না। জামাইয়ের তো মানসন্মান পুরো সমাজ দেখে ফেললো এখন কি হবে! ভীষন লজ্জা লাগতেছে। শুধু ভূত থাকলে এতোটা লজ্জা লাগতো না। হাজার হাজার পেত্নী ও বিয়ের দাওয়া খেতে আসছে। কয়েক জনের আবার চোখের দৃষ্টি ভালনা। বার বার আমার ওইটা দিকে তাকাছে। চোখে চোখ পড়তেই মুচকি হাসতেছে। ছিঃ কি লজ্জার বিষয়!

আমার সারা শরীরে জঙ্গলীদের মত কাল ডোরাকাটা দাগ দেয়া হয়েছে। মুখে দিতেও বাদ রাখে নাই। মনে হয় এটাই ভূত সমাজে বিয়ের পোষাক। এমনিতেই আমি কাল মানুষ তার উপর কাল রং। অন্ধকারে একবার গেলে আমাকে আর খুঁজে পাওয়া লাগবে না। সাথে একটু সাদা রং দিয়ে দিলে আরও ভল হতো। আমাকে দেখতে বাঘের মত লাগতো। যাক মনের একটা আশা পুরন হলো তাহলে। শরীরে সাদা রং দেয়া হচ্ছে। হবু জামাই এর মনের আশা বলে কথা। যৌতুক তো চাই নাই। মনের দু’একটা আশা পুরন করায় জামাই যদি খুশি থাকে তো ক্ষতি কি! মেয়ের জামাই খুশি মানেই মেয়ে খুশি। না ভুল হইছে, পেত্নী খুশি।

এখানে এতো ভূতের মধ্যে বোঝা যাচ্ছে না কোনটা আমার হবু শ্বশুর আর কোনটা আমার শাশুড়ি। আাচ্ছা পেত্নীর কি ভাই বোন আছে? মানে হবু শ্যালক শালিকা! শালিকা না থাকলে বিয়ের পর মজা নাই। বউ এর পরেই শালিকার স্থান। সারাদিন চোখের সামনে ঘুর ঘুর করবে আর ঢং করবে। তাহলে না বিয়ে করে মজা। দুলাভাই দুলাভাই বলে সারাদিন কান ফাটিয়ে ফেললেও শালিকার ডাকে কোন দিন বিরক্ত লাগে না। এখন পর্যন্ত আমার হবু বউ পেত্নী টাকে দেখতে পাইনি। মনে হয় পার্লার এর গেছে। পেত্নী হলেও সে আজ নতুন বউ। সাঁজুগুজু না করে বিয়ে করাটা ঠিক না। বিয়ে তো আর সব সময় করে না। বিয়ের আগে আফসোস না রাখা ভাল।

জামাই হিসেবে আমার আফসোস লাগতেছে। আমার পক্ষের কোন লোক নাই। অন্তত বাপ মা’কে খবর দেয়াটা দরকার ছিলো। হাজার হোক তারা আমাকে জন্ম দিছে। ছেলের বিয়েতে তাদের থাকাটা জরুরি। কয়েক জন বন্ধু বান্ধব এর কথাও খুব মনে পড়তেছে। আমার বিয়েতে অনেক আনন্দ করতে চেয়ে ছিলো। ভূত সমাজে বন্ধু বান্ধবদের আসার অনুমতি আছে কি না জানা নাই। মনের ভিতরে একটা চাপা কষ্ট। বিয়ে তো আর বার বার করবো না। কোন দুঃখে যে পেত্নী বিয়ে করবো বলতে গেছিলাম।

মাথার মধ্যে বেশ বড় একটা টুপি পড়ানো হয়েছে। টুপিটা বেশ ভারি। ভারি হওয়ার যথেষ্ট কারন আছে। টুপিটার ঠিক মাঝখানে আছি একটা মরা মহিষ এর মাথা যেটা দিয়ে টপটপ করে এখনো রক্ত পড়তেছে। চারপাশে বেঁধে দেয়া হয়েছে জীবজন্তুর হাড়। চোখের সামনে দুইটা মালা এনে রাখলো। মালা দুইটা পছন্দ হইছে। নানা রকমের পাহাড়ি ফুল দিয়ে বানানো। ভূত জগৎ এর এই একটা জিনিস ভাললাগলো। আসতে আসতে বিয়ের সরঞ্জামাদি আনা হচ্ছে। আমি তাকিয়ে দেখছি। সে কি! আমার না এখান থেকে পালানোর কথা! আমি আশপাশটা ভাল করে দেখে নিলাম। পালানোর একটা রাস্তা বের করতে হবে। কোন ভাবেই পেত্নীর জামাই হওয়া যাবে না। কিন্তু পালাই কি করে?কোন উপায় আছে কি?

অনেক সময় ধরে বসে আছি। কার সাথে বিয়ে হচ্ছে কি আসয় বিষয় কিছুই বুঝতেছি না। পেট খালি হয়ে আছে। কিছু খাবার খেতে পারলে ভাল হতো। নাহ! ভূত সমাজে জামাই এর কোন আদর নাই। এতো সময় ধরে বসিয়ে রাখছে অথচ কিছুই খেতে দিচ্ছে না। কেনো? বিয়ে উপলখে কি কোন রান্নাবান্না হয়নি না কি! হঠাৎ চার জন লোক এগিয়ে আসছে আমার দিকে। কিছুটা ভয় হতে শুরু করলো। না জানি এবার কি করে বসে কে জানে। ওরা এসেই আমার চার হাত পা ধরে ব্যাঙ এর মত কোলে তুলে নিলো। মাথার ভারি টুপিটা পড়ে গেলো। ছাড়েন আমাকে! ছাড়েন! না ছাড়া যাবে না। কি আশ্চর্য! এ ভাবে একটা নেংটা মানুষকে কোলে তুলে নেয়া ঠিক না। ছাড়েন আমাকে। বললাম না ছাড়া যাবে না। এইটা কেমন কথা! ভূত বলে কি আপনাদের কোন লজ্জা শরম নাই! দেখছেন না আমি নেংটা। আরে ধূর! ছাড়েন, ঘোড়ার ডিম!

এতো দেখি বিশাল মুশকিলে পড়লাম। নেংটা হয়েও শান্তি নাই। মনুষ্য সমাজে এমন হতে শুনি নাই। মানুষ নেংটা দেখলে দূরে সরে যায়। আর ভূত সমাজে নেংটাই হলো জামাই। কি অদ্ভুত বেপার! আমাকে নেয়া হচ্ছে কোথায়! এইটা কি কোন বিয়ে? মনে তো হচ্ছে আমাকে মেরে ফেলতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ও আল্লাহ গো! কি বিপদে ফেললা আমাকে! আমি না হয় দুষ্টুমি করে একবার বলেছিলাম পেত্নী বিয়ে করবো। আর তুমিও আমার মনের আশা পূরন করে দিলে! আমাকে এখন এখান থেকে বের করো। আমি পেত্নী বিয়ে করতে চাই না। কে কোথায় আছেন! আমাকে বাঁচান। বাঁচান আমাকে! ওই চুপ একদম চুপ!

ছিঃ কি বাজে ব্যবহার! ভূত সমাজের হবু জামাই আামি। আমি না হয় একটু চিৎকার দিয়েছি! তাই বলে এমন ভাবে ধমক দেয়া লাগে! জামাইদের মনে হয় ভূত সমাজে কোন মূল্য নাই। হবু শ্বশুর আব্বা’কে পেলে ভাল হতো। তিনি নিজেও একজন ভূত সমাজের জামাই। তার কাছ থেকে জেনে নিলে ভাল হয়। হঠাৎ ওরা থেমে গেলো। তবে আমাকে এখনও কোল থেকে নামানো হয়নি। একজন অর্ধ নেংটা মাঝ বয়সি লোক আমার দিকে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে। এই লোকেরও কি আজ বিয়ে না কি? বিয়ে না হলেও মনে হয় গায়ে হলুদ এমন কিছু হবে। বিয়ে হলে তো আমার মত পুরো নেংটা হয়ে থাকতো। আহারে! কত ইচ্ছা ছিলো ধুমধাম করে গায়ে হলুদ হবে। এই পেত্নীর বাপ মা দিলো আমার সব স্বপ্ন ভেঙ্গে। আহা! এমন করতে হয় না। জামাই মানুষ এমন করলে আমাদের মানসম্মত থাকবে? আপনার পরিচয় কি? আমি পেত্নীর বাবা।

ওহঃ! তাহলে এই সেই হবু খুনি শ্বশুর আব্বা যিনি আমার জীবনের সব স্বপ্ন ভঙ্গের নায়ক। নাইয়কা কোথায়! মানে আমার হবু শাশুড়ি আম্মা? তাকে তো দেখতে পারছিনা! এখন কি পার্লার থেকে আসে নাই না কি। খালি একবার ছাড়া পাই। ভূতের বংশ নিরবংশ করে দিবো। মানুষের সাথে পেত্নীর বিয়ে দেবার সখ আজীবন এর জন্য মিটিয়ে দেব। আমি পেত্নী বিয়ে করবো না। কেনো বিয়ে করবে না? আমি আর এক জনকে ভালবাসি। হে হে হে! বিয়ের আগে সবারই এমন দু’এক থাকে। তোমার শাশুড়ির সাথে বিয়ে হওয়ার আগে আমারও অনেক ছিল।

কি সাংঘাতিক বেপার! হবু শ্বশুর আব্বা দেখি পুরাই ঝানু মাল। সবার সামনে গড়গরিয়ে সব বলে দিচ্ছে। না জানি তার মেয়ে পেত্নীর কি অবস্থা। প্রেম তো মনে হয় বাপের থেকেও বেশি করছে। হবু শ্বশুর আব্বার চরিত্র বেশি একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। আল্লাহই জানে পেত্নীর চরিত্রের কি অবস্থা! শোনেন আমার প্রেমিকা অন্যরকম। আমাকে না পেলে সে বিষের বোতল হাতে নিয়ে বসে থাকে। সকাল থেকে আমার কোন খোঁজ নাই। এতোখনে মনে হয় বিষ খেয়েও ফেলছে। সত্যিই? জী সত্যি। তাহলে তো ঝামেলা শেষ। বিষ খাওয়া হয়ে গেছে, মরেও গেছে। এখন আর তোমার যেএ কাজ নাই।

কত বড় সাহস, আমার জয়া’কে নিয়ে এতো বড় কথা! একবার খালি ছাড়া পাই একটা ঘুষি মেরে নাকের হাড় হাডি ফাঁটায়া ফেলবো। আমি আমার জীবনের থেকেও বেশি ভালবাসি ওকে। আমার এই পুরো পৃথিবীটা জুড়ে এই একটা মানুষই। অনেকের অনেক কিছু আছে। জয়া ছাড়া আমার কেউ নাই। এই একটা মানুষের মাঝেই আমি হাসি, আমি নামের এই মানুষটা কাঁদি। আমার সব নিরব অভিমান, আমার চাওয়া পাওয়া সব ওই একটা মানুষকে ঘিরে। বছরের পর বছর ধরে চলছি। আর যখন লাল নীল সংসার শুরু করবো তখন পেত্নীর বাপ মা এসে হাজির। নাহ! এ বিয়ে কোন মতেই করা যাবে না। যে ভাবেই হোক পালাতে হবে।

ইয়া আল্লাহ! এই বুড়া মহিলা কে? এইটাই কি আমার হবু শাশুড়ি আম্মা না কি? মনে তো তাই হচ্ছে। বয়সটা যদিও আমার হবু শ্বশুর এর চেয়ে একটু বেশি। দেখতে অবশ্য খারাপ না। সামনের দুইটা দাঁত বড় হওয়ায় হাসি দিলে ভয় লাগে এই আর কি। তবে উনি যে বেশ রাগী তা বুঝতে পারছি। এই তোরা ওকে নিয়ে আয়। বিয়ের সময় হয়ে গেছে। না আমি যাবো না। ছাড়েন আমাকে। আমার এতো বড় সর্বনাশ করবেন না। আমার বিয়ে হলে জয়া মরে যাবে।

কোন ভাবেই এ বিয়ে করা যাবে না। আমি শরীর এর সবটুকু শক্তি প্রয়াগ করে মুচরামুচড়ি করছি। পিচ্ছিল তেল জাতীয় রং সারা শরীরে থাকায় ভূত গুলার বেশ কষ্ট হচ্ছে আমাকে ধরে রাখতে। প্রায়ই আমি পিচ্ছলে মাটিতে পড়ে যাব যাব ভাব। বেশ কয়েক বার মাটির কাছাকাছি যাওয়ায় ভূত গুলা আবার আমাকে ধরে কোলে তুলে নিচ্ছে। এবার শরীরের বাকি শক্তি দিয়ে মারলাম এক ঝাড়া। ধপাস করে ব্যাঙ এর মত উপর হয়ে পড়লাম মাটিতে। ভূত গুলাও আমার থেকে কয়েক হাত দূরে গিয়ে পড়লো। আমি আর কোন দিকে না তাকিয়ে নেংটা হয়েই দিলাম এক দৌড়। জীবন মরন সমস্যা! দৌড়ের গতি কোন ভাবেই কমানো যাবে না। ধরা পড়লে আর রক্ষা নাই। এই একটা মাএ সুযোগ পালিয়ে যাবার।

চোখের সামনে দিয়ে গাছপালা গুল সাঁইসাঁই করে পেছনের দিকে চলে যাচ্ছে। খুব জানতে ইচ্ছে করছে আমি কতটা জোরে দৌড়াছি। ঘন্টায় কত কিলোমিটার হবে জানতে পারলে ভাল হতো। তবে এতো জোরে এর আগে কখনও দৌড়াইনি। হাজার হাজার ভূত আমার পেছনে দৌড়াছে। যদিও তারা আমার থেকে বেশ দূরে। নেংটা হয়ে যে এতো জোরে দৌড়ানো যায় আগে জানতাম না। স্কুল এ পড়ার সময় অনেক বার দৌড় প্রতিযোগিতা দিয়েছিলাম। খুব ইচ্ছা ছিলো দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার কিন্তু কখনই পথম হতে পারিনি। ইসসস! তখন যদি নেংটা হয়ে দৌড় দিতাম তাহলে প্রথম পুরষ্কারটা আমিই পেতাম।

আমার হবু শাশুড়ি আম্মা বেশ রেগে গেছেন। মাঝে মাঝেই বাঘের মত গর্জন দিচ্ছেন আর ভূতদের বলছেন কোন ভাবেই যেনো আমি পালাতে না পরি। মনুষ্য সমাজে কোন কারনে মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে গেলে সমাজের চোখে মেয়েটাকে খারাপ ভাবে দেখা হয়। বাপ মা কষ্টে ভেঙ্গে পড়েন। ভূতের সমাজেও মনে হয় এমন রীতিনীতি আছে। মানুষ হিসেবে পেত্নীর মায়ের কষ্ট আমি বুঝতে পারতেছি কিন্তু আমার কিছু করার নাই। কোন পেত্নী পরিবার এর মানসম্মত বাঁচাতে গিয়ে আমি মনুষ্য সমাজে জয়া’র মত মেয়েটার জীবন নষ্ট করতে পারি না। চিল্লান, আরো জোরে চিল্লান। তবু আমি নেংটা হয়েই দৌড়াবো।

আমার দৌড় এর গতি ধীরে ধীরে কমতেছে। হৃদপিন্ডটা যেনো বুকের খাঁচা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসবে। নিঃস্বাস নিয়ে বুক ভরছে না। মনে হচ্ছে কে যেন বুকের উপরে বসে চাপ দিয়ে ধরে রেখেছে। অনেক দিন পরে দৌড় দিলে যা হয়। ভূত গুলাও বেশ কাছে চলে আসছে। তবে কি ধরাই পড়ে যাব! ধরা পড়লে পেত্নীর সাথে বিয়ে নিশ্চিত। আর একবার বিয়ে হয়ে গেলে আমার আর পৃথিবীতে ফেরা হবে না। মানুষ হিসেবে জীবনটা তো এখানে যাবেই। মরার পর ভূত হয়েও এখানেই থাকতে হবে।

শেষ বারের মতন শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে দৌড়ের গতি বারালাম। হঠাৎ মনে হলো আমি শূন্যে ভাসতেছি। পায়ের নিচে মাটিও নাই। ইয়া আল্লাহ! এই ছিলো তোমার মনে! এই বার বুঝি মরলাম। মরলে আমি শেষ। বিনা কবুলে পেত্নীর জামাই হয়ে যাওয়া লাগবে। আমি সোজা নিচে পড়তে শুরু করলাম। তবে কোথা থেকে কোথায় পড়তেছি তা জানি না। দেখে মনে হচ্ছে কোন বিশাল এক পাহাড়ের গুহার মুখ দিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছি। যেখানেই যাই হবু শ্বশুর বাড়ির সামনে গিয়ে না পড়লেই হলো। পাহাড় এর গুহায় জন্মানো গাছের ডালপালা আর লতা ছিড়ে নিচে পড়তেছি আমি। হাত পা ছিঁলে একাকার। এবার ভাল কাজ হইছে। এতোখন তো ভালই ছিলাম। গেলাম না আটকে! লাতা পাতায় এইবার আমার সারা শরীর পেঁচিয়ে গেছে। মাটি থেকে বেশ অনেকটা উপরে আমি টারজেন এর মত ঝুলতেছি। ছোট বেলায় টারজেন হওয়ার খুব সখ ছিলো। এ জন্য কয়েক বার অবশ্য হাত পাও ভেঙ্গেছে। ভূত সমাজে আসায় একট জিনিস ভাল হয়েছে। জীবনের অনেক অপূর্ণতা এখানে পূর্ণ হয়েছে।

আমি ঝুলছি তো ঝুলছিই। এভাবে নেংটা হয়ে গাছের উপরে ঝুলাটা মোটেও ঠিক না। শুনেছি জঙ্গলে না কি গাছের উপর সাপ থাকে। আমি আমার সাপ খুব ভয় পাই। যে ভাবে লতাপাতা দিয়ে পেঁচিয়ে গেছি এখন এখান থেকে নিজেকে ছাড়াই পারলেই হয়! আর ছাড়ালেও আরেক বিপদ। সোজা গিয়ে পড়বো কম করে হলেও একশো ফিট নিচে তাও আবার মাটির উপর। এতো দেখি সব দিকেই মুশকিল! আশেপাশে কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না। এমন কি ভূত গুলা কেউ দেখা যাচ্ছে না।

নাহঃ এই ভাবে আর কত সময় ঝুলে থাকা যায়। সারা শরীর জ্বালা করতেছে। শরীর এর বেশ কয়েকটা জায়গা কেটে গিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। ভূত সমাজে হাসপাতাল আছে কি না জানা নাই। মানুষ হিসেবে আসলেই আমি ব্যর্থ। ভূতের সমাজে কি কি আছে আমি এটাও জানি না। জয়া’র কথা খুব মনে পড়তেছে। আমার যখন অনেক খারাপ লাগে তখন ওর কথা খুব বেশি মনে পড়ে। আমি অসুস্থতা সহ্য করতে পারি না। একটু জ্বর হলেই জয়া’কে ফোনে অনেক জ্বালাই। এমনও সময় গেছে ও সারারাত আমার সাথে ফোনে জেগে থাকতো। আমি মাঝে মাঝেই এই সামান্য জ্বরে কান্না করে দিতাম আর বলতাম তুমি চলে আসো। তুমি আসলেই আমি ভাল হয়ে যাব। অথচ আজ আমার কত কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ওকে জানাতেই পারছি না। হয়ত প্রচন্ড কষ্টের সময়টা একা একাই পার করতে হয়।

অনেকখন ধরে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছি। কোন ভাবেই কোন কাজ হচ্ছে না। এমন বিপদ মানুষ এর হয়! এখন নিচে নামবো কি করে! আশেপাশে মানুষতো দূরের কথা, ভূত গুলারো কোন দেখা নাই। কি করা যায়? নিচে নামার তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবে আর কতখন ঝুলে থাকবো। ওহে ভূত সমাজ! এই যে আমি এখানে। আপনাদের হবু জামাই, নেংটা হয়ে গাছের গাছের উপর ঝুলতেছি। আমাকে নামান।

নাহ! কারও কোন সারা শব্দ নেই। গেলো কোথায় সব? তাহলে কি বিয়ে ভেঙ্গে গেলো? তা যদি হয় তবে তো বেঁচে গেলাম। ওই পেত্নীর জন্য আমার আজ এই অবস্থা। এ বার গিয়ে জয়া’র কাজ থেকে বিষের বোতলটা এনে ওই পেত্নীটাকে খাওয়াবো। হতছারা পেত্নী। আমার যে এখন ভীষন বিপদ! এমন ভাবে পেঁচিয়ে গেছি লতাপাতা দিয়ে হাতটা পর্যন্ত ছাড়াতে পারছি না। এখন কি হবে আমার। তবে কি নেংটা হয়ে এখন গাছের উপরেই ঝুলতে থাকবো?

আমি প্রায় দুই ঘন্টা যাবদ গাছের উপর ঝুলছি। এখন পর্যন্ত নিচে নামার কোন ব্যবস্থা করতে পারিনি। ভূত সমাজ হাওয়ায় মিশে গেছে। কারো কোন দেখা নাই। এভাবে আর কতখন ঝুলে থাকবো! অসভ্য ভূত সমাজ! হবু জামাই গাছের উপর নেংটা হয়ে ঝুলছে আর তাদের কোন চিন্তাই নেই। নাহ! যা করার নিজেকেই করতে হবে। যে করেই হোক এই লতাপাতা ছিড়ে নিচে নামতেই হবে। কিন্তু সমস্যা হলো আমার কাছে নাই কোন ছুঁরি নাই কোন ধারালো কিছু। হাত দু’টোও পেঁচিয়ে আছে লতাপাতায়। ইয়া আল্লাহ আমাকে মারার যখন তোমার এতোই ইচ্ছা ছিলো তখন পৃথিবীতেই মারতে! এই ভূত সমাজে এনে গাছের উপর নেংটা করে মারার কি দরকার ছিলো!

আমি কোন ভাবে হাত দু’টো ছাড়ানোর চেষ্টা করছি। আর দাঁত দিয়ে লতাপাতা কাটছি। ডিসকাভারি চেনেল এর বিয়ার গ্রিলস কথা খুব মনে পড়ছে। ওনাকে পেলে ভাল হতো। উনি একটু লতাপাতা খেয়ে কমিয়ে দিতেন। তিনি না কি পৃথিবীর সব জায়গায় গিয়েছেন। ভূত সমাজে তার আসা যাওয়া আছে কি না এ বিষয়ে আমার জানা নাই।

কোন ভাবে একটা হাত ছাড়িয়েছি। দাঁত ব্যথা হয়ে গেছে লতাপাতা কামড়াতে কামড়াতে। অবশেষে দু’হাত ছাড়িয়েছি। টারজেন এর মত দোল খাচ্ছি লতাপাতা ধরে। উদ্দেশ্য যে করেই হোক পাশের মোটা গাছের ডালটা ধরেতে হবে। ভীষন রকম ভয় করছে। যদি একবার লাতাপাতা ছিড়ে নিচে পড়ে যাই তবে হাড় হাডি সব ভেঙ্গে যাবে এ বেপারে কোন সন্ধেহ নাই। শরীরের জোর দিয়ে দোল দিচ্ছি। আরো জোরে দিলাম। আরো জোরে। হঠাৎ করে মটমট করে শব্দ হওয়া শুরু হলো। ও আল্লাহ না! নাহ, এ হতে পারে না! লতাপাতা ছিড়ে গেছে! আমি নিচে পড়ছি। ও আল্লাহ গো! ও….ও…ও..! উপপসসস!

চোখ খুলতেই দেখি আমি মাটি থেকে ঠিক তিরিশ চল্লিশ হাত উপরে। ঘসঘসে কোন কিছুর উপর চিত হয়ে শুয়ে আছি। বেশ নরম বিছনার মত লাগছে। আহঃ! একটু আরাম বোধ করছি। জীবন এর উপর কমতো আর ধকল গেলো না। চোখ বন্ধ করে একটু ঘুমিয়ে নেই। পেট ভরা থাকলে ভাল হতো। খালি পেটে আমার আবার ঘুম আসে না। তাও চোখ বন্ধ করে যদূর জিরিয়ে নেয়া যায়।

আমি বেশ ঘুমের ঘোরে। হঠাৎ ঘুমের মধ্যে মনে হচ্ছে কে যেনো জিহ্বা দিয়ে শরীর চাটতেছে। আমি ঘুমের মধ্যেই হাত দিয়ে কয়েক বার সরিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। আবারো একই অবস্থা। ঘুম চোখে একবার তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। আচ্ছা আমি কি দেখলাম! একটা বিরাট বড় ভাল্লুক এর মাথা। কি দেখছি আমি! এক লাফে উঠে দাঁড়ালাম। হে আল্লাহ এইটাই কি দেখার বাদ রাখছিলা! ভাল্লুকটা এতোটাই বড় যে আমি তার পেটের উপরে দিবি ঘুম দিয়েছিলাম। এখন কি হবে আমার! শেষমেষ এখন ভাল্লুকের পেটের খাবার হবো। নাহঃ আমি আর পারলাম না! এইবার কেঁদে দিলাম। এ জীবন আমার আর ভাললাগে না। ভাল্লুক তুই হা কর! আমি নিজেই তোর পেটে চলে যাবো। আমার আর বাঁচার ইচ্ছে নাই।

আমি ভাল্লুক এর পেটের উপর দাঁড়িয়ে কাঁদছি। ভাল্লুকটা হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর তাকানো দেখে মনে হচ্ছে অসহায় কোন ভূত মহা বিপদে পড়ে ওর এতো বড় পেটের উপর এসে পড়েছে। আমি কান্না থামিয়ে দিয়ে ভাল্লুক এর দিকে তাকিয়ে রইলাম। বুকের ভীতরটা ধূকধূক করছে। জানি না কখন আমার উপর হামলা করে বসে। যদিও ওকে খুব শান্তই দেখাচ্ছে।তবুও বোবা প্রাণীর বিশ্বাস নেই, কখন কি করে বসে বলা যায় না। বেশ কিছুখন নিরবতা চলছে। আমি নেংটা হয়ে মূতির মত দাঁড়িয়ে আছি। ছোট বেলায় স্পিং এর বিছানা পেলে ওটার উপর খুব লাফালাফি করতাম। ওর এই নরম পেট এর উপর কিছুখন লাফাতে পারলে ভাল লাগতো। যাক, ভাল্লুকটা মাথা কাত করে শুয়ে পড়লো। পেটে মনে হয় ভরা। সবাই কি আর আমার মত না খেয়ে আছে। ওরে, আবার দেখি গথগথ করে নাকও ডাকছে। যাক, বেঁচে গেলাম মনে হয় এ যাএায়।

আমি জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে নেংটা হয়ে হাঁটছি। সারাটা শরীর এ ব্যথা। পেটটা ক্ষুধায় চো চো করে উঠছে । কোথায় যাব? কি করবো? কিছুই বুঝতেছি না। সত্যিই আমি আজ দিশেহারা। হেঁটে চলার মত আর শক্তি পাচ্ছি না। হয়ত ভূত সমাজের এই গহীন জঙ্গলেই আমার মৃত্যু হবে। বন্য প্রাণী গুলা আমার মৃত্য দেহটাকে খেয়ে ফেলবে। কেউ জানতে পারবে না আমি কোথায় হারিয়েছি। বেঁচে আছি না মরে গেছি। আহ! জীবনে কত স্বপ্ন ছিলো। সব শেষ হয়ে গেলো। আমি আর শরীরটা চালিয়ে নিতে পারলাম না। কাত হয়ে মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

জ্ঞান ফির দেখি ভূতের দুইটা ছোট্ট বাচ্চা আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চট করে আশেপাশে তাকালাম। নাহ আর কেউ নেই। কিন্তু এ দু’টো আসলো কোথা থেকে। আমি এখনও মাটিতে শুয়ে আছি। বাচ্চা দু’টো চুল পরিমান নড়ছে না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই হঠাৎ করে দুই’টা মিলে এক সাথে আমার মুখের উপর পেশাব করা শুরু করলো। ইসসসস! এ কি হচ্ছে! এতো দেখি ভারি অসভ্য। আমি উঠে দাঁড়াতেই দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেলো। মেজাজটা চরম খারাপ হওয়ার অবস্থা। যা ইচ্ছা তাই হচ্ছে আমার সাথে। যে করেই হোক এখান থেকে বের হতেই হবে। ভূত সমাজ নিলজ্জ এক জাতিতে পরিনত হয়েছে। ছোট ভূতের বাচ্চা গুলা অবস্থাও একই রকম।

আসে পাশেই হয়তো ভূতরা আছে। সাবধানে থাকতে হবে। আমি আবার হাঁটা ধরলাম। মারাত্মক ক্ষুধা লাগছে। শরীর এ আর চলার মত শক্তি পাচ্ছি না। কোথায় যাচ্ছি তাও জানি না। আমি পাগলের মত এ দিক ও দিক ছুঁটতে থাকলাম। বেশ কিছু দূর হাঁটার পর চোখে পড়লো ভূত সমাজ। আমি ঝোপ এর আড়ালে লুকিয়ে আছি। আশপাশটা ভাল করে দেখে নিচ্ছি। বেশ ভয় করছে। না জানি কখন যেনো পেছন থেকে খপ করে ধরে ফেলে। আমার আর কিছুই ভাল লাগছে না। হঠাৎ নাকে খাবার এর গন্ধ ভেসে এলো। আমি খাবার খুঁজতে শুরু করলাম। মনে হয় ভূত সমাজের কোন পরিবারে রান্না হচ্ছে। ঝোপ থাকে বেরিয়ে গেরিলাদের মত এগিয়ে যাচ্ছি। কোন এক ভূতের ঘরের পেছনে লুকিয়ে পড়লাম। দরজাটা আসতে করে সরাতেই দেখি বেশ কিছু খাবার।

আমি আবার চারপাশটা খুব ভাল করে দেখে নিলাম। যে করেই হোক ভূতের খাবার চুরি করতে হবে। আমি আসতে আসতে চোরের মত ঘরে ঢুকলাম। ভূতের ছোট একটা বাচ্চা ঘরের ভেতর ঘুমিয়ে আছে। আমি দাঁড়িয়ে পরলাম। বাচ্চাটার অনেক কাছে চলে এসেছি। কি সুন্দর করে ঘুমোচ্ছে! ছোট বাচ্চা দেখলে আমার অনেক ভাল লাগে। এরা অনেক পবিত্র হয়। এদের শরীর আর চেহার থেকে কেমন যেনো একটা স্বর্গীয় আভা ছড়ায়। খুব ইচ্ছে করছে বাচ্চাটা কোলে নিয়ে আদর করতে। অনেক ইচ্ছে ছিলো জয়া আর আমার সংসারে দুইটা ফুঁটফুঁটে বাচ্চ হবে। সারাদিন বাবা বাবা বলে ডাকবে। বাবা হওয়ার স্বপ্নটা আর হলো না। হয়ত ভূতের বাচ্চা গুলাই একদিন আমাকে বাবা বাবা বলে ডাকবে, কে জানে!

কথায় বলে জঙ্গল এই না কি মঙ্গল! আমিও সেই মঙ্গলেই আছি। রাতের বেলা পাহাড় এর গুহায় ঘুমাই আর দিনের বেলায় ভূতের খাবার চুরি করে খাই। বাহ! ভালই একটা জীবন কাটাছি। আজ কতটা দিন হয়ে গেলো আমি এখানে। জানি না পৃথিবীর কি অবস্থা। কোন রেডিও টিভি নাই এখানে তাই খবর নেবারও কোন সুযোগ ও নাই। আজ আবার খাবার চুরি করতে যাচ্ছি। আপাতত আমি চোর হলেও আমি কিন্তু খারাপ না। খাবার চুরি করা ছাড়া আমি আর কিছু চুরি করি না। চোর হলেও আমি বেশ ঈমানদার। আমার আবার নীতিও খুব ভাল। রোজ এক বাড়িতে খাবার চুরি করি না। একেক দিন একেক বাড়িতে।

ঘুরতে ঘুরতে আমি চলে এলাম আমার হবু শ্বশুর বাড়িতে। ভাবছি আজ এ বাড়িতেই খাবার চুরির কাজটা সেরে ফেলি। ঝোপের ভেতর থেকে ভাল করে নজর রাখছি কার অবস্থান কোথায়। বাড়ির ভিতরটায় তেমন কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। মনে হয় কেউ নাই। তাছাড়া এই সময়টায় ভূতের বাড়ি গুলাতে তেমন কেউ থাকেও না। মনে হয় সবাই চাকুরীজীবি। আমি এক পা দু’পা করে এগিয়ে গেলাম। প্রথম ঘরটায় কোন খাবার নাই। দ্বিতীয় ঘরে গেলাম। ওই ঘরেও নাই। বেপারটা কি! হবু শ্বশুর বাড়ির লোকজন কি না খেয়ে থাকে না কি। আরেকটা ঘর বাদ আছে। দেখিতো ওই ঘরে রেখেছে কি না! আমি তৃতীয় ঘরে ঢুকে পড়লাম। হ্যে, এখানেই খাবার রাখা। আমি হাত দু’টো এগিয়ে খাবার নিতে যাচ্ছি। এমন সময় পেছন থেকে কে যেনো দিলো এক চিৎকার। এই কে আপনি? আমি চুপ করে আছি। কাজ সেরেছে আজ! ধরা খেয়ে গেছি। জীবন শেষ আমার আজ। হায়রে কপাল আমার। একটু খাবার চুরি করে খাই তাতেও শান্তি নাই। আমি পেছনে না তাকিয়েই বললাম। আমি.! মানুষ।

কথাটা বলার সাথে সাথেই কে যেনো ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। মনে হয় এই সেই পেত্নী হারামজাদী যে আমার মত নিঃপাপ একটা মানুষকে জোর করে বিয়ে করতে চেয়েছিলো। আমিও খাবার হাতে নিয়ে দৌড় দিয়ে জঙ্গলে পালিয়ে গেলাম। নাহ! জঙ্গলে থাকা যাবে না আর। পেত্নী যদি বলে দেয় সে তার হারানো হবু জামাই’কে আজ দেখেছে তবে পুরো ভূত সমাজ আমাকে আবার খুঁজবে। তার চেয়ে এই ভাল আমি পাহাড় এর গুহায় চলে যাই।

হাতটা গাছের পাতা দিয়ে মুছে খেতে বসলাম। বাহ! খাবারটা তো বেশ মজার। পেত্নী মনে হয় নিজ হাতে রান্না করেছে। বেশি খাবার চুরি করতে পারিনি। যাক যেটুকু হয়েছে তাতেই যথেষ্ট। পেত্নীটা ওভাবে দৌড় দিলো কেনও সেটাই মাথায় ঢুকতেছে না। মনে হয় হবু জামাইকে নেংটা দেখে লজ্জা পেয়েছে। ভুল হয়ে গেলো একটা। মাথা ঘুরিয়ে একবার এর জন্য হলেও পেত্নীটাকে দেখা উচিত ছিলো। তবে যাই বলি, পেত্নীর গলার আওয়াজটা হাতের রান্না থেকেও অনেক ভাল। আওয়াজটা এখনও কানে বাজতেছে।

খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসতেছে না। আবার উঠে বসলাম। এখন দিন না কি রাত তাও জানি না। গুহার এক পাশে বসে পাথর এর সাথে ঢেলান দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আকাশ দেখছি। কত দিন হলো চাঁদ দেখা হয় না। জীবন থেকে সব কিছুই কি ভাবে যেন হারিয়ে গেলো। কোন এক অজানা বিষাদ এ মনটা ভর করে বসলো। কতটা দিন হয়ে গলো কারো সাথে কোন যোগাযোগ নেই আমার। জয়া’র কথা খুব মনে পড়ছে। হয়ত বিষের বোতলের মুখটাও খুলে ফেলেছে এতো দিনে। হয়ত বিষ খেয়েও ফেলেছে। যে আমি একটা দিন ওর সাথে কথা না বলে থাকতে পারতাম না সেই আমি আজ দিনের পর দিন কথা না বলেই দিন পার করি। হয়ত দূরে গেলেই বোঝা যায় কে কার কতটা আপন ছিলাম। হয়তো জয়াও বুঝতেছে।

আজ খাবার চুরি করেছি অন্য এক বাড়িতে। হবু শ্বশুর বাড়ি আর যাওয়া যাবে না। কাল যে দৌড়ানি খেয়েছি আর যাবার সখ নেই। করার মত কোন কাজ নেই আমার। তাই ভাবছি ঝোপের মাঝে লুকিয়ে থেকে পেত্নীটা কে একবার দেখলে কেমন হয়! এতো দিন হয়ে গেলো অথচ পেত্নীর দেখা পেলাম না তা তো হতে পারে না। আমি ঝোপের মধ্য লুকিয়ে আছি। এখান থেকে স্পষ্ট সব দেখা যায়। চোখ এদিক ওদিক ঘোরাতেই দেখি আমার হবু শ্বশুর আব্বা কাপড় ধুচ্ছেন। আহারে বেচারা! এমন দরজাল বউ থাকলে কাপড় কেনো বাড়ির সব কাজই করা লাগবে।

গতকাল অনেকখন বসে থেকেও পেত্নীর দেখা পেলাম না। তাই আজ আবার বসে আছি। অনেকটা সময় হয়ে গেলো। শুধু হবু শ্বশুর আব্বা কেই দেখা যাচ্ছে। বাড়ির যত কাজ আছে সে দেখছি নিজেই সব করে। ঘর জামাই না কি। একটু দূরে চোখ দিতেই দেখি অন্যান ভূত গুলাও আমার শ্বশুর আব্বার মত ঘরের সব কাজ করছে। এ কি সর্বনাশ! তার মানে হলো ভূত মানেই ঘর জামাই! বাড়ির সব কাজ ভূত করবে আর পেত্নীরা উড়ে উড়ে বেড়াবে! ভাগ্য ভালো মনুষ্য সমাজের মেয়ে’রা এই ঘটনা জানে না। জানলে তারাও দলে দলে পেত্নী হয়ে মানুষ গুলাকে ভূত বানিয়ে ঘর জামাই করে রাখতো।

হঠাৎ আমার হবু শ্বশুর আব্বার মতিগতি ভাল ঠেকলো না। বার বার এদিক ওদিক তাকাছে। মতলবটা কি! এমন করছে কেনো! হাতের কাজ সব ফেলে রেখে কোথায় যেনো যাচ্ছে আর বার বার পেছনের দিকে তাকাছে। বেপারটা তো বেশ সন্দেহ জনক। নাহ! দেখা উচিত হবু শ্বশুর আব্বা যাচ্ছে কোথায়। আমি পিছু নিলাম। ঝোপঝাড় এর মধ্যে দিয়ে হবু শ্বশুর আব্বার দিকে নজরদারি করছি। ঘটনা এখনও বুঝতেছি না। এমন চোরের মত করে যাচ্ছে কোথায়! হবু শ্বশুর আব্বা এবার রাস্তা রেখে ঝোপের মধ্যে দিয়ে হাঁটছেন। আমার মাথাটা ঘুরপাক খাচ্ছে। ঘটনাটা তো কিছুই বুঝতেছি না। আমার হবু শ্বশুর আব্বা যাচ্ছে কোথায়?

ঝোপের মধ্যে কিছুখন পরপর হবু শ্বশুর আব্বা উট পাখির মত মাথা উচু করে এদিক ওদিক তাকাছে আবার সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি বেশ চিন্তিত! কেনও এমন করছে কিছুই মাথায় আসছে না। আমিও নাছড় বান্দা। যে করেই হোক দেখেই ছাড়বো হবু শ্বশুর আব্বার মতলবটা কি। হবু শ্বশুর আব্বা এক পা আগায় আমি দু’পা আগাই। আমি দু’পা আগাই হবু শ্বশুর আব্বা এক পা আগায়। এভাবে চলতে থাকলো অনেকটা সময়। ঝোপটা ঠিক শেষ প্রান্তেই ছিলো একটা বয়ে চলা ছোট নদী। নদীর খুব কাছের একটা ছোট্ট ঝোপের মধ্যে হবু শ্বশুর আব্বা লুকিয়ে পড়লেন। আমিও তার পাশের ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়লাম।

আগের দিনে গ্রাম অঞ্চল গুলোতে টয়লেট করার একমাএ ভাল ব্যবস্থা ছিলো ঝোপঝাড় আর নদীর পাড়। ছিঃ হবু শ্বশুর আব্বার এই সব কর্ম কান্ড দেখতে কষ্ট করে এতো দূর এলাম। ধ্যাত! আমি উঠে চলে আসতে লাগলাম এমন সময় হঠাৎ দেখি হবু শ্বশুর আব্বা দু’হাত দিয়ে ঝোপটা আসতে আসতে সরিয়ে কি যেনো দেখার চেষ্টা করছেন। উহুম! কাহিনী তো অন্য কিছু। আমি আসতে আসতে আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলাম। হবু শ্বশুর আব্বার মুখে রোমান্টিক হাসি আর আমার মাথায় চিন্তার রেশ। মাথা উচু করে নদীর পাড়ে তাকাতেই দেখি বেশ কিছু যুবতি পেত্নী গোসল করতেছে। আচ্ছা! তাহলে এই কাহিনী!

আমার পেট ফেটে হাসি আসতেছে। হি হি হি… হা হা হা… কোন ভাবেই হাসি থামাতে পারছি না। হি হি হি হাসতে হাসতে কিছুটা সময় মাটিতে গড়াগড়ি খেতে পারলে ভাল হতো। দু’হাত দিয়ে মুখটা শক্ত করে চেপে ধরে হাসি আটকাবার অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কোন ভাবেই শব্দ করা যাবে না। হবু শ্বশুর আব্বার এই রোমান্টিক মুহূর্তে আমি কোন ভাবেই তাকে বিরক্ত করতে চাই না। আহা! তার হাসি মুখটা দেখে আমারও যে ভীষন হাসি পাচ্ছে। বুড়া ভূতরাও যে এমন করতে পারে তা জানা ছিলো না। হবু শ্বশুর আব্বা মাটিতে বসে খুব তৃপ্তি সহকারে ঝোপ এর আড়াল থেকে পেত্নীদের গোসল করা দেখতেছে। আর আমি হবু শ্বশুর আব্বার রোমান্স দেখতেছি।

আজ দু’দিন ধরে হন্যে হয়ে প্যান্ট খুঁজতেছি। সার্ট না পাওয়া গেলেও সমস্যা নাই কিন্তু প্যান্টটা পেতেই হবে। আমার জন্ম হয়েছে নেংটা হয়ে এইটা ঠিক। তাই বলে সারা জীবন নেংটা হয়ে থাকবো এইটা তো কোথাও লিখা নাই। তাছাড়া গতকাল রাতে আমার ওইটাতে কি যেন একটা কামড় দিয়েছে। এখন বেশ ব্যথা করছে। নাহ! এভাবে আর নেংটা থাকা যাবে না। প্যান্ট না পেলে আর উপায় নেই। খুঁজতে খু্ঁজতে হাপিয়ে উঠলাম। পুরো ভূত সমাজের কোথাও আমার সার্ট প্যান্ট খুঁজে পেলাম না। এইটা নিশ্চয়ই ওই বদ পেত্নীটার কাজ। হবু জামাই বিয়ের আশর থেকে পালিয়ে গেছে সেই দুঃখে হয়ত আমার সার্ট প্যান্ট বুকে মধ্যে জরিয়ে ধরে রোজ রাতে হু হু করে কাঁদে। অসভ্য পেত্নী একটা।

দেখতে দেখতে মাস দু’এক হয়ে গেলো। আমার বুঝি পৃথিবী আর যাওয়া হবে না। খাবার চুরি করে খাওয়া, পাহাড় এর গুহায় ঘুমিয়ে থাকা আর ভূত সমাজ সারাদিন কি করে এগুলা দেখেই আমার দিন কাটে। এখানে রেডিও নাই টিভিও নাই। নাই কোন ইন্টারনেট কানেকশন। তাই বিনোদন বলতে একমাএ হবু শ্বশুর আব্বা। হবু শ্বশুর আব্বা মানেই ব্যপক বিনোদন। দিনের বেশিরভাগ সময় আমি এখন আমার হবু শ্বশুর আব্বার পেছনে লুকিয়ে থাকি আর বিনোদন নেই। হি হি হি।

রোজকার মত আজও আমি ঝোপের ভিতরে লুকিয়ে আছি। আর আমার হবু শ্বশুর আব্বা পাশের ঝোপে লুকিয়ে লুকিয়ে পেত্নীদের গোসল করা দেখতেছে। মাঝে মাঝে মুচকি হেসে উঠে আর মাথাটা এদিক ওদিক করে পেত্নীদের গোসল করা দেখে। এ এ আমার জন্য এক বিশাল বিনোদন। ভূত সমাজে এই একঘেমি জীবনে হবু শ্বশুর আব্বা যা দিচ্ছেন আমাকে তার মেয়েকে বিয়ের সময় যৌতুক নেয়ার থেকেও মূল্যবান। হঠাৎ ঝোপের একটু দূর থেকে খচমচ আওয়াজ শুনতে পেলাম। কে যেন এদিকেই আসতেছে। আমি সতর্ক হয়ে দৌড় দেবার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলসি। ইইইয়য়য়! সর্বনাশ! আমার হবু শাশুড়ি আম্মা! আজ হবু শ্বশুর আব্বার খবর আছে। আসতে আসতে বিড়াল এর মত পা ফেলে হবু শ্বশুর আব্বার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। এখন খপ করে ধরে ফেলার পালা। বেচারা হবু শ্বশুর আব্বা রোমান্স এ এতোটাই মশগুল যে তার পিছনে যে আমার হবু শাশুড়ি আম্মা দাঁড়িয়ে আছে তার কোন খেয়ালই নাই।

আমার হবু শ্বশুর আব্বা’কে এখন টেনে হিঁছড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি ঝোপের মধ্যে দিয়ে নিজেকে আড়াল করে এগিয়ে যাচ্ছি আর হাসতেছি। অবশেষে তারা বাড়ির ভিতরে ঢুকলো আর শুরু হলো মাইর। আহা সে কি মাইর! হবু শ্বশুর আব্বার আজ কপালটাই খারাপ। বেচারা মাইর খেয়ে হাউমাউ করে কাঁদতেছে। একটু পর আমার হবু শাশুড়ি আম্মার কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। এবার তারা দুই জনই কাঁদছে। স্বামীর চরিএ খারাপ হলে বউ এর কষ্টের শেষ থাকে না। মনুষ্য সমাজেও এমন অনেক হয়ে থাকে।

আজ আমার হবু শাশুড়ি বাড়িতেই আছেন। যদিও এখন পর্যন্ত আমি পেত্নীর দেখা পাইনি। তবে মাঝে মধ্যে তার গলার আওয়াজ শুনি। ভারি মিষ্টি গলা। আমি বাড়ির পেছনে ঢেলান দিয়ে বসে আরাম করছি আর কান পেতে কথা শুনছি। ভূত সমাজে থাকতে থাকতে সাহস বেড়ে গেছে। তাই ঝোপ ছাড় ছেড়ে দিয়ে মাঝে মাঝে এদের মাঝেই লুকিয়ে থাকি।

নাও হা করও, আমি খাওয়াইা দিচ্ছি। আরে নাহ! আমিই খেতে পারবো। কিছু হবে না, নাও তো হা করো। সারাদিন বাড়িতে কত কাজ করো। আমিতো তোমাকে তেমন কোন সাহায্যই করতে পারি না। আরে না। এ আর তেমন কি কাজ। আমি ভূত, তোমার থেকে কিছুটা হলেও আমার শক্তি বেশি তাই কাজ করতে তেমন কোন কষ্ট হয় না। মাঝে মাঝে একটু হাপিয়ে উঠি এই আর কি। বয়স তো আর কম হলে না। তুমি যত যাই বলো। আমি সবি বুঝি। নাও এখন হা করো। তুমি না! একেবারে নাছড় বান্দা।

মনটা খারাপ হয়ে গেলো হবু শ্বশুর আব্বা আর হবু শাশুড়ি আম্মার ভালবাসা দেখে। মনের ভিতরে পুরনো স্বপ্নটা আবার জেগে উঠলো। খুব ইচ্ছা ছিলো জয়া আর আমার শেষ বয়সটা এমন খুনসুটিতেই কেটে যাবে। খুব ভাললাগে শেষ বয়সের এমন ভালবাসা দেখলে। চলে এলাম আবার পাহাড় এর গুহায়। জয়া’র কথা ভাবতে ভাবেত ঘুমিয়ে পড়লাম।

ভূত সমাজে আমার হবু শ্বশুর আব্বার চরিএে কিছুটা সমস্যা থাকলেও তিনি যে যথেষ্ঠ ভাল ঘর জামাই তা আমার এতো দিনে বোঝা হয়ে গেছে। বাকি ভূত গুলাও বেশ ভাল। তাদের সংসার মনুষ্য সমাজের সংসার এর মত এতো ঝামেলার না। পৃথিবীর বুকে সংসার করার চেয়ে ভূত জগৎ এ এসে সংসার করা ভাল। মানুষের চেয়ে ভূতের সংসার অনেক সুখের। হঠাৎ দুই ভূতের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি যে ঘরের পেছনে আজ লুকিয়ে আছি তার ঠিক সামনেই ওরা বসে গল্প করছে। হ্যে রে, ওই পেত্নীটার আর বিয়ে হলো না। তাই না? হ্যে, জামাই না কি পালিয়ে গেছে। শুনেছিলাম জামাই না কি মানুষ ছিলো? হুম, তবে বিয়ের আশর থেকেই পালিয়ে গেছে। তা পালিয়ে গেলো কি করে ? ওই যে বড় পাহাড় এর গুহাটা আছে না। বড় ভাল্লুক এর গুহা! ওই পথ দিয়েই মনুষ্য পৃথিবীতে চলে গেছে।

তার মানে পৃথিবীতে যাবার রাস্তা আছে? ভাল্লুক এর গুহার রাস্তা দিয়েই পৃথিবীতে যেতে হয়! নাহ, আর দেরি করা যাবে না। যে করেই হোক পৃথিবীতে যেতে হবে। আমি দৌড়াতে শুরু করলাম। হঠাৎ মাথায় চিন্তা এলো পৃথিবীতে যাবার আগে পেত্নীর হাতের রান্নাটা আর একবার খেতে পারলে ভাল হত। কোন দিন তো আর আসা হবে না। শেষ বার এর মত না হয় খেয়েই গেলাম। পেত্নী ও খুশি হতো, বিয়ে না করতে পারলেও হবু জামাইকে খাওয়াতে তো পারলো। ঘুম থেকে উঠার পর এখনও আমি কিছু খাইনি। খালি পেটেই দৌড়াচ্ছি। আবার চিন্তা হচ্ছে যদি ধরা খেয়ে যাই তবে আমার আর পৃথিবীতে যাওয়া হবে না।

আমি ভাল্লুক এর গুহায় ঠুকে পরেছি। ভীষন রকম ভয় করছে। ওই দিন ভাল্লুকটার পেট ভরা ছিলো তাই কিছু করেনি। আজও যে তার পেট ভরা থাকবে এমন কোন কথা নাই। চারিদিকটা নিরব নিস্তব্ধ। কোন একটা শব্দ নেই। বুকের ভিতরে ধুকধুক আওয়াজটা স্পষ্টই শুনতে পাচ্ছি। পায়েও চাপে শুকনো গাছের পাতা গুলো মরমর শব্দ করে উঠছে। যতই সামনে এগিয়ে যাচ্ছি ততই ভয় করছে। ঘন হয়ে আসা নিঃশ্বাস ক্রমেই বারছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি দৈত্য আকারের ভাল্লুকটা আমার উপরে এসে পড়বে। ধাঁরালো দু’হাতের নখ দিয়ে ছিড়ে ফেলবে আমার শরীরটাকে। বেশ কিছুটা সামনে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো ঘুটঘুটে অন্ধকার একটা রাস্তা ঠিক দুই পাহাড় এর মাঝখানে। আশেপাশে আরও কোন রাস্তা আছে কি না দেখে নিলাম। নাহ, এই একটাই রাস্তা।

এটাই হয়তো পৃথিবীতে ফিরে যাবার একমাএ রাস্তা যা অন্ধকারের ভয়ংকর রুপ ধারন করেছে। আমার পুরো শরীর ভয়ে জারকাটা দিয়ে উঠলো। খুব সাবধানে পা ফেলে অন্ধকার এই রাস্তায় নিজেকে এগিয়ে দেয়ার চেষ্ট করছি। এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার নিজের শরীরটাও দেখতে পাচ্ছি না। অন্ধকারে হাঁটতে গিয়ে বেশ কয়েক বার নিচু হয়ে থাকা গাছের ডাল শরীর ছুঁতেই চাপ দিয়ে উঠছিলো বুকের মধ্যে। মনে হচ্ছে হৃদপিন্ডটা বুকের ভিতরে আর থাকতে চাইছে না। যতই সামনে আগিয়ে যাচ্ছি ভয়ে আমার ঠোঁট মুখ ততই শুকিয়ে আসতেছে। মনের ভিতরে একটাই প্রশ্ন না জানি সামনে আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে। কথায় বলে মানুষ না কি বাঘের ভয়ে মরে না। মনের ভয়েই মরে। আমারও হয়েছে সেই দশা। আমি মনে হয় এখানেই মাথা ঘুরিয়ে মরে যাব।

আরও বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে গেলাম। চোখের সামনে এই প্রথম অন্ধকারে কুয়াশা দেখতে পাচ্ছি। এটা কুয়াশা না কি ধোয়া ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। অতিরিক্ত চিন্তার কারনে নাক দিয়ে কোন কিছু অনুভব করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। আমি কুয়াশাময় ধোয়া ভেদ করে হেঁটে যাচ্ছি। আর চিন্তা করছি না জানি সামনে কি দেখতে পাই। মাথার ভেতটা ভনভন করছে। জীবনে এই প্রথম এতোটা ভয় পাচ্ছি। আর কোন পথ না পেয়ে দোয়া দুরূদ পড়া শুরু করলাম। হঠাৎ পেছন থেকে ভাল্লুক এর বিকট এক আওয়াজ আমার কান এর পর্দাটাকে চির ধরিয়ে দিলো। আমিও ভয়ে চিৎকার দিয়ে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে দৌড় শুরু করলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে একটা সময় মনে হলো আমি যেনো হাওয়া ভাসতেছি। এর পর আমার আর কোন কিছু মনে নেই।

আমি চোখ দু’টো মেলতে পারছি না। মনে হচ্ছে কে যেন চোখের পাতায় ইট বেঁধে দিসে। তবে নাকের মধ্যে ভেজা কাদামাটির গন্ধ পাচ্ছি। বেশ অনেকখন সময় হয়তো উপুর হয়ে শুয়ে ছিলাম। বুকটা বেশ ব্যথা করছে। কোন রকমে শরীরটাকে চিত করলাম। আমি যে এখন কোথায় আছি আমি নিজেও জানি না। তবে পায়ের কিছুটা অংশ পানিতে ডুবে আছে তা বুঝতে পারছি। অনেক চেষ্টা করে চোখটা খুলতেই চোখের মধ্যে তীব্র আলো এসে পড়লো। আমি ধীরে ধীরে চোখ মেলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। শরীরটা ঘুরিয়ে উঠে বসলাম। চারপাশটা তাকিয়ে দেখি আমি কোন এক নদীর তীরে। মাথার উপরে সূর্য। তবে কি আমি পৃথিবীতে! না কি অন্য কোনও গ্রহে! বলা যায় না, আমার কোন কালে সখ ছিল মঙ্গল গ্রহে যাবার। সেই সখ আবার পুরোন হলো কি না তা কে জানে! আশে পাশে কোন বাড়ি ঘর দেখতে পাচ্ছি না। যদি এটা পৃথিবী না হয়ে অন্য কোন গ্রহ হয় তবে আমি আর এখান। থেকে উঠছি না। এখানেই শুয়ে পড়বো। আমার আর জীবন বাঁচানোর ইচ্ছা নাই।

অনেকটা পথ হেঁটে এলেও এখন পর্যন্ত কোন মানুষ এর বাড়ি ঘরের দেখা পেলাম না। ক্ষুধার যন্ত্রণা কি জিনিস আজ হারে হারে টের পাচ্ছি। আমি আর হাঁটতে পারছি না। বড় ভুল হয়ে গেলো। পেত্নীর হাতের খাবারটা খেয়েই পৃথিবীর উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার দরকার ছিলো। আমি মাটিতে বসে পড়লাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম ট্রেন এর হুইসেল এর আওয়াজ। সাথে সাথেই আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমার চোখ মুখে আনন্দের সীমা নেই। আমি পৃথিবীতে চলে এসেছি। আমি এখন পৃথিবীতে!

স্টেশন এর কাছে যেতেই নিজেকে কেমন যেন অদ্ভুত লাগতে শুরু করলো। মানুষজন কেমন ভাবে যেন আমার দিকে তাকাছে। আমি হাঁটা থামিয়ে দিলাম। ভাবতেছি, সবাই এভাবে আমার দিকে কেন তাকাছে ! ওরাও মানুষ, আমিও মানুষ। না কি ভূত সমাজে থাকতে থাকতে শরীর এর কোন অঙ্গের পরিবর্তন হয়েছে কে জানে। একটা আয়না পেলে ভাল হতো। নিজেকে একবার দেখে নেয়া যেতো। হঠাৎ নিজের পা থেকে শরীর এর বাকি অংশের দিকে তাকাতেই বুঝে গেলাম রহস্য। ইসসসসস! আমি তো ভূলেই গিয়ে ছিলাম আমি ন্যাংটা! এখন কি করি! তবে কি ভূত সমাজের মত মনুষ্য সমাজেও আমি নেংটা হয়ে থাকবো?

আমি অনেকখন ধরে নেংটা হয়ে ইস্টেশনে দাঁরিয়ে আছি আর ভাবছি কি করা যায়। আমি আসলেই ভাবছি। কারন আমাকে ভাবতে হচ্ছে। মাতার চুল গুলো এলোমেলো। মুখটা দাঁড়ি গোঁফ দিয়ে ঢেকে গেছে। সারা শরীরে কাদামাটি। সাথে নাই ম্যানিব্যাগ। মোবাইলা কোথায় তাও জানি না। যাও একটা প্যান্ট সার্ট ছিলো তাও ভূত সমাজ রেখে দিলো। এখন আমি যাবো কোথায় আর খাবোই বা কি! ভূত সমাজে চুরি করে এতো দিন খাবার খেয়েছি। ধরা পড়লে শাস্তি স্বরুপ আমার বিয়ে হতো পেত্নীর সাথে, এর থেকে বেশি কিছু না। কিন্তু মনুুষ্য সমাজে চুরি করে ধরা খেলে আর নিস্তার নাই। এদিকে ক্ষুধায় পুরো পৃথিবী চোখের সামনে ঘুরতেছে। ওদিকে জয়া’কে ও একটা ফোন করা দরকার। কি যে করি কিছুই বুঝতেছি না। এই ময়লা শরীর নিয়ে কোন দোকানের কাছে গেলেও পাগল বলে দৌড়ানি দিবে এতো সন্দেহ নাই।

ইস্টেশন এর শেষ মাথায় ছোট্ট একটা চায়ে’র দোকান এর সামনে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। দোকানের কেক, কলা, পাউরুটি আরও অনেক কিছু ঝুলানো। নিজের অজানতেই ঢোক গিলে ফেলাম কয়েক বার। জীবনে কখনও খাবারের কষ্ট করিনি। খাবারের কষ্ট কি জিনিস আজ টের পাচ্ছি। আজ বুঝতে পারছি অনাহারী মানুষ গুলো কেন খাবারের দোকানের সামনে হা করে দাঁড়িয়ে থাকে। ছোট এই পেটটা ভরাতেই মানুষকে পৃথিবীতে এতো কিছু করতে হয়। পেটের জন্যই হয়ত এই পৃথিবী। হঠাৎ দোকানদার এর চোখে চোখ পড়লো। লোকটা এগিয়ে আসছে আমার দিকেই। এখন মনে হয় পাগল বলে আমাকে তাড়িয়ে দেয়া হবে। মারবে কি না তা জানি না। কি রে এমন নেংটা হইয়া দাঁড়ায়া আছোস কেন? এদিকে আয়, আয় এ দিকে আয়! আমি তার সাথে সাথে দোকানের খুব কাছে চলে গেলাম। নাকে খাবারের গন্ধ আসতেই অবিরাম ঢোক গিলতে শুরু করলাম। পেটের ভেতরটা চো চো শব্দ করে উঠছে।

নেয়, এই লুঙ্গিটা নেয়! এমনে নেংটা হইয়া থাকতে হয় না। মানুষ খারাপ কইবো। ধর, লুঙ্গি পড়! আমার দৃষ্টি লুঙ্গির দিকে না। আমার দৃষ্টি খাবার এর দিকে। ক্ষুধার যন্তনায় পুরো শরীর কেঁপেকেঁপে উঠছে। মনে হচ্ছে না জানি কত বছর ধরে আমি না খেয়ে আছি। লোকটা লুঙ্গি না দিয়ে কিছু খাবার দিলেই পারতো। আমার তো নেংটা হয়ে থাকার অভ্যাস আছে কিন্তু না খেয়ে থাকার অভ্যাস তো নাই। কি হইলো নেয়! লুঙ্গিটা পড়! আইচ্ছা আমি পড়ায়া দিতাছি তোরে।

লোকটা আমার ময়লা শরীরেই নিজ হাতে লুঙ্গিটা পড়িয়ে দিলো। আজ কত দিন পর কাপড় পড়লাম নিজেও জানি না। অবশেষে খাবারও দিলো। আমি পাউরুটি, কলা আর চা দিয়ে পেটটা ভরে ফেললাম। নিজেও জানি না শরীর এর ক্লান্তিতে কখন যে দোকানের পাশে ঘুৃমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙ্গলো চায়ের দোকানে বসে থাকা কিছু মানুষের কথাবার্তায়। পাগলটা আর শোয়ার জায়গা পেলো না এমন হাজারও তিরস্কার মূলক কথা শুনতে পাচ্ছি এখনও। মানুষ পাগল হলে তার কোন মানসম্মত থাকতে নাই। আমিও এখন পাগলের মতই। তাই আমারও এখন কোন কথা গায়ে লাগানো চলবে না। আমি কোন কালেই লুঙ্গি পড়ি নাই। কারন ছিল একটাই। আমি লুঙ্গি পড়তে পারতাম না। খালি খুলে যেত। তাই শোয়া থেকে উঠতেই দেখি পড়নের লুঙ্গিটা কয়েক হাত দূরে পড়ে আছে।

এখন রাত! তবে কয়টা বাজে আমার জানা নাই। লোকাল ট্রেন ছাড়া এখন পর্যন্ত কোন দূরপাল্লার ট্রেন থামতে দেখিনি। তাছাড়া ইস্টেশনটা এমনিতেও জন শূন্য। মানুষের পকেটে যখন টাকা থাকে না তখন না কি ঘনঘন ক্ষুধা পায়। আমার অবস্থা তো আরও খারাপ! আমার প্যান্টও নাই, পকেটও নাই। তাই ক্ষুধার পরিমানটাও বেশি।

আহারে! আবার নেংটা হইয়া বইসা আসছ! তরে না লুঙ্গি দিলাম। আইচ্ছা ঠিক আছে, কাল তরে প্যান্ট কিনা দিমু নি। অহন নেয়, ভাত কয়টা খাইয়া নেয়।

আমি লোকটার দিকে হা করে তাকিয়ে আছি। পাগল আর অসহায় মানুষের প্রতি কারও এমন ভালবাসা থাকতে পারে আমার জানা ছিলো না। অচেনা অজানা নিঃস্ব একটা মানুষের প্রতি ভালবাসা দেখাতে হলে হয়তো জানার প্রয়োজন হয় না এতো কিছুর। শুধু এতোটুকু জানলেই হয়। সে একজন মানুষ। কিরে খা! আরে তরে বাসি পচা খাওন দেইনাই তো! বাড়ি থেইকা তর লাইগা খাওন আনাইছি। বিশ্বাস হয় না? আইচ্ছা এই দেখ আমি খাইতাছি।

কথাটা বলেই লোকটা আমার ভাতের প্লেট থেকে এক নলা ভাত খেয়ে নিলেন। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করলো। সত্যিই আমি কখনও জানতাম না একটা নিঃস্ব মানুষের প্রতি কারও এতোটা ভালবাসা থাকতে পারে। কয়জন মানুষ পারে একজন পাগলের খাবার এর প্লেট থেকে খাবার খেয়ে বুঝিয়ে দিতে খাবার গুলো ভাল! তুমি খেতে পারও।

আমি হাত ধুয়ে খাওয়া শুরু করলাম। লোকটাও খাচ্ছে টং এর দোকানে বসে আর একা একাই আমার সাথে কথা বলছে। এক পর্যায় জানতে পারলাম তার নাম গফুঁর মিয়া। স্বামীস্ত্রী দু’জনের সংসার। বয়স গড়িয়েছে পঞ্চাশ এর কাছে। বাচ্চা কাচ্চা আজও হয়নি আর হবেও না। চা এর এই টং দোকান আর মাথা গোজার ছোট একটা টিনের ঘর ছাড়া তার আর কিছু নাই। পৃথিবীতে অতি ভাল মানুষ গুলার এমনই হয়। এদের সৃষ্টিকর্তা তেমন কোন কিছুই দেন না। একেবারে নিঃস্ব করে রাখেন যাতে প্রতিনিয়ত সৃষ্টিকর্তাকে স্মরন করেন। আর সৃষ্টিকর্তাও এদেরই খুব কাছে থাকেন। মানুষ আমরা কিছু হলেই সৃষ্টিকর্তার দোষ দেই। কিন্তু এইটা বুঝতে চাই না, যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি সব সময় চান সৃষ্টির সাথে থাকতে। অথচ আমরা যা পাই তা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে যাই। তাই সয়ং সৃষ্টিকর্তা নিজেই দায়িত্ব নিয়েছেন তার সৃষ্টিকে অল্প কিছু দেবেন যাতে করে আমরা তাঁকে ভুলে না গিয়ে সবটা সময় স্মরণ করি। রাতের খাবারের পর দোকানটা পাশেই ঘুমিয়ে পড়ে ছিলাম। সকাল এ ঘুম ভাঙ্গে গফুঁর মিয়ার ডাকা ডাকিতেই। কি রে আর কত ঘুমাবি! উঠ!

আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি গফুঁর মিয়া নাস্তা নিয়ে এসেছে। তার হাতে একটা সার্ট আর একটা প্যান্টও দেখতে পাচ্ছি। লোকটা আসলেই খুব ভালও। আমি লুঙ্গি পড়তে পারিনা সে হয়তো বুঝতে পেরেছে। এমন মানুষ এই পৃথিবীর জন্য মানানসই না। পৃথিবীতে মানুষ হবে নিষ্ঠুর। কাঠের মত শক্ত। তাহলেই কিছু করা সম্ভব। তা না হলে গফুঁর মিয়ার মত ইস্টেশনে চা বিক্রি করতে হবে।

এখন পর্যন্ত আমি মুখে কোন কথা বলি নাই। তাছাড়া কথা বলার প্রয়োজন ও হয় নাই। দোকান এর জন্য নতুন খাবার কেনার টাকা হিসাব করছেন গফুঁর মিয়া। আমি সামনে এগিয়ে গেলাম। একহাজার টাকার একটা লাল নোট তার হাত থেকে নিয়ে হাঁটা ধরলাম। গফুঁর মিয়া হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তার কিনে দেয়া সার্ট আর প্যান্ট পড়ে ট্রেনে উঠে বসলাম। লোকটা এখনও এক দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। হয়ত ভাবছে কার জন্য এতো কিছু করলাম! হয়ত ভাবছে পৃথিবীতে মানুষ মানেই স্বার্থপর! স্বার্থের প্রয়োজনে গফুঁর মিয়া নামের লোকটার কাছে কেউ একজন এসেছিলো। প্রয়োজন শেষ, এখন চলে যাচ্ছে। যা খুশি ভাবুক! আমাকে যেতেই হবে। জয়া’র চিন্তায় আমার আর কোন কিছুই ভাল লাগছে না। যত তারাতারি সম্ভব ওর সাথে যোগাযোগ করতে হবে। না জানি মেয়েটার কি অবস্থা!

ট্রেন চলছে। আমি জানালার পাশে মাথাটা কাত করে দিলাম। আজ কত দিন পর বাড়ি ফিরছি নিজেরও জানা নাই। তবে এটা জানি পাগলী মেয়েটা আমাকে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে দিবে। কোন এক সময় ভালবাসা হারিয়ে গেলে আর সে ভালবাসা কোন এক দিন ফিরে এলে মনে হয় আত্মাটা এতো দিন শরীর এর বাহিরে ছিল। আজ অনেক দিন পর জয়া কে দেখবো। আজ আমি আবার আমার নিজের পৃথিবীতে ফিরবো। যেখানে শুধু জয়া আর আমি!

বাড়িতে ফিরতেই কাঁন্নার উৎসব শুরু হলো। যে যার মত কাঁদতেছে। সবার কান্নার আওয়াজ অবশ্য এক রকম না। কার কান্নার আওয়াজ মোটা কারো বা চিকন। খুব সম্ভবতো গলার আওয়াজ এর উপর কান্নার আওয়াজ নিরভর করে। যদিও এ বেপারে আমার তেমন কোন ধারনা নাই। নিজের ঘরে যেতেই দেখি আমার ঘরের দরজাটা ভাঙ্গা। পরে জানতে পারলাম বেলা গড়িয়ে রাত হলেও যখন আমি দরজা খুলছিলাম না আর কারও কোন ডাকাডাকিতে সাড়াও দিচ্ছিলাম না তখন দরজা ভাঙ্গার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। কিন্তু ঘরে ঢুকতেই দেখে আমি নেই। আমার ঘর থেকে এই দরজা ছাড়া বের হওয়ার কোন রাস্তা নেই। বালিশের পাশে মোবাইল ছিল। আর সব কিছু যেভাবে থাকার ওভাবেই ছিল। শুধু ছিলাম না আমি। তাই খুব সহজেই বাড়ির সবাইকে বিশ্বাস করাতে পারলাম আমি এতো দিন ভূত সমাজে ছিলাম।

হাতে মোবাইল পেয়েই জয়া কে কল করলাম। কিন্তু কল যাচ্ছে না। আমি বেশ কয়েকবার কল করলাম। নাহ! মোবাইলতো বন্ধ! তবে কি ও আমাকে না পেয়ে এতো দিনে আত্মহত্যা করে ফেলছে? না না এ হতে পারে না। ও আমার সম্পূর্ণ পৃথিবী। ওকে ছাড়া আমি অন্ধ। আমার পুরো পৃথিবী অন্ধ। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে দু’চার জন বন্ধুকে কল করলাম। যে করেই হোক জয়া’র খোঁজ নিতে হবে। আমার সারা হাত পা কাঁপছে। চিন্তায় কপালের ঘাম গুলো টপটপ করে পড়ছে।

কি রে তোদের এতো সময় লাগে আসতে? কই দেরি করলাম! তোর ফোন পেয়েই তো সাথে এলাম। দোস্ত তুই এতো দিন কই ছিলি? সে গুলা পরে শুনিস। জয়া কই? ওর ফোন বন্ধ পাচ্ছি। যে করেই হোক ওর সাথে যোগাযোগ করতে হবে। ও যেই সেন্টিমেন্টাল মেয়ে। না জানি ওর কি অবস্থা। হবে সব হবে। তুই এতো দিন পর আসছিস আজ। রেস্ট নেয়। তারপর সব শুনিস। দেখ ভনিতা ভাল লাগতেছে না। জয়া’র কি হইছে সেটা বল। জয়া কই? ওর মোবাইল কেনো বন্ধ? ওর বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ে হয়ে গেছে? মানে কি?

জয়া’র বিয়ে হয়ে গেছে এই কথাটা শুনে যতটা যতটা না খারাপ লাগছে তার চেয়ে বেশি খারাপ লাগছে যখন শুনলাম জয়া না কি প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করছে। এ নিয়ে না কি ওর পরিবারে এখনও অনেক ঝামেলা চলছে। আমি পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়ার দিন কয়েক পরের না কি জয়া অন্য এক ছেলের সাথে সম্পর্কে জরিয়ে পরে। এই নিয়ে আজ তৃতীয় বার আমি আমার পায়ের নিজে মাটি খুঁজে পাচ্ছি না। জয়া কি সত্যিই এমন কিছু করতে পেরেছে! বন্ধুদের বার বার জিজ্ঞেস করলাম। আমাদের সম্পর্কটার কথা আশে পাশে সবাই জানতো। খবরটা যে সত্যি তা বুঝতে আর বাকি রইলো না।

মাথার উপর এর বিশাল আকাশটা যেন খুব ছোট হয়ে গেলো। এলোমেলো ভাবনা গুলো বিশ্বাস নামের দেয়ালটাকে যেন ক্রমেই ভেঙ্গে চলছে। কিছুতেই নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছি না জয়া এমন একটা কাজ করতে পারে। কি করি নাই আমি ওর জন্য! ওর ওই মায়া ভরা মুখটার দিকে তাকালে স্বর্গ দেখার ইচ্ছে হতো না আমার। তাকেই তো পৃথিবীর সবটুকু উজার করে ভালবেসে ছিলাম। শুধু নিজের হাতে বুকটা চিড়ে কলিজাটা বের করে ওকে খাওয়াই নি। আর কি আমি করিনি। বলে ছিলাম কখনও আমি তোমার জন্য বৃষ্টিতে ভিজতে পারবো না। কখনও তোমার জন্য রোদে পুঁড়তে পরবো না। কিন্তু আমি তো সবই করেছিলাম। বাড়িতে একটা পোষা কুকুর থাকলে সে হঠাৎ হারিয়ে গেলে তার জন্য কয়েকটা দিন হলেও মায়া হয়। আর আমি তো ভালবাসার মানুষ ছিলাম! আমার জন্য কি এতো টুকু মায়া ছিলো না! কি করে পারলো এতো গুলা বছরের ভালবাসা দু’দিনেই ভুলে যেতে!
তবে কি সবই ছিলো মিথ্যে!

ভূত সমাজ থেকে কতটা কষ্টে নিজের জীবন এর মায়া ত্যাগ করে পৃথিবীতে এসে ছিলাম তা আমি ছাড়া কেউ জানে না। কার জন্য এসেছিলাম! এমন হাজারটা প্রশ্ন উকি দিচ্ছে মনের ভিতর। জয়া’র কিছু কথা কানে বাঁজতেছে খুব। মেয়েটা চিৎকার করে কেঁদে দিয়ে প্রায়ই বলতো আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। হয়তো পৃথিবীতে চিরন্তন মিথ্যে কথা এটাই, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। আমার মাথা ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে হয় বমি করে দিবো। রাস্তার পাশের একটা গাছে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম। সব শেষ হয়ে গেলো আমার। নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলাম না। হাউমাউ করে কেঁদে মাটিতে গড়াগড়ি শুরু করলাম। এতোটা জোরে চিৎকার করেও যেন বুকের ভিতরে জ্বলে উঠা আগুনটা নেভাতে পারছি না। এ কি হলো আমার সাথে! কেন এমন হলো! কি পাপ করে ছিলাম আমি! যে মানুষটাকে কোন দিন সন্দেহ করি নাই, যাকে অন্ধের মত বিশ্বাস করতাম আর সেই মানুষটা আমার জীবনটাকে এভাবে শেষ করে দিলো! আমি এখন কাকে নিয়ে বাঁচবো? ও ছাড়া তো আমার কেউ ছিলো না! তবে কি অন্ধের মত সবটুকু উজার করে ভালবাসার নামই পাপ!

আমি আজ দ্বিতীয় বার এর মত নেংটা হয়ে হাঁটছি। আমার সারা শরীর এ ধূল্যো ময়লা। আমি হাঁটছি আর হাঁটছি। জানি না কোথায় যাচ্ছি। এই পৃথিবীটা এখন আর আমার না। আর কখনই আমার হবে না। কারন আমি আর কখনই কাউকে বিশ্বাস করতে পারবো না। আর যেখানে আমি কাউকেই বিশ্বাস করতে পারবো না সেখানে আমি থাকতেও চাই না। তবে আফসোস একটাই, যে কয়টা দিন বাঁচবো বেঁচে থাকতে হবে এক বুক যন্তনা আর হাজারটা প্রশ্ন নিয়ে।
আজ আমার আর নেংটা হয়ে হাঁটতে লজ্জা করছে না। কে আমাকে দেখে কি ভাবছে সে দিকেও আমার কোন দৃষ্টি নেই। মানুষের ভীর ঠেলে আমি নেংটা হয়ে হেঁটে যাচ্ছি। এই কয়টা দিন পাগলেও মত অভিনয় করলেও আজ জীবন আমাকে সত্যিকারের পাগল হবার সুযোগ করে দিয়েছে। তার মানে আজ থেকে আমি নেংটা পাগল। আচ্ছা, আমি এখন যাব কোথায়?

আমি আবারও নেংটা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি গফু্ঁর মিয়ার চায়ের দোকানের সামনে। গফুঁর মিয়া মনযোগ দিয়ে চা বানাছেন। আজও আমি বেশ ক্ষুধার্ত। হঠাৎ করেই চা বানাতে গিয়ে আমাকে চোখে পড়লো। টং এর দোকান ছেড়ে অবাক দৃষ্টি মেলে আমার কাছে ছুঁটে এলেন। হয়ত তিনি ভেবেই নিয়ে ছিলেন আমি আর কোন দিন ফিরবো না। আমি তো নিজেও জানতাম আমি আবার এখানে আসবো। তবে কষ্ট হচ্ছে এই ভেবে লোকটার এক হাজার টাকা আর সার্ট প্যান্ট গুলা হারিয়ে ফেলেছি। এবার নিশ্চয়ই আর আমাকে জামা কাপড় কিনে দেবে না। হয়ত আমার অনন্ত নেংটা কাল শুরু হবে। কি রে তুই কই গেছিলি রে? আবার নেংটা হয়ে আছে রে! ক দেখি কি জ্বালায় পড়লাম। তর জামা কাপড় কই? হারায় ফালাইসছ? আইচ্ছা আমি আবার কিনা দিমু। আয় এদিকে আয়, আয়!

বুঝিনা এই লোকটা নেংটা মানুষ দেখতে পারে না কেন! যার কিছু নাই সে তো নেংটা হয়েই থাকবে। আমার কিছু নাই তাই আমি নেংটা হয়ে আছি। আর তাছাড়া আমি এখন পাগল। পাগল জামা কাপর পড়লেই কি আর নেংটা হয়ে থাকলেই কি! গফুঁর মিয়া আবারও আমাকে লুঙ্গি পড়িয়ে দিলেন। যদিও বেশিখন শরীরে থাকবে না জানি। আশ্চর্য হয়নি এসব দেখে। আশ্চর্য হয়েছি এই দেখে গফুঁর মিয়া লুকিয়ে চোখের পানি মুছতেছে খসখসে হাতের তালু দিয়ে। কেনো তার চোখে পানি তা জানি না।

আজকাল অনেক রাত করে দোকান বন্ধ করা হয়। মাসখানিক ধরে আমি এই রেল ইস্টেশনেই থাকি। গফু্ঁর মিয়া চোখের আড়াল হতে দেয় না। বড্ড ভাল মানুষ। তবে দোকান খোলা থাকলে আমি বেশ কিছুটা দূরে নিরিবিলিতে একা একা বসে থাকি। গফুঁর মিয়া রেডিও তে গান শুনছেন। মাঝরাত পর্যন্ত দোকান খোলা রাখায় নিশাচর মানুষ গুলা ভীর করে তার দোকানে। আর আমি দূর থেকে চেয়ে চেয়ে দেখি। হঠাৎ করে নাইট গার্ডের মোবাইল বেঁজে উঠতেই মাথাটা কেমন যেন ঝিম ধরে গেলো। মাথাটার ভিতরটায় কি সব চিন্তা ভাবনা যেন এলোপাথাড়ি ছোটাছুটি করছে। আমি দু’হাত দিয়ে মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরলাম। আমার যে বন্ধুর বিয়ের দাওয়াত খেতে গিয়েছিলাম ওর নাইট শিফট এ ডিউটি থাকায় ওর নাম দিয়ে ছিলাম নাইট গার্ড। বিয়ের দাওয়াত সেরে বাড়ি ফিরতেই মোবাইলে কথা বলাম। এক সময় বললাম আমি পেত্নী বিয়ে করবো। আর তখন গাছের উপর বসা ছিলো পেত্নীর বাবা মা। তারপর আমি চলে গেলাম ভূত সমাজে।

আসতে! আসতে! এখানে একটা হিসেব আছে। হিসাবটা মনে হয় এখান থেকেই শুরু। আমি পেত্নীকে বিয়ে করতে চেয়ে ছিলাম। আর তাই পেত্নীর বাবা মা পেত্নীর সাথে আমার বিয়ের আয়োজন করে। হয়ত সে দিন পেত্নী বিয়ের সাঁজে সেঁজে বসে ছিলো। হয়ত ভূত সমাজে মিথ্যা বলে কিছু নেই। আর তাই আমি যে বন্ধুর সাথে মজা করছিলাম পেত্নী বিয়ে করবো তা তার বুঝতে পারেনি। কারও সাথে মিথ্যে বলে যে মজা করা যায় হয়ত ভূত সমাজ এটা জানেই না। হয়ত তারা এটাও জানে না মিথ্যে বলা কি জিনিস। আমরা মানুষ মিথ্যা বলি! আর তার নাম দেই মজা করেছি বা দুষ্টামি করেছি। আসলে আমরা মানুষ এতো বড় বড় অপরাধ করি কারো চোখে হয়ত আমার এই মিথ্যে কথাটাকে অনেক সামান্য মনে হবে। আচ্ছা যদি এমন হতো কেউ আমাকে মিথ্যে করে বলতো আমি তোমাকে বিয়ে করবো আর আমি তাকে বিশ্বাস করে বিয়ের জন্য সব কিছু করলাম। কিন্তু সেই মানুষটা দু’দিন পর হাওয়া হয়ে গেলো তখন আমার কেমন লাগতো?

এমনই তো হয়েছে আমার সাথে। আমি পেত্নীর স্বপ্ন ভেঙ্গেছি। সৃষ্টিকর্তা আমার স্বপ্ন ভেঙ্গেছে। আমি পেত্নীর বিয়ে ভেঙ্গেছি। সৃষ্টিকর্তা আমার বিয়ে ভেঙ্গেছে। আমি পেত্নী কে ছেঁড়ে পালিয়ে গিয়েছি। জয়া আমাকে ছেঁড়ে পালিয়েছে। জয়া কে না পেয়ে আমি যেমন কেঁদেছি হয়ত আমাকে না পেয়ে পেত্নী ও সে দিন কেঁদে ছিলো। পেত্নীর তো কোন দোষ ছিলো না। কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা আর ভালবাসার অধিকার সবারই আছে। মিথ্যে তো আমি বলেছি। আমার মিথ্যা বলার কারনেই পেত্নীর বাবা মা আমাকে নিয়ে গিয়ে ছিলো পেত্নীর সাথে বিয়ে দিতে।

হায়! কি সর্বনাশ করলাম আমি! এ সব কিছুর জন্য আমিই দায়ী। আজ আমারই কারনে আমার এতো কষ্ট। আমার জীবনের এই অবস্থার জন্য আমি নিজেই দায়ী। চাইলেই পেত্নী সে দিন সবাইকে ডেকে আমাকে ধরিয়ে দিতে পারতো যে দিন আমি খাবার চুরি করতে গিয়ে পেত্নীর কাছে ধরা খেয়ে ছিলাম। কিন্তু সে তা করেনি কারন আমার প্রতি ছিল তার নিরব অভিমান। যাক অবশেষে হিসেবের ফলাফলটা হাতে পেয়ে গেলাম। আমি পাপ করে ছিলাম। আমার শাস্তি হয়ে ছিলো। আর সেই শাস্তিই ভোগ করছি। যদি কোন দিন সুযোগ পাই তবে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবো। আজ থেকে প্রায়শ্চিত্ত করার দিন গুনবো।

আজ গরম বেশি পড়ায় গফুঁর মিয়ার দেয়া সার্ট পড়া হয়নি। তবে পেন্ট পড়েই শুয়ে আছি। ঘুমের মধ্য বুঝতে পারলাম কে যেন ডাকছে। কয়েক বার চোখ খোলার চেষ্টা করেও পারলাম না। এবার একটা মহিলার ডাক শুনতে পেলাম। আমি হুড়মুড়িয়ে উঠে দেখি চোখের সামনে পেত্নীর বাব মা দাড়িয়ে আছে। আমি ভীষন লজ্জা বোধ করছি তাদের দিকে তাকাতে। আমার কারনে ভূত সমাজে তাদের মানসম্মত নষ্ট হয়ে গেছে। আমার কারনে হয়ত পেত্নীকে নানান কথা শুনতে হয়েছে। মাথ নিচু করে থাকা ছাড়া আমার তো কিছু করার নাই। যদি এখনও রাগ থাকে তবে চাইলেই আমার দু’গালে দুইটা থাপ্পর মারতে পারে। ইচ্ছে করলে মাথায় তুলে ব্যাঙ এর মত আছাড়ও দিতে পারে। আমি কিছু মনে করবো না।

তুমি কি যাবে আমাদের সাথে? চাইলে তুমি আমাদের মেয়ে পেত্নীকে বিয়ে করতে পারও। ইয়া আল্লাহ! জীবনএ মনে হয় কোন একটা ভাল কাজ করে ছিলাম যার কারনে প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগটা দিয়েছো। আমি হ্যে সূচক মাথা নাড়লাম। এক দৌড় এ গফুঁর মিয়া’কে দোকান থেকে বের করে আনলাম। গত বার যখন চলে গিয়ে ছিলাম তখন লোকটার কাজ থেকে বিদায় নিয়ে যাইনি। আজ চিরদিন এর মত পৃথিবী ছাড়বো। এমন ভাল একটা মানুষটাকে আর না বলে চলে গিয়ে কষ্ট দিতে চাই না। কি রে! এমনে দোকান থাইকা নিয়ে আসলি কেন! আমি আজ চলে যাব। আর দেখা হবে না কোন দিন।

আজ প্রথম আমি লোকটার সাথে কথা বললাম। হয়ত তিনি জানতে না আমি কথা বলতে জানি। আজও গফুঁর মিয়া নামের সহজ সরল এই লোকটার চোখ দিয়ে পানি পরছে। আজ বুঝতে পারছি লোকটা সে দিন কেন কেঁদে ছিল। যার সন্তান নেই সে বোঝে সন্তান না থাকার কি জ্বালা। তাই তার সেই জ্বালা মিটিয়ে দিতে নিজের হাতের খসখসে তালু দিয়ে তার চোখের পানি মুছে দিলাম। ঠোঁট এর কোনায় ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে জরিয়ে ধরলাম। নিজের অজানতেই কখন যেন আমার চোখ দিয়ে পানি চলে এলো। এ কান্না কষ্টের না! এ কান্না সুখের। আমি জানি বাবা না হতে পারার কষ্ট আমি তার মন থেকে দূর করতে পারবো না। কিন্তু কিছুটা সময়ের জন্য হলেও সন্তানের ভালবাসা কি জিনিস তা দিয়ে গেলাম। তাই হয়ত পরম সুখে আমাকেও তিনি জরিয়ে ধরলেন।

চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসলাম। প্রচন্ড হাঁচি আসতেছে। পরপর দিয়ে দিলাম দুইটা হাঁচি। মাথা ঘুরিয়ে দেখি হাজার হাজার ভূত পেত্নী। ওহঃ ভূলেই গিয়ে ছিলাম আজ পেত্নীর সাথে আমার বিয়ে। ভূত সমাজকে দাওয়াত দেয়া হয়ে গেছে আর তারা এসেও পরেছে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। হবু শ্বশুর আব্বা আর শাশুড়ি আম্মা ফিসফিস করে কি যেন বলতেছে। তাদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে তারা কিছু একটা বলতে চায়। ভূত সমাজ এ যৌতুক প্রথা আছে কি না আমার জানা নাই। হয়ত সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা চলতেছে। যদি মেয়েকে উল্টা যৌতুক দেয়া লাগে তবে আমি শেষ। গফুঁর মিয়ার দেয়া প্যান্ট ছাড়াতো আমার কাছে আর কিছু নাই। শেষমেশ না কি আমার বিয়েই ভেঙ্গে যায় কে জানে! তুমি কি সত্যিই পেত্নী’কে বিয়ে করতে চাও? জী, আমি চাই। তুমি চাইলে আরেক বার ভেবে দেখতে পারও।

এমন সময় পেত্নীর আগমন। ইয়া আল্লাহ! এ আমি কি দেখছি! এ কি সত্যিই পেত্নী? না কি হুর পরী! পেত্নী দেখতে এতো সুন্দর হয় কি করে। দুধে আলতা তার গায়ের রং এ যুবতী হরিণী চোখ। চোঁট দু’টো যেন তার গোলাপ এর পাপড়ি। পৃথিবীর সব কবি লেখকদের এনে পেত্নীর রুপের বর্ণনা দিতে বললেও তারা লিখে শেষ করতে পারবে না। মনুষ্য জগৎ এ এমন মেয়ে থাকলে আমি নিশ্চিত যুদ্ধ লেগে যাবে বিয়ে করার জন্য। আমি পেত্নীর দিকে তাকিয়ে আছি তো আছিই।

নাহ! আর দেরি করা যাবে না। প্যান্টটা এক টানে খুলে নেংটা হয়ে বসে পড়লাম। এ নিয়ে তৃতীয় বার আমি নেংটা হলাম। তবে এটাই শেষ, আর কোন দিন নেংটা হবো না। আমার সারা শরীরে সাদা আর কালো রং দেয়া হচ্ছে। আমি এখনও পেত্নীর দিকে তাকিয়ে আছি। পেত্নী এবার মুষ্টি একটা হাসি দিয়ে ঘরে চলে গেলো। মনে হয় লজ্জা পেয়েছে। পাওয়াটাই স্বাভাবিক। এতো ভূত পেত্নীর মাঝে হবু জামাই’কে নেংটা দেখলে কার না লজ্জা পাবে। আশে পাশের কিছু বদ পেত্নী আমার ওইটার দিকে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসছে। তবে আজ আমিও হাসছি। আজ আমার আর লজ্জা করছে না। কারন আমি পেত্নীর জামাই। আর পেত্নীর জামাই এর এতো লজ্জা থাকতে হয় না।।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত