বাঘ মারি

বাঘ মারি

আমি ইমো। নামটা মেয়েদের মত শোনালেও আমি কিন্তু ছেলে। পৃথিবীতে বাবা ছাড়া আমার আর কেউ নেই। আমার বয়স যখন চার তখন মা মার যান। খুব অল্প বয়স থাকায় মা’র সাথে মনে পড়ার মত আমার তেমন কোন সৃতি নেই।
মা’র মৃত্যুর পর বাবা আর বিয়ে করেনি। কেন করেনি তা আমি জানি না। আর বাবাও আমাকে কখনও এ বেপারে কিছু জানান নি। স্কুল লাইফে দু চারটা বন্ধু থাকলেও প্রেম করার সুযোগ পাইনি। তবে প্রেমের প্রস্তাব যে দেইনি তা কিন্তু নয়। দিয়েছিলাম, কেউ রাজি হয়নি। কলেজ এ একটা মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পরেছিলাম। খুব একটা বেশি দিন সম্পর্ক ছিল না। সম্পর্ক ভাঙ্গার কারন হিসেবে দেখানো হয়েছিলো আমি নাকি ক্ষেত, আনস্মার্ট। আমার মত হাবাগোবা ছেলের সাথে প্রেম করে সে তার জীবন ধ্বংস করতে চায় না। আমিও মেনে নিয়েছিলাম। প্রথম প্রথম একটু খারাপ লাগতো, আসতে আসতে সহ্যে হয়ে গিয়ে ছিলো।

বাবার খুব ইচ্ছে ছিল আমি ডাক্তার হবো। মা’র মৃত্যুর কারন হয়তো বাবাকে এমন স্বপ্ন দেখিয়েছে। বাবার মুখে শিনেছি মা’র চিকিৎসার খরচ বাবা জোগার করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। অপারেশন করাতে পারেন নাই টাকার অভাবে। আমাদের আর্থিক অবস্থা যখন এখন কার মত ভাল ছিলো না। তাই বাবার ইচ্ছে ছিল আমি সার্জিক্যাল ডাক্তার হবো। মানুষের নারীভূরী কেটে তাদেরকে সুস্থ করে তুলবো। স্টুডেন্ট একেবারে খারাপ ছিলাম না। সমস্যা বাধে অন্য জায়গায়। আমি ছোট বেলা থেকেই রক্ত সহ্য করতে পারতাম না। মানে রক্ত দেখলেই মাথা ঘুরতো, চোখ ছাপসা হয়ে আসতো। আমি টিভির সামনে থাকলে বাবা কখনও খুনাখুনি, মারামারি টাইপের মুভি দেখতেন না। প্রতি বছরি আমরা কোরবানি দেই কিন্তু আমি কখনওই জবাই করার সময় সামনে থাকি না। ইনফেক্ট এখনও না।

কিছুদিন হলো গ্রাজুয়েশন শেষ করেছি। ছোটখাটো একটা চাকুরী করছি, একটা কোম্পানির এক্সিকিউটিভ। যাতায়াত আর লান্চ বিল দেয়ার পর পকেটে আর তেমন কিছু থাকে না। বাপ ছেলের দু’জনের সংসার এ অভাব বলে কিছু নেই। সারাদিন বাহিরে থাকলেও রাতের খাবারটা আমরা এক সাথেই খাই। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বাব তোমার হাতে কি হয়েছে? ওঃ ছেকা লেগে গেছেরে। ছেকা লাগলো কি করে? চুলা থেকে ভাত নামাতে গিয়ে হাতের উপর ভাতের মাড় পরে গিয়েছিলো। আহঃ একটু সাবধানে করবে না। আরে এতো কিছুই না। কত কি হয়ে গেলো এই পর্যন্ত। ওষুধ দিছো ওইখানে? হ্যা, তা দিছি।

আমার বাবা একটু খুঁতখুঁতে টাইপের। খুঁতখুঁতে টাইপের বলতে তিনি কাজের বুয়ার হাতের রান্না খাবেন না। তার ধারনা কাজের বুয়ার হাত নোংড়া থাকে। সে ওই নোংড়া হাত দিয়ে খাবার রান্না করে। রান্না করার সময় হাঁচ্ছি কাঁশি যা আছে সব খাবার সামনে রেখেই দেয়। আর তাই আমার বুঝ হওয়ার পর থেকেই দেখছি বাবা নিজেই রান্না করেন। তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো ইমো। হুম বলো, কি কথা?

আমি তোমার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখছি। কয়েকটা দেখা হয়ে গেছে। ওগুলো মনের মত হচ্ছে না। আর তোমার যে কোন পছন্দ নেই তা আমি জানি। কখনও তো দেখলাম না আমি ছাড়া তোমার ফোনে কাউকে কল্ করতে।
বাবা, সবে মাএ চাকরী শুরু করলাম। তুমি ভাল করেই জানো আমি কত টাকা পাই। আর কিছুটা দিন যাক না।
শোন ইমো, মানুষের জীবনে চাহিদা আর সাফলের কোন শেষ নেই। কেউ কখনও বলতে পারবে না এটাই শেষ। আমি এমন মেয়েকেই এ বাড়িতে আনবো যে তোমার অল্প আয় নিয়ে কখনও অসন্তুষ্ট হবেনা। যে তোমার বউ হয়ে আসবে সে সব কিছু জেনে শুনেই আসবে যাতে বিয়ের পরে এসব নিয়ে তার কোন অভিযোগ না থাকে।
বাব, এমন খাপে খাপে মেলাতে পারবে? চেষ্টা করে দেখতে তো দোষ নেই। হাতের পাঁচ আঙ্গুলতো আর সমান হয় না। আর তা ছাড়া আমাদের তো কোন ডিমান্ড নেই। তোমার আছে কিছু চাওয়ার? না বাবা, আমার ডিমান্ড করা পছন্দ না। আমারও না, আর তাই তোমার মা’র হাত ধরে এক জামা কাপড় পড়েই বেরিয়ে গিয়েছিলাম। হ্যা অভাব ছিলো কিন্তু তোমার মা’কে কখনও ভাত কাপড় এর কষ্ট করতে হয়নি।

আমার দাদা আর নানা বাড়ির কেউই বাবা মার সম্পর্ক মেনে নিচ্ছিল না। দুই পরিবারই ছিল অবস্থাশালী। আমার মা অবশ্য দেখতে অনেক সুন্দরী ছিলেন। বাবার গায়ের রং কালো হলেও চেহারাটায় অনেক মায়া আছে। সব কিছুই ঠিক ছিলো কিন্তু সমস্যা ছিলো একটাই। আমার মা’র বয়স বাবা’র বয়সের থেকে কিছুটা বেশি ছিল। আর এ কারনেই কেউ বিয়েটা মেনে নেয়নি। মা’র মৃত্যুর পর তারা এসে ছিলেন। বাবাকে অনেক বুঝিয়ে আমাদের নিয়ে চেতে চেয়ে ছিলেন। কিন্তু বাবা রাজি ছিলেন না। আর তাদের সাথে আজ পর্যন্ত বাবা কোন যোগাযোগও রাখেনি এবং আমাকেও রাখতে দেননি। বাবার কিছু চাপা অভিমান ছিল। আজও সেগুলাই বয়ে বেড়াছেন।

আমার বউ খুঁজতে বাবার ঘুম হারাম হবার মত অবস্থা। এই বুড়ো মানুষটা আজও মেয়েদের মত চুলোয় হাড়ি পাতিল নিয়ে যুদ্ধ করে। বেপারটা ছেলে হিসেবে আমার কাছে মোটেও সুখকর নয়। তাই আমিও বিয়ে করতে মত দিয়ে দিলাম। কিন্তু বাবা যেমন মেয়ে চাইছেন তেমন মেয়ে পাওয়া এ যুগে সোনার হরিণ। নিজেদের আত্মীয় স্বজন না থাকায় ঘটক সাহেবরাই একমাএ ভরসা। বেশ কিছু দিন ধরেই বাড়িতে ঘটকদের আনাগোনা চলছে। সবাইকে বাবা নিরাস করে দিচ্ছেন, স্বয়ং বাবা নিজেও হতাশ হয়ে সোফার উপরে বসে থাকেন। ইতি মধ্য কয়েক ডজন মেয়ে দেখা হলেও এখন পর্যন্ত কাউকেই সিলেক্ট করা হয়নি। মাস গড়িয়ে বছর যাবে যাবে ভাব। অফিস থেকে বাড়ি ফিরতেই দেখি গেটের কাছে সাদা পাঞ্জাবী পরা এক লোক দাঁড়িয়ে দু’গাল ভরে পান চিবুছে। বাবার থেকে বয়সে কম করে হলেও দশ থেকে পনেরো বছর বেশি হবে। আমাকে দেখা মাএ পানের পিক্ ফেলে লাল হয়ে যাওয়া দাঁতের জোরালো একটা হাসি দিলো।

সালামালকুব বাবাজী। ওয়ালাইকুম আচ্ছালাম। বাবাজীর শরীরটা ভালো। জী ভাল। আপনাকে ঠিক চিন্তে পারলাম না! আপনার আব্বা আমাকে আসতে বলছিলেন। এসে দেখি দরজায় তালা মারা। আপনার বাবার সাথে ফুনে কথা হইছে, তিনি আসতেছেন। ও আচ্ছা, আসুন ভিতরে আসুন। বাবার কাছে সচরাচর কেউ আসে না। মোট কথা এ বাড়িতেই তেমন কেউ আসে না। ইদানিং যারা আসছেন তারা সবাই ঘটক। এই লোকটাও ঘটক। তার হাব ভাবেই বোঝা যায়।

বাবাজী ফেনটা একটু ছাইরা দেন। হাই পেশারতো তাই গরমটা একটু বেশি লাগে। জী দিচ্ছি। তা বাবাজীর কাজ করমো কেমন চলতেছে? ভালই খারাপ না। যাক ভাল হইলেই ভাল। আল্লাহর রহমতে আপনাদের তো সবি আছে। এখন দরকার একটা লাল টুকটুকে বউ। কোন চিন্তা করবেন না, এমন মেয়ে আছে আমার কাছে ঘরে আনলে আর বাতি লাগবো না। পুরা ঘর ফকফক করবো।

আমি বসে বসে চিন্তা করি এই লোক কি সত্যিই ঘটক নাকি টিউবলাইট ব্যবসায়ী! বউ দেবার নাম করে আবার আমাদের কাছে কয়েক জোড়া টিউবলাইট না বিক্রি করে যায়। ইতি মধ্যে বাব চলে এসেছেন। বেশ খোশ মেজাজেই ঘটক সাহেব একটানা কথা বলে যাচ্ছেন। মুরুব্বীদের মাঝে এ সব বেপারে থাকতে হয় না। তাই পাশের রুমে বসে তাদের আলাপচারীতা কান পেতে শোনার চেষ্টা করছি। সবি তো বুঝলাম ঘটক সাহেব। জে আমার নাম আমানুল্লাহ। ও আচ্ছা আমানুল্লাহ সাহেব। মোটামুটি সবি ঠিক আছে কিন্তু সমস্যা একটা জায়গাতেই। কি সমস্যা জনাব?

মেয়ের ছবিতে যা দেখলাম, মেয়ে অনেক সুন্দরী। ফ্যেমেলি মধ্যবিও সেটা ঠিক আছে। আমরা এমনি চাই ছিলাম। আসলে আমরা একটু ঘরোয়া টাইপের মেয়ে চাই। এমন একটা মেয়ে যে এই সংসার এর দায়িত্ব নেবে। সংসারটা আগলে রাখবে। জে জনাব আপনি ঠিক বলেছেন। আর তাইতো আমি নিজ দায়িত্বে একশত মেয়ের থেকে এই মেয়েটা ঠিক করে রাখেছি আপনার ছেলের জন্য। হ্যা, মেয়েটা একটু বেশি সুন্দর এই আর করি। আসলে হয় না, ওই যে কথায় আছে গোবরে পদ্ম ফুল। বেপারটা এইটাই। কিন্তু মেয়ে মাশাআল্লাহ, এমন মেয়ে আপনি আর একটাও পাবেন না। একটু চিন্তা ভাবনা করি। তারপর আপনাকে জানাই কেমন।

জনাব কোন চিন্তা ভাবনা আপনার করতে হবে না।আপনি সব চিন্তা ভাব না করলে আমি কি করবো? আমি মেয়ে পক্ষকে কথা দিয়া দিছি। এই শুক্রবার মাগরীব বাদ আমরা মেয়ে দেখতে আসতেছি। না না কাজটা ঠিক করেন নাই। আমাদের না জানিয়ে সিন্ধান্ত দেয়াটা ঠিক হয় নি। আরে রাখেন তো জনাব, বিয়ে সাদি আল্লাহ্ হাতে। কার কপাল কোথায় লেখা আছে তা কেউ জানে বলেন! মেয়ে দেখলেই যে বিয়ে করতে হবে এমন তো কোন কথা নাই। দেখা শোনার কাজটা শেষ করি, পছন্দ না হলে না করে দিবেন।

ঘটকদের মধ্যে এক অসম্ভব ক্ষমতা আছে। এদের একটা বিশেষ ক্ষমতা হচ্ছে এর সব সময় পজেটিভ। ছেলে মেয়েদের দোষ ত্রুটি এদের চোখে কখনই ধরা পড়ে না। আর এই ঘটক আর দশটা ঘটকের থেকে বেশ আলাদা আর অভিজ্ঞ মনে হচ্ছে। বাবাকে কি সুন্দর কথার জালে আটকে দিল। আহ! মেয়েটার ছবি যদি একটা বার দেখতে পেতাম।

অবশেষে শুক্রবার চলে এলো। আমি, বাবা আর ঘটক সাহেব রওনা হলাম। আমার হাতে দই মিষ্টির পেকেট। ঘটক সাহেব যতই বলছেন এইতো চলে আসছি আর একটু আমি ঠিক ততো বারই ঢোক গিলছি আর ভয়ে বুক কাঁপছে। এই প্রথম নিজের জন্য বউ দেখতে যাচ্ছি। বাবা সাথে থাকায় বেশ লজ্জা পাচ্ছি। কিন্তু কিছু করার নেই। মেয়ে বাড়ির সামনে যাওয়া মাএ একজন ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। কুশল বিনিময়ে জানতে পেলাম তিনি মেয়ের দুলা ভাই। বাড়ি ঘরের অবস্থা খুব বেশি একটা ভাল না, আবার খুব খারাপও না। তবে বসার ঘরটা সুন্দর করে সাঁজানো।

চিরাচরিত নিয়মে আমাকে আর আমার হবু বউকে আলাদা একটি রুমে বসানো হলো। জীবনে আনেক মেয়ে দেখেছি কিন্তুু এমন সুন্দর মেয়ে এই জীবনে প্রথম দেখলাম। ঘটক সাহেব ঠিকি বলেছিলেন এতো মেয়ে নয় যেন পদ্ম ফুল। এতো মায়াবী কারো চোখ হতে পারে তা জানা ছিল নানা। অনেক সময় পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ কেউ কারো সাথে কোন কথা বলছি না। বলার মত কোন কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না। বাবা আর ঘটক সাহেব কেউই কিছু বলে দেয়নি কি কি জিজ্ঞেস করবো। একবার ভাবলাম জিজ্ঞেস করে আসি কিন্তু উঠার সাহসও পাচ্ছি না। অধৈর্য হয়ে মেয়েটিই কথা শুরু করলো। আমি কি আপনার সামনে হাঁটাহাঁটি করবো? জী না। আমার দাঁত দেখবেন? জী না। গান গাইতে হবে? জী না। কি কি রান্না করতে পারি তার লিস্ট বলতে হবে? জী না। তাহলে আসছেন কেনও? তাতো জানি না। বাবা কে জিজ্ঞেস করি? আপনার বাবকে জিজ্ঞেস করতে হবে কেন? আপনি জানে না? জী না। আপনি প্রেম করেছেন কখনও? জী না, জী করে ছিলাম।

ওহঃ ছেঁকা খেয়েছেন। খুব বেশি না অল্প? অল্প। আমাকে পচ্ছন্দ হইছে? জী হয়েছে। বিয়ে করবেন নাকি আরো মেয়ে দেখবেন? আমিতো জানি না। বাবা জানেন। যা জিজ্ঞেস করছি তাই বলছেন আপনার বাবা জানে। বিয়ে কি আপনি করবেন না আপনার বাবা করবেন? জী আমি করবো। তাহলে আপনার বাবা’র কাছে যান। গিয়ে বলেন আমার মেয়ে পছন্দ হয়েছে। আর পছন্দ না হলে কেটে পরেন।
জী আচ্ছা।

আমিও লক্ষ্মী ছেলের মত বাবার কাছে গিয়ে বসলাম। আমি মেয়ে দেখতে এলাম না মেয়ে আমাকে দেখতে এলো সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না। যাই হোক, ঘটক সাহেব একটার পর একটা পান খেয়ে যাচ্ছেন। আমার বাবা আর মেয়ের বাবা গল্পে মেতে উঠেছে। আমার কি কিছু বলা উচিৎ! হঠাৎ বাবা কথা থামিয়ে দিয়ে আমাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হলেন। মনে হয় কিছু জিজ্ঞেস করবেন।

মেয়ের সাথে কথা হয়েছে? হ্যা বাবা হয়েছে। কি বুঝলে? কি বুঝবো বাবা? আরে, মেয়ে কেমন! তুমি সংসার করতে পারবে কি না এই সব আর কি। সংসার করতে পারবো কি না তা তো জিজ্ঞেস করিনি। জিজ্ঞেস করে আসবো? আরে ধ্যাত! বুঝেছি। তবে যাই বলো, মেয়েটির সাথে কথা বলে বেশ বুঝলাম সে যথেষ্ট পরিমানের সাহসী। তুমি যেই পরিমানে ভীতু তোমার জন্য এমন মেয়েই দরকার। আচ্ছা চলো, ওদিকে সবাই বসে আছে আমাদের জন্য। জনাব, মেয়ে কেমন লাগলো কিছু বলেন। মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে। এখন যদি আপনাদের ছেলে পছন্দ হয়ে থাকে তাহলে বিয়ের বেপারে কথা বলা যেতে পারে।

বাহ! জনাব আপনার কথা শুনে খুব খুশি হলাম। কই মেয়ের বাপ কিছু বলেন? আমাদের কোনও আপত্তি নেই। তবে দেনা পাওনার বেপারটা যদি একটু বললে ভাল হতো! জী না আমাদের কোন ডিমান্ড নেই। আপনারাতো জানেন, সংসারে আমি আর আমার ছেলে ছাড়া আর কেউ নেই। আমাদের আগলে রাখবে, সংসারটা দেখে শুনে রাখবে এতটুকুই চাওয়া। মাশাআল্লাহ! তা হইলে শুভ কাজে আর দেরি না করে দিন তারিখ ঠিক করা যায়, কি বলেন জনাব? হ্যা তা করা যেতে পারে। ঠিক এমন মুহূর্তে আমার হবু বউ সবার সামনে এসে দাঁড়ালো। কিছুখন এর জন্য সবাই চুপ হয়ে গেলো। আমি হা করে তাকিয়ে আছি। সবাই একজন আর একজন এর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু কি হতে চলছে?

আমার কিছু কথা আছে। হ্যা মা, বলো কি কথা? আমি বিয়ের কাবিন এ কোন টাকা নিবো না। এমন কি কোন স্বর্ন অলংকারো নয়। আমার আলাদা কিছু চাওয়ার আছে। কি সেটা? উনাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হবে। কাবিন নামায় এটাই লিখা থাকবে। আর তা না হলে আমি বিয়ে বসবো না। এ কথা শুনে সবার মুখে তৃপ্তির এক হাসি খেলে গেলো। বাবাও হাসছেন। অবশেষে তিনি তার ছেলের জন্য উপযুক্ত পাএী খুঁজে পেয়েছেন। আর তাই এই সাহসী মেয়েটিই আগামী মাসের প্রথম শুক্রবার আমার বউ হতে যাচ্ছে।

আজ শুক্রবার। আমি ইমো আর আমার বউ জয়া তিন বার কবুল বলে বিয়ের কাজ শেষ করলাম। আমার শাশুড়ি অবিরত কেঁদেই চলছেন। বার বার আমাকে একই কথা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলছেন। বাবা আমার অনেক আদরের ছোট মেয়ে, একটু দেখে রেখো। আমি আমার কথা দিয়ে সবোচ্চ চেষ্টা করলাম উনাকে আসস্ত করতে। কিন্তুু মনে হচ্ছে আমি ব্যর্থ। কারন তিনি এখনও কেঁদেই চলেছেন। শুধু তিনিই নন, আমার বউ এর পরিবারের সবাই কাঁদছেন। মনে হচ্ছে আমি তাদের মেয়েকে বিয়ে করিনি। বিয়ে করতে এসে হত্যা করেছি। একে একে সবাই জয়া কে ধরে কাঁদছে আর বিদায় দিচ্ছে। অবশেষে বিয়ের সাঁজানো গাড়ি মেইন রোড ধরে এগোচ্ছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো জয়ার চোখে আমি এক বিন্দু পরিমান পানিও দেখিনি। মেয়েটা একটা বারের জন্যও কাঁদলো না।

মনে মনে হয়তো ভাবছে বাপের বাড়িতে কোন কিছু করতে পারিনি। এই বার আমি স্বাধীন। এখন আমার যা ইচ্ছা আমি তাই করবো, হু হা হা হা ! তবে কি সে আমার উপর আজ থেকে স্বৈরাচার শাসন ব্যবস্থা কায়েম করবে? আর আমি সংসার নামক জেলখানায় বন্দী জীবন যাপন করবো? ভাবতে ভাবতে আমার কপাল ঘেমে ঘাম পড়ছে। আমার বউ কয়েক বার আমার দিকে ঘোমটা সরিয়ে তাকালো। কিন্তুু আমি মূর্তির মত নিরব ভূমিকা পালন করছি। আমার মাথা ঘুরছে। ভিতরে খুব অসুস্থ বোধ করছি। মনে হচ্ছে বমি করে ফেলবো।

বাসর ঘরে ঢুকতেই বউ বিছানা থেকে নেমে এসে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো। কাবিন নামায় লিখা ছিল পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হবে। তাই ওযু শেষে আমরা দু’জন নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমি নামাজ শেষ করে দেখি বউ এর নামাজ ও শেষ হয়ে গেছে। ঘোমটা কিছুটা সরিয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখি আমার পাশে পৃথিবীর সব চাইতে সুন্দরী মেয়েটি। এক অপরুপ সাঁজে তার মায়াবী মুখ দিয়ে যেন পবিত্র আলের আভা সারা ঘরে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ঘটক সাহেব ঠিকি বলে ছিলেন। এই মেয়ে ঘরে থাকলে টিউবলাইট লাগবে না। কি দোয়া করলেন আজ? তেমন কিছু না। তুমি? যে হাত ধরে আজ আপনার ঘরে এলাম সেই হাত ধরে যেন দু’জনে বেহেশত এ প্রবেশ করতে পারি।

এমন সুন্দর দোয়া করার পর কিছু কি বলার থাকে! নিজেকে আজ পৃথিবীর সব চাইতে ভাগ্যবান পুরুষ হিসেবে দাবি করতে পারি। জীবনে হয়ত কোন ভাল কাজ করে ছিলাম যার ফলপ্রসূত এমন বউ পেয়েছি। জয়া শুধু সুন্দর না, ওর গুছিয়ে কথা বলার আশ্চর্য একটা গুন আছে। অবশ্যই আমার আল্লাহর প্রতি বিশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়া উচিত। আর তাই জয়াকে ফ্রেস হতে বলে আমি আবার নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি আর দেরি না করে নাস্তা আনতে রওনা হচ্ছি। বাপ ছেলে এতো দিন যাই খেয়েছি এখন আর তা খাওয়া যাবে না। বাড়িতে নতুন কেউ এসেছে। তার জন্য এখন থেকে সব কিছুই নতুন করে করতে হবে। এই যে শুনছেন! কোথায়া যাচ্ছেন? নাস্তা আনতে যাচ্ছি। আনতে হবে না।, আমি বানিয়েছি। আপনি টেবিলে বসেন আমি নাস্তা দিচ্ছি। বাবা’কে ডাকা হয়েছে, তিনি আসতেছেন।

আমি কিছুটা অবাক। একই সাথে ভালও লাগছে। আজ ঠিক কত দিন পর এ বাড়িতে সকাল বেলা নাস্তার আয়োজন মনে নেই। বাবা আর আমি টেবিলে বসা। জয়া নাস্তা এগিয়ে দিচ্ছে। বাবা একটা কথা বলি? হ্যা, মা বলো? আজ থেকে আপনি আর কখনও রান্না ঘরে যাবেন না। আপনার কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবেন। আজ থেকে দুপুর এর রান্না সহ যা আছে সব আমিই করবো। না না মা! তুমি কেন এতো কষ্ট করতে যাবে। না বাবা এটা কষ্ট না। এটা আমার কাজ। আর আমি আমার কাজকে কখনও কষ্ট মনে করি না।

জয়া এমন ভাবে কথা বলে, ওর কথা বলার পর আর কারো কিছু বলার থাকে না। বাবা’কে আজ অনেক দিন পর হাসি খুশি দেখাচ্ছে। আর তাই নাস্তা শেষ করে বাজার করতে বেরিয়ে পড়লেন। আজ থেকে সংসার চলবে নতুন নিয়মে। ভুলে যেতে হবে পুরোন সব কিছুই। অনেক বছর পর বাবা’র ছুঁটি হলো। তাকে আর রান্না ঘরে গিয়ে হাড়ি পাতিল নিয়ে যুদ্ধ করতে হবে না।

দেখতে দেখতে আমাদের বিয়ের এক মাস পার হয়ে গেলো। ছুঁটির দিনে নাস্তা সেরে আমি আবার বিছানায় শুয়ে পরলাম। চোখটা প্রায় লেগে এসেছে। এমন সময় ঠাসঠাস শব্দ। কি সের শব্দ? বউ কি ঘর বাড়ি সব ভেঙ্গে ফেলছে না তো? আমি এক লাফে উঠে দৌড় দিয়ে রান্না ঘরে গিয়ে দেখি বউ তেলাপোকা মারছে। ইতি মধ্যে কয়েকটাকে মেরেও ফেলছে। মেয়ে মানুষ হাতি ঘোড়া ভয় পায় না। কিন্তু তেলাপোকা আর মাকড়সা ভয় পায় না এমন মেয়ে নাই। অথচ এই মেয়ে দেখছি পুরোই উল্টো। ও যে শুধু মাএ সাহসী তা কিন্তু নয়। পুরো গুন্ডি টাইপের মেয়ে। ওর গুন্ডামির একটা গল্প বলা যাক। আমরা সচরাচর রিক্সা দিয়েই ঘুরাঘুরি করি।

একটু বেশি দূর হলে সিএনজি অথবা টেক্সিতে যাতায়াত করা হয়। পাবলিক বাসে বউ নিয়ে যাতায়াত করতে আনইজি লাগে। মানুষ জন কেমন যেন হা করে তাকিয়ে থাকে। তো যাই হোক, হঠাৎ একদিন ওদের বাড়ি থেকে আসার সময় কিছুই পাচ্ছিলাম না। বাধ্য হয়েই সে দিন বাসে এ উঠতে হলো। কোন একটা সিটও খালি নাই। আমি দাঁড়িয়ে আছি। জয়া আমার শার্ট এর এক পাশ ধরে আমার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুখন পর ও হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার গালে টাস করে একটা থাপ্পর মেরে বসলো। থাপ্পর খেয়ে ছেলেটা দুই হাত সরে গেলো। বউ এর গলায় ভারী গর্জন। এখন কেন সরলি? আয় কাছে আয়! শরীর এর সাথে ঘষাঘষি করবি না? এতোখন তো খুব মজা নিলি। আয় কাছে আয়! মজা নিবি না আর?

আমি সহ মোট কথা পুরো বাসের সাবাই হা হয়ে গেলাম। ছেলেটা মাথা নিচু করে এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। বাসের সবার দৃষ্টি এখন আমাদের উপর। মনে মনে ভাবছি, মরার আর জায়গা পেলি না। এই গুন্ডি মেয়ের কাছে আসছিস্ ঢলাঢলি করতে! তোর কপাল ভাল যে তোর দাঁত ভাঙ্গে নাই। তাহলে আর পানি খেতে পারতি না। আমার বউ এর এমন অনেক ঘটনা আছে। থাক সে সব আর নাই বলাম। বললে পরে বলবেন আমি শুধু বউ এর প্রশংসা করি। এই শোনও? হুম বলো। বিয়ের পর মানুষ দূরে কোথাও বেড়াতে যায়। অথচ আমরা কোথাও গেলাম না। হানিমুনে যাওয়ার কথা বলছো? ওই রকমি কিছু একটা। কোথায় যেতে চাও? সেটাই ভাবছি কোথায় যাওয়া যায়।

ঠিক আছে ভাবো, ভেবে পেলে জানাও আমাকে। আচ্ছা একটা কাজ করলে কেমন হয়? কি কাজ? চলো আমরা তোমার দাদা বাড়ি বেড়াতে যাই! কি বলছো তুমি? কেনো তুমি বুঝি শোননি কি বলছি? বাবা শুনতে পেলে দু’জন কেই ঘর থেকে বের করে দিবে বুঝলা! আচ্ছা এমন কেনো বলোতো! আত্মীয় স্বজন থাকবে অথচ যোগাযোগ থাকবে না। এটা কি হয় বলো? আমাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নাই। বাবার কাছে যাও, বাবা কেই জিজ্ঞেস করো। এই চলো না যাই! প্লিজ জয়া, বাবা শুনলে ভীষণ রাগ করবেন। আমরা বাবা’কে বলবো না। বাবা জিজ্ঞেস করলে বলবো কক্সবাজার যাচ্ছি। বেস হয়ে গেলো।

তোমার কাছে এতোই সহজ মনে হচ্ছে সব কিছু? যদি কোন দিন বাবা’র কানে যায় তখন কি অবস্থা হবে ভেবে দেখেছো? ভীতুর ডিম! সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তখন বাবা’কে আমিই মেনেজ করবো। তুমি যাবার ব্যবস্থা করো।জয়া একটু বোঝার চেষ্টা করো। বছর এর পর বছর তাদের করো সাথে আমাদের কোন যোগাযোগ নেই। তারা কে কোথায় থাকেন আমি নিজেও জানি না। জানো না ভাল কথা, জানবে! আমি এতো কথা শুনতে চাই না। আমার জামাইটা আমাকে নিয়ে যাবে আমি এটাই জানি। তাই না সোনা!

মনে হচ্ছে কেউ যেন মুখের ভিতর কাগজ গুজে দিলো। এই বউ গুলা মারাত্মক কৌশলবাজ। এরা আবেগময় কথা ছড়িয়ে সব কিছু হাছিল করে নেয়। যাকে বলে ইমোশনালি ব্লাকমেইল। না পারা যায় কিছু বলা না পারা যায় মেনে নেয়া। ভাবছি বাবা’র কানে যদি যায় তবে কপালে শনি আছে। এখন দাদা বাড়ির ঠিকানা কি করে মেনেজ করি? আর তা ছাড়া তাদের না জানিয়েই বা কি করে সেখানে যাই! নিজের চুল ছেড়ার অবস্থা। আামার এক বাল্যকালের বন্ধুর বাড়ি অবশ্য আমার দাদা বাড়ি থেকে বেশ দূরে। দেখি ওর মাধ্যমে কোন ভাবে যোগাযোগ করা যায় কি না।

অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেলাম সেই বন্ধুর খোঁজে। নিউমার্কেট এ কাপড় এর পাইকারি দোকানদার। এখনও আছে কি না জানি না। বছর দুই আগে গিয়েছিলাম। এখন গিয়ে পেলেই হয়। অনেক দিন না আসায় দোকানটা কোন গলিতে সেটাও মনে করতে পারছি না। আচছা ভাই, এইখানে সাজ্জাদ এর দোকান কোনটা বলতে পারেন? কিসের দোকান ভাই? পাইকারি কাপড়ের। দোকানটা বেশ বড়। ও আচ্ছা, পাশের গলিতে। সোজা গিয়ে ডানে যাবেন। তারপর হাতের বাপে চার নাম্বার দোকানটা। ধন্যবাদ ভাই। যাক অবশেষেে পাওয়া গেলো। বন্ধু আমার কেশ কাউন্টার এ বসে হিসাব করায় ব্যস্ত। অনেক দিন পর আজ আবার দেখা।

সাজ্জাদ সাহেব কি খুব ব্যস্ত নাকি? আরে দোস্ত! তুই এতো দিন পর, আয় আয় ভিতরে আয়। তা আচ্ছিস কেমন? এইতো আছি ভালোরে। তোর কি অবস্থা? আছি খারাপ না। এতো দিন পর এই গরীব দোস্তর কথা মনে পড়লো তর? তুই আবার গরীব হলি কবে থেকে? নারে দোস্ত আসলে তা নয়। অফিস সংসার এগুলা নিয়ে থাকায় এখন আর আগের মত কোথাও যাওয়া হয় না। বিয়ে করছিস নাকি’রে? হুম, করছি। শালা! দাওয়াতও দিলি না। না’রে দোস্ত খুব অল্প সময়ের মধ্যে সব হয়ে যাওয়াতে তেমন কাউকে বলা হয় নাই। হ হ বুঝছি। আজকাল বিয়ে করলে কেউ দাওয়াত দেয় না’রে। এই ভাবে বলিস না দোস্ত। যাই হোক তোর কাছে একটা কাজে আসছি।

ওহঃ তুই তাইলে কাজ ছাড়া আসিস নাই। আরে ধূর! কথা শোন। আচ্ছা বলো। আমার দাদা বাড়ির কারো সাথে তোর কোন যোগাযোগ আছে? তোর দাদা বাড়ির কারো সাথে আমার কি করে যোগাযোগ থাকবে? তবে আমার এক কাস্টমার আছে। ওই লোক তোদের দাদা বাড়ির ওইখান কার। তা হঠাৎ এতো বছর পর কি মনে করে? আর বলিস না, বউ যেদ ধরেছে হানিমুনে যাবে আমার দাদা’র বাড়িতে। কোন ভাবেই বুঝাইতে পারতেছি না।
আঙ্কেল জানে? না জানে না।

দেখিস আবার ঝামেলা যেনো না হয়। ঝামেলা হবার কথা না। বাবা তার ছেলের বউ এর খুব ভক্ত। তুই একটা কাজ কর। তোর ওই কাস্টমার এর মাধ্যমে দাদা বাড়ির কারো মোবাইল নাম্বারটা জোগার করেদে। আচ্ছা আমি ঝোগার করে তোরে দিবোনি। এখন বল কি খাবি। নারে কিছু খাবো না। এখন বাসায় যাবোরে। আরে ধূর বেটা বয়! বাসায়তো যাবিই। এতো দিন পরে আসলি, একটু আড্ডা মারি তারপর যাইস্। চল চায়ের দোকানে গিয়ে বসি। হুম, চল। বাসায় ফিরেই দেখি বউ এর গদগদ মুখ। আজ এতো হাসি খুশি! কাহিনী কি! নিশ্চয়ই তার মনের মত আজ কিছু হয়েছে। কি বেপার আজ এতো দেরি করলে যে। এক বন্ধুর ওখানে গিয়ে ছিলাম। ওহঃ আচ্ছা।

কি বেপার এতো খুশি কেনো আজ? বাবা কি করছে আজ জানো? কি করছেন? গরুর হাঁটে গিয়ে ইয়া বড় একটা গরু কিনে নিয়ে আসছে। ওঃ হো! আজ তো আমারো যাবার কথা ছিল। কিন্তুু এতো আগে ভাগে না কিনলেও হতো। কেনো কি সমস্যা? আরে ওটার দেখাশুনা করতে হবে না? রোজ খাওয়াতে হবে না? তুমি খাওয়াবে। কি? আমি? হ্যা তুমি! শোনও, কোরবানির জিনিস আগে থেকে কিনে সেটাকে আদর যত্ন করে কোরবানি দিলে সোয়াব বেশি পাওয়া যায়। ঈদের তো আর আর তিন দিন বাকি। এই তিনটা দিন একটু কষ্ট করলে সোয়াব যদি বেশি পাওয়া যায় তো সমস্যা কোথায়?

আগেই বলেছি, জয়া কথা বলার পর আর কারো কথা বলার কোন কিছু থাকে না। আর বাবা এতো আগে গরু কিনেছে ওর বুদ্ধিতেই। এখন বাপ ছেলে মিলে গরুর যত্ন করতে হবে। বেশি বেশি সোয়াব কামাতে হবে। নিচে গিয়ে দেখি বাবা গরুকে খাওয়ানোয় ব্যস্ত। গরু খাচ্ছে আর বাবা ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।

কিরে! দেখতো গরুটা কেমন হলো? ভাল হয়েছে। তা এতো আগে না কিনলে হতো না? আরে সোয়াবের আশায় যখন কোরবানি দেই তো দু’এক দিন আগে কিনলে ক্ষতি কি! জয়া নিশ্চয়ই তোমাকে এই বুদ্ধি দিয়েছে। হ্যা, বউ মা’র বুদ্ধিতেই কেনা। তবে যাই বলিস, বউ মা’র মাথায় কিন্তুু অনেক বুদ্ধি। দেখিস না সংসারটা কি সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে। হুম, বুঝলাম। নাও তুমি এখন গরুর যত্ন নাও। আমি উপরে গেলাম।

আজ ঈদের দিন। বাপ ছেলে নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরে গরুর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সাথে আছে কসাই আর লম্বা একটা ছুঁরি হাতে টুপি মাথায় সাদা পাঞ্জাবী পড়া এক হুজুর। জয়া এসে আমার পাশে দাঁড়ালো। হুজুর বাবা’র অনুমতি চাইলেন। বাবা’র চোখ দিয়ে টলটল করে পানি পড়ছে। এই তিন দিনে গরুটার প্রতি বাবা’র যে বেশ ভালবাসা তৈরি হয়েছে তা বুঝতে আর বাকি নেই। জয়ার মুখটাও মলিন হয়ে আছে। গরুটাকে ইতি মধ্যে শোয়ানো হয়েছে। আমি চলে আসবো এমন সময় জয়া আমার হাত চেপে ধরলো। আমি কোন মতেই ওকে বোঝাতে পারছি না আমি এগুলা সহ্য করতে পারি না। কিন্তু কে শোনে কার কথা।

কি মহা মুশকিল! আমি এগুলা দেখলে ফিট হয়ে পরে যাবো। যেই কথা সেই কাজ, ছুঁরি চালাতেই গরু হামবা বলে দিলো এক ডাক আর সাথে সাথেই আমি মাটিতে ধরাসায়ি। এর পর আমার আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরে দেখি জয়া বিছানার পাশে বসে চুল আচড়াচ্ছে আর গুনগুন করে গান গাইছে। আমি ওর তামাসা দেখছি। আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম আর ও দেখছি মনের সুখে গান ধরেছে। ইচ্ছে করছে ওর মুখটা চেপে ধরতে। কিছু খাবে? না। তুমিই খাও। ওমা! রাগ দেখাছো কেন? রাগ কেন দেখাবো না? তোমাকে বার বার বলাম আমাকে যেতে দাও। তুমি কি করলা আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখলে। আমি কি জানি তোমার এই অবস্থা হবে! হি হি হি হাসবে না, সবার সামনে কি একটা অবস্থা হলো।

হাসবো না তো কি করবো কাঁদবো? এই তুমি এতো ভীতু কেনো! তোমার সামনে কেউ যদি আমাকে তুলেও নিয়ে যায় তুমি তো মনে হয় উল্টো আমাকে রেখেই পালাবে। হি হি হি নাও এখন উঠো, সকাল থেকে কিছুই খাওনি। আমি খাবার দিচ্ছি, তুমি ফ্রেস হয়ে আসো। ঈদেরর ছুঁটি শেষে আবার সেই কর্ম ব্যস্ততা। এদিকে জয়া মাথা খারাপ করে ফেলছে দাদা বাড়ি যাবে বলে। সাজ্জাদও এখন পর্যন্ত কিছু জানালো না। আজ আবার ওর ওখানে যেতে হবে। কিন্তু রাস্তার এতো জেম ঠেলে যেতে ইচ্ছে হয় না। কি আর করার! বউ এর আবদার মেটাতেই হবে। তাই অফিস শেষে সোজা চলে গেলাম ওর দোকানে। সাজ্জাত! আরে দোস্ত, আয় ভিতরে আয়।কি অবস্থা তোর, আমাকে তে কিছু আর জানালি না। দোস্ত কোন বেপারটা জানি?

আরে তোরে যে বলছিলাম দাদা বাড়ির কারো মোবাইল নাম্বার জোগার করতে, তা কি করলি? ওহঃ নাম্বার তো সেই কবেই জোগার করেছি। তো দিস নাই কেনো, তোর না আমাকে কল করে দেবার কথা। সরি দোস্ত! ঈদের বাজার গেলোতো। কাজের চাপে একদম ভুলে গেছিলামরে। দাঁড়া দিতেছি এখনই। আমি নাম্বার নিয়ে আর দেরি করিনি। যতটা সম্ভব তারাতারি বাড়ি চলে আসি। আজ জয়া অনেক খুশি হবে। অনেক দিন ধরে ঘ্যন ঘ্যন করছে কানের কাছে। আমি ফ্রেস হয়ে মোবাইলটা নিয়ে বসে আছি। জয়ার রান্না এখনও শেষ হয়নি। ও আসলেই কল করবো। কি হলো ডাকছো কেন? ক্ষুধা লেগে গেছে? কিছু খাবে? না ক্ষুধা লাগেনি। তোমাকে একটা কথা বলার জন্য ডেকেছি। কি কথা?

দাদা বাড়ির নাম্বার জোগার করেছি। নাম্বারটা দাদা নিজেই ব্যবহার করেন। সত্যিই! হুম সত্যি। তোমার সাথে কথা হয়েছে? না আমি এখনও কল্ করিনি। ভাবলাম তোমাকে আগে বলি। দাও, এখনি কল দাও। তার আগে বলও বাবা কোথায়? বাবা টিভি দেখছেন। তুমি কল্ করো! কি বলবো কল্ করে? আজবতো! কি বলবে সেটাও আমি বলে দিব? আরে আমি তো কোন দিন কথা বলিনি। হঠাৎ করে কি বলবো আমি? প্রথমে সালাম দিবে। তারপর নিজের পরিচয় দিবে। আর শেষে বলবে আমরা আপনাদের ওখানে বেড়াতে আসতে চাই। আর পারলে আমার সাথে কথা বলায় দিবা।

আপন মানুষরা কাঁদে। তাদের কান্নার ভিতরে ভালবাসা লুকিয়ে থাকে। নিজের পরিচয় দিতেই দাদা হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন। তার একটাই প্রশ্ন এতো দিন পর বুড় দাদা’র কথা মনে পড়লো। আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। দু’চোখ দিয়ে অঝরে পানি ঝরে পড়ছিল। কোথায় যেনো একটা টান অনুভব করলাম। বুকের ভিতরে তীর্ব একটা শূন্যতা আমাকে বেশিখন কথা বলতে দিলো না। যা বলার জয়াই বললো। কেন যেনো মনে হচ্ছে সব কিছু ফেলে এখনই চলে যাই।

তাই আর দেরি না করে অফিস থেকে ইমারজেন্সি কয়েক দিনের ছুঁটি নিলাম। বাব’কে অবশ্য বলা হয়েছে আমরা কক্সবাজার যাচ্ছি। আর ও দিকে দাদা’কে বার বার বলা হয়েছে বাবা যেন ভুলেও কিছু জানতে না পারে। যাই হোক, আজ আমি আর জয়া যাচ্ছি দাদা বাড়ি। এই প্রথম যাচ্ছি। অজানা একটা ভাললাগা আমাকে ঘিরে ধরে আছে। এ যেন নাড়ির টানে বহু দূর থেকে ছুঁটে যাচ্ছি আপন মানুষের ভিড়ে। জয়া আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। হাই ওয়ে বাস সাঁইসাঁই করে ছুঁটে চলছে দাদা বাড়ির পথে।।

গন্তব্যে পৌছানো মাএ আমি আর জয়া বাস থেকে নেমে পড়লাম। ফোন এ কথা হয়েছিলো আমরা নামা মাএই দাদা বাড়ি থেকে লোক এসে নিয়ে যাবেন। সমস্যা হলো আমরা কেউই কাউকে চিনি না। জয়া আর আমি এদিক ও দিক তাকাতে থাকলাম। কিছু মানুষ অবশ্য আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তুমি ইমো? জী। আমি তোমার ছোট কাকা।

এই কথা বলেই তিনি আমাকে জরিয়ে ধরলেন। এতোটাই শক্ত করে জরিয়ে ধরে কেঁদে দিলেন যেন মনে হলো এ যেন রক্তের টানে কোন এক প্রশান্ত সাগরে ঝড় উঠেছে। কেনোই বা হবে না! আমাদের শরীর এর শিরায় শিরায় যে একই রক্ত বয়ে চলছে। বাস স্ট্যান্ড এ কান্নার রোর পড়েছে। এ এক পরম শান্তির কান্না। আঞ্চলিক কোন একটি গাড়িতে করে পাহাড় এর ঢাল আর ঘন সবুজ জঙ্গল পেরিয়ে ছুঁটে চলছি আমরা। ছোট কাকা একটু পর পর আমার মাথায় আর কাঁধে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর জয়া কে বার বার জিজ্ঞেস করছেন কোন সমস্যা হচ্ছে কি না। গাড়ি এসে থামলো এক বাংলো বাড়ির সামনে। আর দশটা গ্রাম্য বাড়ির মত এ বাড়ির সামনেও অনেক বড় উঠান। সারা উঠান জুরে মানুষ আর মানুষ।

উনারা হয়তো আমার আত্মীয় স্বজন। গাড়ি থেকে আমি আর জয়া নেমে পড়লাম। বৃদ্ধ একজন মানুষ হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে এগিয়ে এলেন। তার দু’চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। একটি হাত বাড়িয়ে দিতেই আমার বুকে আঁচড়ে পড়লেন। হ্যা তিনি আমার দাদা। আজ পরম সুখে আমায় জরিয়ে ধরে কাঁদছেন। ইতি মধ্যে সবাই আমাদের ঘিরে ধরেছেন। একে একে আমি আর জয়া সবাইকে সালাম করলাম। দাদি জয়াকে সেই যে জরিয়ে ধরে কাঁদছেন এখনও কেঁদেই চলেছেন। এখানে না এলে কোন দিনই বুঝতাম না এই পৃথিবীতে আমাদের জন্য কতটুকু ভালবাসা জমানো ছিল। হয়তো কোন দিনও বোঝা হতো না আত্মীয়তার সম্পর্ক কি জিনিস। জয়া আজ ভীষণ খুশি। ওর মুখএ এখনও হাসি লেগেই আছে। অনেক মানুষের আদর যত্নে গদগদ অবস্থা। পেট ভরে নাস্তা সেরে বিছানায় শুয়ে পরলাম। ক্লান্তিতে ঘুম চলে এলো।

এই ঘুমিয়ে গেছো। হুম। উঠো দাদা ডাকছেন। হুম। আরে উঠো না। দাদা ডাকছেন তো। হুম উঠছি। ঘুম ছাড়ছে না কিছুতেই। তুমিও ঘুমিয়ে পড়। আরে দাদা ডাকছেন। পরে ঘুমিয়ো। অনেকখন ধরে বসে আছেন। ওহঃ, আচ্ছা তুমি যাও। আমি আসতেছি। আরেকটু ঘুমিয়ে নিতে পারলে ভাল হতো। মাথার ভিতরটা ঝিমঝিম করছে। কিছুতেই বিছানা ছাড়তে মন চাইছে না। কি আর করার উঠতেই হবে। এসো দাদা ভাই এসো। ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি। জী দাদা, চোখ লেগে এসেছিলো।

তা তো হবারই কথা। ঢাকা থেকে দূরতো আর কম নয়। দাদা ভাই কোন সমস্যাতো হচ্ছে না। জী না দাদা, কোন সমস্যা হচ্ছে না। আর তা ছাড়া নিজের বাড়ি এখানে সমস্যা কিসের। হ্যা তা ঠিকি বলেছো। তা তোমার বাবা’র অভিমানটা আজও রয়ে গেল তাই না! থাক না দাদা এসব কথা। কি করে ভুলি বলো? ওই বুড়িটা আজও ছেলের জন্য কাঁদে। বলে কোন দিন যেন মরে যাই। ছেলেটা বুঝি মাটি দিতেও আসবে না। বাদ দিন না দাদা। এগুলা কথা কষ্ট বারাবে, কমাবে না। হ্যা তা ঠিকি বলেছো। আচ্ছা চলো, গ্রামটা ঘুরিয়ে দেখাই তোমাদের। বউ মা তুমিও চলো। শহরে থাকো, গ্রামতো আর দেখা হয় না। জী দাদা চলেন।

আমরা গ্রাম ঘুরতে বেরিয়ে পরলাম। উৎসুক জনতার দৃষ্টি আমাদের দিকে। গ্রামে দাদা’র ভাল নাম ডাক আছে। একের পর এক সালাম এর জবাব নিয়ে দাদা জমিদার সাহেব এর মত হেঁটে চলছেন। জয়া আর আমি পেছনে হাঁটছি। সবারই একি প্রশ্ন আমরা কারা? দাদা যেন বুক ফুলিয়ে ভরা কন্ঠে বলছেন এর হচ্ছে আমার নাতী আর নাত বউ। সন্মান আর আত্থিতিয়তায় আমরা সত্যিই মুগ্ধ। জীবনটা এখানে সম্পূর্ণ ভীন্ন। এখানে থেকে ইট পাথর এর শহরকে খুব বিশ্রী লাগতে শুরু হলো।

বাড়িতে ফিরেই দেখি পিঠা উৎসব শুরু হয়ে গেছে। দাদী আর ছোট চাচী মিলে পিঠা বানাছেন। জয়া রান্না ঘরে যেতে চাইলে দাদী নিষেধ করেন। ও যে সেই কথা শোনার পাএ নন দাদীতা প্রথম দিনেই টের পেয়ে গেলেন। আহঃ খেজুর গুড় আর নানা রকম পিঠার গন্ধে পেট ভরে যাবার অবস্থা।

ওরে পোড়া মুখি বুড়ি! বউটা আসতে না আসতেই চুলোর কাছে টেনে নিলে? দেখও দেখও মুখের কি কথা! নাতি নাতবউ এর সামনে কি সব বলছে। হা হা হা না দাদা আমি নিজেই এসেছি। দাদী মানা করেছিলেন। যাই হোক, ওই বুড়িটার সাথে বেশি থেকে নিজে আবার বুড়ি হয়ে যেও না বউ মা। আমার নাতি কিন্তু এখনও জোয়ান। আচ্ছা তুৃমি যে আমাকে বুড়ি বলছো নিজের বয়সটা কি চোখে পড়ে না? তোমার বুদ্ধি দিন দিন কমছে। আমি যদি বুড় না হতাম তবে সেই কবেই না নতুন কাউকে জুটিয়ে নিতাম। সেই যে তোমার প্রেমে পড়লাম, আজও তোমার প্রেম সাগরেই ডুবে রইলাম। হা হা হা ছিঃ ছিঃ ছিঃ লজ্জা শরম কিছু আছে এই লোকের।

দাদা’র কথায় আমরা সবাই হেসে দিলাম। দাদী লজ্জা পেয়ে শাড়ির এক পাশের আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে নিলেন। দাদা এ বয়সেও বেশ খোশ মেজাজি। পিঠা পর্ব শেষ করার পরেই রাতের খাবার এর আয়োজন। এখানে কিছু দিন থাকলে ওজন যে কি পরিমান বাড়বে তার কোন হিসেব নাই। খাওয়া দাওয়া শেষে বাড়ির বড় উঠনে আমি, জয়া আর দাদ-দাদী গোল হয়ে শীতল পাটিতে বসে গল্প জুরিয়ে দিলাম। খোলা আকাশের নিচে এমন চাঁদনী রাতে আগে কখনও বসা হয়নি।

হেরে দাদা ভাই! জী দাদী? তোর বাবা কখনও আমাদের কথা কিছু বলে? না দাদী কিছু বলে না। কি করে বলবে! তোর বাবা’র তো মা’য়ের দরকার হয় না। দরকার হলে ঠিকি মনে করতো। সেই যে ছেলেটা বাড়ি ছাড়লো আজও ফিরলো না। কত দিন ছেলেটাকে দেখি না। আমি মরার আগেতো আর আসবে না। আমি মরে গেলে আমার কবরে যেন এক মুঠও মাটি দিয়ে যায়। থাকনা এসব কথা দাদী। ওরে দাদা ভাই, এ যে আমার নাড়ি ছেড়া ধন! দশ মাস আমি পেটে ধরেছি। জ্বালাটা আমার সবার থেকে একটু হলেও বেশি। যাক বাদ দাও, অনেক রাত হয়ে এলো। চলো তোমাদের শোবার ব্যবস্থা করি।

দেখতে দেখতে দুই দিন কেটে গেলো। কেন যেন বাড়ি ফিরতে মন চাইছে না। জয়ও দিবি হেসে খেলে সময় পার করছে। সারা দিনই ছুঁটো ছুঁটি, ওর যেন ক্লান্তি নেই। শহরের বন্দী জীবন থকে বেরিয়ে এসে এই মূক্ত পরিবেশে যেন ডানা মেলে দিয়েছে। এমন একটা জায়গা ছেড়ে কার মন চায় ওই শহরের দিকে তাকাতে! চারিদিক সবুজে ঘেরা, পাহাড়ি ঝরনা, সারা দিন অচেনা পাখির ডাকা ডাকি। জীবনটা এখানে অনেক শান্ত। নেই কোন কর্ম ব্যস্ততা। আহাঃ জীবন! এখানে যদি সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারতাম। এই শোনও। হুম বলো। শোনও না।শুনছিতো। এতো গদগদ করছো কেনো? এখান থেকে একটু দূরে পাহাড় এর ঢাল পেরোলেই উপজাতিদের একটা গ্রাম আচ্ছে। সে গ্রাম এ নাকি রোজই বুনো বাঘ আক্রমণ করে। হুম তো হয়েছে কি? বাঘ থাকলে আক্রমণতো করবেই। আমরা ওখানে যাবো। কি বললা? বলাম আমরা ওইখানে যাবো। জয়া! কি?

তোমার বাঘ দেখতে ইচ্ছে হলে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাবো। বাঘ কি হরিণ নাকি যে সেটা মুক্ত ভাবে হাঁটা হাঁটি করবে আর তুমি হাত দিয়ে আদর করে দিবে! তুমি যত যাই বলো, আমি যাবো। যেতে ইচ্ছে হয় তুমি একা যাও। আমি যেতে পারবো না। তোমাকেও যেতে হবে সাথে। জয়া বোঝার চেষ্টা করো ওটা বিড়াল না, ওটা বাঘ। একটা বার যদি আমাদের উপর আক্রমণ করে বসে তখন কি অবস্থা হবে ভেবে দেখেছো? আমি অত কথা শুনতে চাই না। আমরা যাবো ব্যস্ এটাই কথা। আমি যাবো না। তোমার ইচ্ছা হলে তুমি যাও। সবাই তো যাবে, তোমার যেতে কি সমস্যা? সবাই যাবে মানে? আরে সবাই যাবে বাঘ’টাকে মারতে, আমরাও যাবো। তোমার মাথা ঠিক আছে? আমরা যাবো বাঘ মারতে। জীবনে আমি কোন দিন মুরগী মারি নাই। আমি যাবো বাঘ মারতে?

আমি এতো কথা শুনতে চাই না। তুমি আমার সাথে যাবে কি না? না আমি যাবো না। যাবে না তো? না যাবো না। ঠিক আছে আমি একাই যাবো। আমার যদি কিছু হয় তবে এর জন্য তুমি দায়ী থাকবে, মনে রেখো। ইয়া আল্লাহ একি মহা বিপদে পড়লাম আমি। আমি নাকি এখন বাঘ মারতে যাবো। শিয়াল কুকুর হলেও ভেবে দেখা যেতো। তাই বলে বাঘ! নাহ, ওর মাথায় যে মাঝে মাঝে কি হয় আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। এখন সবাই মিলে যাই বাঘ শিকার করতে। আমি এসব বাঘ টাঘের ভিতরে নাই। ওর যখন যাবার এতোই ইচ্ছে ও একাই যাবে।

লোক মুখে শুনলাম উপজাতিদের ওই গ্রাম এর নাম বাঘ মারি। প্রায়ই বাঘের আক্রমণে কেউ না কেউ মারা যেত। কোন এক সময় এক লোক সেই বাঘটাকে মেরে ফেলে। সেই থেকে গ্রামের নামকরন করা হয় বাঘ মারি। বছর কয়েক হলো বাঘের উপদ্রব নাকি খুব বেরেছে। তাই আমার বউ নতুন করে ইতিহাস গড়তে চাইছে। ফজরের নামাজ পড়ে আমি আবার ঘুমিয়ে গেলাম। ইদানিং ঘুমটা খুব বেরেছে। বেশ কিছুটা দূর থেকে ঢাক ঢোলের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। মনে হয় কোন উৎসব হবে হয়তো। আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। এই উঠো! এই.. এই… উঠো! হ্যে, কি হইচ্ছে কি হলো? আরে ভয় পাচ্ছো কেন। ওই বাঘটা এসেছে। ও আচ্ছা। ও আচ্ছা মানে? উঠো যেতে হবে তো! কোথায় যাবো? বাঘ মারতে। প্লিজ জয়া বাদ দাও না, প্লিজ। ঘুমে আমি চোখ খুলতে পারছি না। তুমি উঠবা কি না? জয়া, তুমি না ভাল। প্লিজ যেদ করো না। আচ্ছা তোমাকে যেতে হবে না। আমি একাই যাচ্ছি।

এতো দেখছি মহা যন্ত্রণা। এই ভোর বেলা এখন যাই বাঘ মারতে! খেয়ে আর কোন কাজ নাই। না গিয়েও তো কোন উপায় দেখছি না। জয়া এরি মধ্য বেরিয়ে পরেছে। আমি ওর পিছু পিছু হাঁটছি। আমাদের মাঝ দূরত্ব বিশ থকে ত্রিশ হাত। পাহাড়ের ঢাল পেরোতেই চোখে পড়লো বাঘ মারি গ্রাম। চারপাশে সবে মাএ আলো ফুঁটতে শুরু করেছে। এখনও বেশ অন্ধকার। বউ এর হাতে ছোট্ট একটা লাঠি। আমার প্রচন্ড হাসি আসতে শুরু করলো। এই লাঠি দিয়ে গরু ছাগলও মারা যাবে না। আর ও যাচ্ছে বাঘ মারতে।

গ্রামের কাছাকাছি আসতেই চোখে পড়লো মানুষের ছোটাছুটি। এদিক ওদিক সবাই ছোটাছুটি করছে। নারী পুরুষ সবার হাতেই কিছু না কিছু আছে। বড় বড় রাম দা, বল্লম, ছুঁরি যে যা পেয়েছে তা নিয়েই বাঘ মারতে সবাই প্রস্তুত। হঠাৎ জয়া দৌড়ে ভীরের মাঝে যেতেই কুড়ে ঘরের জানালা ভেঙ্গে বুনো বাঘটি এক লাফে এক উপজাতি মহিলাকে মাটিতে ধরাশায়ি করে পাশে আরেকটি ঘরে লুকিয়ে পড়লো। মহিলা মাটিতে পড়ে অজ্ঞান। জয়া হাতের লাঠিটা ফেলে দিয়ে বড় একটা রাম দা নিয়ে ছুঁটতে শুরু করলো।

চারপাশে মানুষের চিৎকার। ছোট বাচ্চা গুলা ভয়ে কাঁদছে। আমার হার্টবিট অনেক বেরে গেছে। সারা শরীর ঘেমে ভিজে গেছে। হঠাৎ বাঘটি আবার দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলো। এতো মানুষের মাঝে পালানোর কোন রাস্তা না পেয়ে বাঘটি এলোপাথাড়ি এদিক ওদিক ছুঁটছে। জয়া আর কিছু লোক বাঘের পিছু নিয়েছে। আমি আর কোন রাস্তা খুঁজে না পেয়ে সুপারি গাছ বেয়ে সোজা উপরে উঠে গেলাম।
হায়ঃ আজ আর নিস্তার নেই। হে আল্লাহ! মেরেই যখন ফেলবে তখন স্বাভাবিক ভাবেই মারতে। কেন এই বাঘের মুখে নিয়ে এলে। বুক ফেঁটে কান্না পাচ্ছে, কিন্তু ভয়ে কাঁদতে পারছি না। আমি যেন পিচ্ছল সুপারি গাছ বেয়ে ত্রুমেই নিচে নেমে যাচ্ছি।

দুই হাত আর দুই পা দিয়ে শরীর এর সবটুকু শক্তি দিয়ে আটকে থাকার চেষ্টা চালিয়েও তেমন একটা লাভ হচ্ছে না। চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে দোয়া দুরূদ পড়ছি। একেক টা মিনিট যেন একেকটা বছরের মত মনে হচ্ছে। চারপাশ এর আওয়াজ যেন হঠাৎ কমতে শুরু করলো। আমি চোখ বুঝে বোঝার চেষ্টা করছি কি চলছে। উপজাতিদের ভাষা বোঝার মত ক্ষমতা আমার নেই। শুধু চিৎকার চেঁচামেচিই শোনা যাচ্ছে। চোখ খুলে গাছের নিচে বাঘ দেখার চেয়ে চোখ না খোলাই ভাল। বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে গেলো। হাত পায়ে আর জোর পাচ্ছি না। ইতি মধ্যে অনেকটা নিচে নেমে এসেছি। এবার আর চোখ না খুলে উপায় নেই।

সে কি কান্ড! জয়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ওর সারা শরীরে রক্ত মেখে একাকার। বউ এর চোখ দু’টো এখন আর মায়াবী লাগছেনা। আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত কিরমির করে রাগে গজগজ করছে। অপর পাশে লোকজন মরা বাঘটিকে বাঁশ এর সাথে ঝুলিয়ে কাঁধে নিয়ে নাচানাচি করছে। বুঝতে আর বাকি নেই বউ বাঘ মেরে ফেলছে। এ বার যেন একটু সাহস পেলাম। নিজে নামতেই জয়া আমাকে রেখেই বাড়ির পথ ধরে হাঁটা শুরু করলো আর আমি অবুঝ বালক এর মত অনুসরণ করলাম।

বাড়ির সবাই জয়াকে নিয়ে ব্যস্ত। হতের কয়েকটা জায়গায় বেশ ব্যথা পেয়েছে। আসতে আসতে ঘটনা পরিষ্কার হলো। আমার বউ মানে জয়াই নাকি রাম দা দিয়ে বাঘের মাথায় প্রথম আঘাত করে। আর তাতেই বাঘটি আধ মরা হয়ে যায়। পরে সবাই মিলে ওটাকে মেরে ফেলে। কি সাংঘাতিক সাহসরে বাবা! নিশ্চই ওর বাপ মা ছেলে সন্তান চেয়েছিল। ভুল করে মেয়ে হয়ে গেছে। আমি কোন কথা না বলে চুপ করে জয়া’র পাশে গিয়ে বসলাম। কোন কিছু বলার সাহস পাচ্ছি না। যে বউ বাঘ মারতে পারে সেই বউ আমাকে মারতে পারবে না এমন কোন কথা নেই।

বিকেল হতেই বাড়ির উঠনে ভীর জমতে শুরু হলো। উপজাতিদের রাজা এবং সম্মানিত ব্যক্তিগন দাদা’র সাথে কথা বলছেন। বউ আমার সবার মধ্যমনি। তার সাহসিকতার প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ। দূর থেকে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আমার কোন কাজ নেই। যদিও বাঘ মারা ইভেন্ট এ আমিও জরিত ছিলাম তবে কোন কর্ম কান্ডে না থাকায় আমার নাম বাদ পড়েছে। ইস্ঃ এখন আফসোস লাগছে। মরে যাওয়া বাঘটাকে যদি একটা লাঠি দিয়ে খোঁচা দিতাম তবুও সবার সামনে গিয়ে কিছু বলতে পারতাম। বউ মেরেছে বাঘ আর আমি ছিলাম গাছের উপরে। এই কথা বললে মান সন্মান আর কিছু থাকবে না। দাদা ভাই এদিকে এসো। জী দাদা। ওনি হচ্ছেন আমাদের বাঘ মারি গ্রামের রাজা। বউ মা’র এই সাহসিকতায় তারা মুগ্ধ আর তাই কাল তাদের ওখানে উৎসব এর আয়োজন করা হয়েছে। আমরা স্বপরিবারে আমন্ত্রণ পেয়েছি। সেতো ভালকথা। আমরা নিশ্চয়ই যাবো।

বউ আমার সাথে কোন কথা বলে না। সারারাত দুই জন দুই পাশে শুয়ে ছিলাম। ওর হাতে মোটা বেন্ডেজ। কিছুটা জরও আছে। কপালে যে হাত দিয়ে দেখবো সেই সাহসটাও পাচ্ছি না। এই পৃথিবীতে আমার মত ভীতু মানুষরা খুব অসহায়। আর যদি পাশে থাকে এমন একটা বউ তাহলে তো আর কথাই নেই। সকালে নাস্তা না খেয়েই আমরা স্বপরিবারে রওনা হলাম। আজ ওখানেই সারাদিনের সব আয়োজন। ঢাক ঢোল এর আওয়াজ হচ্ছে। আমরা পৌঁছানো মাএ দাদা দাদী আর বাকি সবাই কে ফুলের মালা দিয়ে বরন করে নিলো। আমাকে আর জয়াকে কিছু লোক এসে আলাদা করে নিয়ে গেলো।

পাহাড়ের উপরে এই সমতল জায়গায় উৎসব বসেছে। সবার মাঝখানে খানদানি দু’টো চেয়ারের সামনে আমাদের দাঁড় করানো হলো। যেহেতো আমরা তাদের ভাষা বুঝিনা তাই ইশারা ইঙ্গিতেই সব বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমার আর জয়ার গলায় ইস্পেশাল মালা পড়ানো হয়েছে। মালাটি বন্য লতাপাতা, ফুল আর পশুপাখির হাড় দিয়ে তৈরি। দু’জন উপজাতি সুন্দরী নারী মৃদু হাসতে হাসতে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। হাতে তাদের দুইটা মুকুট। এমন মুকুট ডিসকভারি চেনেলে রেড ইন্ডিয়ানদের মাথায় দেখা যায়। পাখির পালক, সামুক আর ঝিনুক দিয়ে তৈরি। আমাদের পড়িয়ে দিয়ে বসতে বলা হলো। বুঝতে পারলাম বউ মাঘ মারায় সে এখন বাঘ মারি রানী আর যেহেতু আমি তার স্বামী সুতরাং আমি বাঘ মারি রাজা।

কিছুখন পর আমাদের পায়ের কাছে মরা বাঘটাকে এনে রাখা হলো। বাঘের শরীরে এমন বিশ্রী গন্ধ আগে জানতাম না। মনে হচ্ছে বমি করে ফেলবো। এখন অবশ্য কিছু করার নাই। আমি এখন রাজা। ওদের খুশি করাই এখন আমার কাজ। এতে যদি মরা বাঘের মাংসও খেতে হয়ে তাও খেতে হবে। বউ এর দিকে তাকাতেই বউ মুখ পেঁচিয়ে ভেংচি মারলো। মনে হয় আমাকে দেখে খুশি হয় নি। যাই হোক, আজ আমি গর্বিত স্বামী। তার কারনে আজ আমি রাজা। দু একটা ভেংচি খাওয়াই যেতে পারে কি বলেন!

উৎসব শুরু হয়ে গেছে। মাটির ছোট পাএ করে বিশেষ এক ধরনের পানীয় দেয়া হলো আমাদের। আমিও এক নিঃশ্বাসে ঢকঢক করে গিলে ফেলাম। স্বাধটা কিছুটা ঝাঝালো আর কিন্চিত তেতো হলেও মন্দ না। চারপাশে ডজন কয়েক নর নারী ঢোল এর তালে তালে গান গাইছে আর নাচতেছে। গান আর নাচের কোন আগা মাথা বুঝতেছি না। তবুও ঢোলের তালে তালে আমি আর জয়া মাথা দোলাছি আর বুঝিয়ে দিচ্ছি তোমাদের রাজা রানী তোমাদের নাচ গানে খুব সন্তুষ্ট। পানিটা খাবার পর থেকে মাথাটা কেমন যেন ঘুরাচ্ছে। চোখ দুটো আসতে আসতে ভারি হয়ে এলো। আশেপাশের সবকিছু ঝাপসা দেখছি। মাথা আমার যে দিকে নিচ্ছি সে দিকেই যাচ্ছে। বুঝতে আর বাকি নেই, পাহাড়ি মদ গিলে ফেলেছি। নাও এবার ঘুমিয়ে পড়া যাক।

ঘুম ভাঙ্গলো জয়া আর দাদীর কাথা বার্তায়। পাশের ঘরে বসে ভালই গল্প শুরু করেছে। মাথাটা এখনও ঝিমঝিম করছে। কে বা কারা আমাকে এখানে দিয়ে গেছে আমি জানি না। রাজা হওয়ায় হয়তো যাতায়াত ব্যবস্থা ফ্রি ছিলো। তবে অনেক কিছু যে মিস্ করেছি তাতে কোন সন্দেহ নেই। নাহঃ! ওই পানীয় খাওয়াটা ঠিক হয়নি। বউ আর কোন দিন বাঘ মারবে না আর আমিও কোন দিন আর রাজা হবো না। মাঝখান থেকে উৎসব দেখাটা আর হলো না। আচ্ছা দাদী, একটা কথা জিজ্ঞেস করি? বউ মা’র কান্ড দেখও, কিছু বলবে তার জন্য অনুমতি চাইতে হবে নাকি? বলো মা, কি বলবে? আপনার ছেলেকে ফিরে পেতে চান না? চাইলেই কি সব হয় বলো। পৃথিবীতে এমন কোন মা আছে যে তার সন্তানকে দূরে সরিয়ে রাখে!

আমি বাব’কে কল্ করবো। আপনি বাবা’র সাথে কথা বলবেন। ও কি আমার সাথে কথা বলবে? কথা বলতে চাইলে তো অনেক আগেই বলতো। বছরের এর পর বছর গেলো। কই কোন দিন তো মা বলে একটা ডাকও দিলো না। তার আগে আমাকে আর একটা কথা বলেন। মা হিসেবে ছেলের উপর কি আপনার কোন অধিকার নেই? ছেলে আমার! আমি পেটে ধরেছি, আমি জন্ম দিয়েছি। অধিকার যদি কারো থাকে সেটা একমাএ আমারই আছে। তাহলে কেন অধিকার খাটাবেন না? মনের সব কিছু মুছে ফেলে বাব’কে বলেন চলে আসতে। আমার বিশ্বাস বাব আপনার কথা ফেলবেন না। আমি কল্ দিচ্ছি আপনি বাবা’র সাথে কথা বলেন। বেশ, তাই করো।

আসসালামুয়ালাইকুম বাবা। ওয়ালাইকুম আসসালাম বউ মা, কেমন আছো? জী বাবা ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন? আছি মা ভালই আছি। তা কোন সমস্যা হচ্ছে না তো ওখানে? জী না বাবা, কোন সমস্যা হচ্ছে না। বাবা আপনাকে একটা কথা বলার জন্য কল্ দিয়েছি। হ্যে বলো, কি কথা? কথা বলতে কি! একজনের সাথে আপনাকে কথা বলিয়ে দিবো। ওঃ কে সে? আপনি নিজেই না হয় কথা বলে জেনে নেন। আচ্ছা দাও, ফোনটা তাকেই দাও।

হ্যালো,আমাকে চিনতে পেরেছিস? জী না ঠিক চিনতে পারলাম না। আমি সেই মানুষ, যে তোকে দশ মাস পেটে ধরেছি। আমিই সেই মানুষ যে তোকে পৃথিবীর মুখ দেখিয়েছি নিজে প্রসব বেদনা সহ্য করে। এখন চিনেছিস্? মা! তুমি? হ্যে আমি, এখনও মরিনি। তোর মুখটা দেখার জন্য আল্লাহ আমাকে আজও নেয় নি। তোকে একটা কথা বলার ছিলো। বলো মা, কি কথা? আমি কোন দিন কোন কিছু চাইনি তোর কাছে। কিন্তু আজ চাইবো। আমি যদি তোকে জন্ম দিয়ে থাকি, যদি তুই আমার সন্তান হয়ে থাকিস্ তোকে মাতৃতের ঋণ শোধ করতে হবে। কাল সকালে আমি ঘুম থেকে উঠেই তোর মুখ দেখতে চাই। তুই কি করবি আমি জানি না। আমি জানতেও চাই না।

সারাটা রাত আমাদের কারো চোখে কোন ঘুম নেই। বাবা’র সাথে কথা বলার পর থেকেই দাদী এখন পর্যন্ত কেঁদেই চলেছেন। কেনই বা কাঁদবেন না। মা’র মৃত্যুর পর আজ প্রথম বাবা দাদীর সাথে কথা বললেন। যুগের পর যুগ লুকোনো অভিমান গুলো আজ চোখের পানি হয়ে ঝরে পড়ছে। হয়তো বাবাও বাসের জানালা দিয়ে দূর পথের দিকে তাকিয়ে নিরবে কেঁদে যাচ্ছেন। বৃদ্ধ মায়ের কোলে ফিরে আসছেন তার হারানো সন্তান। সন্তান ও আজ ফিরে পাবে মায়ের কোল নামক বেহেশত এর ছায়া। এ এমনই এক বন্ধন কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে গেলেও কখনও ভেঙ্গে যায় না। মাতৃতের স্বাদ আর মায়ের স্বাদ যে পায় তার কাছে পৃথিবীর অন্য সকল স্বাদই অস্বাদ সমতুল্য।

আমার অফিসের ছুঁটি শেষ হওয়ায় আর সেখানে থাকা হলো না। বাবা তার মায়ের কোলে ফিরে গেলেন। আমি আর জয়া ফিরে এলাম ঢাকায়। আমাদের ভাঙ্গা সংসারটা আবার জোড়া লেগে গেলো। এ সব কিছুর অবদান জয়া’র। পৃথিবীতে এখনও জয়া নামের কিছু ভাল মানুষ বেঁচে আছে। যারা জানে কি করে ভালবাসতে হয়। কি করে ভালবাসার মানুষ গুলোকে কাছে টানে নিতে হয়। জীবনে ভয় আর সংশয় এ দু’টো দিয়ে কখনই কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। ওর কাছ থেকে এগুলা আমি খুব ভাল করেই শিখেছি। আর তাই বাকিটা জীবন জয়া’র হাতেই তুলে দিলাম। কারন আমি জানি, জয়া’র জয়ধ্বনি আমাকে কখনও রাজা না বানাতে পারলেও কখনও প্রজা বানাবে না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত