আমি মাছি! এটাই আমার পরিচয়। এছাড়া আর কিছু বলার নাই। ও হ্যে আছে, আমি লোকমান মিয়ার ভাত এর হোটেল এ থাকি। ভাত ছাড়াও এখানে পাবেন নানান পদের মিষ্টি, জিলাপি, ছানা আর দই। গরিব মানুষ এর দোকান তো তাই সব কিছুই বিক্রি করে। আমি কিন্তু একা থাকি না আমার পরিবারও আমার সাথে এখানেই থাকে।
দুঃখের কথা কি বলবো বলেন, গ্রামে মাছি হয়ে জন্মানোই একটা পাপ। ভাল কিছু যে খাবো সে উপায় নাই। শহরে জন্মালে কত কিই না খতে পারতাম। বাসি পচা খাবার খেয়ে কোন মতে আপনাদের দোয়ায় বেঁচে আছি। আমার পরিবার অবশ্য মিষ্টি দই এগুলা খায় কিন্তু আমি খাইনা। মিষ্ট দেখলেই কেমন যেন বমি বমি লাগে। মিষ্টি কিছু হইলো! ইয়াককক! কেমন যেন সারা মুখ আঠালো হয়ে আসে। ইয়াককক! ইয়াককক! ইয়াকককক! আমি মিষ্টি মোটেও পছন্দ করি না। অবশ্য আমার ছোট ভাই আর আম্মার মিষ্টি খুব প্রিয়।
লোকমান মিয়া গরিব মানুষ। মাথার উপরে টিনের চাল এর এই দোকানটাই তা সম্বল। আমি চাল এর বাঁশের উপরে বসে থাকি আর সারা দিন গুন গুন করে গান গাই। খাবারের সময় খাই আর ঘুমাই। একটা জিনিস কি বুঝতে পেরেছেন! আমি কিন্তু বেশ অলস! হি হি হি।
অনেকখন ধরে লোকমান মিয়া আর কর্মচারী মিলে কি যেন একটা বানাছে। আমি বাঁশের উপরে বসে মনযোগ দিয়ে দেখছি। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না। চুলার উপরে চিনি’র রস জাল দিয়ে ঘন করা হচ্ছে। ছানা গুলো হাতে ঘষে ইয়া বড় বড় গোল্লা করে রেখে দিছে। মিষ্টি তো এতো বড় হয় না! তাহলে ছানার এতো বড় গোল্লা দিয়ে করবে টা কি! নাহ! কিছুই তো বুঝতেছি না। আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি তো আছিই। যে করেই হোক এর রহস্য বের করতেই হবে।
খানিক বাদে ছানার গোল্লা গুলো চিনির সিরায় ডুবিয়ে ঢেকে দেয়া হলো। আমার চোখ গুলো ক্রমেই বড় হচ্ছে। কি বেপারটা চলছে এখানে! কিছুই তো বুঝে মাথায় ঢুকছে না। আমার কৌতুহল আরো কয়েক গুন বেড়ে গেলো। সারা শরীর টানটান হয়ে আছে দেখার জন্য, কি হবে এর পর?
ও মা! একি! ছানার গোল্লা গুলো ফুলে ইয়া মোটা হয়ে গেছে। সাদা ধবধবে গোল্লা গুলো রসের মধ্যে ডুবছে আর ভাসছে। ওফ! এতো সুন্দর কেন তুমি! তুমি রসে ডুব দাও আমি ভাসি তুমি ভাস আর আমি ডুবি। কি তোমার নাম ও গো রুপসী! ছানার বড় গোল্লা না কি তুমি? না না, এতো সুন্দর একটা জিনিসের নাম এত বিশ্রী হবে না। যে দেখতে সুন্দর তার নামও হবে সুন্দর। আমি দেখতে বিশ্রী তাই আমার নাম মাছি। দেখেছো আমি কি বুদ্ধিমান! কথার ছলে নিজের নামটাই বলে দিলাম। আচ্ছা, তোমার নামটা কি?
লোকমান মিয়ার ক্যাশ টেবিলের উপরে বড় এক গামলায় ঢেলে রাখা হয়েছে রস ভরতি ছানার বড় বড় গোল্লা। এ যেনও স্বচ্ছ পুকুরের পানিতে সাদা রাজহাঁস এর সাতাঁর কাটা। আমি নয়ন ভোরে আঁড়াল হয়ে তারে দেখি! কে তুমি? কে তুমি ওগো সুন্দরী! রাতের আকাশটা আজ বড়ও সুন্দর। টিনের ফুঁটো দিয়ে পূর্নমার চাঁদ দেখছি। আর ভাবছি, কি নাম দেব তোমার! কি লোকমান মিয়া! আছো কেমন? জী ভাল আছি। কিছু লাগবো? হও, এ কেজি মিষ্টি দাও। আজ নতুন মিষ্টি বানাইছি। রসগোল্লা নাম! দিমু না কি এক কেজি?
আহ! কি তার নাম! রসগোল্লা! রসে ভরপুর গোল্লা তুমি তাই তোমার নাম রসগোল্লা। হুম, এমনটাই তো হওয়ার কথা! অপরুপা তুমি, তোমার নামটা এমনই হতেই হয়। এ জীবন আমার থেমে ছিল হয়ত তোমাকে দেখার জন্যই। কই কত মিষ্টিই তো এলো চোখের সামনে। কেউ তো কোন দিন তো আমার ভালবাসা পায়নি। তবে কি আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি? ছিঃ কি লজ্জা!
লোকমান মিয়া মাজে মাঝেই হাতের চামুছ দিয়ে রসগোল্লা নেড়ে দেয়। রসগোল্লা ভাসে, রসগোল্লা ডুবে! আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখি। সত্যিই তোমাকে ভালবাসে ফেলেছি রসগোল্লা। আমি আর পিছু ফিরতে চাই না। নাহ! মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো। লোকমান মিয়ার ভাঙ্গা টেপরেকর্ডার এ বাজতেছে বুড়া মার্কা গান। এই বুড়া লোকমান মিয়ারে নিয়া আছি আরেক যন্তনায়। রোমান্টিক মুহূর্তে কোন গান শুনতে হয় এ বেটা তাও জানে না। আর এ গান তো হবে এমন তুমি ভাসও ও রসগোল্লা যৌবনের রসে আমি মাছি গাই গান আর নাচি গানের তালে তুমি ডুবও তুমি ভাসও তুমি আমার প্রাণ এর প্রাণ আমি তোমার জন ছাড়তে পারি দেহ মনও প্রাণ।।
হায় সর্বনাশ! সব রসগোল্লা তো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। না এ হতে পারে না! রসগোল্লা শুধু আমার। আমাকে যে করেই হোক রসগোল্লার কাছে গিয়ে আমার ভালবাসার কথা বলতেই হবে। একবার হলেও তার ভালবাসার রসে আমাকে ডুব দিতেই হবে। আমি দুই পাখ ছড়িয়ে উড়াল দিয়ে সাঁইসাঁই করে ছু্ঁটে চলছি রসগোল্লার দিকে। হঠাৎ লোকমান মিয়ার হাত পাখার বারি খেয়ে ছিঁটকে পড়লাম কয়েক হাত দূরে। আবারও উড়াল দিলাম। আবারও লোকমান মিয়ার আঘাত। মাখায় এবার বেশ জোরে ব্যথা পেয়েছি। কোন মতে উড়ে এসে আবার বাঁশের উপরে বসলাম। তবে কি রসগোল্লার কাছে আর যাওয়া হবে না! তবে কি আমার প্রেম বৃথায় যাবে? নাহ! কিছু তেই না! যে কোন কিছুর বিনিময় হলেও আমি আমার রসগোল্লার কাছে যাবোই। কিন্তু আর কি উড়তে পারবো! পাখাটা মনে হয় ভেঙ্গেই গেলো। মাছি আর রসগোল্লার ভালবাসার মাঝে দেয়াল হয়ে আছে বুড়া লোকমান মিয়া। লোকমান মিয়া ইতিহাস তোমাকে ক্ষমা করবে না, কোন দিন না লোকমান মিয়া। মীরজাফর এর নামের পাশেই তোমার নাম থাকবে এ বেপারে কোনও সন্দেহ নাই।
আমি অপেক্ষা আছি কখন লোকমান মিয়া একটু সময় এর জন্য ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমিয়ে পড়লেই আমি আমার রসগোল্লার কাছে একটা উড়াল দিয়ে ছুঁটে যাব। হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে এই ভর দুপুরবেলা লোকমান মিয়া হঠাৎ করেই টেবিলের উপর মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। এইতো সুযোগ! আমি আর দেরি করলাম না। ভাঙ্গা পাখা আর এক বুক ভালবাসা নিয়ে উড়ে এসে সোজা গিয়ে পড়লাম রসগোল্লার উপর।
আমার রসগোল্লা! আমার ভালবাসা! এই তো আমি তোমার কাছে। তোমাকে শক্ত করে জরিয়ে ধরেছি। আজ নিশ্চয়ই বুঝেছো তোমার রসগোল্লার মাছি তোমাকে কতটা ভালবাসে। আমি সত্যিই তোমাকে অনেক ভালবাসি রসগোল্লা। কি বেপার কি ভাবছো? আমি পাখায় ব্যথা পেয়েছি কি না? ধুর পাগলী! ভালবাসাটাই এমন। কষ্ট না করলে কি আর ভালবাসা স্বার্থক হয়! কষ্ট না করলে নিশ্চয়ই তোমার কাছে আসতে পারতাম না।
হুম! হয়েছে এবার আমাকে ছাড়। আর জরিয়ে ধরে রাখতে হবে না। জানি তো তুমিও আমাকে অনেক ভালবাসও। সবার সামনে এভাবে জরিয়ে ধরে রাখতে হয় না লক্ষীটি। আমার বুঝি লজ্জা করে না! ছাড় না সোনা আমার। হয়েছে তো অনেক! লোকমান মিয়া টের পেলে ভালবাসা ছুঁটিয়ে দিবে সারা জন্মের জন্য। ছাড় এবার দুষ্টু সোনা! ছাড়ও না!
আরে এতো মহা বিপদ! এতো দেখি কোন মতেই ছাড়ে না। রসগোল্লার রসে আমার সারা শরীর আটকে গেছে। মুখ রসে ভরে দম আটকে আসছে। নিঃশ্বাস নিতে ভীষন কষ্ট পাচ্ছি। কোন ভাবেই তো নিজেকে ছাড়াতে পারছি না। ইয়া আল্লাহ! এখন কি হবে! ওই লোকমান ভাই উঠেন! আমারে বাঁচান। এই দেখেন মাছি এসে আপনার রসগোল্লা খেয়ে ফেললো। আরে ভাই উঠেন না! হয়েছে আজ সর্বনাশ! গেলাম তো রসগোল্লার রসে আটকে। এই ছিলো তোর মনে! কলঙ্কিনী রসগোল্লা। প্রেমের নামে এমন প্রতারনা করলি!
আমি আর পারলাম না নিজেকে এমন রসগোল্লার প্রেম থেকে ছাড়াতে। লোকমান মিয়া আজ রাজ্যের ঘুম দিয়েছে। শেষ নিঃশ্বাসটা এখানেই ত্যাগ করতে হবে। ভাবছি এমন প্রেম করার কি দরকার ছিল যেখানে জীবনটাই হারিয়ে ফেললাম। আবার এও ভাবছি আমি মাছি যদি রসগোল্লাই না ভালবাসি তবে আমি কি করে রসগোল্লার মাছি হলাম। আর আমি না ভালবাসলে রসগোল্লার ভালবাসারও তো কেউ নেই। ভালবাসা মানেই তো ত্যাগ। আমি না হয় আমার জীবনটাই ত্যাগ করে দিলাম! তাতে কি ক্ষতি! হয়ত এটাই রসগোল্লার ভালবাসা। একবার বুকে টেনে নিলে আর কখনই ছাড়তে চায় না। তাই আর অভিমান করিনি। দু’হাতে জরিয়ে ধরে রসগোল্লার বুকেই শেষ নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়েছি।