আমরা সবাই মিথ্যাবাদী

আমরা সবাই মিথ্যাবাদী

ইট পাথরে ঘেরা এই শহরে শিমুলের সংসার। বউ আর ছোট একটা মেয়ে নিয়ে কোন রকমে কেটে যায় দিন। রোজ বাড়ি ফিরলে সেই ছোট মেয়েটি বাবা বাবা বলে জরিয়ে ধরে আর জানতে চায়, আমার ঈদের জামা আননি বাবা? রোজই মেয়েকে মিথ্যে সান্তনা দিয়ে বলতে হয় এতো আগে কিনলে জামা যে পুরোন হয়ে যাবে। তখন লোকে বলবে এটাতো পুরোন জামা। ঈদের ঠিক আগেই তোমাকে কিনে দেব। অথচ রাত পোহালেই ঈদ। লেম্প পোষ্টের আলোয় ফুটপাতে বসে থাকা শিমুল এর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আজ মেয়েকে কি বলে সান্তনা দেবে! শরীর এর ঘামে ভিজে যাওয়া সার্ট আর পরে থাকা রং চটা প্যান্টটা যদি কেউ কিনতো! কতই বা দাম দেবে? কেউ কি কিনবে? এসব ভাবতে ভাবতে উপচে পরা চোখের জল ভাসিয়ে দিয়ে গেলো শিমুলের দুটি গাল। আর তখনি অন্ধকার হয়ে আসতে চায় পুরো পৃথিবী। আবারও নতুন কোন মিথ্যে নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। হ্যা, শিমুলরা রোজ মিথ্যে বলেন। তাদের মিথ্যে বলতে হয়। কারন শিমুলরা মিথ্যাবাদী।

টিউশোনির টাকায় কোন রকম দিন যাচ্ছে হিমেলের। এর মাঝে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত জাহানারা ইমাম দুই মেয়ে নিয়ে এখন ছেলের এখানেই থাকেন। অভাবের এই সংসারে দু’বেলা চুলো ধরানো হয়ে যায় পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন তম কাজ। যখন সবার শেষে হাড়ি মোছা ভাতের শেষ অংশটুকু মুখে দিয়ে ছেলে প্রশ্ন করে মা তুমি খেয়েছো? জব্বাবে জাহানারা ইমাম রোজ বলেন হ্যা আমি খেয়েছি তুই খা। কখনও বলতে শোনা যায় আমার ক্ষুধা নেই। কখনও বা একটি সত্যকে ঢাকতে গিয়ে বলতে হয় হাজারো মিথ্যা। শূন্য পাতিল পিটিয়ে প্লেটে ভাত বারার শব্দ শুনিয়ে ঘুম পড়াতে হয় প্রিয় সন্তানদের। জাহানারা ইমামদের মিথ্যে বলতে হয়। কারন তারা মা। আর মা’রা মিথ্যাবাদী।

সবে মাএ বুঝতে শিখা রিহান আজ আর খেলার মাঠে যায় না। এই ভর বিকেলে ঘরে বসে থাকায় টিয়া বার বার জানতে চায় কেন সে আজ ঘরে? খেলার ব্যাট না থাকায় তাকে কেউ খেলতে নেয় না। অবহেলায় মাঠের এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সন্ধা পর্যন্ত। রিহান জানে তার মা অথবা বাবার সামর্থ নেই তা কিনে দেবার। শরীর খারাপের অযুহাতে মায়ের চোখ ফাঁকি দিলেও মন আর দূর দৃষ্টি পরে রয় খেলার মাঠে। রিহানের মিথ্যে যেন তার মা’কে হার মানিয়ে দেয়। হ্যা, রিহানরা মিথ্যে বলে। রোজই বলে, কারন রিহানরা মিথ্যাবাদী।

বহু কষ্টে সমাজের জাত রাখতে ঋণের বোঝা নিয়ে বড় মেয়েকে পার করলেন হারুন সাহেব। সংসার নামক জাহানামের আগুনে রোজই পু্ঁড়ছে বীনা। কখনও সেই আগুন শরীর এর চামড়া ভেত করে খুঁনতির ছ্যাকা। কষ্টের তীর্বতা সয়ে যাওয়ার নামই হয়েছে জীবন। এ জীবন নামক দেয়াল ভেত করার সামর্থ যে তার নেই। ঘরে এখনও আছে অবিবাহিত দুই বোন। তাই মুঠো ফোনের ওপাশে ভেসে আসা বাবা নামের মানুষটির কন্ঠে কন্ঠ দিয়ে বলতে হয়, বাবা আমি অনেক ভাল আছি, সুখে আছি। হ্যা, বীনা মিথ্যে বলে। বীনাদের মিথ্যে বলতে হয়। কারন বীনারা মিথ্যাবাদী।

সবে মাএ পাশ করে বেরিয়েছে শিহাব। জেবীন এর সাথে চার বছরের সম্পর্ক যেনো শেষ হয়ে যায় যায় অবস্থা। বিয়ের পিড়িতে অচেনা কাউকে বিয়ে করতে নারাজ জেবীন অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে কখন শুনবে একটা চাকরী পেয়েছে। তাই রোজ চাকরীর খোঁজে ভোরের আলো ফুঁটতেই বেরিয়ে পরা শিহাব শূন্য হাতে মাঝ রাতে বাড়ি ফেরে। চাকুরীর আশা দেয়া বড় ভাই আর আত্মীয় স্বজনরা আজ আর কেউ যোগাযোগ রাখে না। বন্ধ হতে থাকে একের পর এক সব দরজা। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া শিহাবের বুক ভাঙ্গা দীর্ঘ নিঃশ্বাস শিহাবকে কাঁদতে দেয় না। করন লোক সমাজে পুরুষদের কাঁদতে দেয়া হয় না। ও দিকে জেবীন এর উৎকন্ঠায় যখন নিজের কাছেই আশার আলো নিভে যায় তখন মিথ্যে আশার আলো জ্বালিয়ে বলতে হয়, আরেকটু সময় দাও। চাকরী হয়ে যাবে।
শিহাবরা মিথ্যে বলে, রোজই বলে। কারন শিহাবরা যে মিথ্যাবাদী।

মৃত্যুও যেন ভুলে গেছে রশিদ সাহাবকে। বয়স আশি পেরিয়েছে অনেক আগেই তবু মৃত্যুর দেখা নেই। ছেলে, ছেলের বউ আর নাতি নাতনী নিয়ে ভাড়া বড়িতে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস গুনছেন। ছেলের আয়ে এ যুগে সংসার চালাতে গিয়ে নিজের ছেলের বয়সটাও তার বয়সে গিয়ে ঠেকেছে। চোখের সামনে রোজকার সংসার এর বাজার আর ছোট বাচ্চা গুলোর আবদার মিটাতে হিমশিম খাওয়া এই সংসারে নিজেকে বড় একটা বোঝা মনে হয়। এ বয়সে বেঁচে থাকতে হলে বেঁচে থাকতে হয় ওষুধ নামের কিছু অখাদ্য খেয়ে। অভাব নামের এই সংসারে ওষুধ নামের দামী খাবার খেতে রশিদ সাহেবের আর ভাললাগে না। এর মাঝে যখন ছেলের বউ বলে উঠে ঘরে চাল নেই। চাল না নিয়ে আসলে আজ রাতে আর রান্না হবে না। তখন ওষুধ লাগবে কি বাবা? এমন প্রশ্নে বলতে শোনা যায়, না ওষুধ তো শেষ হয়নি। শেষ হলে আমি নিজেই বলবো। অথচ ওষুধ ফুরিয়েছ দু’দিন হলো। বাবা নামের এই রশিদ সাহেবরা এই বুড় বয়সেও মিথ্যে বলেন। রশিদ সাহেবদের মিথ্যে বলতে হয়। কারন বাব’রা মিথ্যাবাদী।

বছর খানিক হলো জান্নাতের বাবা মারা গেছেন। তাই মা, ছোট ভাই আর বোনটার দায়িত্ব এখন তার হাতেই। অনার্স এর তৃতীয় বর্ষে থেকেও তা আর শেষ করা হলো না। বিপদ যেন তার পিছু নিয়েছে। হঠাৎ মায়ের ক্যান্সার, কেমো দেবার টাকা যোগাতে আজকাল তাকে অফিসের বড় কর্তাদের বিছানার সঙ্গি হতে হয়। কখনও বা রাতের নিশ্চুপে আলোকিত হোটেলের পেছনের গেট দিয়ে বাড়ির রাস্তা খুঁজে বেড়াতে হয়। সংসার বাঁধার স্বপ্নটা ধূলোয় ছুঁড়েছে অনেক আগেই। নিজের জীর্ন দেহটাকে কোন ভাল মানুষের হাতে তুলে দেয়া যায় না। বিবেক সেখানে বিষধর সাপের মত দংশন করতে থাকে। আর তাই ছয় বছরের সম্পর্কের ইতি টেনে রফিকে সোজা জানিয়ে দিল, আমি ভাল আছি। আমাকে আর বিরক্ত করো না। অন্য কাউকে বিয়ে করে তুমিও ভাল থালো। জান্নাতরা এভাবেই মিথ্যে বলে। জান্নাতদের মিথ্যে বলতে হয়। কারন জান্নাতরা মিথ্যাবাদী।

সবার প্রয়োজন মিটাতে হিমশিম খাওয়া জলিল আজ একটু যেন বেশিই খুশি। দু’হাত ভরা জামা কাপড়ের পেকেট। বাব-মা, ভাই বোন সবার জন্য ঈদের কেনা কাটা করে মনের সুখে আজ আর বাসে না উঠে রিক্সা করে বাড়ি ফিরছেন। রিক্সার ভাড়া দিতে গিয়ে হা হয়ে গেলেন। পকেটে খুচরা কিছু টাকা ছাড়া আর কোন টাকাই নেই। তবে কি বেতনের সব টাকা কেনাকাটা করতেই খরচ করলেন! সামনের মাসের বেতন পেতে এখনও পনেরো দিন বাকি। নিজের মন কে বুঝ দিলেন, না হয় কিছুটা পথ হেঁটেই যাবেন। ছোট ভাই এর হঠাৎ প্রশ্নে বিব্রত হবার পাএ তিনি নন। তাই বলে উঠলেন আরে বেটা আমার কি তোদের মত সেই বয়স আছে যে ঈদ এলেই নতুন জামা কাপড় কিনতে হবে আর ওগুলা পড়ে রাস্তায় ঘুরবো! অথচ এই সংসার এর ঘানি টানতে গিয়ে তার আজও বিয়ে করা হলো না। জলিলরা আসলেই মিথ্যেবাদী, প্রচন্ড পরিমানে মিথ্যাবাদী। এরা এমন মিথ্যাবাদী এরা সবার সামনে হরহর করে মিথ্যে বলে যায়। কারন জলিলরা মিথ্যুক। জলিলরা মিথ্যাবাদী।

আমার কিছু কথা: মিথ্যে বলা মহাপাপ। তারপরও আমরা এই কাজটি প্রতিনিয়তই করে যাচ্ছি। কিন্তু কেন? এর উওরটা আমরা সবাই জানি। কথায় কথায় আমরা বলি আমার জীবনটা আমার। না, আমাদের জীবনটা কখনই আমাদের না। আমাদের জীবনটা আমাদের প্রিয় মানুষ গুলোর। আর তাই প্রিয় মানুষ গুলোকে ভাল রাখতে প্রতিনিয়ত আমরা মহাপাপের মত হাজারো পাপ করি। শুধু এতোটুকুই চাওয়া, ভাল থাকুক আমাদের প্রিয় মানুষ গুলা। বেঁচে থাকুক আমাদের প্রিয় মানুষ গুলো।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত