নিস্তব্ধ পাড়ার ঘুম ভাঙালো লরির চাকার বিশ্রী আওয়াজটা। ভোর হবে হবে সবে। হুড়মুড় করে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। দোতলার ব্যালকনি থেকে উঁকি দিতেই দেখি, ইটভর্তি দৈত্যাকার লরিটা নির্মলদার ভিটের সামনে।
পঁচিশটা বছর আগে এই মস্ত ভিটেতেই ছিল আভা বৌদির নন্দনকানন। সত্যি স্বর্গের উদ্যান বটে। বছরের বারোমাস কত পরিশ্রম, কত যত্ন! ফলাফলে মিলত পথ চলতি লোকজনের অবাক করা দৃষ্টি আর প্রশংসায় ভরা দু’চার কথা।
পাড়ার সব মাঝবয়সী পুরুষ হিংসে করত নির্মলদাকে। বউয়ের মতো বউ পেয়েছে! নিজে তো প্রায় গোটা বছরই অফিসট্যুরে আজ পাটনা তো কাল ভুবনেশ্বর। দস্যি ছেলেমেয়ে দু’টোকে সামলেও কী সুন্দর বাগানের যত্ন নিত বৌদি!
যমজ ছেলেমেয়ে মেঘ আর বৃষ্টির সে বছরই মাধ্যমিক। টেস্ট হয়ে গেছে। হঠাৎ এক দুপুরে বাড়ি এসে মেঘ জোরে হাঁক পাড়ল – কাকু, আদিত্যকাকু, তাড়াতাড়ি এসো; মা জানি কেমন করছে।
বাড়ির লাগোয়া দোকানের ঝাঁপ ফেলে যেতে বড্ড দেরি করে ফেললাম। ততক্ষণে সব শেষ। হাই প্রেসার আর সুগার অকালে প্রাণটা কেড়ে নিল। আভাবৌদির নিথর দেহটা লাল রঙের শাড়ি, সিঁদুরে সাজিয়ে ওরই নিজের গড়া নন্দনকাননের মাঝে রাখা হলো। নির্মলদা রাঁচি থেকে ফিরছে। মেঘবৃষ্টিকে কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছে না। আমার গিন্নিই প্রাণপণে শক্ত করে ধরে রেখেছে দু’জনকে।
অকাল বর্ষণও নামল। জানুয়ারির শীতে এক পশলা বৃষ্টি। সাদা গোলাপগাছটার একটা পাতাও দেখা যাচ্ছে না। পাড়ার দুই বৌদি ওই সাদা গোলাপগুলো দিয়েই একটা মালা গাঁথলো। নির্মলদাই বৌদির বুকে রাখল মালাটা, দাঁতে দাঁত চেপে চলল শ্মশান পর্যন্ত।
নির্মলদাও চলে গেল গত বছর। মেঘ-বৃষ্টি অনেক বছর ধরেই প্রবাসী। গত মাসে দু’জনেই একসাথে দেশে ফিরে বসত ভিটের পাকাপাকি ব্যবস্থা করে গেল। সেদিনই রাতের বিছানায় গিন্নির দীর্ঘশ্বাসের রঙ বদলে গেল– ভাগ্যিস! আমি কাউকে পেটে ধরিনি!
সব ইট নামিয়ে ফিরে চলল লরি। পুবের রোদ এসে পড়েছে ব্যালকনিতে। সকাল সকাল মনটা হু হু করে উঠল। তখনই চার-পাঁচটা বাচ্চার আওয়াজ কানে এলো। উঁকি দিতেই দেখি– ফুল চুরি করতে বেরিয়েছে বাচ্চাগুলো। কিন্তু নির্মলদার বাড়ির ধ্বংসস্তূপে কী দেখছে ওরা! এ কী! পাতাহীন ডালে সাদা গোলাপটা অমন রঙরূপ নিয়ে কী সুন্দর উজ্জ্বল হয়ে আছে!