কৃষ্ণচূড়া বৃদ্ধাশ্রম

কৃষ্ণচূড়া বৃদ্ধাশ্রম

একমাত্র ঘুমের ভেতর জীবনের সহজ সরল অথবা খুবই জটিল কিছু অর্থ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায় ব্রতী চৈতালি বেগম স্নানাহার ফেলে ক্ষয়ে যাওয়া বীভৎস শরীর নিয়ে ঘুমের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে জীবনধারণ বা জীবনযাপন করবে ইদানীং। তাছাড়া কখনো খুব বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়বে চৈতালি বেগম, কেননা স্বপ্নের ওপর তার কোনো হাত থাকবে না, অথচ স্বপ্ন দেখতে দেখতে ক্রমশ তাকে হাঁপিয়ে উঠতে হবে এবং কখনো বুকের বাম অথবা ডানপাশে শুন্যতাবোধের করাল ছোবলের মুখোমুখি হতে হবে, তখন সে আচমকা নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে বসবে, কিন্তু যদিও বলা যায় আপেক্ষিকভাবে যে, বেঁচে থাকা থেকে অব্যহতি পাওয়ার পথ রুদ্ধ, আবার রয়েছে আত্মহত্যার মত সহজ এবং সরল সমাধান, কিন্তু চৈতালি বেগম যেহেতু এখন পর্যন্ত সে পথে পা মাড়ায় নি, কাজেই বর্তমানে চৈতালি বেগমের আবাস হবে নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, রাজশাহী অথবা সিলেটের কোনো এক বৃদ্ধাশ্রম এবং সেখানে কাটবে তার জীবনের গোধূলিবেলা।

কিন্তু তার ছেলে সজল শেখ বর্তমান চিন্তাচ্ছন্ন মননে জটিল বিভ্রান্তির শিকার হয়ে ডালিম গাছের ডালে সদ্য উড়ে আসা পাখিটির দিকে তাকাবে, কিন্তু শত চেষ্টা করেও যখন সে পাখিটির নাম স্মরণ করতে ব্যর্থ হবে, তখন পাখিটিকে বিশ্লেষণ করতে শুরু করবে এবং অকস্মাৎ শান্তার কপালে গোলগাল টকটকে লাল টিপের কথা মনে পড়বে, পাখিটির পেছনে যে লাল অংশ আছে সেটির উপমা হিসেবে কল্পনা করবে কপালের লাল টিপ এবং উপমা বেমানান মনে হওয়ায় পেছন ফিরে তাকানোমাত্র গোধূলির টকটকে লাল সূর্যকে উপমা হিসেবে বেছে নেয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হবে, সুতরাং পাখিটির নাম জানার কৌতূহল মেটাতে বর্তমানে কাউকে না কাউকে তো জিজ্ঞেস করতে হবে, যেহেতু এই সময় রমেশের আবির্ভাব ঘটবে এবং প্রশ্নটি ছুঁড়ে দেয়া হবে মূলত তাকেই, কিন্তু রমেশ উত্তর প্রদানের আগেই নিজের মধ্যে যখন সে আবিষ্কার করবে পাখিটির নাম বুলবুলি, তখন তার মায়ের কথা মনে পড়বে।

সজল শেখ মায়ের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পর হঠাৎ সে কোনো এক বন্ধুর ভাড়া করা বাসায় গিয়ে উঠবে, কেননা বন্ধুদের সাথে দীর্ঘদিন ধরে তার দেখা সাক্ষাৎ নেই, আবার সেসময় তার খুবই প্রয়োজন হবে টাকার এবং সজল শেখ অবাক হবে যখন দেখবে যে, নগ্ন একটি মেয়ের সাথে কতিপয় বন্ধু আদিম উল্লাসে মেতে উঠছে, যদিও সে সেখান থেকে চলে আসতে পারে, কিন্তু সে আসবে না, কেননা ততক্ষণে কোনো এক বন্ধু তাকে অফার করবে নারী স্পর্শের এবং সে স্বভাবতই প্রত্যাখ্যান করতে চাইবে। যেহেতু টেবিলের ওপর হাতের কাছে সাজানো থাকবে কিছু সংখ্যক বই এবং স্বভাবতই সে একটি বই হাতে নেবে এবং বইয়ের পাতা ওল্টানোর চেষ্টা করবে এবং আরো অবাক হবে যখন সে বইয়ের প্রতিটি পাতা জুড়ে দেখবে পর্ণগ্রাফি, তখন সে অপ্রস্তুত হয়ে বইটি টেবিলের ওপর রাখবে, মেঝেতে তাকাবে এবং দেখবে নারী পুরুষের পোশাক, তখন সে প্রথম অনুভব করবে নিজের শরীরে সেই নারীর স্পর্শ, তাছাড়া বেশ্যা মেয়েটির প্রতি তার মনে জন্মাবে না কোনো সহানুভূতি, কিংবা মনে সঞ্চারিত হবে না বন্ধুদের প্রতি কোনো ক্ষোভ, বরং আদিমতা থেকে সরে এসে পরিশেষে, সে বন্ধুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে সটান বাসে উঠে পৌঁছাবে মায়ের কাছে ঢাকা, রাজশাহী অথবা চট্টগ্রামে অবস্থানরত সেই বৃদ্ধাশ্রমে, বরং এখন সেই বৃদ্ধাশ্রমের নাম দেয়া যাক কৃষ্ণচূড়া বৃদ্ধাশ্রম। চৈতালি বেগম ছেলের দিকে তাকাবে যেভাবে পৃথিবীর দিকে সূর্য ছড়ায় রৌদ্রচ্ছটা, কাজেই শতচ্ছিন্ন বস্ত্রের মত কষ্টে থেকেও চৈতালি বেগমের দন্তহীন মুখে হাসি ফুটে উঠবে, কিন্তু সজল শেখ তখনও নির্বিকার এবং সে তখনও জানেবনা কী অপেক্ষা করছে ভবিষ্যতে, তবে কল্পনার আঙিনায় নিমেষেই সজল শেখ দেখতে পাবে, প্রিয় পেশা অধ্যপনা করে সে যখন বাসায় ফিরছে, তখন মা হাসছে ঠিক এভাবেই এবং স্বামীর অপেক্ষার প্রহর গুনছে শান্তা, এবার কল্পনার ভূখণ্ড ছেড়ে কৃষ্ণচূড়া বৃদ্ধাশ্রমে সজল শেখ মাকে জড়িয়ে ধরবে এবং চৈতালি বেগমের সেই হাস্যোজ্বল মুখ মেঘের ভেতর হারিয়ে যাবে পলকেই এবং অতিক্রান্ত কিছু সময় পরে সজল শেখকে সেখান থেকে ফিরতে দেখা যাবে জাদুঘরে, পার্কের বেঞ্চে, চা বাগানে, তিস্তার ধারে অথবা তাজমহলের পাশে, কিন্তু সে যেখানেই থাক পাশে থাকবে শান্তা, আজীবন না হোক, অন্তত সে সময় এবং শান্তা যখন বলবে, বাবা আমার বিয়ে ঠিক করছেন, তখন সজল শেখের নিশ্চুপ থাকা ছাড়া যদি কিছু করবার থাকে, সেটি হলো আকাশে তাকিয়ে থাকা এবং সে আকাশে তাকাবে, তখন শান্তা অভিমান করে চলে যাবে এবং সেই চলে যাওয়া হবে জীবনের শেষ চলে যাওয়া। একদিকে বৃদ্ধাশ্রমে মায়ের আবাস আবার প্রেমিকাচ্যূত হয়ে এমন একটি বিপর্যস্ত জীবন নিয়ে কি করবে সজল শেখ, এটি সজল শেখকে যতদূর না ভাবায় তার চেয়েও বেশি ভাবায় আমাদের, এখন সে এমন একটি সিদ্ধান্ত নেবে যা ক্রমশ আমাদের মগজে এমন একটি ছাপ রেখে যাবে, যা হয়ে উঠবে আমাদের নিজস্ব অনুভব এবং সজল শেখকে নিজেদের চেনা বাস্তবতায় খুঁজে পাব আমরা, যেমন পাই দেবদাস, পোষ্টমাস্টার আর রাসকলনিকভকে কিংবা সজল শেখকে আমরা সেভাবে নাও পেতে পারি কেননা সেই ব্যর্থতার দায়ভার বর্তাবে সজল শেখের ওপর অথবা স্বয়ং গল্পকার বহন করবে সেই দায়ভার।

সজল শেখ পৌঁছে যাবে দুঃখ কিংবা দৈন্যের শীর্ষ সীমায় এবং সেই দৈন্যদশা দেখে বন্ধুর আনুকূল্যে সজল শেখ নিজস্বতা থেকে সুদূর অবস্থানে দাঁড়িয়ে থেকেও দেখা যাবে সে ঢুকছে ঘুপচি গলির ভেতর, যেখানে সারি সারি মর্ত্যের অপ্সরী পরিলক্ষিত হবে এবং বদ্ধ ঘরে নব্বই বছর বয়সী গ্যাবোর উপন্যাসের চরিত্রের মত সে সেই কক্ষে প্রবেশ করবে এবং জীবন হোঁচট খাবে কল্পনাতীতভাবে, কক্ষের অভ্যন্তরে যে নগ্ন মেয়েটি দেখা সে সজল শেখের বোন, হয়তো ইডিপাসের মত সে নিজের দুচোখ অন্ধ করে ফেললেও আমরা অন্তত স্বস্তি পেতাম অথবা ঝট করে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লেও আমরা সজল শেখকে সম্মিলিতভাবে স্যালুট দিতাম, কিন্তু সজল শেখ নিজের বোনের সাথে বলাৎকারে লিপ্ত হবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, কেননা একই মায়ের উদরে জন্মেও সূর্য থেকে বিচ্ছিন্ন দুটি ভিন গ্রহ ঘুরছে জীবনের ঘূর্ণিপাকে এবং তখন পর্যন্ত কেউ কাউকে চেনে না।

বিড়ালের ম্যঁও ম্যঁও শব্দে ঘুমনগরে কোলাহল তৈরি হলে অতি হঠাৎ ভেঙে যাওয়া ঘুমে সজল শেখ ফোন বেজে ওঠার শব্দ আবিষ্কার করবে এবং যখন সে শুনবে মা লোকান্তরিত, তখন সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়বে এবং দাঁত মাজার অভাব অনুভব করলে দেখতে পাওয়া যাবে তার হাতে টুথব্রাশ, ঠিক সেই সময় একটি মশা তার গালে বসবে এবং সজল শেখের হাতের থাপ্পড়ে মশাটি শাহাদাতবরণ করবে, তাছাড়া কিছু সময় অতিক্রান্ত হবে মশাটির দিকে তাঁকিয়ে এবং কিছুক্ষণ পর তাকে শেভ করতে দেখা যাবে এবং আরও কিছুক্ষণ পর সে কৃষ্ণচূড়া বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে, যদিও মায়ের মৃত্যুতে মোটেও তাকে শোকাহত বা বিচলিত মনে হবে না।

বলাৎকারে লিপ্ত বেশ্যা মেয়েটি প্রথম সজল শেখের নজরে আসবে কৃষ্ণচূড়া বৃদ্ধাশ্রমে এবং সে ধরেই নেবে এখানেও হয়তো তার কোনো ক্লায়েন্ট আছে, তবু ভদ্রতার খাতিরে সজল শেখকে কথা বলতে দেখা যাবে বেশ্যা মেয়েটির সাথে, মামুলি দু চারটে কথার ফাঁকে সজল শেখ জানতে পারবে তার মত বেশ্যা মেয়েটির মা লোকান্তরিত এবং পৃথিবীর সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মঞ্চে তারা আবার মিলিত হবে এবং চৈতালি বেগমের লাশের পাশে বেশ্যা মেয়েটি আপন ভাই সজল শেখের সাথে পরিচিত হবে এবং দুজন জানতে পারবে মা একই হলেও দুজনের বাবা ছিল ভিন্ন এবং সজল শেখ নিজের মাকেও সেসময় বেশ্যা ভাবতে শুরু করবে, তখন সজল শেখের চোখ জানালার বাইরে একটি পাখির দিকে নিমজ্জিত হবে এবং প্রথম দর্শনেই সে সুনিশ্চিত হয়ে উঠবে পাখিটির নাম বুলবুলি।

সড়ক দুর্ঘটনায় যদি সজল শেখসহ তার রক্ষিতা অথবা তার বোন নিহত হত, আমরা বিচলিত হতাম না, অথবা আত্মহত্যা করে জীবনাবসান ঘটত তাদের, তাতেও অস্বস্তিবোধ আমাদের স্পর্শ করতো না, কিংবা সৃষ্টিকর্তার কাছে নতজানু হয়ে পরস্পর মার্জনা ভিক্ষা করলে, হয়তো তাদের ওপর তখন আমরা সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতাম, কিন্তু গল্পকার আমাদের নিয়ে যান ভিন্ন এক বাস্তবতায় এবং ঠিক তখন আমরা সজল শেখ, রক্ষিতা বোনকে তিরস্কার করি এবং ভাবোদয় হলে সেই তিরস্কার গিয়ে পৌঁছায় গল্পকারের ওপর যখন তিনি বলতে শুরু করেন:

সজল শেখ অনুভব করবে রক্ষিতা বোন ব্যতীত সে চলবে না চিন্তায়, ভাবনায় অথবা নিঃশ্বাসে, অন্যদিকে রক্ষিতা বোনও হৃদয়ের খুব নিকটে সজল শেখের উপস্থিতি টের পাবে এবং মায়ের লাশ দাফনের পরদিন সজল শেখকে পুনরায় বেশ্যালয়ে দেখা যাবে এবং প্রথম বারের মত কোনো বন্ধুকে ছাড়া, একা এবং সেই যাতায়াত চলবে নিয়মিত।

প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনোপোতা আবিষ্কারের মত আমরা যখন কৃষ্ণচূড়া বৃদ্ধাশ্রমের খোঁজে পথে বের হই, তখন আমরা অতি ঘোর বিভ্রান্তিতে পড়ি এবং কোথাও সেটির সন্ধান না পেলে, আমরা খুঁজে পাই কোনো এক গল্পকারকে যিনি আমাদের এমন এক বাস্তবতার সম্মুখীন করান, যা আমাদের ঘাবড়ে দ্যায় এবং আমরা যখন তাকে তিরস্কার করতে শুরু করি, তখন দেবদারু গাছে একটি পাখি দেখতে পাই এবং সজল শেখের মত হঠাৎ আমরা সমস্বরে বলে উঠি পাখিটির নাম বুলবুলি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত