ইলেক্ট্রিসিটিহীন প্রায় জঙ্গলের মতো প্রত্যন্ত এ তল্লাটে সন্ধ্যার পর থেকে নেমে আসে অঘোষিত কারফিউ। পুরো লোকালয় তখন চলে যায় হিংস্র জানোয়ারদের শাসনে! রাতের বেলা জন্তুদের দাপাদাপি, শেয়ালের হুক্কাহুয়া আওয়াজে সজাগ হয়ে যায় ঘুমন্ত মানুষও। একটু কান পাতলে আঙিনায়, দহলিজে শুনা যায় পশুদের পায়ের শব্দ। বাদুর চামচিকারা চষে বেড়াচ্ছে দুর্দান্ত প্রতাপে। দিনের বেলা গাছের ডালে নিরীহভাবে ঝুলে থাকলেও রাতে তাদের উৎপাত বেড়ে যায়। তাদের দাঁত, নখ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না কাঁচাপাকা কলার কাদি, পেয়ারা এবং অন্যান্য ফলমূলও। সন্ধ্যার আগে যে ফলটি অক্ষত তরতাজা; পরদিন উঠে দেখা যায় ক্ষত বিক্ষত। বন্য জন্তুদের কাছে এখানকার মানুষজন প্রায় জিম্মি। হাঁস, মুরগি, ছাগল হিংস্র জানুয়ারদের পেটে চলে যাওয়া এখন নিত্যকার ঘটনা। পঞ্চাশোর্দ্ধা সন্তানহীনা বিধাবা রমিজার ছাগলটাকে এই সেদিন চোখের সামনে শিয়ালরা ধরে নিয়ে গেলো। বাধাঁ দেয়ার একটুও সাহস হলো না তার। পরদিন পাশের কচুক্ষেতে পাওয়া গেলো আধ খাওয়া মাথা, হাড্ডি, চামড়া। দেখে ছেলেমরা কান্নায় ভেঙে পড়ে রমিজা বিবি। তার একটি মাত্র ছাগলের কথা মনে পড়লে রমিজা বিবি এখনো কাঁদে আর অভিশাপ দেয়।
তবারক মাতব্বরের ঘরে গত তিন বছর থেকে যে কাজের ছেলেটি ছিল গত কয়েকদিন থেকে তাকেও পাওয়া যাচ্ছে না। ছেলেটা নিষেধ সত্ত্বেও রাতে বিরাতে একা একা ঘুরতো, বাঁশি বাজাতো। সবার ধারনা তাকে বাঘ বা ভাল্লুক ধরে নিয়ে গেছে। কোন মায়ের বুক খালি হলো গো কে-জানে। দিনের বেলা মহিলাদের গল্প গুজবে বিভিন্ন কানকথাতো প্রচলিত আছেই।
আজকাল রাতে এখানকার লোকজন বাইরে বের হয় না বললেই চলে। সন্ধ্যার আগে আগেই তারা বাজার সওদা, প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সেরে ঘরে ফিরে। সন্ধ্যার পর খাওয়া দাওয়া শেষ করে যতো দ্রুত পারে বাচ্চাদের নিয়ে চলে যায় বিছানায়। হিংস্র জানোয়ারদের চোখের আড়ালে থাকতে তারা কুপিবাতিগুলো নিভিয়ে রাত্রির আন্ধারে এমন ভাবে মিশে যায়, কোন সাড়া শব্দ তখন থাকে না। খিলবদ্ধ ঘরে কেউ আছে কিনা বাইরে থেকে বুঝার উপায় নেই।
সুরত আলি এমনিতেই কিছুটা ভিতু টাইপের মানুষ। সব কিছুতে তার আলগা ভয়। তার ঘরটাও অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন এবং একটু দূরে প্রায়। নিতান্ত গরিব মানুষ। সবার মতো সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যার আগে আগে সে ঘরে ফিরে। তার অতিরিক্ত ধারনা, মানুষের সুরগোল শুনলে হিংস্র জানোয়াররা টের পেয়ে আক্রমণ করে বসবে। তাই রাতে সে কাউকে উচ্চ স্বরে কথা বলতে দেয় না। বলতে গেলে এটা তার ঘরে ঘোষিত আইন। সুরত আলির এই আইন সবাই মেনে চললেও তার যে তিন মাস বয়সি বিদ্রোহী মেয়েটি তা যেন পরোয়া করে না। সুরত আলির আইন লঙ্ঘন করে জোর চিৎকারে কেঁদে ওঠে বারবার। একটু শান্ত হলেও পরক্ষণে আবারো সেই আন্ধার এফোঁড় ওফোঁড় কান্না। সুরত আলি তাতে বিরক্ত হয়। শুধু বিরক্তি নয়, ভয়ও! আজ এমনিতেই তার মেজাজটা একটু বেশি খারাপ। বিড়ি না হলে তার চলে না। আজ সে বিড়ি আনতে ভুলে গেছে। ঘরে একটিও বিড়ি আজ নেই। বিড়ির নেশা খুব কামড়াচ্ছে তাকে। আজ তার ঘুমানোও দায়! খাটের উপর বড় মেয়েটটা গভীর ঘুমে শ্বাস টানছে। সেই শ্বাসটাও তার কাছে অসহ্য লাগছে। অতটুকুন মেয়ে এতো জোরে শ্বাস টানে কেন? ইচ্ছে করে এক থাপ্পড় দিয়ে মেয়েকে তোলে জিজ্ঞাস করে। সে আবার সার্টের পকেট, বালিশের নিচে, চাটির তলে তন্ন তন্ন করে খোঁজে– বিড়ির একটি টুকরোও পায় না।
সুরত আলি বউকে জিজ্ঞাস করে– একটা বিড়িও নাই?
আমি কি কইমু। বিড়ি আমি খাই না আনি।
বউয়ের এমন উত্তরে সন্তোষ করে না। সুরত আলির রাগ আরো বাড়ে। রাগে গিজ গিজ করে বউয়ের দিকে চোখ লাল করে তাকায়। কোন ছুতা খুঁজে পায় না। দিনের বেলা হলে বাচ্চাটির কান্না থামানোর ব্যর্থতায় বউর পিঠে দু একটা বসিয়ে দিত। এখন রাত্রিকাল। সে শোরগোল বাড়াতে চায় না। গর্দান ফুলিয়ে ক্রোধ গলনালি করে। বউর প্রতি তার যে ভালবাসা ছিল ফের মেয়ে জন্ম হওয়াতে তাও উবে গেছে। ঝগড়ার ছলে বউকে খেটকি দিয়ে বলে-আকামা মাগি কোনখানের, মাইয়া বিয়ানো ছাড়া তোর কোন কাম নাই। এবার একটা পোলা বিয়াইতে পারলে না?
এ্যাঁ, মাইয়া পোলা যেমন আমি বানাই, খামোখা আমাকে গালি দিবা না কইলাম? বউ উত্তর দেয়।
সুরত আলি বউকে ধমক দেয়– চুপ থাক শালি। মুখে মুখে তর্ক করে। ইতা দিয়া কি করতাম। আমার আছে নি অতোটা, খাওয়াইয়া পড়াইয়া বিয়া দিমু। তোর বাপেরতো কুলাইতো না দু টেখা দেওয়ার।
মাইয়্যা অনেক কামও আয়। পোলাও হকল সময় কামও আয় না। আসব আলির জোয়ান দুইটা পোলা থাকতে ভিক্ষা করে ক্যান দেখো না। এখন মাইয়্যা পোলা সবাই সমান। সমান অধিকার। আমি লেখা পড়া করাইমু।
সুরত আলি ভেংচি দিয়ে বলে– এ্যাঁ, ফকিন্নির হাউসতো কম না। নিজে খাইবার পায় না, মাইয়্যা লেখা পড়া করাইবার খোয়াব দেখে।
তুমি কি জানো? লেখা পড়া করাইতে টেখা লাগে না। এখন ইস্কুল গেলে সরকার টেখা দেয়। খাইবার পাই না হিডা আমার দোষ না। তুমি খাওয়াইতে পার না কেন? বউ উত্তর দেয়।
সুরত আলি এমনিতেই মুখের ওপর তর্ক সহ্য করতে পারে না। শেষের কথায় সে আরো চেতে ওঠে। বউর দিকে তেড়ে যায়-হারামজাদি মুখের ওপর কথা কয়। আমি না খাওয়াইলে কি তোর বাপে খাওয়ায়? মুখ বেশি বাড়ি গেছে, এক্কেবারে সিলাই দিলাইমু। হাত প্রসারিত করলেও মারে না। আবার গুটিয়ে নেয়। বউ বিড়বিড় করে কি বলে সুরত আলি তা শুনতে পায় না। সুরত আলি বউর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে রয়।
রাত যতো গভীর হচ্ছে মেয়েটিরও কান্না ততো বাড়ছে। বউ মেয়েটিকে কোলে নিয়ে এদার ওদার করে। স্তন মুখে দেয়। একটু থামলেও খানিক পরে আবার সেই চিৎকার। সুরত আলি রাগে ফুঁসফুঁস করে। কিছু বলে না। তার ক্ষোভ জমা হয় বউর ওপর। মনে হয় সারাদিন ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল। এখন না ঘুমিয়ে যন্ত্রণা করছে। দিনমান কাজ করে ঘরে ফিরলেও রাতে একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারে না। হিংস্র জন্তুদের ভয় তাছাড়া এখন বৈশাখ মাস উপনীত হয়েছে। আকাশে মেঘের ডাক শুনলে রাতে আর তার ঘুম হয় না। আজ বুঝি তার নড়েবড়ে ঘরটা উড়িয়ে নিয়ে যায় বা ভেঙে মাথায় পড়ে। ছন পচে খসে গেছে। বৃষ্টি হলেই সারা ঘর ভাসবে। ভিজে জুবুথুবু হয়ে যাবে। সারাদিন সে মানুষের কাজে শ্রম দিলেও নিজের ঘর মেরামতে একটু সময় হয় না তার। ঠিক করবে করবে করে বৈশাখ মাস চলে এসেছে। বাঁশও যোগার হয়নি। তবারক মাতব্বরকে গতকাল বলেছিল দুটো বাঁশ দেয়ার জন্য। মাতব্বর অবশ্য রাজি হয়েছে। বলেছে– বৃহঃবার বাঁশ কাটতে মানা, অন্যদিন নিও। মাতব্বরের ঝাড় থেকে বাঁশ এনে সময়ক্ষেপন না করে আগে তার ঘরে হাত দিবে।
রাত ঘনানোর সাথে বিড়ির নেশা এখন আরো বেড়েছে। তিন মাসের মেয়েটি আবার চিৎকার দিলে অন্ধকারে বউর দিকে ফের অগ্নিচোখে তাকায়। রাত্রির আন্ধারে সুরত আলির চোখের সেই দাউ দাউ আগুন বউ দেখতে পায় না। বউকে চাপা কণ্ঠে গালি দেয়। বউ মেয়েটাকে বার বার সামলানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। কান্না থামে না। কান্না আরও শাণিত হয়। বলকানো ক্ষোভে সুরত আলি এবার উঠে আসে। দাঁত কিরমিরিয়ে মেয়েটার মুখ চেপে ধরে। চিপা গলায় গালি দেয় শুয়োরের বাচ্চি…! বউ তখন তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। মেয়েটি আরো জোরে কাঁদে। কান্নার আওয়াজে চারপাশ কাঁপিয়ে দিচ্ছে। এতোটুকুন মেয়ে, গলায় এতো জোর নিয়ে এসেছে! সুরত আরি আবারও চাপা কণ্ঠে বউকে ধমক দেয়– আবার চিৎকার দিলে আছার মারি মারিলাইমু। বউও কান্না থামানোর চেষ্টা করে যায়। মেয়েকে নিয়ে গিয়ে ঘরের এককোণে আশ্রয় নেয়। বুকে চেপে এধার ওধার হাঁটে।
একটা চামচিকা ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। অন্ধকার ঘরে মাথার ওপরে এদিক ওদিক উড়াউড়ি করছে। ঘরের পিছে শিম ঝাড়ের নিচে কিসের নাড়াচাড়া আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। সুরত আলির উদ্বেগ আরো বাড়ে। এই মেয়ে বুঝি এবার তাকে বাঁচতে দিবে না। সে যেন এক যমদূত জন্ম দিয়েছে। চিৎকার করে হিংস্র জন্তুদের নিমন্ত্রণ জানাচ্ছে। আত্মগোপন করেও তার শেষ রক্ষা হবে না আজ। রাতের গভীরতা অনুমান করতে চেষ্টা করে। কিছুই বুঝতে পারে না। তবে এতোটুকু বুঝেছে– রাত যে আরো গভীর হয়েছে। বাইরে বাতাসের শাঁ-শাঁ শব্দ। সুরত আলি বেড়ার ফাঁকে উকি দিয়ে সন্তর্পণে বাইরের দিকে তাকায়। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। ঘনসিয়া আন্ধারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তার পেঁপে গাছে বাদুরের খেঁচাখেঁচি, চেঁচামেচি শুনতে পায়। সম্ভবতো সব খেয়ে সাবাড় করে দিচ্ছে। ‘দূর যা’-টাও করতে পারছে না। বেড়ার ফাঁকে চোখ রেখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, হঠাৎ তার চোখ পড়ে উঠানের এক কোণে। দেখতে পায় একজোড়া চোখ জ্বলজ্বল করে জ্বলছে সেখানে। তা দেখে সুরত আলির বুক ধকধক করে। এমন সময় তার তিন মাসের কন্যাশিশুটি আবারও জোর চিৎকারে কেঁদে ওঠে। সুরত আলি এবার তেড়ে যায়– রাখ হারামজাদির গলার জোর থামাইয়ার। আজ জিত্তা মাটিত কবর দিলাইমু। এবার বউও তার দিকে চেতে ওঠে– কিতা আরম্ব করছো। নিজর মাইয়ারে খেয়ে ফেলতে চাও? তুমি আর বন’র জন্তুর মাঝে কোন ফারাক আছে? তুমি আস্তা একটা জানুয়ার!
বউয়ের কথাগুলো গরম তেলের মতো তার গায়ে লায়ে। সুরত আলি ক্ষিপ্র গতিতে বউর চুল খামচে ধরে। শালি তোর গলায়ও জোর বাড়ছে, সময় দেখছস? মা-মেয়ে হক্কলটিরে জিত্তা কবর দিমু। তাতে সুরত আলির বউর গলার জোর আরো ঝাঁঝালো হয়– হ, পারয়বাতো, গায়ে জোর আছে শুধু আমরার ওপর জোর খাটাইটে পারো। তোমরা মাইয়্যা মাইনষের ওপর জোর খাটানো ছাড়া আর কি পারো? গায়ে যদি এতো জোর থাকে পাড়ার হক্কল পুরুষ মিলিয়া জন্তু-জানুয়ারদের তাড়াইতে পারো না? আমরার সাথে বাহাদুরি না করি জানুয়ারদের সাথে লড়ো। হক্কলে রেহাই পাইমু। দুয়ার লাগাইয়া চুপ করি আর কতো দিন থাকবায়?
বউয়ের এমন ঝাঁঝালো গলায় সুরত আলির জ্বলে ওঠার কথা। কিন্তু সে এবার জ্বলে ওঠে না। সহসা সে চুপসে গেলো।
বাইরে বাতাস আরো ভারি হয়ে বইছে। ঘরের চাল মেড়মেড় করছে। সুরত আলি অন্ধকারে ঘরের চালের দিকে তাকায়। বেড়ার খুঁটি নেড়েচেড়ে পরখ করে নেয়। খানিক চুপ থেকে পরে বউর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে– বউ! মনে হয় কালবইশাখী আইবো। বউ নির্লিপ্ত স্বরে বলে– আসমান ভাঙ্গিয়া আউক। ঘর’র চাল উড়াইয়া লইয়া যাক তাইলে খিল লাগাইয়া চুপ করি থাকতে হইবো না। কতো কইছি বইশাখ আওনের আগে আগে ঘর ঠিক করো। কথা কানে জায়গা দিছো? আমার কোন কথা কানে যায় না। ঘরে আসি মাইয়া মাইনষের সাথে মাইর করা ছাড়া আর কিচ্ছু পারো?
সুরত আলির কণ্ঠে আর জোর নেই। দমকা বাতাসে যেন সে নিভে গেছে। গলার স্বরটা এখন তার মতোই নিরীহ।
– মাতব্বর কইছে বাঁশ দিবো। আজ রাইতটা পার হইলে কাল ঠিক করিলাইমু।
আজ রাইত পার হইলে না?
ঝড়’র বেশি ভাব দেখলে মাতব্বর ওখানে যাইমুগি।
মাতব্বর কি অতো রাইতে দরজা খুলবো?
ক্যান খুলতো না। সারাদিন তার খেতে কাম করি। এক রাতের লাগি কি আশ্রয় দিতো না?
অতো রাইতে যাইবায় কেমনে, জন্তু-জানুয়াররা তোমারে খাইতো না?
আরে কি কও, লাঠি আছে। লাঠি দেখলে কি একটাও সামনে থাকবো?
বউ আর কোন কথা কয় না। কোলের মেয়েটা স্তন চুষতে চুষতে ঘুমিয়ে পড়ছে। খাটের উপর বড় মেয়ে ঘুমের ঘোরে কি সব বলছে। হয়তো স্বপ্ন দেখছে। সুরত আলি পাশের ঘরে চলে যায়। অন্ধকারে সে তার লাঠি হাতড়ায়।