৩ ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেছে। শুয়ে ছিলাম নাকি আধশোয়া ছিলাম আমার তেমন মনে নেই। যতটুকু মনে পড়ে, দরজা খোলাই ছিলো। আমি বাইরে উঠোনের দিকে তাকিয়ে আছি। ঘরের মধ্যে মেয়ে অবয়বের কেউ একজন ঢুকলো। বাইরে মায়ের সাথে কথোপকথনে বুঝলাম অবয়বটি আমার বোন। কথোপকথনটি ঠিক কি নিয়ে তা আমার শ্রবণেন্দ্রিয় পুরোটা গ্রহণ করছে না। আবার ঠিক এড়িয়েও যাচ্ছে না। ইন্দ্রিয় সংগ্রাহক বোধহয় চাচ্ছে কিছুটা তথ্য জমা করে রাখতে। এই ভাসা ভাসা অস্পষ্ট তথ্যেও আমার অনুভূতি যে জেগেছে তা বুঝতে পারলাম। তবে অনুভূতিটা কেমন তা বোঝাতে পারবো না। পরিচিত কোনো অনুভূতি যে নয় তা স্পষ্ট। বোন এবং মায়ের কথোপকথনের কিছুই আমি ধরতে পারছি না। তবে আমার অবেচেতন মন যেন সব বুঝে নিয়েছে। সংগ্রাহকের সব ভাসা ভাসা তথ্য মিলিয়ে নিজের মতো গল্প তৈরি করে ফেলেছে। এবং সংগ্রাহক কোষসমূহ উদ্দীপ্ত হয়ে আমাকে সেই গল্পই দেখাতে চাইছে। কিন্তু আমার চেতন জগত তখনো অসার। অবচেতন জগতের মেলানো গল্প তখনো আমার চেতন জগতে আসেনি। ফলে আমি বুঝতে পারছি না প্রকৃত তথ্য কী! সব মিলিয়ে কেমন একটা দ্বিধার মধ্যে আছি। খুব বড় কিছু ঘটে গেছে এবং সবাই সেটা জানে। কিন্তু কেবল আমি জানি না। এটাই আমাকে অস্থির করে তুলছে।
আমি নির্নিমেষ তাকিয়ে আছি। আমার কাছে মনে হতে লাগলো, পরম কাঙ্ক্ষিত কিছুর জন্য আমি অধীর অপেক্ষায় আছি এবং এখনি তা ঘটতে চলেছে। আমি যেন কোনো একটা রহস্যের মধ্যে আছি। রহস্যের খুব কাছাকাছি চলে গেছি কিন্তু সবকিছুকে মেলাতে পারছি না। যেন আমার স্নায়ুতন্ত্রে নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে এবং তার স্থায়িত্ব খুব অল্প সময়ের। যেন আমার মস্তিষ্ক এই ক্ষুদ্র সময়কে দীর্ঘ করে আমাকে অন্য জগতে নিয়ে যেতে চাইছে। একটা লম্বা গল্পকে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ফ্রেমে আনতে চাচ্ছে।
একটা মেয়ে। আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পরে না। খুব বেশি জৌলুস নেই বেশভূষায়। যৎ-সামান্য সাঁজ। মুখটাতেও একটু ময়লার আভা। খুব বেশি অকৃত্রিম এবং ধীর। মেয়েলি সম্পদ বলতে যা বিবেচনায় ধরা হয় তেমন নেই। মেয়েলি ভাবের থেকে নারীত্বই বেশি। দরজার ফাঁক গলিয়ে যতটুকু দেখা যায় ততোটুকুই আমার দেখা। খুব সাবলীল ভঙ্গিমায় হেঁটে টিউবয়েলের দিকে গেল। যেন রোজকার চেনা এই বাড়ি।
এই প্রথম আবিষ্কার করলাম আমি বসে আছি। এও বুঝে গেছি এতক্ষণ যে অস্থিরতা আমাকে জেকে বসেছিলো তা আসলে কিসের জন্য। রহস্যের ফলাফল আমার মস্তিস্কে এসে গেছে এবং মস্তিস্ক তার নিজের ওয়েতেই পরবর্তী পদক্ষেপ সাজাতে ব্যস্ত। কিন্তু আমার মস্তিস্কের একটা অংশ এখনো অনেক তথ্য মেলাতে পারছে না। হুট করে শুরু হওয়া গল্পের কেবল চূড়ান্ত পরিণতিটা জানতে পেরেছে। মাঝের তথ্যগুলো এখনো অন্ধকারে রয়ে গেছে। যার জন্য কেমন একটা দোলাচলতা রয়েই গেছে।
আমার কাছে মনে হচ্ছে কোনো ভাবে এই মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। কিন্তু কবে হয়েছে , কিভাবে হয়েছে , সেই অংশটুকু যেন আমার মেমোরিতে নেই। খুব জটিল পরিস্থিতিতে যেমন খুব ভাল প্রোগ্রামও ঠিকমত রান হয় না, মস্তিস্কের প্রোগ্রামও কিছু কিছু সময় তেমন জট পাকিয়ে যায়।হঠাৎ করে শক পেলে কিংবা দ্রুত তথ্য জানতে চাইলে অনেক সময় মস্তিস্ক সঠিক সিগন্যাল পাঠাতে পারে না। ফলে এমন হয় যেন সমস্ত মেমোরি ব্ল্যাংক হয়ে গেছে। সবকিছু কেবল সাদা।
আমি এই সাদা অংশটুকু পড়তে চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না। এই উত্তর জানতে যে সময়ের প্রয়োজন তার আগেই অন্য ঘটনা সামনে এসে যাচ্ছে। যার জন্য এই অংশটুকু বাদ রেখেই আমাকে পরের ঘটনার জন্য প্রস্তুত হতে হচ্ছে। এবং সেটা খুব চতুর ভাবেই আমাকে করতে হচ্ছে। এখানে আমি বলতে আমার মস্তিস্ককে বোঝাচ্ছি। এতক্ষণে যে সব ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাতে সন্দেহ থেকেই যায় সত্যিই আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছি কিনা।
যতটুকু মনে পড়ে, মেয়েটি আমার রুমের দিকে আসছে।আমার ভেতরে ইতস্ততবোধ বাড়তে লাগলো। আমি ঠিকমত তাকাতে পারছি না। অপরাধীরা যেমন চোখে চোখ রাখতে পারে না আমিও তেমন অন্যদিকে তাকিয়ে আছি।
আমি বুঝতে চেষ্টা করলাম। আমার আসলে খারাপ লাগছে না। বেশ ভালোই লাগছে। একটা শিহরণ ভাব খেলে যাচ্ছে রক্তের ভেতর। কোথাও একটু টান, কোথাও একটু সংকোচ।আমি অবাক হলাম। কাউকে এতো সহজেই এতো আপন লাগছে কেন আমার? মরুভূমির প্রান্তরে তৃষ্ণার্ত পথচারীর মতোই আমিও কি তৃষ্ণার্ত? যেন এক পসলা বৃষ্টি কিংবা এক পেয়ালা পানিই এই শিহরণের কারণ?
মেয়েটি বোধহয় আমার পাশেই বসেছিলো। আমি অন্যদিকে তাকিয়ে। আমি জানি এটাই আমাদের প্রথম দিন। প্রথম সাক্ষাৎ।
– তুমি কি এর আগে আমাকে কখনো দেখেছো?
– হ্যা, দেখেছি। সরল উত্তর।
– তুমি এখন কী করছো?
– আপনার পাশে বসে আছি।
– না আসলে পড়াশোনা?
– বিবিএ করছি।
আমার খুশির অন্ত রইলো না। ব্যবসামুখী ছেলের বউ বিবিএ পড়ছে এর থেকে খুশি কি হতে পারে? মনে মনে মায়ের তারিফ করতে থাকলাম।
আমি পাশ ফিরে মেয়েটির মুখের দিকে তাকালাম। কিছুটা ঝাপসা। অন্ধকার। স্পষ্ট একটা অবয়ব থেকে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি হাতটা ওর কাঁধের উপর রাখতে চাইলাম।
৩ ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেছে। আমি এখনো শুয়েই আছি।মেয়েটার মুখটা মনে পড়ছে না। ওর কাঁধে সত্যিই হাত রেখেছিলাম কিনা আমার তেমন মনে নেই।