শাস্তি

শাস্তি

আমি দেবী। বয়স আমার তেমন না। সবে ষোল। কিছুদিন হলো বাবুদের জমিদার বাড়িতে আমার যাতায়াত। আমার বাপ মরার পর মা জমিদারদের বাড়িতে ফরমায়েশি খাটে। মাসিক দু আনা মাইনে। দুবেলা ভাত— তা মাগনাই খেতে দেয় বটে। গেল বসন্তে জমিদার বাড়ির খাস মালি স্বগ্গে গেলে জমিদার গিন্নী আমার মাকে ডেকে কইলেন, “বলি ও মালা তোর মেয়ে কে বলিস আমি সুধিয়েছি, এসে যেনো রোজ মালা গেঁথে দেয় ঠাকুরের জন্নে। মালিটা তো মরে গেলো গাছগুলো অযত্নে মরো মরো, তোর মেয়েটা এসে গতর খাটালেও তো হয়!”

“জে গিন্নি মা। দেবী রে পাইটে দেবো।”

গিন্নী মা সদয় হওয়াতে এই বাড়িতে আমার পা পড়লো। পেথ্থম যেদিন গিন্নি মা আমায় দেখলেন সেদিন মাকে ডেকে কইলেন, “বলি কই গেলি রে দেবীর মা, মেয়ে তো তোর সত্যিই দেবী, অমন দুধে রাঙ্গা গা, অমন কাজল কালো ডাগর চোক, মেঘ বরন কেশ, অমন ডালিম রাঙ্গা ঠোঁট, এ মেয়ে তো সাত পুরুষের মাতা খাবে। এ তো মানবী নয় গা অপসরা। তা হ্যাঁগা দেবীর মা, দেবীব বাপ কি ব্রাহ্মণ ছিল নাকি রে?”

মা একটু লাজুক হেসে কইলেন, “তা ছিল বটে। (দীর্ঘশ্বাস) একন হয়তো স্বগ্গে খুব সুকেই আচেন।”

গিন্নি মা আমার চিবুক ছুঁয়ে চুমো খেয়ে কইলেন, “তাই ত বলি এমন ভুবন বোলানো রুপ এ কি আর যেমন তেমন নিচু জাতে হয় নাকি গা।”

গিন্নি মা আমায় খুব ভালোবাসতেন। তিনি আমায় রোজ খেতে দিতেন আর মাইনে দিতেন মাসিক এক আনা। আমি কেবল মালাই গেঁথে দিতেম।

প্রতিদিন কাক ভোরে জমিদার বাড়ির সামনের বাগান থেকে ফুল তুলে পেছন দিককার শান বাঁধানো ঘাটের পাশ দিয়ে ঠাকুর ঘরে যেতেম। এ পথে তেমন কেউ আসে না। তবে জমিদার বাবু কালেভদ্রে দু একদিন খিড়কি দিয়ে এপানে চেয়ে পুষ্করিণী দেকেন। সেদিন গিন্নি মা আমাকে একখানা নতুন শাড়ি দিয়ে কইলেন, “আজ জমিদার বাবুর জনম দিন। তাই আজ ককানা মালা বেশি বানাতে হবে।” শাড়ি পেয়ে আমার খুশি যেনো আর ধরে না। এমন টুকটুকে লাল রঙ্গের শাড়ি পরার ইচ্ছে আমার অনেক দিনের। গরীবের খাওয়াই জোটে না তায় আবার শাড়ি। আমি শাড়িটা পরে ফুল তুলতে গেলেম। ফেরার পথে পুকুরখানা দেখে খুব নাইতে ইচ্ছে হলো। ভাবলাম কতই বা দেরী হবে। পুকুর পাড়ে ফুলগুলো রেখে পুকুরের জলে পা ভেজাতে ভেজাতে পেছনে চেয়ে দেখি জমিদার বাবু খিড়কি দিয়ে চেয়ে আছেন এদিক পানে। আমি হরবরিয়ে ফুল নিয়ে চলে এলেম। মনের মধ্যে অজানা এক ভয় হলো এই বুঝি জমিদার বাবু পুকুরে পা ডোবানোর অপরাধে আমার মাইনে না কেটে নেন। ঠাকুর ঘরে ফিরে মালা গেঁথে সেদিনকার মতো বাড়ি ফিরলেম।

রাতে দরজায় কড়া শুনে মনের মধ্যে এক ভয় হলো এই বুঝি পাইক পাঠিয়েছেন জমিদার বাবু আমার অপরাধের শাস্তি দেবার জন্য।

মা দরজা খুলতেই দেখেন পাইক এয়েচে। মা শুধোয় কি দরকার!

পাইক কইলেন, “জমিদার বাবু দেবীকে ডেকে পাইটেচেন।” আমার ভয় বেড়ে গেলো। কলিজা একসা হলো শুকিয়ে।পাইকের পিছু পিছু আমি যাচ্ছি আর আমার পিছু পিছু মা। আমার মার যে আর কেউ নেই। আমিই তার একমাত্র হারাধন। তাই সে আমায় একলা ছাড়তে ভরসা পেলেন না। পাইক জমিদার বাড়ি চাড়িয়ে বাগান বাড়ির দিকে হনহনিয়ে ছুটছে। মা পাইককে সুধালেন, “কি হে পাইক ভাই জমিদার বাড়ি তো ছাড়িয়ে এলেম কোতা যাচ্চ?”

পাইক গম্ভীর গলায় কইলো, “জমিদার বাবু বাগানবাড়িতে দেবীকে নে যেতে বলেচে। অত কতা বোলো নাকো চুপচাপ চলো।”

মা তখন আমার হাতটা শক্ত করে ধরলো। মা বুঝতে পেরেছেন কেনো জমিদার বাবু আমাকে ডাকলেন, তিনি বজ্র কন্ঠে কইলেন, “দেবী যাবে নে বাগান বাড়ি। আমি ওরে যেতে দেবো নে। “

পাইক মাকে ধ্বাক্কা মেরে ফেলে আমাকে জোরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগলো বাগানবাড়ির দিকে। আধাঁরে মা হারিয়ে গেলো। এদিকে ভয়ে আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। অবশেষে পাইক আমাকে কাঁধে তুলে বাগানবাড়ি পৌঁছলো। আমাকে জমিদার বাবুর ঘরের দরজায় ছেড়ে দিয়ে দরজা বাইরে থেকে লাগিয়ে দিল। জমিদার বাবু খাটে বসে আছেন। আমাকে ডেকে কইলেন, “দেবী এদিক পানে আয় তো একবার।”

আমি ভীরু পায়ে এগুলেম। জমিদার বাবু আমাকে একটানে পাশে বসিয়ে কইলেন, “আজ আমার জনম দিন। তুই আমাকে কিচু দিবি না দেবী, আজকে তুই আমাকে খুশি করে দে।” আমি কিছু কইলেম না। কওয়ার সাহস ও আমার ছিল না।আমি কেবল জানতাম হয়তো এটাই আমার ভবিতব্য। এটাই আমার ভাগ্য। গরীবের ঘরের মেয়ে তো। এদের রা থাকতে নেই। মনে মনে কেবল ভাবলেম, এ রাত কখন শেষ হবে। সূর্য ওটার আগে পাইক আমাকে জমিদার বাড়ির পেছনে পুকুর পাড়ে এনে ছেড়ে দেয়। আমি পুকুর পাড়ে এগুই, এটা শান বাঁধানো একটা পুকুর ঘাট। বসার সিঁড়িও আছে। কত সুন্দর কারুকাজ করা সিঁড়িতে। আমি একবার ছুঁয়ে দেখছি। এই শান বাঁধানো ঘাটে পা ডোবানোর শাস্তি জমিদারবাবু কাল রাতে আমায় দিলেন। আমার শরীর আসাড় হয়ে এলো, নিজেকে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত লাগছে। মনে হচ্ছে সাতজন্মের কামলা একদিনে খেটেছি আমি। মনে মনে ভাবলাম পা ডোবানোতে এই শাস্তি হলে শরীর ডোবানোর শাস্তিটা কি হবে! একবার ডুবিয়ে দেখতে ইচ্ছে হলো। আমি ধীরে ধীরে পুকুরের দিকে এগোই, পা-হাটু-উরু-পেট-বুক-মুখ-চোখ-চুল সব ডুবোই। কে জানে জমিদার বাবু এবার কী শাস্তি দেবেন আমায়!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত