আজ শরীর এর তুলোনায় মাথার ওজনটাই যেন বেশি মনে হচ্ছে। জল খাবে কাকাবাবু? জল এনে দেই? আর কত জল খাবো? সেই সাঁঝ এর বেলা থেকে খেয়েই যাচ্ছি। জলে পেট যে ভরে আছে। কি করবো বলো? তুমি যে জল ছাড়া আর কিছুই পেটে রাখতে পারছো না। কটা মুড়ি মেখে দিব পেট পুরে খেয়ে নাও? না লাগবে না, তোমায় আর কত কষ্ট দিব বলো। সেই যে আমার বোঝা টানছো, আজও টেনেই যাচ্ছ। আমার মরন না হলে তোমার আর রেহাই নেই। ছি ছি ছি কি অলক্ষুণে কথা! তোমার মুখে কি কিছুই আটে না!
সুশান্ত কাকা’র আমি ছাড়া তিনকূলে কেউ নেই। বছর আট হলো আমার এখানেই থাকে। আমার মরার কথা শুনলেই কেমন জানি হাসফাস শুরু করে দেয়। মাঝে মাঝেই জলপারের হাসনাহেনা গাছে মুখ লুকিয়ে কাঁদে। আমি বিছানায় কাত হয়ে জানালা দিয়ে দিবি দেখতে পাই বয়সের ভারে নূয়ে যাওয়া মানুষটি পুরোন গামছা দিয়ে চোখের জল মোছে। খুব কঠিন মানুষ। বুঝতেই দিতে চায় না কি চলছে তার ভিতরে। তবু তার লাল হয়ে যাওয়া চোখ দু’টো আমাকে ফাঁকি দিতে পারে না। ও মা জ্বর দেখি আরো বারলো কাকাবাবু। ওষুধ খাওনি? হুম খেয়েছিতো। কি ওষুধ দিচ্ছে যে এই সামান্য জ্বরই কমছে না। এ মরা ডাক্তার এর কপালে আর স্বর্গ নেই। মরন হোক, মরন হোক ডাক্তারের। আহ কেনো অযথা অভিশাপ দিচ্ছ! ও বেটা ডাক্তার এর কি দোষ। তার যা করার সে করেছে। অসুখ ভাল হলে সে কি করবে!
সুশান্ত কাকু চুপ হয়ে যায়। মাথা নিচু করে বিরবির করে কি যেন বলে। আমার সামান্য কিছুতেই বড় ঘাবড়ে যায় লোকটা। যদি কোন দিন শুনতে পায় আমার আয়ু আর বেশি দিন নেই তখন কি করবে? আমায় জরিয়ে ধরে কাঁদবে? নাকি অধিক কষ্টে পাথর হয়ে যাবে! কাকাবাবু? হুম বলো। তামুকটা ধরিয়ে দেব? কিছুখন বসে টানো, ভাললাগবে। না কাকু, খুব কাশ উঠে যায়। টানতে গেলেও সারা মুখ তেত হয়ে আসে। শরীর এ আর জোর পাই না। তুমি যে কি বল না তোমার বয়সে থাকতে সারা দিন রাত কত খেতাম। না বাপু তোমাদের যুগে না জন্মে ভালই করেছি।
ক’দিন আগেও কাকু রোজ বকতো। বলতো এই ছাইপাশ খেয়ে কি লাভ। অযথা পয়সা খরচ করে যমের কাছে যাবার টিকিট কাটছো। ছাড়ও এখনও সময় আছে, ছেড়ে দাও। অথচ কি অদ্ভুত ব্যাপার আজ কাকু নিজেই তামুক ধরিয়ে দেবার কথা বলে। মানুষটা আর কি করতে পারে? আমাকে ভাল রাখতে সারাদিন যে তার চেষ্টার কমতি নেই।
এবার বর্ষা যেন আগে ভাগেই শুরু হয়ে গেল। বৈশাখ এর শুরু থেকেই বৃষ্টি। টিন এর চাল গরিয়ে অবিরাম বৃষ্টির জল পরছে। আকাশ এর যেন আর তর সইছে না। পাশের ঘরে কাকু গুনগুনিয়ে গান গাইছে। বৃষ্টিও যেন কাকুর সাথে তাল ধরেছে। বেশ ভালই লাগছে শুনতে। ভাবছি কাকুকে কি বলবো এ ঘরে এসে গান ধরতে! না থাক। কিছু জিনিস আছে দূর থেকেই সুন্দর। তাই হয়ত জৈনক কবি বলে ছিল কাগজের ফুল তুমি দূর থেকে সুন্দর, কাছে এলে প্রানহীন। বেশি সময় আর একা তার থাকা হয় না।
সারাদিনই তার হাজার খানিক প্রশ্ন নিয়ে হাজির হওয়া লাগে। কাকাবাবু তোমার কিছু লাগবে? এই প্রশ্নটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। আর প্রশ্ন শেষ হলে কোন না কোন প্রসঙ্গ টেনে কিছুখন কথা বলেই আবার তার জিজ্ঞাসা কাকবাবু তোমার কিছু লাগবে? মানুষটা খুব সহজ সরল। যা এ জগৎ এর সাথে বড্ড বেমানান। ওই তো কাকুর গান থেমে গেছে, আসার সময় হয়ে এলো বুঝি। কি কান্ডটা শুরু হলো দেখ দেখি কাকাবাবু! আবার কি হলো? সেই যে বৃষ্টি নামা শুরু হলো আর যে থামার নাম গন্ধও নেই। বলি আজ কি আকাশের মা মরল নাকি! কাকু তুমি যা বলো না। তো আর কি বলবো? চুলোয় আগুন যে দিতে পারছি না। বারান্দার চুলো ধরালেইতো কাজ সেরে যায়। তা যায় বটে, কিন্তু ও মরার চুলো যে ঘরশুদ্ধ ধোয়া করে দেবে। তখন তোমার আবার চোখে জালা ধরবে।
তা না হয় একটু হোল। অত চিন্তা করে কাজ নেই। তুমি গিয়ে চুলো ধরিয়ে দাও। হুম তাই করি গিয়ে। তুৃমি তো জানোই আমি আবার খালি পেটে থাকতে পারি না। সারা শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে। কি করবে বলো! বয়সতো আর কম হলো না। তা তো হোলই। এখন ভালয় ভালয় বিদেয় হতে পারলেই বাঁচি। মরলে আবার কেউ বাঁচে নাকি? অত ভুল ধরোনাতো কাকাবাবু। আমি কি অত জ্ঞানী নাকি। যা ভাল ভেবেছি তাই বলে ফেলেছি। তুমি বুঝলেই হলো। আচ্ছা ঠিক আছে বুঝলাম। যাই আমি গিয়ে বরং রান্না বসাই। পেটে আর সইছে না বাপু।
আজ সত্যিই বুঝি আকাশের মা মরেছে। বৃষ্টির পানিতে বাড়ির উঠোন প্রায় ডুবে যায় যায়। এক দিকে অবশ্য ভালই হয়েছে। রোজ রোজ বুড়ো মানুষটাকে আর জল টেনে হাসনাহেনা গাছে দিতে হবে না। কয়েকটা দিন বিশ্রাম পাওয়া গেল। জয়া যাবার আগে হাসনাহেনা চারা গাছটা লাগিয়ে ছিল। যার ভরন পোশন এর দায়িত্ব এখনও কাকুর হাতেই।
শোন সুশান্ত কাকু! জী বউমনি শুনছি। গাছটায় রোজ জল দেবে। আগাছা হলে পরিষ্কার করে দেবে। দেবে তো? দেব বউমনি, ও নিয়ে তুমি ভেব না। দেখ গরু ছাগলে যেন নষ্ট না করে ফেলে। আমি এলে যেন দেখতে পাই অনেক বড় হয়ে গেছে। গরু ছাগলের বংশও এর কাছে ঘিরতে পারবে না বউমনি। তুমি এ নিয়ে কোন চিন্তাই করো না।
এ গাছটা আর আমার পাগলটাকে তোমার কাছে রেখে যাচ্ছি। অনেক আদর যত্নে রাখবে কেমন। ও তুমি না বলেও আমি করবো। আচ্ছা কাকু গাছটা বড় হলে ফুল দেবে? ঘ্রাণ ছড়াবে? তা তো হবেই, পুরো বাড়ি ঘ্রাণ মৌ মৌ করবে। তুমি যখন দাওয়ায় বসে গান ধরবে তখন ঘ্রাণ পাবে? তা আর বলতে বাকি! যে মিষ্টি ঘ্রাণ, নিঃস্বাস এই বুক ভরে যাবে। চলো এবার জল দেয়া যাক। ও দিকে তোমার আবার বাড়ি যেতে হবে।
দেখতে দেখতে হাসনাহেনা গাছটা মাথা ছুঁয়েছে সে অনেক দিন আগেই। শাখা প্রশাখায় আজ সে পরিপূর্ণ। সময় তো আর কম হলো না বছর পাঁচ পেরিয়ে ছয় বছরে পা দিবে কিছু দিন বাদে। কাকুর যত্নে আমি আর গাছটা আজো প্রাণএ বেঁচে আছি। জয়ার সাথে কাকুর বছর দুই তিনেক স্মৃতি আছে। রোজকার আবদার আর করা শাসন গুলো কাকু যেন সুবোধ বালকের মতই মাথা কাত করে মেনে নিত। কখনও শুনিনি দুজনের মাঝে মতের পার্থক্য। তাই বুঝি রেখে যাওয়া হাসনাহেনা গাছের পাশে বসেই কাকু স্মৃতিচারণ করে। একলা মনে বিরবির করে বউমনি বউমনি বলে ডেকে ওঠে।
কাকাবাবু ও কাকাবাবু ঘুমিয়ে গেলে নাকি? না ঘুমাইনি কাকু, কিছু বলবে? বলি খাওয়া লাগবে না! নাও খাবার টুকু খেয়ে নাও। চট জলদি খেয়ে ওষুধ খাওয়ার কাজটাও সেরে ফেলও। দেখবে রাতে আর জ্বর আসবে না। কাল একবেলা ডাক্তার ডেকে আনি, তোমায় দেখে যাবে। কি রেধেছ আজ? তেমন কিছু না, ওবেলা কটা ছোট মাছ এনেছিলাম। এবেলা তো আর বৃষ্টিতে বাজারেই যাওয়া হলো না। তা দিয়েই কোন মতে রাতের খাবার এর আয়োজন। যাই হোক দাও দেখি খেতে পারি কি না! আজকাল আর খাওয়ার রুচি হয় না কাকু।
বউমনি থাকলে কি আর বৃষ্টির তোয়াকা করতাম বলো! ও জল মাথায় নিয়েই বাজার করে বাড়ি ফিরতাম। কাকে বউমনি বলছো শুনি? ওকে তো আমি বিয়েই করিনি। অযথা বউমনি বলে ডাকারতো কোন কারন দেখছি না। সম্পর্কের টানে নিজ বাড়ি থেকে এ বাড়ি আসতো। এর চেয়ে বেশি কিছু না। ও মা রাগ করছো কেন? না হয় একটু আদর করেই ডাকলাম। মেয়ে সমতুল্য, একটু আদর করে ডাকতেই পারি। হয়েছে! তোমার আর আদর সোহাগ দেখিয়ে কাজ নেই। ভাত দাও।
কি আশ্চর্য! কাকু যে দিন প্রথম জয়াকে এ বাড়িতে দেখে সে দিন কাকু নিজেই বলেছিল কাকাবাবু কি বলে ডাকা যায় বলতো দেখি। আমিই বলেছিলাম বউমনি বলেই ডেকো। আর আজ নিজেই রেগে গেলাম। তবে কি শরীর আর মনের অসুখটা ব্যাবহার এর উপরও এসে পরলো! মানুষটা কষ্ট পেলেও কিছু বলে না। কি সুন্দর ভাত মাখিয়ে দিবি খেয়ে যাচ্ছে। কাকু? তোমার বউমনির কথা মনে পড়ে?
কথাটা জিজ্ঞেস করতেই ভাতের থালার উপর হাত যেন জমে গেল। বুঝতে বাকি রইলও না, আঘাত এর উপর আঘাত দিয়ে বসলাম। পড়ে! খুব মনে পরে। যে দিন থেকে বউমনি চলে গেল সে দিন থেকে এ বাড়ির হাসি আনন্দও হারিয়ে গেল। তোমার বউমনি আর কোন দিনই ফিরবে না কাকু। ও আশা জলে ডুবিয়ে দাও। এ সব যা তা বলো না তো। এমনিতেই আজ কিছু ভাল যাচ্ছে না। হয়ত কোন জামেলায় আটকে গেছে তাই আসতে পারছে না। এক দিন দেখও ঠিকি ফিরবে। সে দিন কত আনন্দ হবে। তুমি দেখ কাকাবাবু, বউমনি ঠিকি আসবে। আসতে যে তাকে হবেই।
সকাল গরিয়েছে অনেক আগেই। রাতে ভাল ঘুম হয়নি। সারা রাত গেছে কাশতে কাশতেই। বুড় মানুষটাও ঠিকমত ঘুমতে পারেনি আমার জ্বালাতনে। বুকে গরম তেল মালিশ করে দেয়ায় যাও একটু ঘুমিয়ে ছিলাম তাও ভোর বেলা ঘুম ভাঙ্গলো কাকুর চেঁচামেচিতেই। কার গরু যেন হাসনাহেনার ডাল ভেঙ্গেছে। তা নিয়েই লেগেছে তুলকালাম কান্ড। কাকু একাই বাড়ি মাথায় তুলেছে। গরুতো গাছের ডাল ভাঙ্গেনি যেন কাকুর হাত পা ভেঙ্গেছে। মরার গরু মরতে আর জায়গা পেল না। এ যে তার বউমনির আমানত। এতে কারো হাত লগেছে তো সর্বনাশ হয়েছে। কাকাবাবু, ও কাকাবাবু আমি চুপ করে শুয়ে আছি। অনেক দিন হলো কাকুর সাথে মজার করা হয় না। হতছারা গরুর কারনে তার মন আজ খুব খারাপ। দেখি মন ভাল করতে কিছু করা যায় নাকি। একি হলো তোমার, ও কাকাবাবু ও কাকাবাবু গো! ভয় পেয়েছ ? মরিনিতো! এই যে বেঁচে আছি! হে আমার কপাল, আমারতো পিলে চমকে গিয়েছিল। তা বলি এই বুড় মানুষটাকে না জ্বালালেই কি নয়? তুমি ছাড়া আমার আর জ্বালানোর কে আছে বলো। হা হা হা।
আমার হাসি দেখে কাকু ও হেসে দিল। আজ কত বছর পর মানুষটার মুখে হাসি দেখলাম। কত বছর পর নিজে হাসলাম তাও জানা নেই। একটা সময় গিয়েছিল যখন রোজই আমি জয়া আর কাকু হাসতে হাসতে মাটিতে গড়া গড়ি খাবার উপক্রম হতো। আজ এই মানুষ গুল হাসতে ভুলে গেছে। এরা ভুলেও আজ আর হাসে না। ভোর বেলা ঘুম ভেঙ্গেছে তোমার চেঁচামেচিতে। এখন আবার কি হলো শুনি?
কেন চেঁচাবোনা বলো? কাকাবাবু তুমিই বল, বউমনি যদি এসে দেখে ও গাছের ডাল ভাঙ্গা, আমার কি অবস্থা হবে ভেবে দেখেছ! কি জবাবটা দেব আমি ? যাবার আগে বার বার বলে গেছে সুশান্ত কাকু খবরদার গরু ছাগলে যেন নষ্ট না করে বসে। এখন আমার শাস্তি হয় কিসে তাই বলো। যা হবার তা হয়েই গেছে। বাদ দাও। ডেকেছো কেনো তাই বলো। ও হে বলতেই ভুলে গেলাম। ডাক্তার বাবু এসেছেন, ভেতরে নিয়ে আসবো? হে নিয়ে এসো।
মাঝে মাঝেই কাকু ডাক্তার ডেকে আনেন। এই লোকটা কে আর বিরক্ত করতে ভাললাগে না। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে একই ওষুধ বার বার। এ ছাড়া আর করারই বা কি আছে। তিনি তো আর কম চেষ্টা করলেন না। স্রষ্টাই যদি না চান তার সৃষ্টি বাঁচুক তবে সৃষ্টি কি করে বাঁচবে! সবাইকে যেতে হবে, আমি না হয় ক’দিন আগেই গেলাম। মরতে আমার ভয় লাগে না। মরার কথা মনে হলেও খারাপ লাগে না। শুধু আফসোস হয় এই ভেবে আমি মরে গেলে আমার স্বপ্ন গুলোও মরে যাবে। অনেক পুরোন স্বপ্নতো। ছেলেপুলের মতই বড় করেছিলাম।
কাকাবাবু তোমাকে একটা কথা বলার ছিল। হুম বলো, কি কথা? কথা বলতে কি! আমার একটা কষ্ট আছে। কষ্ট? এই প্রথম জানতে পারলাম তোমার কষ্ট বলে কিছু আছে। হে আছে, অনেক পুরোন একটা কষ্ট আছে। বলি বলি করে বলা হয়ে ওঠে না। তা আজ বল, শুনি তোমার কি কষ্ট! তার আগে বলো তুমি রেগে ওঠো না যেন। আচ্ছা ঠিক আছে, এবারতো বলো? ওই ডাক্তর বাবু যখন আসেন তখন তুমি আমায় ঘর থেকে বেরুতে বলো। তোমরা শিখিত মানুষ কি কথা বলছো তা আমি মুর্খো মানুষ বলে কি শুনতেও পারবো না ? না হয় আমি তোমাদের কথা নাই বুঝলাম।
কিছু প্রশ্ন আছে যার উওর জানা থাকলেও দেবার মত ক্ষমতা থাকে না। আজ আবারও আমার মাথা নিচু হয়ে এলো। যে মানুষটির দিনরাত্রি এতো পরিশ্রম আমার জন্য, যে মানুষটি বয়সের ভার কাটিয়ে সকাল সন্ধে ছুঁটে চলে, সেই মানুষটিকে কি করে বলি, কাকু আমি যে ওপারের টিকিট কেটে ফেলেছি! আমার যে আয়ু ফুরিয়ে এলো! এই সহজ সরল মানুষ গুলোর কথায় এক ধরনের বিশেষ ক্ষমতা আছে। এদের কথার কাছে খুব সহজেই মানুষের মাথা নত হয়ে আসে। কেনই বা আসবে না! এরা যে প্রকৃত অর্থেই ভালবাসতে জানে। শুধুমাত্র এরাই জানে কি করে ভালবাসতে হয় স্বার্থহীন ভাবে। তার বউমনি একদিন ফিরবে। এটাই তার বিশ্বাস, আর তার এই বিশ্বাস আমার নিঃশাস এর মাঝেও জন্ম দেয় ও একদিন ফিরবে সে দিন হাসনাহেনা গাছেও ফুল ফুটবে। কাকাবাবু ও কাকাবাবু এমন করে গোঙাচ্ছো কেন! আমার যে ভীষন ভয় করছে। নিঃশ্বাস নিতে পরছি না। প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। আমি গিয়ে গরম তেল নিয়ে আসি। বুকে মালিশ দিলেই ভাল বোধ করবে। লাগবে না। তুমি আমার পাশে একটু বোসও কাকু।
এই আট বছরে আজ প্রথম কাকুর চোখে জল দেখতে পেলাম। মানুষটা আজ প্রথম আমার সামনে বসে কাঁদছে। কেনই বা কাঁদবে না! কষ্টের তীর্বতায় আমার মুখ যে নীল হয়ে গেছে, সে তো আমার নিজেরো জানা। কাকুর চোখে জল দেখে কি তবে আমার চোখের কোণ ঘেষেও জল চলে এলো? কেন এলো? এ মানুষটা তো আমার কেউ না! না আছে তার সাথে আমার রক্তের কোন সম্পর্ক। তবে কেন মানুষটি আমার জন্য কাঁদছে? কেন আমি কাঁদছি? তবে কি পার্থিব জগতের কিছু সম্পর্কের কোন নাম হয় না! কাকাবাবু আমি বরং চট জলদি ডাক্তার ডেকে আনি। তোমার অবস্থা যে ভাল ঠেকছে না।
তোমার কোথাও যেতে হবে না কাকু। আমার যাবার সময় হয়ে গেছে। এভাবে বলো না! এভাবে বলো না কাকাবাবু। তুমি ছাড়া এই তিনকূলে যে আমার যে আর কেউ নেই। কাকু? বলো কাকাবাবু। আজও সন্ধে হয়ে এলো তাই না। তা তো হলোই। তোমার বউমনি আজো এলো না। আসবে কাকাবাবু, আসবে। অধৈর্য হয়ো না। দেখো ঠিকি চলে আসবে। আর কবে আসবে কাকু! আর কত কাল পর! দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর চলে গেলো। তোমার বউমনির আজও আসার সময় হলো না। তুমি একটু থামো কাকাবাবু। একটু বিশ্রাম নাও। আমাকে কথা বলতে দাও, এই হয়তো তোমার সাথে আমার শেষ কথা। তোমার দোহাই কাকাবাবু, এমন করে বলো না।
কাকু হু হু করে কেঁদে ওঠে। পুরোন গামছায় মুখ লুকিয়ে কাঁদে। এই বুড় মানুষটি আজ বড় বেশি অসহায়। আজ তার আর কোন চেষ্টাই আমাকে ভাল রাখবে না। কাকু, কাথা দিয়ে আমায় মুরে দাও তো। খুব শীত করছে। এইতো দিচ্ছি, তুমি বিশ্রাম নাও। কাকু, বাজারে যেতে পথের ঠিক পাশেই একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিলো। ওটা কি এখনও আছে? আচ্ছে কাকাবাবু। আজও কি ওতে ফুল ফোঁটে? তা তো বটেই, ওই রাস্তাটুকু লাল হয়ে যায় ঝরে পরা ফুলে। আমি মারা গেলে আমার কবরে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের চারা বুনে দিয়। আমার কবরটাও কোন এক সময় লাল ফুলে ঢেকে যাবে।
ধীরে ধীরে রাত গভীর হতে শুরু করলো। আমার অবস্থা আরো খারাপ এর দিকে। চোখের পাতায় কেউ যেন ইট বেঁধে দিয়েছে। হাজার চেষ্টা করেও মেলতে পারছি না। তবে বুঝতে পারছি মাথার কাছেই কেউ একজন বসে আছে। ঘরের চারপাশে যম এর ঘুরঘুরি, সময়ের অপেক্ষা। কেন যেন সব কিছু এলোমেলো লাগছে। মাথার ভিতরে মনে হচ্ছে হাজারটা চিন্তা। কিন্তু কিছুই চিন্তা করতে পারছি না। তবে কি মৃত্যু ভয়ে এমন হচ্ছে? না না না! আমি তো মরতে ভয় পাই না। সেই পাঁচ বছর আগেই তো আমি মরে গিয়েছি। প্রতিটা মূহুর্তেই বেঁচে থেকেও ছিলাম মৃত। দেখও কাকাবাবু বউমনি এক দিন ঠিকি ফিরবে।
আমিও মনের অজান্তে স্বপ্ন বুনে চলে ছিলাম। যা আমার মরন ব্যাধিও আমাকে বিরত করতে পারেনি। নিঃশ্বাস এর মাঝে বিশ্বাসটাকে আটকে রেখে আমিও রোজ অপেক্ষায় থাকতাম। তবে কি আজ আমার অপেক্ষার মৃত্যু হবে? হুম! আজ আমার অপেক্ষার মৃত্যু হবে। আজ থেকে আর আমাকে জানালা দিয়ে দূর পথের দিকে সকাল সন্ধা তাকিয়ে থাকতে হবে না। আজ থেকে আর কাকু কে জিজ্ঞেস করতে কবে না তার বউমনি কবে ফিরবে। আজ যে শুধু আমার মৃত্যু নয়, আজ মৃত্যু হবে সকল অপেক্ষার। আচ্ছা কাকু কি করবে? বড় ভুল হয়ে গেল, আমার মৃত্যুর আগে কাকুকে কারো কাছে রেখে যাওয়া উচিৎ ছিল। বেচারা বুড় মানুষ কি করে এত বড় বাড়িতে একা একা থাকবে! জয়া থাকলেও না হয় দু’জন মিলে গল্প করে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারতো। এই শেষ বয়সে তার আর কেউ রইলো না।
ভোর বেলায় কাকুর ঘুম ভাঙ্গলো। আমার ঠান্ডা আর শক্ত হয়ে যাওয়া শরীর এর সাথে স্পর্শ লাগেতেই তার আর বুঝতে বাকি রইলো না আমি গত রাতেই মারা গিয়েছি। রোজ সকালে ঘুম ভাঙ্গলেই কাকু স্রষ্টার প্রার্থনা করেন, আজ সব ভেস্তে গেলো। বুড় মানুষটা যেন জমে গেলো আমার লাশের পাশে। মনে হচ্ছে কাকু যেন হিমালয় এর বরফ পরা দেশে হঠাৎ করেই জামা কাপর ছাড়া চলে এসেছে। বড্ড বলিন হয়ে গেছে মানুষটার চেহারা। বয়সের ভারে মুখের চামড়ার ভাঁজ গড়িয়ে পরছে চোখের নোনা জল। খুব মায়া হচ্ছে, আজ যেন তার চেহারার দিকে তাকানোই যাচ্ছে না। উঠে দাঁড়াবার শক্তিটুকু যেন আজ নেই তার। কয়েক বার দাঁড়াতে গিয়েও বসে পরলো। আমি জানি কাকুর মন আর আমার মরা লাশের দিকে টানছে না, তার মন তাকে টানছে অন্য কোথাও। অন্য কোথাও? কোথায়? কোথায় আবার, ওই জলপারের হাসনাহেনায়।
আজ যে কাকুর মনে অনেক প্রশ্ন। আমার মৃত্যু যে কাকুর মনে জমানো কারো জন্য অপেক্ষা নামক বিশ্বাস এর খড় খুটো উড়িয়ে দিয়েছে। আজ যে তার সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। তাই বহু কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে দু এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে সুশান্ত কাকু। বয়সের সব ভার যেন আজ তাকে নুইয়ে দিয়েছে। দুই পা আজ তার জীর্ন দেহটাকে কোন ভাবেই টানতে চাইছে না। এ ঘর থেকে বেরুতেই তার যেন লেগে যাবে কয়েক যুগ। অবশেষে দাওয়া ছেড়ে হাসনাহেনা গাছের খুব কাছে যেতেই হুমরি খেয়ে পরলো। সজোরে পুরো গাছটাকে বুকের ভিতরে জরিয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে দিল। যেন বহু বছর পর হারিয়ে যাওয়া সন্তান খু্জে পেয়েছে বৃদ্ধ বয়সি কোন বাবা।
যে মানুষটা পাঁচটা বছর সান্তনা দিয়েছে তার বউমনি একদিন ফিরবে আজ সেই মানুষটাকে সান্তনা দেবার মতন কেউ নেই। আজ তাকে কেউ জিজ্ঞেস করবে না কাকু তোমার বউমনি যে আজও এলো না, আর জিজ্ঞেস করলেও তার উত্তর কাকু আর কখনই দিতে পারবে না। আজা আমার মত কাকুরও অপেক্ষার অবসান হলো। তাই বুঝি আরো একবার সজোরে হাসনাহেনা গাছটা বুকে জরিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো বউমনি তুমি আর ফিরলে না।।