হাবাগ জাদুঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আবির ভাবতে থাকে সত্যিই যদি কোনো যাদু হতো আমার সাথে। নতুন কোনো রঙ, রাঙিয়ে দিতো আমার জীবন। আবির শব্দের অর্থ তো সুবাস। তবে কেনো আমার জীবনটা অন্ধকারে এমনি ভাবে নিমজ্জিত হলো? কেনো পারছি না নিজেকে শুধরাতে। পাশ দিয়ে যাওয়া চলন্ত রিক্শা থেকে কেউ একজন ডেকে উঠল, এই আবির।
মাঘ মাসের শীতের কড়কড়া উজ্জ্বল রোদ যতই আরাম দায়ক হোক না কেনো শীত উপশম হবার অল্প পরেই সেই রোদ গায়ে অসহ্য হয়ে ওঠে। গা চিড়বিড় করতে থাকে। তেমনি দাম্ভিক শব্দটাও গায়ের চামড়ার গভীরে চিড়বিড় করে হুল হয়ে ফুটতে থাকে।
মাঝে মাঝে সুফিয়া খুব বিরক্ত হয় আর ভাবতে থাকে মোত্তালেব সাহেব আজকাল একটু বেশি-ই বাড়াবাড়ি করছেন। অসহ্য যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠছেন তিনি। আর এই শীতকালটা আসলেই উনার বাড়াবাড়িটা একটু বেশিমাত্রায় বেড়ে যায়। পাড়ার লোকজন কি কমছিল? বোধহয় কমই ছিল। আর এখন মিডিয়ার লোকজন তার পেছনে ফেউ এর মত লেগে তাকে মাথায় তুলছেন। টাকা থাকলে যা হয় আার কী!
প্রচণ্ড দাম্ভিক আর অহংকারী মানুষ হচ্ছেন মোত্তালেব সাহেব। তবে তার চেহারার ভেতরে একটা শান্ত এবং সৌম্য ভাব আছে। এই শান্ত, সৌম্য ভাবটার জন্য তার দাম্ভিকতার ওজন কয়েকগুণ ফুটে ওঠে তার মুখমণ্ডলে। যে কোনো কথা একবার বলাটা বেশি পছন্দ করেন তিনি। মানুষ জনের কাছে নিজেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয় দিতে আরো বেশি গর্ব বোধ করেন তিনি।
সুফিয়া অবশ্য তাকে মুক্তিযোদ্ধা বলতে নারাজ। কারণ তার কথার মধ্যে সত্য লুকানোর গন্ধ পায় সুফিয়া। তিনি আসল মুক্তিযোদ্ধা না নকল মুক্তিযোদ্ধা এই নিয়ে সুফিয়ার কোনো মাথাব্যথা নেই। আবার মাথাব্যথা আছেও খানিকটা। এই খানিকটা মাথাব্যথা তার সমাজসেবার বহর দেখে আর অতিকথন কথাবার্তা শুনে।
সুফিয়া রাজনীতি করে না আবার রাজনীতির রণনীতিও বুঝতে পারে না। খুব সাদাসিদে খেটে খাওয়া একজন মানুষ সুফিয়া। রেজিস্ট্রি অফিসে চাকরি করে। সকাল থেকে বিকাল অব্দি জমির দলিল লেখাতেই ব্যস্ত থাকে। তবে এই লেখার মাঝে মাঝেই কথা হয় সহকর্মীদের সাথে। বিভিন্ন ধরণের মানুষ আর বিভিন্ন ধরণের কথার মারপ্যাচে অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয় সারাদিন।
সুফিয়ার সংসারে তেমন কেউ নেই একবৃদ্ধ বাবা ছাড়া। স্বামী মারা গেছে বেশ ক’বছর হলো। একমাত্র সন্তান পড়ে ঢাকা বিশ্ববাদ্যালয়ে ইকোনোমিস্ক নিয়ে। তার ধারণা অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে দেশের অভাব নির্মূল করে দেশকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তাই সে অর্থনীতির মতো সাবজেক্ট কে বেছে নিয়েছে।
সুফিয়া সারাদিনের খাবার রান্না করে টেবিলে ওদের জন্য গুছিয়ে রেখে নিজের জন্য টিফিন বাটি ভরে নিয়ে অফিসে চলে যায়। বৃদ্ধ বাবাকে দেখার জন্য একজন লোক আছে তার নাম বজলু মিয়া । সে সারাদিন বৃদ্ধের সাথে বসে গল্প করে, পেপার পড়ে, লুডু খেলে আর দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জ্ঞানী ব্যক্তির মত কথা বলে। কোনটা করলে ভালো হতো আর কোনটা না করলে উপকার হতো।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে রোজ-ই বিকেল ফুরিয়ে যায় সুফিয়ার। আর বাড়ি ফিরে একই দৃশ্য দ্যাখে প্রতিদিন– বৃদ্ধ বাবা আর বজলু মিয়া তাদের গল্প নিয়ে ব্যস্ত। রোজকার মতো আজও সুফিয়া জিজ্ঞেস করল– কী গল্প করছ বজলু মিয়া?
– আফনি শুনবেন ফুবু?
– বলো শুনি।
– প্যাপারে নাকি দিছে, আশ-পাশের দ্যাশের তুলনাত আমাগো দ্যাশের মানুষ বাইট্টা। আমাগো শইলে নাকি জিংক না দস্তা কি নাকি কই, হেইডার অভাব রইছে। তাই আমাগো বেটা-বেটি বাইট্টা হইয়া জন্মাইতেছে। অহন যদি আমরা জিংক সমরৃদ চালের ভাত খায়, তই আমাগো বেটা-বেটি লাম্বা হইবো। ভাইবা দ্যাখছেন ফুবু, মানুষ লাম্বা হওনের কি সহজ উপায়!
সুফিয়া খিলখিল করে হেসে ওঠে আর বলে, ‘বজলু মিয়া এই ধানের চাল কই পাওয়া যাইবো আমারে জানাইয়ো।’
এমন হাজারও খবর পাওয়া যায় বজলু মিয়ার কাছে। বজলু মিয়ার তিনকুলে কেউ নেই। সুফিয়াদের জমি-জিরাত চাষ-বাষ করে আর সুফিয়ার অনুপস্থিতিতে ওর বৃদ্ধ বাবার দেখাশোনা করে। বৃদ্ধকে দাদা বলে ডাকে আর সুফিয়াদের জমিতে একখানা টিনের ঘর তুলে থাকে বজলু মিয়া। এই মানুষগুলো খুব সহজ-সরল। তাই এদের সরলতার সুযোগ নিয়ে সুযোগ সন্ধানী মানুষগুলো নিজেদের কাজ হাসিল করে নেয়।
সুফিয়া রাজনীতি করে না। তবে সমাজের এই সব অসহায়, দুস্থ আর সুযোগ সন্ধানী মানুষজন তার মনের গভীরে চিন্তার উদ্রেক ঘটায়! মাঝে-মাঝে খুব আশ্চর্য হয়ে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে–‘ আচ্ছা, মানুষকে নিয়ে ভাবাটা কী রাজনীতি?
লতিফ সালাম দিয়ে সুফিয়াকে বলে, কী খবর আপা? আজ আপনাকে বেশ হাসি-খুশি দেখাচ্ছে যে?
সুফিয়া সালামের উত্তর দিয়ে বলে, ঠিকই ধরেছ লতিফ। আজ আমার মনটা সত্যিই ভালো। অনির্বাণ এসেছে ঢাকা থেকে। ওর কয়েকদিন ক্লাস বন্ধ আছে।
– ও, তাই তো বলি!
– বুঝলে লতিফ, একটা মাত্র সন্তান তো। দূরে থাকে। যা দিনকাল পড়েছে! সব সময় একটা ভয় থেকে যায় মনের মধ্যে।
– এত ভয় করেন কেনো আপা? সোনার টুকরো ছেলে আপনার।
– ভয় কী আর এমনি হয়! মোত্তালেব সাহেবের ছেলের কথায় ধরো না কেনো। কি শান্ত শিষ্ট-ই না ছিল। অথচ–।
– এর জন্য কিন্তু ওর পরিবার দায়ী। আমি ভীষণ অবাক হই, কী ছিলেন আর কী হলেন উনি। আমরা দূরবিন দিয়ে দূরের আকাশ দেখতে ভালোবাসি। কিন্তু চোখ মেলে কাছের আপনজনদের খোঁজ-খবর করতে ভুলে যায়। বুঝছো লতিফ, এই হলো আমাদের চরিত্র। মোত্তালেব সাহেবের কথায় ধরো। আবির তার একমাত্র সন্তান। দিন দিন ছেলেটা কেমনতরো হয়ে যাচ্ছে। আবিরের এই বদলটা পাড়ার আর-দশজনের নজরে পড়লেও উনার নজরে পড়ল না। যখনই মানুষজন কিছু বলতে গিয়েছে তখনই তাদের তুচ্ছ্য-তাচ্ছিল্য করে, অপমান করে ফিরিয়ে দিয়েছে। বুঝছো, এরা নাকি করবে সমাজের সেবা। উঁহ, যে নিজের ঘর সামলাতে পারে না সে নাকি!
এলাকায় মোত্তালেব সাহেবের প্রভাব আছে। শুধু এলাকায় না আমাদের কথিত সভ্য সমাজেও তার বেশ নাম ডাক আছে। কীভাবে কীভাবে যেন, তিনি সমাজে নাম কিনে জেকে বসলেন। লোকজনও নানান সমস্যা নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে তার কাছে।
ঘররামির নিজের ঘরের চাল নাকি থাকে না। তেমনি দশা মোত্তালেব সাহেবের। দেশ আর দশের উদ্ধারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেও, নিজের একমাত্র সন্তানের কোনো খবর রাখেন নি। টাকা দিয়েই মনে করেছেন সব দায়িত্ব পালন শেষ। টাকা দিলেই যদি সব দায়িত্ব, কর্তব্য পালন করা হয়ে যেত, তবে তো আর কোনো কথায় থাকতো না। আর কোনো কথা উঠতো না। আবির খুব ভালোবাসার কাঙাল। মা-বাবা কাছে থেকেও অনেক দূরে। তাদের নেই কোনো ফুরসত; ব্যস্ততা আর ব্যস্ততা ছাড়া।
– বুঝলে লতিফ, অনির্বাণ আর আবির সমবয়সী। দু’জন একই সঙ্গে খেলতে-খেলতে বড় হয়ে গেল আমার চোখের সামনে। কতদিন আমাদের বাড়িতেই গোসল-খাওয়া করে অনির্বাণের সাথেই পড়ালেখা করে থেকে গেছে । খুব কষ্ট হয় জানো, ছেলেটার জন্য।
– আবির এখন কী করে আপা?
– ঢাকার কোনো এক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।
– কেনো আপা ও কি আপনদের সাথে আর যোগাযোগ রাখে না?
– একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সুফিয়া বলে, না রে দেখা হয় কদাচিৎ। তাও কেমন এড়িয়ে চলে। ভীষণ কষ্ট হয় ওর জন্য।
– ও কী একেবারেই সম্পর্ক রাখে না ওর বাবা-মার সাথে?
– সন্তান তো। সেটুকু সম্পর্ক আছে। তবে, ওদের সে সম্পর্কের মধ্যে নেই ভালোবাসা। নেই সম্পর্কের মধ্যে সমঝোতার কোনো বাঁধন।
– তাহলে?
– ওই যে বলছিলে না, ওর পরিবার দায়ী। আবির ওর বাবা-মায়ের, বিশেষ করে ওর বাবার এই সব কর্ম-কাণ্ড একেবারেই পছন্দ করে না। সহ্য-ই করতে পারে না ওর বাবার এই সব অনৈতিক কাজকর্ম। ওর বাবা সমাজের বুকে এমন একটা মিথ্যে বলে দিনের পর দিন লোক ঠকাচ্ছে।
– কী মিথ্যে? তাছাড়া সন্তানদের জন্য তো অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়। তাই না?
– তা তো অবশ্যই। সন্তানদের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয় বাবা-মায়ের।
– মিথ্যেটা কী?
– আসলে এখনকার ছেলে-মেয়েরা প্রযুক্তিনির্ভর। এরা জানে বেশি, বোঝেও এদের মতো করে। এদের কোনো কিছু বললে, যাচাই-বাছই করে তবেই সত্যিটা গ্রহণ করে। আমাদের সেই যুগ নেই তো। বড়রা যা বলল, চোখ বুঝে তাই বিশ্বাস করবে।
– তাতে কী? সমাজে তো একজন মোত্তালেব সাহেব নেই। তাদের সবার সন্তানই কী আবিরের মত?
– একটা বিষয় ভুলে যাচ্ছো কেনো। সবার ধারণ ক্ষমতা সমান না।
– এটা ঠিক বলেছেন আপা। তবে কী সত্যিই উনি একজন দাগী অপরাধী?
– দাগী না চিহ্নিত অপরাধী তা বলতে পারব না। তবে, তার মুক্তিযোদ্ধা হবার গল্পের সত্যতা অনেকটাই ধোঁয়াশা।
– অনেকটা মানে বুঝলাম না!
– দেখো বাবার কাছে যতাটা জেনেছি, মোত্তালেব সাহেবে সংস্ক্রিয় ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন নি।
– তবে তিনি যে খুব গর্ব করে বলেন, ‘স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হয়েই তিনি গেরিলা ট্রেনিং নিয়েছিলেন। পরে তিনি ভারতে যান আরও ট্রেনিং নিতে!’
– দেখো লতিফ, এই বলার মধ্যে কতটা সত্য আর কতটা মিথ্যে লুকিয়ে আছে, সেই সত্যটুকু আমার জানা নেই।
– আপনার বাবাও তো একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি কিছু বলতে পারেন না?
– ওই টুকুই আমার অহংকার। আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। আর বাবার কথা বলছ? বাবার তো বয়স হয়েছে, এসব নিয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করি না। একদিন অবশ্য এর সত্যতা জানতে চেয়েছিলাম। বাবা বললেন, ‘দেখো মা, ১৯৭১ সালে নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। তখন ঘটনাপ্রবাহ এত দ্রুত বদলে যায় যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন দ্রুত পাল্টে গোটাদেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। ছেলে-মেয়ে-বৃদ্ধ সবাই তখন একযোগে শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর যুদ্ধ তো এক জায়গাতে হয়নি। গোটা দেশ জুড়েই যুদ্ধ হয়েছিল। কাজেই কে, কখন কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে বলাটা খুব মুশকিল। যে যা বলছে, বলতে দাও। শুধু একটা বিষয় মাথায় রাখবা দেশের ক্রান্তি লগ্নে চোখ বন্ধ করে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। কোনো রকম দ্বিধা-সংকোচ রাখলে চলবে না।
– সেটাই আপা।
– অনেক বকর বকর হলো আজ উঠি লতিফ।
শীতকাল আসতে না আসতেই প্রকৃতির ভেতরে কেমন একটা সাজ সাজ ভাব চলে আসে। নতুন ধান আর খেজুর গুড়ের মৌ মৌ গন্ধে ধুম পড়ে যায় নবান্ন উৎসবের। আজ সরকারি ছুটি । অফিস যাবার কোনো বালাই নেই। সুফিয়াও সকাল থেকে লেগে পড়েছে বিভিন্ন ধরণের রান্নাতে। ছেলেটা অনেকদিন পর বাড়িতে এসেছে। হোস্টেলে যতসব বাজে খাবার দেয়।
সুফিয়ার মনটা কেমন করে ওঠে আবিরের জন্য। ওরা দুই বন্ধু পিঠাপিঠি ভাইয়ের মতো সময় কাটিয়েছে। সেই আবির ধীরে ধীরে সরে যায় অনির্বাণের কাছ থেকে। এক সময় সিগারেটের গন্ধটা সহ্য হতো না আর এখন সিগারেট থেকে শুরু করে আরও কত আজেবাজে জিনিসে অভ্যাস্ত হয়েছে আবির।
সমাজে মোত্তালেব সাহেব-রা নিজেদের স্বার্থের জন্য হাজার হাজার আবিরদের ঠেলে দিচ্ছে বেপথে। নেশায় বুদ হয়ে জড়িয়ে পড়ছে যতসব অপকর্মের সাথে। একটু বাড়তি সহানুভূতি, একটু ভালোবাসা পেলেই হয়ত এসব ছেলে-মেয়েরা পঙ্কিলতা থেকে নিজেদের মুক্ত করে শুধরে নিত নিজেদের। এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই সুফিয়ার রান্না শেষের পথে। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো বজলু মিয়া।
– সুফিয়া বজলু মিয়াকে জিজ্ঞেস করে, কী খবর বজলু মিয়া? কী হয়েছে?
– বজলু মিয়া বলে, ফুবু গো ফুবু, পুলশে ভইরা গ্যাছেগা!
– কোথায় পুলিশ?
– ওই তো মোত্তালেব সাবের বাড়িত।
– কেনো, কী হলো আবার?
– হুনতাছি, হেই নাকি কারে জাল সারফিকেট দিছে ভত্তির জন্যি।
– একটা চেয়ার দিয়ে সুফিয়া বলে, এখানে বসে ভালো করে বলো কী হয়েছে। ততক্ষণে বৃদ্ধও এসে দাঁড়িয়েছেন ওদের কাছে।
– কে নাকি ইস্কুলেত ভত্তি হবি। হ্যায় আইসা মোত্তালেব সাবরে ধরছে ভত্তি কইরা দিবার জন্যি। তহন মোত্তালেব সাব হ্যারে আত্মিয় কইয়া সারফিকেট দিছে। এই সব মিথ্যা জানাজানি ইইয়া গ্যাছে। অহন পুলশে আইছে হ্যারে ধ্যরতে।
– ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুমি যাওতো বজলু গাছ থেকে ঝুনা নারিকেল পারো কয়েকটা। পিঠা করবো।
– জে আইচ্ছা ফুবু।
– সুফিয়া তার বাবা কে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘বাবা তোমার মনে আছে, অনির্বাণের ভর্তির সময়ও এমন ঘটনা ঘটেছিল। অবশ্য সে ঘটনা তেমন কেউ একটা জানে না।
– কোন ঘটনা মা?
– ওই যে, অনির্বাণের বন্ধু মারুফের কথা মনে নেই। ওদের বাড়ি নেত্রকোনা। ওর বাবা পল্লীবিদ্যুতে চাকরি করে। ওর মায়ের জ্যাঠা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তো উনার নাতি হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা কোটাতে ভর্তি হলো মারুফ। মনে নেই তোমার?
– ও হ্যাঁ মনে পড়েছে!
– এত নির্লিপ্তভাবে বললে যে?
– কিছু তো বলার নেই মা। জ্ঞানের দীনতা। জ্ঞানের দীনতা না হলে কেউ কী নৈতিকতা বিসর্জন দিতে পারে?
বৃদ্ধের এই জিজ্ঞাসা দেশ না সমাজের কাছে, তা জানা নেই। তবে, তরুণ প্রজন্মই পারে ঘুনধরা সমাজটাকে বদলাতে। তাইতো অনির্বাণ বলে ওঠে ‘দেখো নানাভাই, আমরা, আমাদের এই প্রজন্ম একদিন সব দীনতা দূর করে নির্মল আলো জ্বেলে দেবো।’ ধীর পায়ে কখন এসে যে অনির্বাণ দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিল, ওরা খেয়াল করেনি। তবে, অনির্বাণের এই আশার বাণীতে ওরা চমকিত হয়, নতুন স্বপ্নের আলোয়।