আমি স্বর্ণার হোম টিউটর ছিলাম। কোন এক বিকেলে যখন টিউশনি করছিলাম দেখি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট ফুটফুটে একটা মেয়ে। সম্পর্কে আমার ছাত্রী স্বর্ণার ভাগ্নি। হাতে চকলেট নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বারবার মেয়েটা আমাকে চকলেট খেতে বলছিল। তবে, তখন মোটেও আমার চকলেট খেতে ইচ্ছে করে নি। কিন্তু মেয়েটা ব্যর্থ হতে নারাজ। সর্বাত্মক চেষ্টা করছে চকলেট খাওয়ানোর। রাজি না হওয়ায় আমার মুখ মেখে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে হা করে খেয়ে নিলাম। না খেলে মুখ নোংরা করে ফেলার নিশ্চয়তা ছিল অত্যধিক।
চকলেট খাওয়ার পাশাপাশি পড়া দেখিয়ে দিচ্ছিলাম। খাওয়া শেষ। পিচ্চির মুখে হাসি কারণ অবশেষে আমি ওর ছোট্ট উপহার গ্রহণ করেছি সাদরে। কিছু বলল না; দাঁড়িয়ে রইল নিরবে কমপক্ষে পনেরো মিনিট।
হঠাৎ আমাকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরে দৌড়ে চলে গেল পাশের ঘরে। আমি একটু হাসলাম। গভীরে চিন্তা করি নি। একটু পড়েই কেঁদে উঠল মেয়েটা। কিছু বুঝতে পারলাম না। রান্নাঘর থেকে মেয়েটার মা নাঈমা জিজ্ঞেস করল– “স্বর্ণা, কী হয়েছে? আবিরা কাঁদছে যে!” আমার পাশ থেকে স্বর্ণা উত্তর দিল– “আপু, স্যার আবিরার চকলেট খেয়ে ফেলছে! তাই।”
এ কথা শোনামাত্র বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। এ কোন মহাবিপদ!
স্বর্ণার আম্মু আবিরাকে নিয়ে ছাদে গেল। কান্নার শব্দ ভারী হয়ে যাচ্ছে। এমন সময় অফিস থেকে বাসায় আসল আবিরার নানু ভাই; মানে আমার ছাত্রীর বাবা। এসেই শুনে আবিরা কাঁদছে। কাঁদার কারণ জিজ্ঞেস করতে না করতেই কাজের মেয়েটা বলছে– “খালুজান, স্বর্ণা আফার মাস্টারে আবিরার চকলেট খাইয়্যা ফেলছে।” আবিরার কান্না থামানোর জন্য তখন কাজের মেয়েটা বলেই ফেলল– ‘কাইন্দোনা বাবু, স্যারকে মাইর দিমু।’
লজ্জায় আমার মাথা নিচ। এই কথাগুলো শুনে ঐ বাসায় থাকাও সম্ভব ছিল না বের হওয়ায় ছিল অসম্ভব। পড়ানো শেষও হয় নি তখনও। ঐদিকে আবিরার কান্না থেমেছে। পাশের ঘরেই ছিল আবিরা তার নানা-নানির সাথে। পড়ানো শেষে আমি যখন উঠতে প্রস্তুত তখন কানে আসল– “আবিরা মামণি, কী হয়েছে তোমার?” কণ্ঠটা আবিরার মেঝো খালামণির। আবিরা এতক্ষণে মুখ খুলল। আমি আবিরার কথা শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হাসব নাকি কী বলব বুঝত পারছিলাম না তখন।
আবিরা বলছিল– “জানো খালামণি, তুমি আমাকে যে চকলেট দিয়েছিল ঐটা আমি ঐ রুমে যে আংকেল বসে আছে তাকে দিয়েছি।”
– তো কী হয়েছে?
– আংকেল চকলেট খেয়ে ফেলেছে।
– খাবেই তো। তুমি তাকে খেতে দাও নি?
– দিয়েছিলাম তো। কিন্তু, আংকেল আমাকে থ্যাংক ইউ বলল না কেন?
– বলে নি তাতে কী হয়েছে, মামণি?
– তুমি না বলেছ কেউ কিছু দিলে তাকে থ্যাংক ইউ বলতে হয়। আচ্ছা, তাহলে কি আংকেল পচা?
– না, মামণি। তোমার আংকেল পচা না; দুষ্টু।
সবাই যখন আবিরার কথায় মনযোগী তখন স্বর্ণাকে ‘আসছি’ বলে বেড়িয়ে এলাম। বাসা থেকে বেড়িয়ে এসে খুব করে হাসলাম। হাসি থামিয়ে বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিলাম।
পরদিন আবার টিউশনিতে গেলাম। সাথে একটা রঙিন কাগজ আর এক বাক্স চকলেট। বাসায় ঢুকতেই দেখি আবিরা ওর আব্বু আম্মুর সাথে বেরুচ্ছিল। আমি কিছু না বলে আবিরার হাতে কাগজে মুড়ানো চকলেটের বাক্স দিয়ে স্বর্ণার রিডিং রুমে গিয়ে পড়ানো শুরু করে ভাবছিলাম আবিরা কি চকলেট পেয়ে গতকালকের অভিমান ভুলবে আদৌ?
ঐদিন পড়ানো শেষে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আবিরা আবার ফিরছিল তখন। আমাকে দেখেই বলল– “থ্যাংক ইউ, আংকেল।” “জানো খালামণি, আংকেল আজকে আমাকে চকলেট দিয়েছে।”
এ কথা শুনে পাশে দাঁড়িয়ে থেকে স্বর্ণার মেঝো বোন পান্না জিজ্ঞেস করল– মামণি, তোমার আংকেল কেমন?
– দুষ্টু!