আবর্তন

আবর্তন

গত কয়েকদিন তীব্র মানসিক যন্ত্রনায় ভুগছিলেন তড়িৎ বাবু। প্রবীণ সেতারি তড়িৎ মুখোপাধ্যায়। স্ত্রী বিছানায় শয্যাশায়ী, তিনি নিজেও এখন সব সময় সেতারে হাত দিতে পারেন না শরীরের কারণে। ছেলেকে সেতার শেখাতে চেয়েছিলেন আগে অনেক করে বলতেন, বোঝাতেন– “বাবা, তোর হাতে গুণ আছে, বাজনা আছে। মা সরস্বতীর দেওয়া গুণ এভাবে নষ্ট করতে নেই।”

ছেলে শিখলো না, গিটার নিয়ে মেতে রইলো। রক মিউজিক, কনসার্ট, হেভি মেটালের ঝঙ্কার এসবই তার প্রিয়। তাও শিল্পের মধ্যেই আছে।তবে পছন্দ যেমনই হোক মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে বিদেশ থেকেও শো ফেলে ছুটে এসেছে ছেলে।

“বউয়ের অসুস্থতার জন্যে হলেও দু বছরে অন্তত একবার সন্তানের মুখ দেখতে পাব।”, স্বগতোক্তি করেছিলেন তিনি।

স্ত্রী রমার অসুখের জন্য রাতে প্রায়ই ঘুম হয় না তড়িৎ বাবুর। আজকাল এই শেষ বয়সে এসে জীবনের অনেক অসফলতা, অনেক অসম্পূর্ণতা বড্ড মনে পড়ে যায়। যন্ত্রণা দেয় শিল্প থেকে বিচ্ছিন্নতাবোধ।

আজ সমস্ত রাতটা যেন স্থির অন্ধকারের চাদর মুড়ে বসে আছে। চরাচর ব্যাপী এক আদিম মৌনতা গ্রাস করেছে যেন মহাবিশ্বের ব্যাপ্তি বিস্তারকে।

হঠাৎ শুনলেন একটা ধ্বনি উঠল। সাধারণ আওয়াজ নয়, অচেতন মানুষের নিদ্রালস চেতনায় আঘাত করে এমন কমনীয় অথচ মন্দ্র ঝঙ্কার। এ যে সরোদের ধুন! শুদ্ধ মাইহার ঘরানার বাজনা নয় কিছু ছাপ আছে আগ্রা ঘরানার। শব্দের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কিছুটা আচ্ছন্ন বেশিটাই অভিভূত হয়ে তিনি এসে থামলেন ছেলের ঘরের দরজায়।

দেখলেন চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরের দাবার বোর্ডের মতো ছক কাটা সাদাকালো পুরোনো দিনের মেঝেয় আর সারা বাড়ি ভেসে যাচ্ছে দরবারীর আন্দোলনে। মধ্যরাত্রিকালীন রাগ। যৌবনে তিনি নিজেও প্রচুর বাজিয়েছেন।

তার মনে পড়ছে গুরুদেবের কথা। তিনি বলেছিলেন– “বাবা তড়িৎ, এ হল উত্তরাধিকার। এ যে গর্ভের মধ্যেও কাজ করে। তুমি আমি আর শিক্ষা দেওয়ার কে!”

তখন মনে হয়েছিলো যে গুরুজীর কথা কিছুটা হলেও সর্বৈব সত্য নয়। আর যদি সত্যিই হয়ে থাকে তবে তো বলতে হয় এত পরিশ্রম, রেওয়াজের কোনো মূল্যই রইল না, আজ বুঝছেন। বাবার হাজার কথা, হাজার বকুনি যাকে ফেরাতে পারলো না তাকে ফিরিয়ে আনল মায়ের অসুখ ফিরিয়ে আনলো শিকড়ের টান।

এই আন্দোলনে শুধুই স্বর নয় ফুটে বেরোচ্ছে আবেগমথিত বাৎসল্যের মায়া। জীবনে অনেক না পাওয়া, অনেক অপ্রাপ্তি থেকে উঁচুতে উঠে শিল্পী হিসেবে, পিতা হিসাবে তো বটেই মানুষ হিসাবেও তড়িৎবাবু আজ বড় পূর্ণ। অনেকদিনের পুরোনো সেতারী তড়িৎ মুখোপাধ্যায় নতুন করে জেগে উঠলেন। তার মনে হল সেতার যেন হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত