এমন এক সমাজে জন্ম হয়েছিলো আমার যেখানে নারী একটা অসম্মানের গালি। নারী মানেই রান্না ঘরে সারাদিনব্যাপী ব্যস্ততা আর সন্তান জন্ম দানের পর তার লালনপালন । নারী কে নারীই সবার আগে অসম্মানিত করে। নারী মানেই এক আজব মানুষ যার আলাদা কোনো পরিচয় আলাদা অস্তিত্ব অবান্তর । আমি যে নারীর গর্ভে জন্ম নিয়েছি তিনি এক বীর নারী । জীবনে কখনো কারো কাছে নতি স্বীকার করেননি এবং আজীবন নিজ উপার্জনে ,নিজ পরিচয়ে সর্বত মাথা উঁচু করে চলেন।
আমার নিজের আলাদা করে কোনো পরিচয় দেবার মতো যোগ্যতা নেই। আমি এক অর্বাচীন নারী। কিন্তু আমি সব কর্মরত নারীদের গভীর ভাবে শ্রদ্ধা করি। বাড়ির কাজের বুয়া যে মাস শেষে বেতন নিয়ে হাসি মুখে ঘরে ফেরে তাকে যেমন সম্মান করি তেমনি একজন গারমেন্টস কর্মীকে অথবা যে নারী নিরুপায় হয়ে শরীর বিক্রি করে পরিবারের দায়মোচন করে তাকেও। এ শুধু মুখভরা কথার কথা নয় এ আমার একান্ত নিজের উপলব্ধি । মায়ের অনেক দুঃখ রয়ে গেলো আমি নিজেকে কেনো কোনো পেশায় প্রতিষ্ঠিত করলামনা। সবাইকে দিয়ে সব হয়না। আমি শুধু ভালো জায়া ,ভালো জননী হতে চেয়েছি। তনু হত্যায় আমি মানব বন্ধন এ যাইনি,রাজনৈতিক অনুষ্ঠান আমাকে টানেনি। ডাক্তার ,মোক্তার আমার হওয়া হয়নি। আসলে আমার সেসব যোগ্যতা ছিলোইনা কখনো ।
আমাকে এই পৃথিবীতে সবাই ভালোবেসেছে শুধুই স্বার্থের জন্য। প্রয়োজনমতো ব্যবহার করেছে আবার প্রয়োজন ফুরোলে বাঁকা কথা বলতে কসুর করেনি এতটুকু। ভাইদের যখন অবলম্বন প্রয়োজন ছিলো তখন মায়ের আসনে বসিয়েছে আবার যখন স্বার্থে টান পড়েছে মিথ্যে অপবাদ দিতে কার্পণ্য করেনি। প্রেমিকের অভাব হয়নি কখনো কিন্তু যখন তাদের ডাকে সারা দিইনি ঠিকই তির্যক কথা বলতে ছাড়েনি। স্বামী তো বুকে করেই রাখে আবার যখন তার পরিবার আমাকে অবর্ণনীয় অত্যাচার করে তখন সে অচেনা! সন্তানেরা ও তো মুখের ওপর থুথু ছিটায় যখন তাদের শাসন করি অথবা অন্যায় আবদারে বাঁধা দিই।
আমি নারী । তাই শ্বশুরবাড়ির সবার মুখ ঝামটার পাত্রী । আমি নারী তাই নাড়িছেঁড়া ধন যখন অন্যের গৃহের ঘরণী হয় এবং কিছু আবদার অথবা কোনো কাজ ঠিকমতো করতে না পারে তখন জামাতা অবলীলায় আমাকে গালাগালি করে-“তোমার মা একটা অমানুষ তাই তোমাকেও একটা অকর্মা অমানুষ বানিয়েছে । ” জামাতাকে এতোটা জামাই আদর করার পরও মেয়েকে – “তুমি তো খানকির মেয়ে বেশ্যার মেয়ে” শুনতে হয় মাথানীচু করে। আমার দোষ-আমি নারী , হ্যাঁ আমি নারী । আমার মাতামহী এক নারী ,আমার মা এক সংগ্রামী নারী , আমি এক অসম্মানিত নারী ,আমার কন্যাও এখন নারী এবং তার কন্যাও একদিন অসম্মানিত এই নারী সমাজের সম্মানীত নারী হবে একদিন এই আশা মনেমনে।
যখন মা ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ভিডিও কলে তার বিদেশী বন্ধুদের ডেকে বলে“ দেখো দেখো আমার মেয়ে” আমি তখন আপ্লুত হই। যখন প্রাণের সন্তান গভীর রাতে দুঃস্বপ্নপীড়িত হয়ে “আম্মু আম্মু “বলে জড়িয়ে ধরে নিরাপদ আশ্রয়ে -তখন এ নারী জীবন স্বার্থক মনে হয়। স্বামীর না বলা সমস্যার কথা যখন আপনাতেই বুঝে যাই তখন মনে হয় সত্যিই আমি পারি সবটা জানতে । যখন সীমাহীন দুঃখের সময় ভাইয়েরা কোনো কথা না বলে শুধু হাত ধরে চুপচাপ পাশে বসে থাকে ঠিক ঐ মুহূর্তে মনে হয় আমি নারী হয়ে স্বার্থক । ভায়ের ছেলে যখন ফোন করে বলে-“ফুপি আজকেই আসো,প্লিজ আসো”তখন ভালোবাসায় দু’চোখ ভিজে যায়। দুবাই প্রবাহী কাজিন যখন বলে-আপু ,আপনাকে অনেক ভালোবাসি,মিস করি খুব” সে জানেনা তারপর ঘন্টা দুই আমি নিরবে কাঁদি। কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে সবাই যখন অধীর আগ্রহে আমার জন্য অপেক্ষা করে আমি দিশাহারা হই ওদের ভালোবাসায়।
আমি নারী ,একটা গালি যার উপযুক্ত অর্থ তবু কেউ যখন ভালোবাসে কিন্তু বলেনা আমি ঠিক বুঝে যাই। আমি যে নারী । এক ব্যর্থ নারী। জীবনের অনেক কঠিন অংক আমি করতে পারিনি । শুরুটাই হয়তো ভুল ছিলো তবু মনে হয় সেইসব ভুল আমার এক জীবনের কুঁড়িয়ে নেয়া ফুল। আমি নারী আমি তোমাদের সমাজে আলাদাভাবে পরিচয় দেয়ার যোগ্যতাহীন । তবু যখন সন্তানেরা“ মা ” “মা” বলে ডাকে মনে হয় আমার নারী হওয়া স্বার্থক।