দান বাক্সটা সামনে না আসার জন্য মনে প্রাণে খোদাকে কতবার যে ডাকা হয়েছে, সেটা আমার আঙ্গুলের কর জানে। জানে উপরওয়ালা। সিরিয়াস সময়ে প্রভুকে ডাকতে ডাকতে কিভাবে আঙ্গুলে গুনছিলাম মনে নেই।
পকেটে মাত্র সতের টাকা। দশ টাকার আস্ত একটা নোট, পাঁচ টাকার একটা যমুনাসেতু মার্কা কয়েন আর মুজিবের ছবি আঁকানো ভাঁজ করা দুই টাকা। পল্টনে যাব বলে ছোটুর পকেট থেকে দশ টাকা না বলে নিয়েই আমার বর্তমান সম্বল মোট সতের টাকা।
তড়িঘড়ি করে বের হলাম বাসা থেকে। একরকম উড়ে উড়েই চলছি বলা যায়। আমার হাঁটার স্পিড ঘন্টায় আড়ায় থেকে তিন কিলোর বেশি তো হবেই! লক্ষ্য পুরানা পল্টন।
বাইরের রোদ কেমন তাপ ছড়াচ্ছে সেটা না বুঝেই বের হয়েছি। তাপমাত্রা কমে জিরো ডিগ্রি সেলসিয়াসে পুরো কুয়াশায় বরফ পড়ার মতো দরদর করে ঘাম ঝরছে। অবশ্য বরফের কথা একেবারেই আসতো না, যদি না মাঝেমধ্যে একটু আকটু বাতাস শরীরে না লাগতো।
একটু পরেই আযান শুরু হলো চারদিকে। টুপি পরে সব পুরুষ লোকেরা বাসা থেকে মসজিদের দিকে আসা শুরু করতেই আমার মনে হলো এখানেও এক ধরণের বৈষম্য কাজ করছে। জুমার আযান শুনে মহিলারা কেন হিজাব নিয়ে বের হয় না? আশপাশে কাউকে না দেখে প্রশ্নটা নিজের ভেতরেই স্থির করে রাখতে হলো। ব্যাপারটা নিয়ে কোনো একদিন মসজিদের ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। যদিও আমার প্রায় প্রশ্নের উত্তরই তিনি অবান্তর মনে করে এড়িয়ে যান, তারপরও জিজ্ঞাসা করব।
এসব আউলফাউল চিন্তাধারা মাথায় ঘোরাতে ঘোরাতে কখন যে মসজিদের গেটের সামনে এসে জুতা খোলা শুরু করেছি, সেটা খেয়ালই করিনি। প্রতিদিন দুই তিনবার না হলেও বেশ কয়েকবার মসজিদের আসা হয় আমার। আর প্রতিদিনই আমি জুতা খুলে ভেতরে নিই। প্লাস্টিক কিংবা কাঠের সুন্দর সুন্দর বক্সগুলোতে জুতা রেখে তারপরই বসে যাই। জুতার সেই বক্সটা বেশিরভাগ সময়েই সামনে থাকে। প্রভুর ডাকে সাড়া দিতে এসে এই জুতা চুরি হয়ে যাওয়ার ভয়টাকে ভেতরে বহন করতে বেশ অস্বস্তি বোধ হয়। কিন্তু চুরি হলে তো আব্বার খিটমিটে মেজাজ দেখা তো আর বাদ যাবে না!
আজ জুতা খুলতে গিয়েও খুললাম না। কী মনে করে খোলা হলো না সেটাতে পরে আসি। হাতির মতো উঁচু গেইটের পাশে মার্বেল পাথরে “জুতা নিজ দায়িত্বে রাখুন” বলে যে কথাটা লেখা আছে, ওটাই আমার জুতা না খোলার একমাত্র কারণ হয়ে দাঁড়াল। কেন? জুতা আমার দায়িত্বে রাখতে হবে কেন? এখানে জুতা রাখলেই বা কেন চুরি হবে? অবান্তর চিন্তারে ময়লার ঝুড়িতে রেখে জুতা ঠিকই হাতে নিয়েছিলাম।
ওজুখানায় বসে বসে এসবের চিন্তা করতে করতে কারো হাতের স্পর্শ “ভাই দ্রুত অযু শেষ করেন না।” মানুষের চলার ক্ষীণ শব্দে যেমন ফিঙে পাখি হঠাৎ উড়ে যায়, আমারও তাই হলো। ভাবনাগুলো আমাকে মুক্তি দিয়ে অন্য কারো মগজে সাময়িক সময়ের জন্য স্থানান্তরিত হলো।
ইমাম সাহেব ওয়াজ করছেন কুরবানি সম্পর্কে। চামড়া সম্পর্কে। মাইকের সাউন্ড এত্ত বেশি দেয়া, একটু পরপরই ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ শুরু করে দিচ্ছে। মেজাজ খারাপ না করে আবার প্রশ্ন খোঁজাই মনোযোগী হতে হতেই দেখি কে যেন “দান বাক্সটা চালু করে দিই” লাফিয়ে বলে উঠল।
আশপাশের মানুষগুলোর নড়াচড়ার ভঙ্গিমা ঠিক কতখানি বিরক্ত করছিল আমাকে সেটা মাপার যন্ত্র থাকলে অবশ্য মেপে রাখা যেত। কেউ পকেটের সবচে ছোট টাকার নোটটাকে বের করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আবার কেউ একশ পাঁচশ টাকার নোট বের করে এদিক-ওদিক বারবার তাকাচ্ছে, কিছু মানুষ দেখুক যে আমার দানের হাতও কিন্তু একেবারে ছোট না। আচ্ছা, এই যে মসজিদে কিছু টাকা দিবে, এটা এতো ফরমাল করার প্রয়োজন কী?
মসজিদে আমি যে কাতারে বসেছি তার শুরুতে বেশ কয়েকবার তাকালাম। দানের বাক্সটা নেই। স্বস্তির বড়সড় একটা নিঃশ্বাস ফেলতে না ফেলতেই পাশের দু’জন বেশ হাবভাব নিয়ে টাকা বের করল। আমি আর আশপাশে তাকাই না। পকেটে হাত দিয়ে সবচে ছোট অংকের নোটটা বের করতে চাইলেইও চাওয়াটা আমার ইচ্ছে মতো হয় না। দশটা টাকা খুইয়ে এসেছি বলে নিজেরে অপমানিত ব্যক্তি বলে মনে হতে থাকে।
নামাজ শেষে মসজিদের দান বাক্সের দিকে তাকিয়ে পাশের দুজন লোককে কুত্তার বাচ্চা বলতে বলতে আমি প্রস্থান করি। পৃথিবীর নিকৃষ্টতম মানুষ বলে আখ্যায়িত করতে হলে আমি এদেরই করতাম।
যাত্রাবাড়ী চার রাস্তার মোড়ে অনেক গাড়ি। অনেক মানুষ এক জায়গায় জমা হলে উদাহরণ সমেত বলা হয় “পিঁপড়ার মতো মানুষ পিলপিল করছে।” আর এখন আমি যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় এসে পিঁপড়ার মতো গাড়ি দেখতে দেখতে পকেট হাতড়াই।
মাত্র সাত টাকা দিয়ে পল্টনের শেষপর্যন্ত যাওয়া গেলেও আমি গাড়িতে যাবো না বলে মনস্থির করে ফেলেছি। পকেট একেবারে ফাঁকা হয়ে গেলে মানুষের রুচি কিংবা বিহ্বলতার মাত্রা অনেকখানি বেড়ে যায়। বাপ মা থেকেও এতিম এতিম একটা ভাব ভেতরে ঝড়ের মতো কাজ করে। সো লেটস গো, নিজেকে নিজেই কন্ট্রোল করে রাস্তার ফুটপাতে উঠিয়ে দিই!
সায়দাবাদের বিশাল ডাস্টবিনের পাশে ব্যাঙের ছাতার মতো দাঁড়িয়ে থাকা চায়ের দোকানে টুল পাতা ছিল। কোনো কথা না বলে হুট করে ঐ হাফ ফুট চওড়া কাঠের টুলে বসেই হাসফাস লেগে যাওয়া গরমকে উদ্ধার করছি। আর মেইন রাস্তার ভাঙাচোরা তুরাগ আর গাবতলির সাত নম্বর বাসের হেলপারগুলো তখনো ডেকেই যাচ্ছে, হৈ গুলিস্থান পল্টন প্রেসক্লাব— আবার কেউ হৈ মালিবাগ রামপুরা হাতিরঝিল….!
এই হেলপারগুলোকে আনাড়ি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। কেউ যদি রাস্তায় পেশাব করতে করতে হাত দিয়ে সিগনাল দেয়, তাহলে ঐ লোক আছে বলে বাসের পাছায় জোরে একটা থাপ্পড় মেরে রাস্তার মাঝেই বসে থাকে। লোকটা তার প্রকৃতির প্রয়োজন সেরে ধীরে-সুস্থে এসেই বসে যায় বাসে কোনো ময়লাযুক্ত সীটে। হেলপারের মুখে কমিশনের হাসি ফোটে।
এদের চিল্লাপাল্লার ভেতর দিয়েও আরেক দলের চিল্লানীর মাত্রা হঠাৎ-ই একটু বেড়ে গেল। একজন লোককে অনেকগুলো মানুষ ঘিরে হুল্লোড়ে ব্যস্ত। মারামারি কিংবা বর্তমান ক্ষমতাধারী কেউ কাকে মাইর দেওয়া নয়, বরং হালকা “শাসনকাজ” চালাচ্ছে কি না সেটা একবার হাতেনাতে দেখে আসি বলে ওদিকে আগাতেই আমার বিভ্রমের পর্দা একেবারে চূর্ণ-বিচূর্ণ হলো।
বিরিয়ানির প্যাকেট দেখে আমার জিহ্বায় যে লালার কোনো লেশমাত্র নেই, এইরকম মিথ্যা কথা বলার মতো জোচ্চর আমি নই। দৌড়ে গিয়ে একটা প্যাকেট হাতে গছিয়ে পাশ ফিরে আবার যাত্রাবাড়ীর দিকে ফিরলাম। মাঝে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে খাওয়াও শেষ করলাম কোনোরকম বাধাবিপত্তি ছাড়ায়। এখানে বাধাবিপত্তির কথা আসলো কারণ এই প্যাকেট নিয়ে বাসায় ফিরলে না আমার না অন্য কারো পেট ভরতো!
পল্টনের আজাদ প্রোডাক্টের পাশে তানহাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিলাম। আজ আমাদের দা-কুমড়ো সম্পর্কের মানে প্রেমের সম্পর্কের কয় বছর যেন পূর্তি হতে যাচ্ছে! আমার খিদেযুক্ত পেট ঠান্ডা হবার পর সেকথা একেবারে বিলকুল ভুলে গেলাম। সে সম্পর্ক আর টিকবে বলে মনে হচ্ছে? আপনারাই বলুন, প্রেম বিষয়টা স্পর্শকাতর কিনা! যদি হয়, তাহলে তো কিসসা খতম।
রাফি আমাকে প্রতিদিন রাতে শোয়ার সময় পুরো দিনের গল্পটা বেশ রসকষ লাগিয়ে শোনাতে থাকে। কেন বলে সে প্রশ্নে শুধু, শেয়ার করতে ভাল্লাগে— বলেই চুপ থাকে। গল্প শোনাতে শোনাতে ও ভাবে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। এজন্য তখন ভেতরে জমে থাকা কথাগুলো একা একাই বলে। আমি পাশ ফিরে শুই। ওর গল্প শুনি।
রাফি তুই মসজিদে যাস কেন? না গেলেই তো পারিস! কমপক্ষে তানহার সাথে দেখাটা তো হতো!
ধুর ব্যাটা, কী বলিস এইগুলা! মসজিদে যাওয়া তো ভালো কাজ।