সেলুন

সেলুন

সেলুনে জীবনের প্রখর চঞ্চলতা হয়ে ওঠে স্থবির, কখনো কখনো নির্মল সুন্দর। অপেক্ষা ক্রমশ অবসরে পর্যবসিত হয়ে মগজকে অতীতের স্মৃতি বিস্মৃতির অতলে দ্যায় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ, ফলশ্রুতিতে জীবন ভাবনায় এক অনাবিল অবগাহনের অপরূপ মুহুর্তে উপনীত হয় শ্যামল। আলুথালু প্রলম্বিত দীর্ঘ চুল নিয়ে ক্রমশ ভাবনার অন্তরালে ডুবে গিয়ে হিরে মানিকের সন্ধান না পেলেও, সময়কে যাপন করার এক মোক্ষম পথ আবিষ্কার করে সে। নাপিতের দোকানে চিন্তাকে অতিদূর টেমস নদীর অববাহিকায় ঘুরিয়ে নিয়ে এসে, অত্যুজ্জ্বল ঘটনায় নিজেকে সন্নিবেশিত করে কাটায় নিষ্ঠুর বৈরী নিঃসঙ্গ কিছু মুহুর্ত।

কান্দুপট্টি এলাকার নাম হঠাৎ করোটির ভেতর দপ করে জেগে ওঠায় শ্যামল প্রথমত থতমত খেয়ে কার্যকারণ তত্ত্বের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাপিত জীবনে সাজ্জাদের কাছে শামসুর রাহমানের কবিতায় কান্দুপট্টি শব্দটি শুনেছিল কিনা সেটি সঠিক ঠাহর করতে না পেরে নাপিত মোসাদ্দেককে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা ভাই….

নাপিত মোসাদ্দেককে শামসুর রাহমান কোনো কবিতায় কান্দুপট্টি শব্দটি ব্যবহার করেছেন কিনা, সেটি বলার জন্য শ্যামল যখন উদগ্রীব, ঠিক তখন শ্যামলের ভাবোদয় হয় যে, সে যেখানে অবস্থান করছে সেটি মূলত সেলুন এবং যেহেতু শিক্ষিত মানুষরা পাঠ্যসূচির বাইরে কখনো কবিতা পড়েছে কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ থেকেই যায়, কাজেই সেখানে একজন নাপিতকে কান্দুপট্টি শব্দের উৎপত্তি সম্বদ্ধে জানতে চাওয়া স্রেফ আত্মবোকামী ছাড়া কী হতে পারে? এমতাবস্থায় আত্মসচেতন হয়ে শ্যামল নাপিত মোসাদ্দেককে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা ভাই, আর কতক্ষণ?

নাপিত মোসাদ্দেক ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ করে চুল কাটতে কাটতে হঠাৎ থেমে যায়, বাইরে থু থু ফেলে, অভ্যাসবসত মুখে গুল দিতে দিতে বলে, এই চুল-টা কেটে আর দুটা শেভ হলে….

সেলুনে এসে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার সুবাদে আয়নার সামনে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার অনভ্যস্ত অপার সুযোগ শ্যামলকে যখন পেয়ে বসে তখন সে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিজের মুখের দিকে, মাকড়সার জালের দিকে, অবিন্যস্ত ঝাঁকড়া চুলের দিকে, আয়নায় পথচারী, চলমান রিক্সা, অটো, ভ্যান, সাইকেলের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে থাকে এবং হঠাৎ যখন আয়নার ওপর দিয়ে হেঁটে যায় একটি হৃষ্টপুষ্ট টিকটিকি, ঠিক তখন অদ্ভুত এক দার্শনিক চিন্তা নিজের ভেতর অনায়াসে উপলব্ধি করে শ্যামল। যদি সে শ্যামল না হয়ে রাস্তার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সুবিশাল ইউক্যালিপটাস গাছ কিংবা ঘাস অথবা সদ্য দেখা টিকটিকি হয়ে জন্মাতো তাতে কি মনের চিলেকোঠায় জন্মাতো কোনো বিন্দুমাত্র ক্ষোভ? অথবা মানুষ হয়ে না জন্মানোর কোনো বিষাদ কি তাকে ছেয়ে নিতো? কিংবা আদৌ যদি সে না জন্মাতো, তাতে কোনো প্রকার লোকসান গুনতে হতো কিনা তাকে?

টেবিলের ওপর স্তুপীকৃত ব্যবহৃত বিগত শেভ উপকরণ, ব্লেড, কিছু পুরাতন পত্রিকা, ধুলোবালি ভরা একটা ডায়েরি। শ্যামল কৌতূহলবসত পুঞ্জিভূত সে স্তুপ নাড়াচাড়া করে অকস্মাৎ ডায়েরিটা হাতে নেয়। প্রথম কয়েক পৃষ্ঠায় চোখ বুলায়। ফুঁ দিয়ে কিছু ধুলো ঝেরে ফেলে। ধুলো পরিষ্কার করতে হাতের আঙুলের দ্বারস্থ হয়। ডায়েরির পাতা ওল্টাতে কিছু হিসাবনিকাশ সেখানে দৃষ্টিগোচর হয়। তাছাড়া নিরক্ষর শিশুর কীর্তির কিছু ছাপ লেগে থাকে ডায়েরির পাতায়। তারপর হঠাৎ ডায়েরির দু এক পাতা উল্টাতে চমৎকার হস্তাক্ষর দেখে একটা পৃষ্ঠায় চোখ নিবদ্ধ হয় শ্যামলের। মনোযোগপূর্বক সে পড়তে শুরু করে, সেখানে লেখা:

“সন্ধ্যায় মহুয়া নদীর ধারে এক তরুণীকে দেখা যায়, মাঝে মাঝে। নদীর পানিতে শ্যাওলার আস্তরণে চোখে পরে যুগল হাঁসের কাটানো কিছু সুন্দর মুহুর্ত। দেবদারু গাছে বাতাস বয়ে গেলে দিগন্তে ছুটে চলে দুটি অচিন পাখি। কখনো মেঘের ভেতর থেকে উঁকি মারে প্রসন্ন পূর্ণিমা। সেই ছায়া অবশ্য পরে মহুয়ার শরীরে। নাম না জানা সেই তরুণীর উপস্থিতিতে আমার কাছে সবকিছু আরো বেশি অপরূপ হয়ে ওঠে।”

কাব্যিক লেখার ভেতর ক্রমশ ডুবে যায় শ্যামল। ডায়েরির পাতা উল্টায়। তখন বিবর্ণ লুঙ্গি, তালিমারা বিড়ির আগুনে পুড়ে যাওয়া ফ্যাকাশে মলিন শার্ট পরিহিত এক রিক্সাচালক এসে নাপিত মোসাদ্দেকের দোকানের বেঞ্চে বসে বিড়িতে অনাবিল সুখ আস্বাদন করার স্বার্থে সুস্থির এক লম্বা টান ছাড়া মাত্র ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছেয়ে নেয় রিক্সাচলকের মুখের অগ্রভাগ এবং নাপিত মোসাদ্দেক হাঁক ছেড়ে বলে, কি মিঞাভাই, শুনলাম আবার বিয়া করছো! রিক্সাচালক বিড়ির ছাইয়ের কিয়দংশ আঙুলের টোকা দিয়ে ঝেরে ফেলে খুকখুক করে কাশতে কাশতে জবাব দ্যায়, মিছা শোনো নাই বাপু, আগের খানকি মাগী বৌটা তো বাচ্চা প্রসব করতে গিয়া ইন্না-নিল্লাহ।

খানকি মাগী শব্দটি গেঁথে যায় শ্যামলের করোটিতে। স্পষ্ট সে মনে করতে সমর্থ হয়, কান্দুপট্টির খানকি মাগী, কিন্তু তারপর আর কিছু মনে করতে পারে না।

রিক্সাচালকের আগের বৌ কি ছিল কান্দুপট্টির খানকি মাগী, নাকি খানকি মাগী বলে পরলোকগত বৌকে ভালোবাসার মোক্ষম বহিঃপ্রকাশ ঘটায় রিক্সাচালক, এ ব্যাপারে যদিও একটু বিভ্রান্তিতে পরে যায় শ্যামল কিন্তু পরক্ষণেই স্কুলফেরত এক ঝাঁক মেয়েকে আয়নায় দেখতে পাওয়ামাত্র চোখ সরিয়ে সরাসরি সেই মেয়েদের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে থাকে শ্যামল।

সজীব ফোকলা দাঁত বের করে বলে, কি মাল, মাইরি!

শ্যামল পুনরায় ডায়েরির পাতা উল্টায়, চমৎকার হস্তাক্ষরে সুনিপুণ সেসব লেখার দিকে চেয়ে থাকে।

“বৃষ্টির একটানা বর্ষণ বাউলের একতারার শব্দের মতন কানকে দ্যায় গুঞ্জন মুখর স্বাদ। একদিন নাম না জানা সে তরুণী আমার হৃদয়ের ওপর ছায়া ফেলে উচ্ছ্বসিত হাসি উপহার দিয়ে চলে যায়, হাতের নাগালের বাইরে, চোখের দৃষ্টির সীমানা ছেড়ে বহুদূরে। সেই স্মৃতি বর্তমান রাতের বৃষ্টিতে বারবার কল্পনায় মহুয়া নদীর ধারে নিয়ে যাচ্ছে আমায়, আবেগে শিহরণে কেঁপে উঠছি, তলিয়ে যাচ্ছি ঘুমের অতলে, স্বপ্নের চৌরাস্তায় মেঘের ভেতর ভাসতে ভাসতে তরুণীর সাথে সুনিপুণ সংলাপে মগ্ন হয়ে উঠছি। নিজের অভ্যন্তরে তরুণীর মুখে সংলাপ গুঁজে দিয়ে কথা চালিয়ে যাওয়া আর নয়, এবার বাস্তব জগতে নাম না জানা সেই তরুণীর সাথে হবে কথোপকথন।”

পরের পৃষ্ঠায়, “নাম না জানা প্রিয়া নাম না জানা ফুলের মালা দিয়া হিয়ায় দেব হিয়া (র.ঠা)।”

দু চার পৃষ্ঠা পরে:

“সেদিনটি ছিল হেমন্তের বিকেল। দূর হতে দেখি, নীল জামা পরিহিত সেই মেয়েটি মহুয়ার পাড়ে। নিজের ভেতর সাহস সঞ্চয় করে মেয়েটির পাশে গিয়ে দাঁড়াই। দূর থেকে বক এসে নদীর ধারে হাঁটে, মাছরাঙা ডুব দ্যায় মহুয়ার জলে। হেমন্তের সাবলীল বাতাসে লেগে থাকে পরস্পরের নিশ্বাস। সূর্য ধারণ করে লাল রঙ। আমি মেয়েটিকে বলি, আমি তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই, তখন অবাক হয়ে যাই যখন মেয়েটি সেদিনের মত পালিয়ে না গিয়ে নিশ্চুপ মনে হাঁটে ঘাসের ওপর দিয়ে। আমি অনুসরণ করি মেয়েটির পদচিহ্ন। হঠাৎ খেয়াল করি নীরবতার ভেতর দিয়ে দুজনের মধ্যে ক্রমশ গড়ে উঠছে এক নিবিড় সখ্যতা।

– আমি তোমার নাম জানতে পারি।

– (মেয়েটি নীরব)

– যদি তোমায় নীলিমা বলে ডাকি।

– (মেয়েটির চোখের কোণে এক চিলতে হাসি)

তারপর মেয়েটির হাতে হাত রেখে বলি, আমি তোমায় ভালোবাসি নীলিমা।

তখন যুগল শালিখ আশ্রয় খোঁজে কাঁঠাল গাছের ডালে। দোয়েল শাদা কালো দেহে ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে ঐ দূর হিজলের বনে ডানা ঝাপটায়। আর নীলিমা ওড়নায় মুখ ঢেকে লাজুক মনে চলে যায়। একবার শুধু সে পেছন ফিরে তাঁকায়, যেন মেঘের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা জীবনানন্দীয় কাস্তের মত বাঁকা চাঁদ পৃথিবী গ্রহবাসীকে শুভ বিদায় জানিয়ে আবার মেঘের আড়ালে কোথায় যেন হারিয়ে যায়।”

ঝালাই মেশিনে কাজ করা সজীব চিরুনি দিয়ে মাথার চুল বুলোতে বুলোতে হঠাৎ বলে যে, পুংলিঙ্গ ছেড়ে হঠাৎ স্ত্রীলিঙ্গে রূপান্তরিত হয়ে গেছে পার্শ্ববর্তী গ্রামের সিদ্দিক হুসেইন যা শুনে নাপিতসহ সবাই কেমন শিউরে ওঠে। কিন্তু শ্যামলের তখন কাফকার মেটামরফোসিস গল্পের কথা মনে পড়ে, যেখানে গ্রেগর সামসা ঘুম থেকে উঠে পতঙ্গে রূপান্তরিত হয়ে ওঠে।

আজ হঠাৎ গল্প থেকে একটা বিষয় অনুধাবন করে শ্যামল। হয়তো ইঁদুর, কুকুর, হাঙর, মাছি হয়ে জন্মালেও কারো কোনো বিন্দু পরিমাণ আপত্তি থাকতো না। প্রকৃতপক্ষে মূল বিষয় তবে কী? হয়তো নিজ অবস্থানে থেকে বেঁচে থাকা, যেমন–বেঁচে থাকায় আপত্তি নেই এ পাড়ার ভিখিরি, পাগল, বর্তমানে এই নাপিত, মোটাসোটা ভুড়িওয়ালা লোকটা, সজীব নামের ঝালাই মেশিন কর্মী, ডায়েরির অভ্যন্তরে গল্পের কথক, বোবা মেয়েটি, দোয়েল, হিজল বন, রিক্সাচালক, ইউক্যালিপটাস, ঘাস, টিকটিকি অথবা বি.বি.এ পাস করে এসে বেকার হয়ে বসে থাকা শ্যামল নামক এই প্রাণীটাও।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একমাত্র যে শ্রেষ্ঠ কাজ শ্যামল করেছে, সেটি হলো সাজ্জাদের সংস্পর্শে এসে কিছু কিছু পরম উপাদেয় একাডেমি বহির্ভূত বইপাঠ, এখন এই মুহুর্তে শ্যামলের নিকট তাই মনে হচ্ছে এবং মনে পড়ে, একদিন সাজ্জাদকে সে জিজ্ঞেস করেছিল, সাজ্জাদ একাডেমিক পড়াশোনা ফাঁকি দিয়ে কেন এসব বই পড়ে সময় কাটায়। অনেকটা হেঁয়ালি করে সাজ্জাদ বলেছিল, মূলত এসব বই পড়ার সময় ফাঁকি দিয়েই সে একাডেমিক পড়াশোনাটা চালিয়ে যাচ্ছে।

মোটাসোটা ভুড়িওয়ালা শরীর লোমে ঢাকা লোকটা হাত ওপরে ওঠালে নাপিত কাখের চুল কেটে দ্যায়, সেটা অতটা দৃষ্টিকটু মনে না হলেও যখন লোকটা লুঙ্গির অগ্রভাগ তুলে বলে, দে রে দে, লজ্জা শরমের মাথা না খাইয়া কামখানা কইরা দে, তখন এক প্রহসনের জন্ম নিলে সবাই উচ্ছ্বসিত হাসিতে মশগুল হলে, মোটাসোটা ভুড়িওয়ালা লোকটা হাঁক দ্যায়, ‘ঐ মিঞারা, তোমরা বাল কামাও না নাকি’ তখন সবাই কেমন নির্জীব হয়ে নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে যায়।

ডায়েরিতে মেয়েটির নাম পর্যন্ত উহ্য। তন্নতন্ন করে পাতা ওল্টায় শ্যামল আর কিছু লেখা আছে কিনা। আর নতুন কোনো তথ্য, নতুন কোনো রহস্য। শুধু একজায়গায় লেখা, নীলিমা তুমি নীলিমার মত নীরব, তবু তোমায় আমি ভালোবাসি। আর কোথাও কি কিছু লেখা নেই? শুধু দু একটি কথা লেখা আছে, যার মর্মার্থ দাঁড়ায়, মেয়েটিকে নদীর পাড়ে আর কখনো দেখা যায়নি।

এক বোবা মেয়েকে ভালোবাসার গল্প ডায়েরির পাতায় পাতায়। একজন প্রেমিকের হৃদয়ের স্বর সুনিপুণ হস্তাক্ষরে লিপিবদ্ধ। কিন্তু তারপর গল্পের কথক কেন নাম না জানা প্রিয়ার দর্শন থেকে বঞ্চিত, তার কোনো পূর্বাভাস পর্যন্ত নেই গল্পের কোথাও এবং এই পূর্বাভাসের অনুপস্থিতি গল্পটিকে করেছে প্রাঞ্জল, এটি শ্যামলের অভিব্যক্তি। ভাষাগত দুর্বলতা, আবেগের আতিশয্যে শিথিল প্রেমানুভুতি ডায়েরির পৃষ্ঠা জুড়ে, কে এই গল্পের কথক যদিও সে জানে না, কিন্তু তার প্রতি এক সহানুভূতির দৃষ্টি ফেলে শ্যামল, কেননা স্যালুনে বর্তমান অপেক্ষার প্রহর অন্তত সমাগত দীন হীন অজানা এই গল্পকারের আনুকুল্যে। শ্যামল ভাবে, বিচ্ছেদে এই প্রেম জাজ্বল্যমান এক প্রগাঢ় অনুভূতি হৃদয়ের প্রতি ঢেলে দিয়েছে ডায়েরির গল্পকার। এজন্য গল্পকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে, বহু আকাঙ্ক্ষিত চেয়ারে বসে চুল কাটার এক অনাবিল চমৎকার মুহুর্তে উপনীত হয়ে শ্যামল অনুভব করে, মগজ অদ্ভুত অদ্ভুত সব চিন্তার কারখানা, কেননা নতুন এক চিন্তাচ্ছন্ন মেজাজে ততক্ষণে মজে গেছে শ্যামল।

শেক্সপিয়রের এক অমর বাণী Money is the second god. এই মনুষ্য সমাজ দ্বিতীয় বিধাতাকে নিয়ে গড়ে তুলছে সাম্রাজ্য এবং পুঁজিবাদ। দ্বিতীয় বিধাতাকে কে না পুজা করে! রাস্তায় ভিখিরিও বের হয় দ্বিতীয় বিধাতার সন্ধানে। প্রথম বিধাতাকে অস্বীকার করে অনেকে নাস্তিক হয়ে উঠলেও দ্বিতীয় বিধাতাকে অমান্য করার ক্ষমতা নেই স্বয়ং নাস্তিকেরও। তবে কী বর্ণে বর্ণে মিলে গেল না আরেক দার্শনিকের বাণী, যদি বিধাতা নাই থাকেন তবে আমাদের সকলের প্রয়োজন একজন বিধাতাকে আবিষ্কার করা। হয়তো বিধাতার অভাবপূরণে অলঙ্ঘনীয় দ্বিতীয় বিধাতাকে আমাদের আবিষ্কার। শ্যামল অবাক হলো নিজের ভেতর হঠাৎ এই ভাবনার স্রোত বয়ে যেতে দেখে। চুল কাটার সুবিধার্থে শ্যামলকে নাপিত মোসাদ্দেক বলে, মাথাটা একটু কাৎ করে রাখেন। তখন চিন্তাগুলো কেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে সরে যায়।

শ্যামলের এবার স্পষ্ট মনে পড়ে কান্দুপট্টি শব্দের প্রাক ইতিহাস। সাজ্জাদ শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতাসমগ্র বই থেকে কবিতাটি পড়তে দ্যায় শ্যামলকে। শ্যামল কবিতাটির পাঠ সমাপ্ত করা মাত্র বলে, তোকে আজ জাদু দেখাব, নে চল। কবিতাটি সম্বন্ধে সে না কিছু শোনে, না কিছু বলে। অগত্যা শ্যামলকে সাজ্জাদের রহস্যের কাছে পরাস্ত মানতে হয়। তারা পরস্পর শাহবাগে উপস্থিত হয় এবং বাদাম বিক্রি করা বাচ্চু নামে খ্যাত এক বালককে কাছে ডাকে। বাচ্চু যখন পুরো কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনায়, তখন শ্যামল ‘থ বনে যায়।

শ্যামল বলে, ও তো পড়তে জানে না।

সাজ্জাদ বলে, ওকে আমি শিখিয়েছি।

চুল কাটা শেষে শ্যামল নিজের মুখচ্ছবির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের অসহায়ত্ব অনুধাবন করে এবং হঠাৎ গুনগুনিয়ে ওঠে, কান্দুপট্টির খানকি মাগীর চক্ষুর কাজলের টান, এই মাতোয়ালা রাইতের তামাম গতরে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত