ভেবেছিলাম পাত্রী বাংলাদেশীই হবে, কিন্তু লন্ডনে পৌছে দেখি পাত্রী লন্ডনী। মানে ব্রিটিশ-বাঙ্গালী। সিলেটি মেয়ে। আমার বাবা-মার পছন্দ। মেয়ে সিলেটি তা নিয়ে আমার একটুও সমস্যা না, সমস্যা হলো, সে না বলে বাংলা, না বলে ইংরেজি। মেয়ে দেখে পছন্দ হলো, কিন্তু ঐ মুখের ভাষাটা ঠিক আমার বোধগম্য হয়না।
ব্রিটিশ ইংলিশ আর সিলেটি – দুইটার একসেন্ট মিলে তিনি মানে আমার হবু বউ বিশাল একটা জগাখিচুড়ী পাকান। সেই দো-আশঁলা খিচুড়ী অন্তত আমি গিলতে পারিনা। আমার বাবা-মাকে অনেক বুঝিয়ে বললাম যে আমার পক্ষে এমন বিয়ে করা কঠিন হয়ে যাবে, অন্য মেয়ে খোজোঁ। তাদের কথা হলো মেয়ে ধার্মিক, সারাজীবন লন্ডনে থেকেও সে ধর্ম-কর্ম করে, নম্র-ভদ্র; এমন মেয়ে আজকাল দেখাই যায়না, সুতরাং কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি বিয়ের কাজটা হয়ে যাক। তাদের মতে সারা লন্ডন খুজেঁ নাকি এমন আর একটা মেয়ে পাওয়া যাবেনা। যাইহোক, এবার আমি একটু পাত্রীর পরিচয় দিই। তার নাম মাইশা আলী। দশ বছর বয়স থেকে এখানেই তার বেড়ে ওঠা। এখানে বড় হলেও ফ্যামিলির কেউ তেমন শুদ্ধ বাংলা বলতে না পারায় সিলেটি উচ্চারণের বিষয়টা রয়েই গেছে। আপন মা ছোটকালেই মারা গিয়েছে। সৎ মার কাছে বড় হওয়া কিন্তু এই সৎ মা কখনোই আপন মায়ের কষ্ট বুঝতে দেয়নি।
আর আমার বাবা-মা বহুকাল ধরে ব্যবসার খাতিরে নিউপোর্টে বাস করেন। সেখানে বাঙ্গালী কম। নেই বললেই চলে। আমি পড়াশুনা ও জব করি নেদারল্যান্ডসে। লন্ডনের চাইতে আমার এই দেশেই ভালো লাগে বলে কালেভদ্রে শুধু ওপারে বেড়াতে যাই। তো এবার আমার বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন তারা। আর এই মাইশা আলীর মা আর আমার মা এককালের বান্ধবী। আমাদের পরিবার আগে লন্ডনে থাকাকালীন সময়ে ওদের পরিবারের সাথে পরিচয়। পরে ওরা হোয়াইটচ্যাপেলে চলে গেলে আর মাইশার মা মারা গেলে আমাদের পরিবারের সাথে আর তেমন যোগাযোগ ছিলনা। আমরা নিউপোর্টে চলে যাই। কিন্তু বহুকাল পরে তাদের সাথে আবার যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে আমার খালুর উদ্দ্যোগে।
তো যা বলছিলাম আরকি! মেয়ে আমাকে দেখে পছন্দ করেছে জেনে আমিও খুশি হলাম, আমার যে একটা ভুড়ি হয়েছে ইদানীং, তাতে করে অমন সুন্দরী রূপসীর চোখে পড়েছি, তা মন্দ না। বিয়ে মোটামুটি পাকা মনে হওয়ায় দুই পরিবারের অনুমতি নিয়ে আমরা নিজেদের চেনা-জানার জন্যে একটু ঘুরতে বের হয়েছিলাম। তেমন কথা হচ্ছিলো না। যা হচ্ছিলো তাও ইংরেজীতে। আমি তাকে বললাম, তুমি আমার সাথে বাংলা বলো, দেখি আমি বুঝতে পারি কিনা। চলুন কিছু আলাপন দেখা যাকঃ তো বসেছিলাম, ব্রিকলেনের এক রেস্তোরায়, বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তানের টানটান উত্তেজনার ম্যাচ, শহীদ আফ্রিদি ব্যাটিং করছে।
যেকোনো সময় ম্যাচ ঘুরে যেতে পারে ওদের দিকে। এমন সময় মাইশা আমাকে জিজ্ঞেস করে, কিতা মনো খরো, বাংলাদেশ জিততো ফারবো নি? বউত ফেরেশানিত আচি! তার মানে হলো, কী মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ জিততে পারবে? খুব পেরেশানিতে আছি। তার সিলেটি বুঝতে আমার এই দফায় কষ্ট না হলেও সে আর আমাকে বোঝেনা। আমি তো ভাই শুদ্ধ ভাষার মানুষ। অরিজিন কুষ্টিয়া। তো শুদ্ধ বাংলাতে উত্তর দিয়েছিলাম, আমি নিজেও খুব টেনশনে আছি। কথা না বলে দেখতে থাকো। বহুবার রিপিট করার পরও সে না বুঝলে ইংরেজিতে বললাম, সে ইংরেজি বোঝে কিন্তু বলতে গেলেই তার সিলেটি টান চলে আসে।
তো আরেকদিন সে আমার বাসায় বেড়াতে আসলে আমার পোষা বিড়াল দেখে বিড়ালকে মেকুর বলে ডেকে ওঠে। আমি তো শুনে হাসতে হাসতে শেষ। সে বোধহয় কিছুটা লজ্জাও পেয়েছিল। আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভাত খেয়ে এসেছো কিনা, তার উত্তর ছিলঃ আমি বাত খাইলিছি। এটা শুনেও আমি হেসে খুন। পরে দেখলাম সে আমার সাথে আর কথাই বলেনা।
ও চলে যাবার পরে মাকে বললাম, মা, এমন করে তো সংসার চালানো যাবেনা তাইনা, তার সাথে ভাষাগত যে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, তাতে করে তো সারাদিন চুপ করে বসে থাকতে হবে। মা কিছু বলেনা। আমি রাগ করে বললাম, তাহলে কি এখন আমার সিলেটি শিখতে হবে? মা দুষ্টুমি করে উত্তর দেয়ঃ ইতা কোন জাতর মাত মাতস বেটা! ই মাত হিকিয়া কিতা ওইত? ( মানে হলো, এটা কোন ধরনের কথা বলিস তুই! এটা শিখে কি হতো ) মায়ের মুখে সিলেটি শুনে আমি অবাক! যাইহোক, তাতে আমার রাগ একটুও কমলো না বরং বাড়লো, আমি ব্যঙ্গ করে বললাম, কিতা ওইতো আবার, তোমার হবু বউমার সাথে অন্তত কথা বলতে পারতাম।
কিতা মাত মাতোরে – এসব শোনা লাগতো না। এরপরে আরো বেশ কয়েকদিন মাইশার সাথে ঘুরলাম, কিন্তু ভাষাগত সমস্যার কারণে আমার মন দিনে দিনে উঠে গেলো। আমি একবারে রাগ করে বাসায় না বলে নেদারল্যান্ডেই চলে গেলাম, বাবা-মা কে শুধু একটা মেসেজ দিলাম, আমি মাইশা কে বিয়ে করতে পারবো না, জীবনটা আমার, আমাকে জোর করো না প্লিজ। মাইশাকে মেসেঞ্জারে নক করে এমনটাই বলেছিলাম। মাইশা নিজেও স্বীকার করতো ভাষাগত সমস্যার কথা। তার ইংরেজি উচ্চারণের সাথে সিলেটি মিশে যায় এটাই বড় সমস্যা, আর এটা যেহেতু এতকালেও পরিবর্তিত হয়নি, আর হবেও কিনা কি নিশ্চয়তা। আসলে, মাতৃভাষার বৈশিষ্ট্যগুলো জন্মগত বা জিনবাহিত বলেই তা দীর্ঘস্থায়ী। প্রকৃতির নিয়মে মানুষের মাতৃভাষা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকে।
নিজ দেশে সিলেটি ভাষা অপাঙ্ক্তেয় হলেও বিলেতে বাংলার চেয়ে সিলেটি ভাষার মর্যাদা বেশি। আর এ মর্যাদা আদায় করতে গিয়ে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে দস্তুরমতো আরেকটি ভাষা আন্দোলন করতে হয়েছে সিলেটিদের। বিলেতে সিলেটি ভাষা বিভিন্ন সরকারি অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ ইত্যাদিতে ফরাসি-স্প্যানিশ-জার্মান ভাষার মতো দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এ ভাষা নিয়ে অনেক বাঙালি, সিলেটি ও ব্রিটিশ পণ্ডিত গবেষণা করছেন। ইতিমধ্যে কম্পিউটারে ব্যবহারের জন্য তৈরি হয়েছে সিলেটি ফন্ট। সে ফন্ট ব্যবহার করে অবলুপ্তপ্রায় মূল্যবান প্রাচীন সিলেটি সাহিত্যকে নতুন করে জীবন দান করা হচ্ছে। সিলেটি ভাষার চর্চা, প্রশিক্ষণ ও প্রসারের জন্য রচিত হয়েছে সিলেটি ভাষার ব্যাকরণ।
যাইহোক, এর এক সপ্তাহ পরে মাইশা আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার রটার্ডামের বাসায় হাজির। ভেতরে বসতে দিই। কোনো কথা নেই, হঠাৎ ছলছল চোখে সে বলতে শুরু করে। অমন বাংলা না বলে সে তার ঐ ইংরেজিতেই বলে, আমি চলে আসার পরে রাতে নাকি সে ঘুমোতে পারেনি, জীবনে আমিই নাকি তার প্রথম পুরুষ যার সাথে বাইরে ঘুরতে বের হয়েছে। আইসক্রিম খেয়েছে এক সাথে, সারা লন্ডনে ঘুরে বেরিয়েছে, আমার হাতে হাত রেখেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি ওর প্রতিটা কথায় নিদারুণ এক অনুভূতির প্রকাশ দেখলাম আমার জন্যে। তার সব কথা পরিষ্কার না বুঝতে পারলেও এটা পরিষ্কারই বুঝলাম, সে আমাকে কয়েক দিনে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছে। তাকেও আমার অসম্ভব ভালো লেগেছিলো, সে কথা আমি অস্বীকার করিনা। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আর কিছু বলবে? মানে আর কিছু কি বলার আছে? সে নাক-মুখ লাল করে বলে উঠলো, আমি তোমারে যে বালা ফাই। মানে আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
বলুন, এরপরে কি আর তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য আমার হয়? আমিও তাকে বললাম, আমিও তোমারে বালা ফাই। আমি তুমার ফেমো ফরি গেছি। ( আমি তোমার প্রেমে পড়ে গেছি ) সেই থেকে আমার সিলেটি ভাষা-শিক্ষা চলছে, চলবে। আর আমার সাথে থেকে মাইশারও ভাষা দিনে দিনে শুদ্ধ হচ্ছে। তো বেশ কদিন পরে মাকে গিয়ে বললাম, আমি হিখিলাইছি সিলেটি মাত। এটা শুনে মা-বাবা আর মাইশা তিনজনেই তখন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমিও হাসি, মাইশার মুখের হাসির দিকে তাকিয়ে থাকি।