রাইটার

রাইটার

দিন দুপুরে, প্রখর রোদে, হেলান দিয়ে থাকা অস্তমিত সূর্যের আলো বা রশ্মিতে কত আনন্দের দেখা পেতেন আপনি। সবাইকে একসাথে বসিয়ে গল্প জুড়ে দিতেন ইংরেজি অনুবাদের ইতিকথা বা আলোকজ্জ্বল সবকিছু নিয়ে হাসি তামাসার সুদীর্ঘকালের বিস্তারিত আলাপ। ম্যাক্সিম গোর্কির “মা”-কে যে কতজন অনুবাদ করেছে, আঙুলের বিয়োগ চিহ্নের মতো আঁকা কর গুনে গুনে বলতে থাকলে একপর্যায়ে আমরা বলতাম থাক, আপাতত এগুলোই চলবে। ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় এই এক গ্রন্থকে কিভাবে কিভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে সেটাও তো এই আলাপের খড়কাঠি জ্বালানো থেকে একেবারে বাদ পড়ত না। মনে আছে, একবারের হঠাৎ কঠিন বজ্রের সাথে হালকা বৃষ্টির কথা! আপনার চেলাপেলা বা সাগরেদদের কেউ কেউ তৎক্ষণাৎ হাতে তুলে নিয়েছিলো দামি মডেলের স্মার্টফোন। আবার কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে করে সবাইকে জানান দিচ্ছিলো– এ বড় বিপজ্জনক আবহাওয়া। দ্রুত বাড়ি ফেরা যাক, এ কথায় ক্যাসেট চলাকালীন সময়ের মাঝে একটু ক্যাঁচক্যাঁচ করে সবাইকে কিঞ্চিৎ “বাজে একটা টেপ রেকর্ডার, বাজে একটা টেপ রেকর্ডার” এই কথার আছড়ে পড়া ঢেউয়ের গতিতে পায়ের নীচ থেকে বালি সরে যাওয়ার মতো অবস্থায় ফেললেও সময়ের সাথে সাথে আবার সবাই গানের দিকে মনোযোগী হওয়ার মতো পূর্বের অবস্থাই আবার ফিরে পায়। হালকা সবুজাভ কালার করা স্পাইক চুল, গ্যাবাডিং প্যান্টের নিচে ছুটে ছুটে পড়া কাদা পানি বা ফোনটার কথা চিন্তা করতে মুহূর্ত সময় নিয়ে আবার তারা মেতে ওঠে চিৎকার চেঁচামেচিতে। বিজলির ফটো ক্যাপচারে ব্যস্ত সময় পার করা ইয়াং ছেলেটার সে কী তীব্র আকর্ষণ আকাশে চমকানো বিদ্যুৎের প্রতি– আপনি মুখ বুজে ঠোঁট চেপে চাঁদের মতো মোলায়েম বাঁকা হাসি হেসেছিলেন। আপনার প্রলাপ বুঝতে বুঝতে যত সময় হলো আমাদের, ততদিনে আমরা আপনার ব্যাপারে জেনে গেছি, মস্ত বড় এক ব্যাপার আমরা জেনে গেছি।

মার্কেসের নিঃসঙ্গতার একশ বছরের গল্প করতে করতে স্বাভাবিক পৃথিবীর বাইরে এক ভিন্ন জগতে নিতে নিতে কথার খই ভাজা শেষ হতো, যখন সকাল গড়িয়ে দুপুর, তার ভেতরে হালকা খাবারের সময় বাদে আবার বিকেল তক কত অজানাকে জানতে আমাদের উৎসাহিত মন আরো কামনায় ফেটে পড়ত। আপনিতো সেই লালসার আগুন নেভাতেন গার্সিয়া মার্কেসের দুই তিনটা বই দিয়ে। কখনো তাবলীগ স্টাইলে গোল করে বসে বসে সবাইকে নিজে শোনাতেন, কখনো বা যে অমনোযোগী সাগরেদ তাকে চিফের আসনে বসিয়ে বলতেন তুমি পড়ো! মুষলধারে বৃষ্টিপাতের মতো গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের গল্পের লাইন, বাক্যের গঠন বা নিজস্ব ধারা সৃষ্টির ব্যাপারে কাউকে কাউকে বেশ আগ্রহী করে তুলতেন আপনি। আপনাকে জ্ঞানের শিরোমণি ভাবতে ভাবতেই তো আম্মার বোরকার পকেট থেকে ১০০ টাকা চুরি করে একটা সিলেট আর কয়েকটা সাদা চকও কিনেছি। কথার ভেতরে যে শব্দ বা বিস্তারিত আলাপের প্রথমভাগ বোঝাতে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মার্কার হোয়াইট বোর্ড নেওয়া লাগে, কষ্টে মুখ দিয়ে জোরেসোরে শ্বাসপ্রশ্বাসের আওয়াজ কানে ঢোকায় এই টাকাটা চুরি করেছি, আচ্ছা আপনাকে আমার এটা দেওয়ার অপরাধে এই চুরির শাস্তি কি হবে? আশা করি হবে না। প্রশান্তির গাঢ় ছায়ায় নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করে লেখকদের প্রাণস্পন্দন হয়ে ওঠাতে তো কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করেনি, আর আমিই বা কে যে আমাকে কেউ কিছু বলতে আসবে? কার কাছে মৌনব্রত পালন করি সেটা কি ওই আবুল সালারা জানে? জানে আপনার লেখকসত্তার ব্যাপারে! জানে না বৈকি, নাহলে আমাদের এমন ভয়ে ভয়ে থাকা লাগতো বলুন?

সেদিন বিকেলে যে সবাইকে “বড় বাপের পোলা খায়” খাওয়ালেন, এতে আপনার ঝরে পড়া উচ্ছ্বাসকে ধরে রাখতে মন চাচ্ছিলো। মধুর তরলতার মতো পবিত্র জিনিসকে ফেলতে নেই বলেই হয়ত আমার এমন মনোভাবের সূর্যোদয়। আহমদ ছফার লেখাকে বলতেন বাজে আর তারপর নব উদ্যমে লেখকদের খরা কাটিয়ে, আর পাঠকের চাহিদা মেটাতে যে হুমায়ূন আহমেদ আসলেন, তাঁকে বললেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সফল লেখক বা সাহিত্যিক! বাতাসের শরীর বা রোদের তাপমাত্রাতেই যে সবকিছু বুঝে নিতে হয় সেটা তখন কারো মাথায় আসেনি। জাগেনি প্রশ্নের বান। যার পূর্বাভাসে আপনি হয়ত আমাদের তাড়িয়ে দিবেন বুড়িগঙ্গার ওপারে কেরানীগঞ্জের কোনো ঝোপঝাড়ে। ছোটদের নামতা আর এ ফর এ্যাপেল বা বি ফর ব্যানানা টাইপ মুখস্ত বুলিতে লুকিয়ে যেত নিজেকে বেজায় বড় লেখক ভাবা মানুষজন। অথচ সবকিছুই ছিলো বাঁশপাতার সাথে লেগে থাকা সামান্য ছিটেফোঁটা পানির মতন। হালকা বাতাসেও যা ঝরে যায় বা খুব অল্প রোদে অস্তিত্ব বিলীন হয়। কিন্তু আপনার চুরিকৃত লেখার ব্যাপারে যেদিন জানি, সেদিন থেকেই আপনার প্রতি এলো আলকাতরা রঙের বিষাদগার ভাবনা। ঠুনকো উয়ে খেয়ে যাওয়া লাঠির প্রতি গাড়িয়ালের বিশ্বাসের মতো আনন্দের কাজ সবাই কি করতে পারে? আপনিই বলুন হে মহান লেখক!

দীপ্র দিদিকে আমরা সবাই দিপু দিদি বলে ডাকি। স্কুলের ক্লাস ছুটির পরে বিশাল যেদিন আমাদের কয়েকজন মুসলিম ক্লাসমেটকে নিয়ে গেছিল ওদের গোবরে ধোয়া পবিত্র বারান্দায়, আর তার পরে গুড়ের প্রলেপ দিয়ে বানানো মুড়কি, নারিকেলের শাস দিয়ে তৈরী নাড়ুর সাথে একবাটি দুধ দিয়ে পাটির ওপর বসতে বসতে বলেছিলাম– এতকিছু দিচ্ছেন একসাথে? টিফিনে আর বাড়ি যাবো না আপু! চোখ বড় বড় করে হেসে ফেলেছিলেন বিশালের দিদি। আমাদের কোনো আত্মীয়কে কোনোদিন দিদি বলে ডেকেছি কিনা মনে পড়ে না, তবে বিশালের দিদি যখন “আমাকে দিদি বলে ডাকবা, ওকে?” বলল, আমার ভেতরে দুধের বলক ওঠার মতো আনন্দ উথলে উঠেছিলো। সেদিন থেকেই বিশালের দিদি আমার একমাত্র দিদি। দিপু দিদি। পৃথিবীর এই একজনই এখনো আমাকে প্রসাদ দেয়, লক্ষী পূজার সময় বই উপহার দেয়, কালীপূজায় দেয় পাঞ্জাবি। বড় ভালো মানুষ দিপু দিদি।

ক্লাস ফোর ফাইভ পড়ে যখন বোডিং-এ এলাম পড়াশোনাতে, অনেকদিন পর পর আসার কারণে দেখা হতো খুব কম। কিন্তু দিপু দিদি আমার জন্য জমিয়ে রাখতো গোপী গাইন বাঘা বাইনের গল্প, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমগ্র বা গোপাল ভাঁড়ের গল্পের বই। এগুলো বাড়িতে না এনে দিপু দিদির রুমে বসেই শেষ করতাম। আর এ পড়ার ফাঁকে আব্বু আম্মুর কাছে হাজিরা দিতাম আমি আছি, আশপাশেই আছি। অভয়ারণ্যের মতো মাটির ঘরের কামরাটারে যে কী শান্তির আসন লাগতো!

কাঠেরপুলের কোনদিকে যেন একবার দিপু দিদি দেখিয়েছিল যে, এখানে আমাদের স্কুলঘর বানানো হয়েছিলো। ব্রাকের স্কুল, এখানেই পড়াশোনা করেছে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত। প্রাইমারি থেকেও হাই লেভেলের পড়াশোনা ওখানে সেই তখনই ছিলো। ব্যাপারটা বুঝ হওয়ার পরে একটু বড় হয়ে বুঝেছি। সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোতে যখন মানুষের আনাগোনায় একটু ভাটা পড়তে লাগলো, তখনই শাসক মহাদয়দের কাছে থেকে ব্রাক স্কুলকে একেবারে নির্মূল করে দেওয়ার আদেশ দেওয়া হলো। তারপর এদিকে, মানে কুষ্টিয়ার আশপাশে আর ব্রাক দেখা যায়নি!

স্কুলের বইগুলো উন্নতমানের বাঁধায় হলেও ফ্রন্ট পেজটা কিন্তু বর্তমানকালের গল্প উপন্যাসের বইয়ের মতো শক্তপোক্ত পেপারব্যাক কখনোই হতো না। না এখন না আগে। সেই মোটা পৃষ্ঠাটা কোথায় হারিয়ে গেছে কেউ জানেনা। দিপু দিদিও না। হ্যামিলিউনের বাঁশিওয়ালা গল্পটা পড়াবার জন্যই এই ছেড়া বইয়ের আবির্ভাব। সিলেবাসের বই ছিলো ওটা। কিন্তু কোন ক্লাসের বই ছিলো সেটা মনে হচ্ছে না। সেটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে কতগুলো কাগজ নিয়ে পাশে বসলো দিপু দিদি।

প্রতিদিনের মতো আজও নারকেলের কয়েকটা কোয়া আর হাফ ঝুড়ি মুড়কি! অন্যান্য দিনের মতো আজও তেমন কোনো পার্থক্য-পরিবর্তন নেই শুধুমাত্র আউলাঝাউলা কিছু সাদা সাদা বা লাল লাল পৃষ্ঠায় গোটা গোটা লেখার কিছু শব্দ দেখা যাওয়া ছাড়া। এটা স্বাভাবিক দৃশ্য। তবে আগমনী পরিবেশ যে আমার জন্য বেশ চমক ধরে রেখেছে সেটা বুঝলাম দিপু দিদির কবিতা শুনে। কী এক শান্তির শীতল প্রলেপ আমার হৃদয়ে এসেছিলো, ইঁদুরের জ্বালাতন সহ্য করতে না পেরে একজন মানুষ বাঁশি বাজিয়ে ইঁদুরগুলোকে সেই সুরে মোহিত করে সাথে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাওয়ার গল্প বাদ দিয়ে সবাই আবার মনোভাব পালটায়। বলা যায় একরকম বাধ্য হতে হয়।

স্বপন প্রামাণিক নামে যে ছেলে দিপুকে সিঁদুর পরিয়েছিলো, সাত পাকে যাদের সবকিছু শুদ্ধ হয়েছিলো সে খুব একটা সময় দিপুদিকে স্থির থাকতে দেয়নি। নিজের সাচ্চা ইনসান প্রমাণে বারবার পরাস্ত হয়েই চলে গেছেন তিনি। সাথে নিয়ে গেছেন দিপুদির প্রায় সব লেখার কাগজ কপি। আর সেই তখনই তো দিপু দিদির হাতের লেখাগুলো পড়েছিলাম মরা পুকুরের ধারে বসে লেখা অস্তমিত সূর্যের গল্প, বাঁশবাগানের নিচে মাচানে বসে লেখা বুড়োদের যৌবন গল্প বা সকালের সোনারোদে মানুষের আঁড়চোখ বা একজন বিধবা নামের গল্প। এসব বোঝার বয়স তো তখন ছিলো না, কিন্তু প্রতিটা লাইনই ভেতরে গেঁথে গিয়েছিলো সীলমোহরের মতন।

দিপু দিদির গল্প শেষ। আত্মহত্যা না করেই মৃত্যুবরণ করা কোনো যুবতীকে ও পাড়ার হিন্দুরা এই প্রথম দেখেছিলো। শ্মশানে থাকা ঠাকুরই দিপু দিদির মুখাগ্নি করেছিলো।

আমাদের মতো চুনোপুঁটি বাচ্চাছোকরারাও লেখালেখি করতে চায়। খুব বাসনা করে যে জাতীয় দৈনিকে তাঁদের লেখা আসুক। তো এই উপলক্ষে তারা প্রতিটা জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যপাতা বা এমন জায়গা যেখানে লেখা দিলে ছাপা হবে সেগুলোর পর্যবেক্ষণে লেগে যায়। নিয়মিত পড়া হয়ে ওঠে শিলালিপি বা ক্যাম্পাসের পাতা। সাহিত্য নিয়ে শুক্রবারের সাময়িকী তো বাদই যায় না! আপনার কাছে এসে এসে আমাদের অনেককিছু জানা হয়েছে মহান গুরু। আপনাকে লাল সেলাম যে কখন দিবো তাঁর জন্য শুভক্ষণও খুঁজে পাচ্ছি না হে গুরুদেব। তবে দিপু দিদির লেখাগুলো চুরি না করলেও আপনি বেশ বড়সড় একজন সৈয়দ হক হতেন, হতে পারতেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বা সময়ের আলোচিত আহমদ মোস্তফা কামাল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত