ছেলেদের কাঁদতে হয় না

ছেলেদের কাঁদতে হয় না

ছোটবেলায় যখন খেলনা হারিয়ে বা ভেঙ্গে গেলে কাঁদতাম, তখন মা বলতেন, ছিঃ!সোনা ছেলেদের কাঁদতে হয় না।
যখন একটু বড় হলাম, মা হঠাৎ করে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। খুব কান্না পেয়েছিলো, দাদি মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলো, ছিঃ! দাদুভাই, ছেলেদের কাঁদতে হয় না।

বাবা আবার বিয়ে করলেন। সৎ মায়েরাও আপন হয়, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তা হল না। সৎ মা, সৎ মা ই রইলেন। খুব খারাপ ব্যবহার করতেন। দাদিই ছিলেন একমাত্র আশ্রয়। একসময় দাদিও চলে গেলেন। আর কেউ রইলো না যে বলবে, ছিঃ! ছেলেদের কাঁদতে হয় না। কিন্তু ততদিনে আমি শিখে গেছি ছেলেদের কাঁদতে হয় না।

সৎ মায়ের অত্যাচার, আর বাবার অযত্ন আর অবহেলা, আদর ভালোবাসাহীন আমি বদলে যেতে লাগলাম। ক্লাসের সেরা ছাত্র হয়েও পড়াশোনা আর করা হলো না। সব ছেড়ে দিয়ে মিশে গেলাম তাদের দলে, যারা সভ্য সমাজের নিকট বখাটে নামে পরিচিত। কেউ শাসন করলো না। বকলো না, ভালোবেসে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলো না।

বখাটেরা যা করে আমিও তাই করতে লাগলাম। নেশা করা, যার তার সাথে মারামারি বাঁধিয়ে দেওয়া। নেশার টাকার জন্য বাসায় গন্ডগোল করতাম। বাবা মেরে বাসা থেকে বের করে দিলেন। একটু আদর করে জানতেও চাইলো না, কেন এমন হলাম। একটু আদর ভালোবাসা ছাড়া তো অন্য কিছু চাওয়ার ছিলো না আমার। নেশার টাকার জন্য চুরি করা শুরু করলাম। মাঝেমধ্যে পুলিশে ধরে, বেদম মার দিয়ে আবার ছেড়ে দেয়।

কেমন শূন্যতা অনুভব করি সবসময়, কিছু একটার অভাব বোধ সব সময় ঘিরে থাকে। জীবনে ভালোবাসার বড্ড অভাব, শাসনের বড্ড অভাব। কেউ আমাকে ভালোবাসে না। সবাই ঘৃনা করে। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়াকে খুব মিস করি। দুষ্টুমি করে মায়ের মারের ভয়ে দাদির আঁচলে লুকানোর কথা মনে পড়ে।

একটা মেয়েকে ভালোবেসে ছিলাম। মেয়েটির নাম নিশি। তাকে জানিয়ে ছিলাম মনের কথা। কিন্তু, সে আমাকে অপমান করেছিলো। কোন যোগ্যতায় তাকে ভালোবেসেছি আমি? ভালোবাসা পাবার কোনো অধিকার নেই আমার। ঘৃনা ছাড়া অন্যকিছু আমার প্রাপ্য নয়। আমি তো বখাটে। কেউ কেন আমাকে ভালোবাসবে? খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। কিন্তু, কাঁদতে পারিনি। ছেলেদের যে কাঁদতে হয় না।

একদিন রাতে উদ্দেশ্যেহীন ভাবে ঘুরাঘুরি করছিলাম। ঘর নেই, তাই ঘরে ফেরার তাড়াও নেই। কনকনে শীতের রাত বলে রাস্তা একদম ফাঁকা। মাঝে মধ্যে দু একটা রিকশা চলছে। রাস্তার পাশের সরু গলি থেকে কেমন একটা চাপা স্বরে মেয়ের চিৎকার শুনতে পেলাম। সাত-পাঁচ কিছু না ভেবেই অন্ধকার গলির মধ্যে ঢুকে গেলাম। মেইন রাস্তা থেকে ল্যাম্প পোস্টের আসা আবছা আলোয় বুঝতে পারলাম, কিছু ছেলে একটা মেয়েকে জোর করে সম্মানহানি করার চেষ্টা করছে। আমি খারাপ তাই বলে এতটাও খারাপ না, যে একটা মেয়ের সম্মানহানি চোখের সামনে ঘটতে দেখবো, আর কিছু বলবো না।

আশেপাশে কোনো বিল্ডিং এর কাজ চলছিলো বোধহয়। একটা লোহার রড পেয়ে গেলাম। রড দিয়ে ছেলে গুলোকে এলোপাতাড়ি পিটানো শুরু করলাম। বখাটে হওয়ার বড় গুন বোধহয় এটাই, মারধোরের ব্যাপারে বেশ পক্বতা অর্জন করেছিলাম। আমিও যথেষ্ট মার খেলাম। আমি তো আর সিনেমার নায়ক নই যে, একাই মারবো আর একটুও মার খাবো না। চার পাঁচজন ছিলো ওরা। যাইহোক শেষ পর্যন্ত আমিই জয়ী হলাম। ছেলে গুলো একসময় মারের চোটে পালিয়ে গেলো। মেয়েটা অন্ধকারে একদম চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁপছে বোধহয় ভয়ে। অন্ধকারে ভালোমত বুঝতে পারছি না।

মেয়েটাকে বললাম, এখানে আর থাকবেন না। ওরা আবার আসতে পারে। চলুন, আপনাকে এগিয়ে দিই। মেয়েটা পড়ে থাকা ভ্যানিটি ব্যাগটা তুলে চুপচাপ আমার পেছন পেছন আসতে লাগলো। জিজ্ঞেস করলাম,”এখানে কিভাবে এলেন? ওরা কি তুলে নিয়ে এসে ছিলো আপনাকে?” মেয়েটি বললো,”না তুলে আনে নি। আমি এখানে একটা টিউশনিতে এসেছিলাম।” আর কোনো কথা না বলে হাঁটতে লাগলাম।

মেইন রাস্তায় এসে ল্যাম্প পোস্টের আলোতে মেয়েটিকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। হয়তো মেয়েটিও চমকে উঠেছিলো। মেয়েটি নিশি। বিস্ময়ভরা দৃষ্টি বিনিময় ছাড়া কোনো কথা হলো না আমাদের। একটা রিকশা পেয়ে গেলাম। নিশিকে রিকশায় তুলে দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। কিন্তু, নিশি ডাক দিয়ে বলল, “এই যে, শোনেন, ভয় করছে আমার। সাথে আসবেন প্লিজ?” রিকশায় উঠে বসলাম। সারা রাস্তা কেউ কোনো কথা বলিনি। চাইছিলামও না কোনো কথা হোক। নিশির বাসায় সামনে রিকশা থামলো। নিশিকে নামিয়ে দিয়ে বললাম,”সাবধানে থাকবেন। রাতের টিউশনি টা পারলে ছেড়ে দিয়েন। ভাগ্য সব সময় সহায় হয় না।”

নিশি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো। বোধহয় সেদিনের জন্য সরি কিংবা আজকের জন্য থ্যাংকস। তবে সে সুযোগ আর দিলাম না। কারণ আমি বখাটে। আমাকে শুধু ঘৃনা করা যায়। সরি কিংবা থ্যাংকস আমাকে বলা যায় না। আমার সে যোগ্যতা নেই। রিকশাওয়ালাকে দ্রুত রিকশা টানতে বললাম। নিশির চোখে আমার জন্যে আজ একফোটাও ঘৃনা দেখিনি। যা দেখেছি তা অন্যকিছু। কিন্তু সেই অন্যকিছু আমার সাথে যায় না। আমার অধিকার নেই। চোখটা পানিতে ভরে যাচ্ছে। বাতাসে কিছুটা শুকিয়ে যাচ্ছে। বেঈমান চোখ আবার ভরে উঠছে। আটকানোর চেষ্টা করছি আর নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছি। ছিঃ!ছেলের কাঁদতে হয় না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত