প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা

প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা

আজ আমার টিউশনি করানোর প্রথম দিন  অনেক এক্সাইটেড আমি। আমার আবার ছোট্ট বাচ্চাদের অনেক ভালোলাগে। কি সুন্দর কিউট,সুইট ইনোসেন্ট হয় তারা! আমার মতে, তাদের কে পড়াশোনা শেখানো অনেক সহজ। তাদের সাথে সময় কাটিয়ে আনন্দ পাওয়া যায়। তাই আমার বান্ধবীকে বলতেই আমার জন্য একটা টিউশনি যোগাড় করে দিলো। আজকে যাবো পড়াতে। আমি প্রায় বিকেলের দিকে ভালোমতো রেডি হয়ে চলে গেলাম ছাত্রীর বাড়িতে। ছাত্রীর নাম মিথিলা। বাড়িতে এসে আমি গেটে দাঁড়িয়ে কলিংবেল চাপলাম। একবার দুইবার।তিনবারের সময় দরজা খুলে গেলো। আধময়লা শাড়ি পড়া আর বেণীতে লাল ফিতা জড়ানো একটা মহিলা আমার দিকে ভুড়ু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।

আমি -“আমি অহনা। মি আমাকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়েই মহিলাটি ভরাট গলায় বলে উঠলো “ওহ আফা আপনে। চিনছি আহেন। আহেন!”

আমি একটু অবাক হলাম। বাড়ির ভিতরে গেলাম। বেশ সাজানো গোছানো ড্রয়িংরুম। আমাকে একটি সোফাতে বসতে বলে ভিতরে চলে গেলো মহিলাটি। আমি সোফায় বসে আছি। কিছু বুঝতে পারছিনা। বাড়ির সবাই কোথায়। কাওকে দেখতে পেলাম না। আমি কি ভুল ঠিকানাতে চলে এলাম নাকি! আমি মোবাইল ফোন বের করে যেই না ফোন দিতে যাবো জান্নাত কে,তখনি মহিলাটি চলে এলো।একগাল হাসি দিয়ে বলে উঠলো “বড় আফায় আপনারে ভিতরে আইতে কইছে।আহেন। ” আমি মহিলাটির পেছনে পেছনে গেলাম। রুমে ঢুকেই থমকে গেলাম। দুই জন মানুষ বসে আছে রুমে। আমাকে দেখেই রুমে থাকা মহিলাটি বলে উঠলেন ” আসো আসো মা।বসো। রহিমা চা নাস্তা নিয়ে আসো।”

বুঝতে পারলাম সেই মহিলাটি কাজের লোক ছিলো।আমি বসতে বসতে বলে উঠলাম-“না আন্টি লাগবেনা কিছু।মিথিলা আমাকে থামিয়ে দিয়েই মহিলাটি বলে উঠলেন-“সাইফ বাহিরে গিয়েছে একটু। বসো। ও আমাকে তোমার কথা সব বলেছে।” আমি পানি খেতে গিয়ে বিষম খেলাম। পানি নাকে মুখে ঢুকে গেলো। কাশি দিতে লাগলাম! সাইফ!! সে কে! সে কেনো আমার কথা বলবে! পুরুষ টি তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন “আস্তে আস্তে। টেনশন করোনা। আমরা সেই আগের যুগের বাবা মাদের মতো না যে কিছু বলে বসবো। বাচ্চাদের সাথে সাথে আমরাও ডিজিটাল বাবা মা হয়ে উঠেছি।হাহা! তা মা তোমার পড়াশোনা কতোদুর?” আমি বললাম-অনার্স পাশ করেছি! মহিলাটি আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন

-“পছন্দ আছে বলতে হবে! ভারি মিষ্টি চেহারা!” আমি বুঝতে পারলাম না পড়ানোর সাথে চেহারার কি সম্পর্ক। আমি বলে উঠলাম ” আন্টি আমি আসলে মহিলাটির চাহনী দেখে আমি থমকে গেলাম! মহিলাটি তার পাশে বসা লোকটিকে আস্তে আস্তে কি যেনো বললেন। আমি কিছুই বুঝলাম না! আমি এসেছি একজন কে পড়াতে আর এখানে এরা কি বলছে! নিশ্চয়ই কোনো ভুল হচ্ছে!
আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম-ও কোথায়??? বাড়িতে নেই?” মহিলাটি এক গাল হেসে বলে উঠলেন-“ও একটু বাহিরে। এসে পরবে এক্ষুণি।চিন্তা করোনা! আহা! সাইফ কে একনজর দেখতে চাচ্ছো! ”

আমি তাড়াতাড়ি বললাম-কে সাইফ! কিসের সাইফ?? আন্টি আমি কোনো সাইফ কে চিনিনা তো!” পাশে বসা লোকটি মহিলার হাত ধরে তার দিকে তাকালেন।দুইজনে চোখে চোখে কি জেনো বললেন।এদিকে আমার মাথা ব্যথা শুরু হয়ে গেছে! কি বারবার সাইফ সাইফ করছে! মহিলাটি এবার বলে উঠলেন-“বুঝতে পেরেছি! ভয় পেয়োনা! তা মা। তোমাদের রিলেশন কতোদিন ধরে?বিয়ের ব্যাপারে কিছু ভেবেছো তোমরা?” এবার আমার মনে হলো কেউ গলায় ছুরি বিঁধিয়ে দিলো! রিলেশন,বিয়ে!! হে আল্লাহ! আমি ঝট করে উঠে দাঁড়ালাম। একনাগাড়ে বলে উঠলাম “দেখুন আপনি কি বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা! আমি অহনা! মিথিলার নতুন শিক্ষিকা। ওকে পড়াতে এসেছি!আপনারা নিশ্চয়ই আমাকে অন্য কেউ ভাবছেন!”

ঠিক তখনি হঠাৎ করে রুমে চশমা পড়া এক ছেলে প্রবেশ করলো। আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেলো। আমি বুঝলাম ইনি ই সেই বিখ্যাত সাইফ! সাইফ তাড়াতাড়ি বলে উঠলো-“মা এটা অনামিকা না! তুমি কাকে এনেছো! ” এবার মহিলাটি উঠে দাঁড়ালেন। বলে উঠলেন “ওহ অহনা। তুমি মিথিলার টিচার। আসলে রহিমার ভুল হয়েছে।ওকে বলেছিলাম অনামিকা আসলে এখানে নিয়ে আসতে। আজ আসার কথা ছিলো। ও তোমাকেই সাইফের প্রেমিকা অনামিকা ভেবে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম! জীবনেও মা এর আদেশ ছাড়া একটা কিছুও করিনি। আবার প্রেম করবো! মহিলাটি আবার বিব্রতভাব নিয়ে বলে উঠলেন-“মাফ করে দাও মা”

আমি তাড়াতাড়ি বললাম-“না আন্টি ঠিক আছে! সমস্যা নেই।মিথিলা কোথায়?”

মহিলা-“আসো আমি নিয়ে যাচ্ছি!”

আমি মহিলাটির পিছু পিছু গেলাম। সাইফ এর দিকে ফিরেও তাকালাম না!এখান থেকে যেতে পারলে বাঁচি! প্রথম দিনেই এই অবস্থা! এতো অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হলো! মিথিলার রুমে গেলাম। দেখলাম মিথিলা গোলাপি চাদরের খাটে শুয়ে শুয়ে কানে ইয়ারফোন দিয়ে গান শুনছে (!)

আন্টি-“মিথিলা। উনি তোমার নতুন মিস। অহনা। মিসকে সালাম দাও। মিথিলা কান থেকে ইয়ারফোন খুলে চুলগুলো পেছনে সরিয়ে বলে উঠলো-“হ্যালো মিস।”

আমি-“মিথিলা ভালো আছো?”

মিথিলা-“ইয়েস ”

বুঝলাম ক্লাস টু তে পড়া বাচ্চাটি যথেষ্ট পরিমাণে আধুনিক! আন্টি চলে গেলেন। আমি মিথিলার কাছে এগিয়ে গেলাম। মিথিলা বসে বসে ইয়া বড় টাচস্ক্রিন ফোন চালাচ্ছে।
আমি স্নেহের স্বরে বললাম-” মিথিলা দেখো মোবাইল টা এখন রাখো।আজ আমরা পড়বো। দেখি বইটা কোথায়?”
মিথিলা আমার দিকে তাকিয়ে অনুরোধের স্বরে বলে উঠলো “লাস্ট স্টেজ। প্লিজ ম্যাম আর একটু গেইম টা খেলে নেই।”

মিথিলা আমার দিকে ওর স্কুল ব্যাগ টা এগিয়ে দিলো।আমি ব্যাগ থেকে বাংলা বইটা বের করতে গিয়ে দেখলাম রুল টানা কাগজ মোড়ানো। আমি কাগজ টা উৎসাহের বশে খুললাম।সেখানে লেখা “কাল চক্লেত দিয়েছি ছোট বাকশে! আজ তেকে বড় বাকশে দিব। কারণ তুমাকে অণেক বালোবাসি !” আমি অবাক হলাম। চক্লেট প্রদান হচ্ছে তাহলে! তাও আবার ফিলিংস নিয়ে! যাক কালকে এ নিয়ে কথা বলবো বলে ঠিক করলাম। কাগজ টা আবার ব্যাগে রেখে বই বের করে এর পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলাম। ৩ মিনিট পর ই মিথিলা মোবাইল টা রেখে দিলো। আমি পড়ানো শুরু করলাম।

আমি-“মিথিলা বাংলা অনেক মজার একটা সাবজেক্ট। আজ আমরা বাংলা অক্ষর দিয়ে নতুন নতুন বাক্য গঠন করা শিখব। কেমন?? ”

মিথিলা-“ওকে মিস”

আমি -“আচ্ছা।তো ঠিক আছে।তুমি এর আগে তো এতোদিন পড়েছিলে বাংলা তাই না?? বলো দেখি “ম” দিয়ে একটা বাক্য। একদম তোমার মনমতো। না পারলে আমি আছি। ” মিথিলা কিছুক্ষণ চিন্তা করলো।তারপর ই হঠাৎ বলে উঠলো ম তে ম্যাসেঞ্জার টি ইন্সটল করো।” আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।এইটুকু মেয়ে এটা কিভাবে বললো! এতো কিছু থাকতে ম্যাসেঞ্জার এর কথা!

আমি-” আরো অনেক কিছুও তো হয়। আচ্ছা ম তে কিচ্ছু ওয়ার্ড বলতে পারবে?”

মিথিলা-“ম্যাসেঞ্জার,মেগাবাইট,মোবাইল”

আমি বুঝলাম এটা ২০১৭ সালের অতি ডিজিটাল বাচ্চা। যা আমার এতোদিনের ধারণার বাহিরে ছিলো! আমি ওকে কতক্ষণ আ,ক, খ ইত্যাদি দিয়ে শব্দ বাক্য শেখালাম।পড়ে খাতায় লিখতে বললাম। মিথিলা লিখতে লিখতে হঠাৎ বলে উঠলো “মিস আপনার হাতের এই টা অনেক সুন্দর।কে গিফট দিয়েছে?লাভার, বিএফ?” আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম-“না মিথিলা! আমার মা ব্রেসলেট টা আমাকে দিয়েছে।তাছাড়া এইসব শব্দ বলতে হয়না। বুঝেছো? আর কখনো বলবেনা।”

মিথিলা-“কেনো মিস? কি হয়েছে? ”

আমি-“তুমি এখনো অনেক ছোট্ট।বুঝেছো? এইগুলো ভালো ওয়ার্ড না।বলতে হয় না এসব”

মিথিলা-“বললে কি হবে মিস?”

আমি অধৈর্য হয়ে বলে উঠলাম-“এগুলো ভালো মেয়েরা বলেনা। পচা মেয়েরা বলে। তাছাড়া তুমি এখনো ছোট্ট।আর বলবেনা এগুলা কেমন?” মিথিলা বলে উঠলো-“আমি তো এখন ছোট বাবু না মিস।আমি ক্লাস টু তে পড়ি!” এই বলে লিখতে লাগলো।আমি সামনে রাখা পানি ঢকঢক করে গিলে খেয়ে ফেললাম! মনে মনে বললাম হ্যা তুমি তো এখন ই বড় হয়ে গেছ আমাদের চেয়ে! হে আল্লাহ! একটা বাচ্চাকে পড়াতে এতো কষ্ট! কতো কিছু বলে!
মিথিলা আবার লেখা বন্ধ করে বলে উঠলো-“মিস আপনি অনেক ভালো।আগের মিস টা না খুউউউব পচা ছিলো। খালি ঘুমাতো আর বকা দিতো। আচ্ছা, আপনাকে একটা কথা বলি মিস?কাওকে বলবেন না!”

আমি হেসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম -“বলো” মিথিলা আমার দিকে এগিয়ে এসে বলে উঠলো-“মিস জানেন আমাদের স্কুলের ক্লাস ফাইভের একটা ছেলে আছে না আমাকে একদিন মিস্টার ম্যাংগো চকলেট দিয়ে বলেছে আই লাভ ইউ।আমি কিছু বলিনি। মিস্টার ম্যাংগো চকলেট ভালো লাগেনা আমার। কেমন সবুজ রঙ!” আমি কিছু বলতে পারলাম না। মিথিলা আবার আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো “মিস জানেন আমি না লাভ লেটার লিখেছি। ক্লাস সেভেনে পড়া সুন্দর ছেলেটার জন্য। সে প্রতিদিন আমাকে দেখে হাসে। অনেক বার হাসে। আমার জন্য একদিন এক বক্স চকলেট ও এনেছিলো।সব খেয়েছি আমি।আম্মুকে ও দেখিয়েছি। আম্মু বলেছে যে ভালো করছো।আম্মু সবকিছুতেই শুধু বলে যে ভালো করেছো। আমি তাই ঠিক করেছি ছেলেটাকে বড় করে বিয়ে করবো। এতেও আম্মু বলবে যে ভালো করেছো। বিয়ের পর সবসময় এক বাক্স চকলেট খাবো। না না এক না। দুই বাক্স। বিয়ের জামা ও ঠিক করে রাখছি মিস। আম্মুর শাড়ির চেয়েও অনে ক বড় লাল শাড়ি! আব্বুকে বলে কিনে আনাবো।

ওহ, জানেন মিস ক্লাসে আরেকতা ছেলে আমাকে বলেছে তিন বাক্স চক্লেট দিবে।কিন্তু এখনো দেয়নি। ও না অনেক কিপটা। এক ই খাতায় সব সাব্জেক্ট লেখে।কিন্তু আমি ওকে বলেছি আমাকে তিন বাক্স কিটক্যাট চক্লেট দিলে ওকে বিয়ে করবো” আমি কয়েক মিনিটের জন্য থমকে গেলাম। কি বলছে আল্লাহ! এইটুকু বয়সে এইসব! এই বাচ্চাতো আমাদের থেকে কয়েক ধাপ উপরে! কানে বাজতে লাগলো আমার বান্ধবী জান্নাতের কথা! আমাকে সাবধান করেছিলো। আমি ই উলটা বলেছিলাম ওরা ইনোসেন্ট (!) হয় অনেক! পড়াশোনা করিয়ে আনন্দ(!) পাওয়া যায়! এখন বুঝতে পারছি কি আনন্দ!! আমি এবার ওকে বলে উঠলাম-“মিথিলা এইগুলো ভালোনা।পচা।এইসব লাভ লেটার লেখলে সবাই তোমাকে পচা বলবে।পচা মেয়ে বলবে! এতে কি তোমার ভালো লাগবে?”

মিথিলা আমাকে বলে উঠলো-“বলুক মিস। পচা শুনবো তাও চকলেট হারাবোনা! মিস আরো অনেক কথা আছে। কাল বলবো। আমরা না একদিন টিফিন এর সময় খালি একটা ক্লাসরুমে আমি হুট করে উঠে পড়লাম। আমি-“মিথিলা আজ যাই কেমন?? ভালো থেকো” এই বলে তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম। মাথা টা যেনো ঘুরছে আমার!! রহিমা বুয়া আমাকে যেতে দেখে বলে উঠলো “অনামিকা আফা কই যান?” আমার আর বলা হলোনা আমি সাইফের প্রেমিকা অনামিকা না, অহনা।এখান থেকে শুধু যেতে পারলেই হলো! এতো ডিজিটাল বাচ্চাকে আমার কেনো,কারো ই পড়ানো পসিবল না! বাচ্চা পড়ানোর শখ মিটে গেছে আমার!!

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত