এই সেই বাহানায় বারবার আমার ঘরে আসতে হবেনা! তুমি ঘুমাও, আমি ঠিক আছি..আবেগের সেই বয়স ফুরিয়েছে,ভয় পেওনা কিছু করবনা! রেহেনা বেগম নাফিসার দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকে তারপর নিঃশব্দে তার ঘর থেকে বের হয়। নাহ নিশ্চিন্তে ঘুম তার হয়না খানিক বাদে আবার ফিরে আসে জায়নামাজ হাতে করে।নফল নামাজে বসে, দুচোখের পানি ছেড়ে দিয়ে হাততুলে কি যেন চায়! ঘুম জড়িয়ে গেলে বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানি দিয়ে আসে।
নাফিসা খুটিয়ে খুটিয়ে সব কিছু দেখে। তার নিজের কষ্ট ছাপিয়ে বুকটা ধক করে ওঠে, সেদিনের কথা মনে হয়। অথচ সেদিন তাদের কথা, তাদের সম্মানের কথা ভাবনায়ও আসেনি।রঙীন সময়ের ভাবনাগুলো শুধু ইলাফকেই ছুঁয়ে ছিল আর কিছু চোখে পড়েনি। সে ইলাফকে বলেছিল তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। ইলাফ বলেছিল, তাদের সামনে না যেতে।
বিকালে তারা যখন আসলো ইলাফও আসলো! সবার সামনেই নাফিসার দুই বাহু ধরে দাঁত কটমটিয়ে চিৎকার করে বলল, “আমি বলেছিলাম তোমাকে এদের সামনে না আসতে, কেন এলে?কথা বল, কেন এলে? “নাফিসা তখন ডুকরে ডুকরে কেঁদে চলছিল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নাফিসার বাবা, মা, অপরিচিত কিছু মানুষ হঠাৎ আসা অপরিচিত এক ছেলের এহেন কর্মকান্ডে বাক বিহ্ববল হয়ে পড়লো। সময় লাগলো খানিক নাফিসার বাবামায়ের বুঝে উঠতে তবে অপরিচিত অতিথিদের নয় তারা চলে গেল দু,চার কথা শুনিয়ে আর বড় বাঁচা বেঁচে গেছে সেই প্রলাপ বকতে বকতে।অপরিচিত ছেলেটাকে কিছু করবে না নিজের মেয়েকে.. সিদ্ধান্ত নেওয়া বোধহয় খুব কঠিন তাই মাথা নিচু করে নাফিসার বাবা বসার ঘর থেকে নিজের ঘরে চলে গেল। বাবা মায়ের মাথা নিচু সেদিন নাফিসার মনে দাগ কাটেনি! সাত সমুদ্দুর তের নদী তেপান্তরে বন্দী এক রাজকুমারী সে যাকে উদ্ধার করতে এসেছে তার রাজকুমার।
এমন অনুভূতিতে কে কোথায় দাড়িঁয়ে কার সম্মান এতো বছরের আদর স্নেহ খোয়া গেল এসব দেখার সময় ছিল না তার। দুনিয়ার সবার সাথে পেরে উঠলেও মানুষ সন্তানের সাথে পেরে ওঠেনা,মানুষের ভিতরে ভিষণ দুর্বল আর নড়বড়ে জায়গা এটা। নাফিসার বাবামা-ও পারেনি। দু, ফ্যামিলির সম্মতিতেই তাদের বিয়ে ঠিক হল, তবে এখন নয় ইলাফ আগে কিছু করুক এতোদিনে নাফিসার পড়াটাও শেষ হোক।অপেক্ষা বেড়েছে, রঙীন সময় ফিকে হয়ে পাঁচটি বছর কেড়ে নিয়েছে। তেইশ বছরের তরুণীর আটাশে এসে সম্পর্কের হিসেব মিলাতে হয়েছে অনিশ্চয়তা আর সংশয়ে! বিয়ে ঠিক হওয়ার তিন বছরের মাথায় ইলাফের চাকরি হয় ঝং ধরা স্বপ্নে আবার রং লাগে। সে আশায় বুক বেঁধে ইলাফের সামনে দাঁড়ায়।
ইলাফ আবদার করে আর কটা দিন একটু গুছিয়ে নেই। নাফিসা মাথা ঝাকিয়ে ঠিক আছে বলে ফিরে আসে।বলা হয়না তাদের সম্পর্কটা নিয়ে সবাই প্রশ্ন তোলে, নিজের চেয়ে চার বছরের ছোট চাচাত বোনটারও সামনের মাসে বিয়ে, বলা হয়না আমার বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে ইলাফ সবাই কানাকানি করে, কেমন করে তাকায়। অপেক্ষা বাড়ে সম্পর্কের রঙ বদলায় আর বদলায় সে।নাফিসার হাতের রান্না করা ইলাফের প্রিয় খাবারটা পড়ে রয়.. তার আজকাল এসব ভালো লাগেনা এসিডিটি হয়, অফিসে কাজের প্রচুর চাপ রাতজেগে কথা বলা যাবেনা, সারা সপ্তাহ অনেক কাজ করেছি বন্ধের দিন ঘুমাব বিরক্ত করবেনা! নাফিসার অভিমান দীর্ঘশ্বাস হয়ে বাতাসে মিশে আর তারপর ছোঁয় আকাশ।
শেষদিন হাতদুটো চেপে ধরে ইলাফ বলল, “সময় বদলায়, অনুভূতিও বদলায়। অনুভূতির জায়গা শূন্য হলেই মানুষের প্রয়োজন পড়ে।” নাফিসা দাঁত দিয়ে ঠোট কামড়ে বাঁকা হাসি একে বলল, “আমার জায়গাটা শূন্য হয়েছে বুঝি?” আকাশ কাপিয়ে চিৎকার করা প্রয়োজন তবুও শান্ত হয়েই নাফিসা বলল, ” কে সে?নীলা নামের মেয়েটা?যার জন্য আলাদা একটা ফোন নিয়েছো, নতুন একটা আইডি খুলেছো রাত জাগার আশায়, নতুন স্বপ্ন বাঁধার আশায়? তোমার ছোটবোন ঝিনুক বলেছিল আরও মাস খানেক আগেই তবে এরও আগেই জেনেছিলাম তোমার আচরণে!ইলাফ এবার তার চোখে তাকিয়ে বলে, ” ইচ্ছে করলে তুমি আমায় বেঁধে রাখতে পার সেই অধিকার তোমার আছে।
নাফিসা চোখের জল গাল উপচে পড়ে , কথা জড়িয়ে যায় এক বুক নিশ্বাস টেনে নিয়ে বলে” অধিকার আছে অথচ ভালোবাসা নেই বাঁধি কি করে? ” নাহ ভালোবাসাহীন সম্পর্কে অধিকার খাটাতে ইচ্ছে হয়নি নাফিসার । নীলা মেয়েটার সাথে ইলাফের বিয়ে ঠিক হলে তার মা এসে বলেছিল ” আমার ছেলেটাকে অভিশাপ দিও নাগো মা তুমি অভিশাপ দিলেই লেগে যাবে, সে ভালো থাকতে পারবেনা,মাফ করে দিও তাকে। ” নাফিসা তখন মুচকি হেসে বলেছিল, ” আচ্ছা মাফ করে দিব!” কি অদ্ভুত সময় বদলায় তার সাথে পাল্লা দিয়ে নাকি অনুভূতিও বদলায় আবার কখনো অনুভূতির মানুষটাই বদলে যায়! অথচ নাফিসাদের অনুভূতি বদলায় না, সময় তাদের বোকা বানিয়ে পিছনে ফেলে যায়! স্বপ্ন ভঙ্গের রাতগুলো হয় বিশাল বড়।নীলা মেয়েটাকে আজ ইলাফ বউ করে ঘরে তুলেছে।
নাফিসার বুক ভেঙে আসে চোখ জ্বালাপোড়া করে। সে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল কি সব বিশ্রী তার চোখে কল্পনায় ভেসে উঠে মেয়েটার সাথে ইলাফ তার বাসররাত তাদের সঙ্গমের দৃশ্য কি যা-তা সব কেউ এসে ভেঙে দিয়ে যায় আর কাছের মানুষগুলো নিরবে পাশে দাঁড়ায় যেন ভেঙে একেবারে গুড়িয়ে নিঃশেষ না হয়ে যায়। বছর খানেক হল স্বামীকে হারিয়ে নিরব হয়েছে রেহেনা বেগম বেঁচে আছে কেবল ছেলেমেয়ে দুটোর মুখের দিকে তাকিয়ে। নাফিসাকে সে চোখে চোখে রাখে এতো দিনের সম্পর্ক ভাঙার কষ্টে তার অভিমানী মেয়েটা না কিছু করে বসে কষ্টের অতলে না হারিয়ে যায়, যদি মেয়েটা সে আর ভাবতে পারেনা তার দুনিয়া শূন্য হয়ে আসে।
কয়েক মাস পেরিয়েছে জীবন সহজ হয়নি তবে কষ্ট সহজ হয়েছে নাফিসার। বসার ঘরের টি টেবিলটায় আধ খাওয়া চায়ের কাপ নাস্তার প্লেট দেখে নাফিসা জিজ্ঞেস করল রেহেনা বেগমকে, ” কে এসেছিল মা? ” রেহেনা বেগম আমতা আমতা করে বলল,” কই কেউ নাতো!” নাফিসা মুখ টিপে হেসে বলল, ” আমার বিয়ের কথা হচ্ছিল বুঝি? ” রেহেনা বেগম বলল, ” নাহ করে দিয়েছি মা এতো দূর দিন আসেনি। ছেলের আগে আরেকবার বিয়ে করেছিল বউ চলে গেছে। ” নাফিসা হেসে দিয়ে বলল,” তাদের জানিয়ে দাও আমি বিয়েতে রাজি…