খুব করে চাচ্ছিলাম কানের কাছে এই প্যানপ্যানানি বন্ধ হোক। ক্লিনিকে অবসরের যে সময়টুকু পাই বিজয়ের নানান প্রশ্নের জবাবদিহিতা তে যায়। মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারি না, কিছুদিন পর যে এই ছেলের সাথে আমার ছোটবোনের বিয়ে হতে চলেছে। তাই রীতিমতো ওর টর্চার সহ্য করতে হয়।
এমন সময় নার্স এসে ডাক দিলো। এক রোগীর অবস্থা ভালো না তার উপর মেডিসিন খেতে বাধা দিচ্ছে। আজ কদিন পরেই নাকি জ্ঞান ফিরেছে। মনে মনে নার্স কে খুব করে বাহবা দিলাম আমায় রক্ষা করার জন্য। কিন্তু সেই রোগী কে দেখতে গিয়ে যে জীবনের সবচে বড় অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে কে জানতো। আজ বছর কয়েক পর অর্পিতাকে হাসপাতালের বেডে দেখতে পাবো এমনটা কখনো আশা করিনি। সাজেদা আন্টি আমাকে দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না। মেয়ের এমন মুমূর্ষু অবস্থায় দেখে মায়ের মন কতোটা বিধ্বস্ত হতে পারে তার ছক কষা মুশকিল। আন্টি কে বুঝিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দিলাম। ওদিকে বিজয় আর দুজন নার্স শতো চেষ্টা করেও অর্পিতা শান্ত করতে পারছে না। আমার পুরো শরীর হিল হয়ে গেছিলো।
সামনে একপা যে এগুবো সেই শক্তিটুকু যেন হারিয়ে ফেলেছি। বেডের পাশে অর্পিতার হাত ধরে যখন বসলাম মেয়েটা বিস্মিত চোখ আমার দিক চেয়ে রইলো। মেয়েটার শরীর অনেক জায়গায় ক্ষত। কপালের দিকে ড্রেসিং খারাপ হয়ে গেছে। ক্রিম লাগালে জ্বালাতন করবে। তাই হয়তো অর্পিতা বাধা দিচ্ছে। যখন অর্পিতা কে ঔষধ খাওয়াচ্ছিলাম মেয়েটা বড্ড শান্ত ছিল। নিজের হাতে করে কপালের ক্ষতটায় ক্রিম লাগিয়ে ড্রেসিং করে দিলাম। বিজয় আমার দিকে অভাবনীয় দৃষ্টি তে চেয়ে রয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ খাওয়ায় অর্পিতা ঘুমে আচ্ছন্ন হতে শুরু করলো। মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শোয়ালাম। কিছুক্ষণের মাঝে অর্পিতা ঘুমিয়ে পড়লো। যখন বাইরে বেরুতে যাবো পিছন থেকে বিজয় জিজ্ঞেস করলো এই মেয়েই অর্পিতা কি না??? আমি চুপ করে ছিলাম। বাইরে যেতে আন্টি জানতে চাইলো মেয়েটা কেমন আছে।
উনাকে নম্রমুখে জবাব দিয়ে সাথে করে নিজের কেবিনে নিয়ে গেলাম। আন্টিকে বড্ড দুর্বল লাগছিল, হয়তো ঠিকমতো খাওয়া হয়নি। আন্টি কে খেতে দিয়ে অতীতের সব স্মৃতির ভাবনায় হারিয়ে গেলাম। বাবা আজ একজন সফল বিজনেসম্যান হলেও তার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন আধুরা রয়ে গেছে। আমাকে দিয়েই বাবা নিজের স্বপ্ন আরেকবার আস্বাদন করতে চেয়েছিলেন। ছোটো থেকে সে সম্পর্কে অবগত ছিলাম। নিজেকে তৈরিও করেছিলাম সেভাবে। অথচ নিজের উসকোখুসকো জীবনে অর্পিতার আগমন আমাবস্যার চাদেঁর চেয়ে কম ছিল না। সবকিছু ঠিক চললেও একসময় কানে আসে অর্পিতার বাবা ওকে বিয়ে দিতে চায়। তখন সবে মেডিকেল জীবনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরু করেছিলাম।
অর্পিতার বিয়ের কথা শুনে জীবনটা স্থবির হয়ে যায়। ক্লাস পারফরমেন্স, টেস্ট, ল্যাবরেটরিতে সবখানে আমার ধস নেমে যায়। সাহস করেই মাকে অর্পিতার কথা বলি। মা এক কথায় জানিয়ে দেয় এমনটা কখনো সম্ভব নয়। বাবা মরে গেলেও তা মেনে নিবে না। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, যার সাথে উপরওয়ালা মিলন লিখে রেখেছে সে আমার আপন হবেই। অর্পিতা হয়তো সেই মেয়েটি নয়। দেখা হওয়ার শেষদিন মায়ের কথা যখন অর্পিতা কে বললাম মেয়েটা হাসি মুখে মেনে নিয়েছিল। চোখেরজলের সাথে বিদায়ের অন্তিম লগ্ন পর্যন্ত আমাকে সাহস জুগিয়েছে। একটা বখাটে ছেলের প্রেমিকা থাকতে পারে বড় কথা না।
কিন্তু কেউ যদি বন্ধুরূপে একজন প্রেমিকা পায় সত্যি সে আমার মতো আটকপালে। কজনের এই সৌভাগ্য থাকে!! আন্টির খাওয়া শেষ হতে না হতে জিজ্ঞেস করলাম, এসব কি করে হলো?? ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় আন্টি বললেন, মেয়েটা কখনোই আমাদের বুঝতে দিতো ওর জীবনের সাথে কি ঘটছে। সবসময় হাসিমুখে দেখতাম বলে ভেবে নেই, না মেয়েটা বুঝি সুখেই আছে। কিন্তু সত্যটা পুরো উল্টো ছিল। জামাই মশায় ব্যবসা করবে বলে প্রথমেই অর্পিতার আব্বুর কাছে টাকা নিয়েছিল। সবকিছু ভালো চললেও অনেকটা সময় পর আবার টাকার চেয়ে পাঠায়। ততদিনে অর্পিতার আব্বু পরলোকগমন করেন। মেয়েটা কে কম মারধর করতো না জানোয়ারটা। তবু অর্পিতা মুখবুঝে সবকিছু সহ্য করে গেছে এতোটা সময়। কিছুসময় আগে জামাই অর্পিতা কে শহর নিয়ে আসলে ভাবলাম এখন হয়তো সবকিছু ঠিক হয়েছে। কিন্তু কয়লা ধুলে যে কভু ময়লা যায় না কথাটা স্মরণে আসেনি। সাহস করে অর্পিতা কে বাড়িতে এনে রাখলে আজকার দিন দেখতে হতো না।
এতোটুকু বলে আন্টি কান্না করতে লাগলেন। অর্পিতা একি শহরে থাকা সত্ত্বেও নিরুপায় ছিলাম, এতো বড় শহরে খবর পেলেও কোথায় আর খুঁজতাম। ভাষা ছিল না কিছু বলার । আঙ্কেল থাকলে হয়তো এমনটা হতো না। অর্পিতার স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করাতে আন্টি জবাব দিলো, জানোয়ারটার নামে কেস করেছি। পুলিশ ধরে জেলে বন্দি করে রেখেছে। আর একটা কথা ওই জানোয়ার টা আমার হাতে ডিভোর্স পেপারস ধরিয়ে দিছে, বলেছে জীবন গেলেও আর সংসার করতে চায় না। কাগজ হাতে নিলাম এরপর আরো ভালোমন্দ কথা বলি আন্টির সাথে। মাথায় হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খেলেও কাউকে বুঝতে দেইনি। বরং আন্টি কে পরেরদিন বাড়ি পাঠিয়ে দেই। ওখানে অর্পিতার ছোটো দুই ভাই বোন কেমনে আছে কে জানে!!
এরপর প্রায় প্রতিটা মুহূর্ত অর্পিতার পাশে ছিলাম। সুস্থ হওয়ার পরেও রিলিজ করিনি। কিছু সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ডিভোর্স পেপারে অর্পিতার সাইন নেই। যাইহোক ওইরকম অমানুষের সাথে অর্পিতা কে সংসার করতে দেয়া যায় না। পরে মাথায় ঘুরপাক খায় এখন কি করবো। জীবনটা আমার একার হলেও হক সবার আছে। এমন এক পরিস্থিতি তে একজন ই আমায় পথ দেখাতে পারে। যে মেয়ে কি না তীর্থের কাকের মতো আমার মুখে এক হ্যাঁ’ শব্দ শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। সে হলো মৃন্ময়ী। বড্ড চিন্তা হচ্ছে আমার। মৃন্ময়ী কে সবকিছু জানানোর পর থেকে বুকটা ধুকপুক করছে। কি বলবে মৃন্ময়ী, এই ভাবনায় আমি অস্থির। মৃন্ময়ী আমার পাশে বসে থাকা অর্পিতা কে এক নজরে চেয়ে আছে। হুট করে মৃন্ময়ী বলল, কি করতে চাস তুই??
ক্ষীণ কণ্ঠে বললাম, তুই যা বলবি, করব। মৃন্ময়ী অনেকটা বাস্তববাদী মেয়ে। আর সবচে বড় কথা হলো আমায় ভালবাসে। কিন্তু ওকে কখনো ওই নজরে দেখিনি। আমার বেচে থাকার জন্য যে অর্পিতার স্মৃতি টুকু পর্যাপ্ত ছিল। জানি আমার প্রতি পদের ওর ভালোই ধারনা আছে। তবু ভয় করছে, অপ্রত্যাশিত কিছু যেন শুনতে নাহয়। এসি চলা সত্ত্বেও আমার গাল বেয়ে টুপটুপ করে ঘাম ঝড়ছে। এমন সময় অর্পিতা একটা সাহসী কাজ করে বসলো। নিজের ওড়না দিয়ে আমার মুখ মুছে দিলো। এরপরে আরো কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো মৃন্ময়ী। বলল, অর্পিতা কে সরাসরি দেখার পর থেকে ভাবছি ওর কি এমন আছে যে, তুই আজো ওকে ভুলতে পারিস নি। বরং আমায় প্রত্যাখ্যান করে গেছিস। এখন বুঝতেছি তোদের সম্পর্ক টা আসলে আত্মার। অর্পিতা যে কাজটা করলো এটা আমি ভাবতেও পারিনা। বেশি হলে এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিতাম। এখানে হয়তো আমার ভালবাসায় খামতি রয়ে গেছে। আর তাই তোর পাশে আজ আমি নয় অর্পিতা বসে আছে।
মৃন্ময়ীর মুখে এসব কথা খারাপ শুনতে লাগলেও কথাগুলো বাস্তববাদী আবার অনেকটা অভাবনীয়। কোনো মেয়েই নিজের ভালবাসাকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার আগে নির্ঘাত হাজার বার ভাবতো। আমাদের বসিয়ে রেখে মৃন্ময়ী একটা ছেলে কে ডেকে সিম্পল বিয়ে হতে যা করতে লাগে আয়োজন করতে বলল। মৃন্ময়ীর প্রতিটা কাজ আমায় বিস্মিত করছে। আমি বললাম, কি করছিস এসব?? তোর কি হবে! মৃন্ময়ী হাসলো। বলল, তোকে হাসি মুখে দেখবো এটাই আমার প্রাপ্তি। আর নিজেকে এমন ভাবে গড়ে তুলবো যেন পণ্যের মতো লেনদেন না হতে হয়। মৃন্ময়ীর কথায় চুপ হয়ে গেলাম। শেষের কথাগুলো বিয়ে তে লেনদেনের কথাকে বুঝিয়েছে। বাবার প্রথম কোনো কাজে আমার মন বেজার। বাবা কেন এমন করছে?? কেনোই বা বোনের বিয়ে তে বিয়াই এর সব শর্ত মানছে।
আবার বড় ভয় মনে, অর্পিতা কে নিয়ে বাবার সামনে কিভাবে দাঁড়াবো?? বাবা তো চেয়েছিল আমার সাথে মৃন্ময়ীর বিয়ে দিয়ে বিজনেস আরো বাড়াবে। বোনের বিয়েতে যতো খরচ হবে উঠাবে। বিয়েটা যেন এক ব্যবসা হয়ে গেছে। সব যেন একপ্রকার অনুচিত লেনদেনের খেল। সন্ধে নাগাদ বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন হলো। মৃন্ময়ী যখন অর্পিতা কে সাজিয়ে সামনে নিয়ে এলো, চোখ সরাতে পারছিলাম না। পুরনো অর্পিতা কে নতুন করে দেখছি যেন। রেজিস্টার খাতায় সাইন করার আগে মাবাবা, বোনের কথা খুব করে মনে পড়ছিল। বিয়ের কাজ শেষ হতে মৃন্ময়ীর চোখে জল দেখলাম। আমার কাছ থেকে লুকাতে চোখেরজল মুছে নিলো। হেসে অভিনন্দন জানালো আমায়। কিছু বলতে না পারলেও এই ঋণ কখনো হয়তো শোধ করা সম্ভব হবে না।
আমার ঠিক পিছনে অর্পিতা দাঁড়িয়ে। বাবার ক্ষণেক্ষণে হুঙ্কারে আমি নিজে কেপে উঠছি। অর্পিতার ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। হুট করে বাবা আবার বলল, কোনো জায়গা নেই তোমার আমার বাসায়। বেড়িয়ে যাও। আর বোনের বিয়েতেও তোমাকে আসতে হবে না। এমনকিছু শুনবো প্রত্যাশিত ছিল। মাকে দেখলাম চুপ করে আছে। হঠ্যাৎ ই আমাদের দিক এসে অর্পিতা কে কাছে টেনে নিলো। নিজের হাতের দুটি বালা অর্পিতার হাতে পড়িয়ে দিলো। আমায় ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, এই মেয়েই অর্পিতা তাই না?? আমি মাথা নাড়লাম। মা হাসলো। বলল, বলেছিলাম না উপরওয়ালা যার সাথে মিলন লিখে রেখেছে তা হবেই। তাই হয়েছে দেখ। ভাবিস না বেশি। তোর বাবা এসময় রেগে আছে; আমি সামলে নিবো।
তুই বরং অর্পিতা কে নিয়ে যা। কষ্ট দিস না মেয়েটাকে, অনেককিছু সহ্য করেছে অল্প বয়সে। নিজেকে সত্যি বড্ড ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। এমন কিছু মানুষ কে জীবনে পেয়েছি যে আমায় নিঃস্বার্থ ভাবে ভালবাসে। চলে যাওয়ার আগে বোন এসে জড়িয়ে কেঁদে ফেলল। হেসে বললাম, আরে বোকা মেয়ে বেশিদূর যাচ্ছি না তো। শহরে থাকবো। আর তোর বিয়ের সব ফাংশনেও থাকবো। বোন এবার আমায় ছেড়ে দিলো। ভাবির সাথে চুপটি করে কি যেন বলে হেসে দিলো। দৃশ্য টা ভালোর লাগার মতোই ছিল। নিজের সবকিছু টা সত্যি খুব আপন লাগে। ছোট্ট ফ্লাটটাও তাই লাগছে। অর্পিতা আমার গায়ে হেলান দিয়ে বলল, ওগো, সবকিছু গোছানোই তো আছে। হেসে জবাব দিলাম, প্রত্যেক দিন ক্লিনিক থেকে বাসায় যাওয়া হতো না। তাই পাশেই ফ্লাট টা নিয়েছি। আর তোমার মতো আমি অগোছালো নাহ।
একথা শোনামাত্র অর্পিতা আমার চোখ রাঙ্গাল। তারপর ফিক করে হেসে বলল, তোমার সাথে আগেকার মতো ঝগড়া করে মজা আসবে। ঝগড়ুটে একটা। অর্পিতার কথায় আমিও হাসলাম। এরপর ক্লিনিক যাওয়ার আগে রোজ একটা করে প্রশ্ন অর্পিতা কে জিজ্ঞেস করতাম। দুপুরবেলা ক্লিনিকে যখন খাবার নিয়ে আসতো কোনদিন জবাব দিতো। কোনদিন পারতো না। এমন করে অর্পিতা কে ভুলিয়ে রাখতাম। আর কয়েকদিনের মতো আজো প্রশ্নের জবাব দিতে পারছে না। ডাইনিং টেবিল থেকে অর্পিতা বলল আজকার প্রশ্ন টা আবার বলতে। সবে আমি রান্নাঘরে ডাল গরম করতে চরিয়েছি। বললাম, ধরো তুমি একটা বন্ধ ঘরে আছো। হাতে একটা ম্যাচের প্যাকেট আর একটি মাত্র কাঠি। তুমি মোমবাতি, কাগজ না বাতি, কি আগে জ্বালাবে।
একথা শুনে অর্পিতা চুপ করে রইলো। হয়তো জবাব ভাবছে। ডাল গরম হলে একেএকে সব রান্না ডাইনিং টেবিলে আনলাম। কিছুক্ষণ পর অর্পিতা কে খাইয়ে দিতে লাগলাম। মাঝখানে অর্পিতা বলল, এটা কেমন প্রশ্ন?? কোথাও তুমি গড়মিল করেছো। বদ একটা। খানিক হাসলাম। আহ্লাদী কণ্ঠেই বললাম, তোমার স্বামী একজন ডাক্তার। তোমায় রান্না করে খাওয়ায়। খাইয়ে দেয়। এতোটা ভালবাসে তাও তুমি তাকে বদ বলছ। অর্পিতা ভেংচি কাটলো আমার কথায়। এমন সময় খুব হাসি পেলো। কিছুক্ষণ ভেবে বললাম, বেশ কদিন তুমি জবাব দিতে পারো নি। আজ তোমায় শাস্তি পেতে হবে। দুষ্টুমি করে বললাম, আজ তো রাতে ফুটবল খেলা আছে মাদ্রিদের। অর্পিতা বলল, তো?? আরেকবার ওর মুখে খাবার তুলে দিয়ে বললাম, বলছি আমার টিম যতো টা গোল দিবে তুমি আমায় চুমা খাবে।
আমার কথায় অর্পিতা মুচকি হাসলো কিছুক্ষণ। তারপর বাঘিনীর মতো করে জবাব দিলো, কই যেদিন আমি উত্তর দিতে পেরেছি তুমি তো শাস্তি পাও নি। আমাকেও পুরস্কার দাওনি। অর্পিতার প্রতিবাদী কণ্ঠে আমাদের রোজকার ভালোলাগার ঝগড়া চালু হয়ে গেলো। ঠিক জানি যতক্ষণ জেগে খেলা দেখবো, এই মেয়ে আমার মাথা নিজ কোলে রেখে বুলিয়ে দিবে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে চুমোও খাবে। বিজয় আজ ছুটি নিতে এসেছে। বিয়ে যে কদিন পর। এরমাঝে বাসাতেও ঘুরে এসেছি। আয়োজন চলছে বিয়ের। কিন্তু বিজয়ের সাথে কথা হলেও যা বলার বলা হয়নি। এখনো পারছি না। বিজয় অর্পিতা আর আমাকে নিয়ে আলোচনা করছে। বড্ড বাচ্চা সুলভ আচরণ ওর। তবু বিশ্বাস আছে, বিয়েতে কোনপ্রকার লেনদেন হোক সে চাইবে না। দিনকাল যেন বড্ড ঝটপট চলে গেলো। একটুপর বোন পর হয়ে যাবে। নতুন এক দুনিয়ায় পা বাড়াবে।
একটা ভাই আমি। শান্তি নেই। খেয়াল না করলে কেউ কাজ করছে না ঠিকমতো। অর্পিতা কে দেখলাম মাকে বসিয়ে রেখেছে। নিজে সব তদারকি করছে। হুট করে বিয়েতে গণ্ডগোলের শব্দ শুনতে পেলাম। রান্নাবান্না চলছে যেখানে সেখানে ছিলাম। দ্রুত এগিয়ে গেলাম। গিয়ে শুনি, বিজয়ের বাবা বিয়ে ঠিক হওয়ার সময় যা কিছু চেয়েছিল এখন নিচ্ছে না। কিন্তু বাবা দিতে চায়। এবার বিজয়ের হেসে বাবা বললেন, আপনার ছেলে যে আঙ্গুল দেখিয়ে সমাজের আমার মতো অনেক বিবেকহীনকে পথ দেখিয়েছে। মৃন্ময়ী কে বিয়ে করলে হয়তো টাকাকড়ি বেশ পেতো। কিন্তু না, সে নিজের মনের শুনেছে। যেখানে ভালবাসা আছে সেখানে কোনো লেনদেন থাকতেই পারে না। বিজয় তো আপনার মেয়ে কে ভালবাসে আর কি চাই!! বাবার এবার আমার দিক তাকালো। তার নজরে একপ্রকার সন্তুষ্টি ছিল। বিয়ে কার্য শেষ হতে বিদায় পালা এসে গেলো।
নিজেকে এতক্ষণ অনেকটা সংবরণ করেছি। কিন্তু বোন যখন জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো আর পেরে উঠলাম না। বোন কে বুঝালাম। ওহ বাবার কাছে গেলো। এদিকে দেখি অর্পিতাও কাঁদছে। বরং আমার থেকে বেশি কাঁদছে। ওহ যেখানে আমাকে সামলাবে, আমি ওকে সামলাতে লাগলাম। চোখেরজল মুছে দিয়ে বললাম, এই তুমি আবার কাঁদছ কেন?? অর্পিতা ফুঁপিয়ে বলল, তুমি কাঁদছ তাই। আমারো কেন জানি তোমাকে কাঁদতে দেখে কান্না পেলো। আমি এমন কথায় হাসবো কিনা দ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। অতশত না ভেবে অর্পিতা কে জড়িয়ে মাথা বুলাতে লাগলাম। ওদিকে বোন গাড়ি তে উঠবে না। বোনের এক কথা ভাইয়া বাসায় নেই বাবামা একা ছেড়ে যাবে না। বাবা একবার আমার দিক তাকাল। বলল, কে বলছে তোকে এসব?? আমরা একসাথেই থাকবো।
এতে বোন গাড়ি তে উঠে চলে গেলো। মন আরো বেজার হলো। টুপ করে গাল বেয়ে পানি পড়তে লাগলো। চট করে অর্পিতার দিক তাকিয়ে দেখি মেয়েটা বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। অনেক কাজ করেছে আজ। বিশ্বাস করা যায় অর্পিতা আজ আমার সাথে আছে, এমনকি সমাজের একটা অমানবিকতা আমি থামাতে পেরেছি। সত্যি জীবন একপ্রকার খেলার মতোই যেখানে। অর্পিতার মতো ভালবাসার মানুষগুলো ফুটবলের মাঝমাঠের খেলোয়াড় হয়। একখানে খেলা বানানোর কারিগর হয়, অন্যদিকে ভালবাসার মানগুলি হয় অনুভূতি গড়ার কারিগর!