তখন বিকেল হবো হবো করছিল। শোভন উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে হাঁটতে মালিবাগ রেলগেট চলে এসেছিল। সে মূলত মগবাজার দিয়ে আসছিল, এত দূর পথ কী করে এলো সে বুঝতেই পারলো না। প্রতিদিনকার মতো বিকেলে দোকান থেকে বাবা ফিরে আসতেই শুরু হয়েছিল উপদেশের ঝড়। উল্টে যাওয়া ছাতার মতো মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়েছিল শোভন ডাইনিং এর একটা চেয়ার ধরে। পুরো ফ্ল্যাটে তখন তাড়াহুড়ো, নড়াচড়া, বুয়া শেষ বিকেলের বাজারে তুলে রাখছিল ফ্রিজে। তার টুকিটাকি প্রশ্ন শোভনের কান হয়ে রান্নাঘরে যাচ্ছিল মায়ের দিকে। উনুনের ভাজাপোড়া শব্দ মেখে সেই প্রশ্নের উত্তর আরেক কানে ঢুকছিল শোভনের। সে ফ্রিজ থেকে এক গ্লাস পানি খাবে ভেবে আবার কি মনে করে ডাইনিংয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বিকেলের ক্লান্তিমাখা ঘাম আর ব্যস্ততার ধুলোকালি ধুয়ে বাবা মাত্র বাথরুম সেরে বেরিয়েছেন। লোকাল বাসের চিড়েচ্যাপ্টা গন্ধ ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে তাকালেন ছোট বোনের ঘরের দিকে। কম্পিউটারে বাজতে থাকা শিরোনামহীনের গান তলানির মোমের মত ধীরে ধীরে কমে গেল, গান, ড্রাম, বিট আর ভোকালিস্টের চিৎকার নামতে নামতে আড়াল হয়ে গেল বাবার শ্রাব্যতার ওপারে। দাদুর ঘরের মৃদু উড়তে থাকা পর্দা, বুয়ার বাজার গোছানো, মায়ের রান্নার আয়োজন সব একে একে পেরিয়ে বাবার চোখ সে থামল শোভনের মুখের ওপর। সে ততক্ষণে সারা ফ্ল্যাটের সুশৃংখল পরিবেশের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। কী হতো যদি দু-একটা পটল বেখেয়ালে পড়ে থাকত মেঝেতে, কোন ঘরের ফ্যান অকারণে ঘুরত, তবে তো রোজ বিকেলের নিত্যনৈমিত্তিক ঝড়ের আঘাত থেকে বেঁচে যাওয়া যেত।
কিন্তু আজকের বিকেলটা অদ্ভুত, সব কিছু সুন্দর পরিপাটি হয়ে শোভনকে যেন মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আসন্ন একটি ঝড়ের সামনে। গলায় তেষ্টা আর পায়ের আড়ষ্টতা নিয়ে সে স্থবির দাঁড়িয়ে রইলো খাবার ঘরের মাঝখানে। চারদিকের অবিরাম ব্যস্ততার মাঝে যেন নিথর হয়ে যাওয়া চঞ্চল প্রাণ এক। শোবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বাবা যেন পূর্ণ দৃষ্টি মেলে চাইলেন ওর দিকে, প্রবল অবজ্ঞা আর উপেক্ষার ঘৃণা যেন আগুন রূপে বেরিয়ে এলো সেই চোখ হতে। ব্যর্থতার, না পারার আক্ষেপ নিয়ে শোভন অনুভব করে উঠল ছাইচাপা জ্বলন্ত কয়লার মত তার জীবনকে। আগুনে জন্ম তার, আগুনেই বাস। শত চাইলেও আর এই জায়গাটা ছেড়ে বেরিয়ে আসবার আশা পূরণ হয় না কিছুতেই। উপরি হিসেবে নিত্যদিন আগুনের আঁচে তাপে জীবনের অন্তঃকরণ কেমন কালো হয়ে উঠেছে।
সে তো ছিল দাদুর উপদেশের মতোই শুদ্ধ নির্মল। বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে ছুটির দিনের পার্কে চুপচাপ বসে থাকা বেঞ্চিতে সে শিখেছে জীবনের পাঠ। একাকী মাথা তুলে দাঁড়ানো বিরাট শিরিষ গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে অনুভব করেছে তার ক্ষুদ্রতাকে। পৃথিবীর বুকে আলাদা, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জাতের জাত্যাভিমান সে বুকে তুলে নিয়েছে। সকালে শিশির ভেজা মাঠে হাঁটতে হাঁটতে দাদু শিখিয়েছেন তাকে মানব জন্মের দায়। সে তো গড়িয়ে যাওয়া মোমের মতো সযত্নে তুলে রেখেছিল সেই সব উপদেশমালা। তারপর আড়ালে নিভৃতে জীবনের ছোট্ট কোমল হৃদয়পাত্রে গলিয়ে নিয়েছে সেই সব মোম। গ্রহণের ছাঁচে ঢেলে গড়ে তুলেছে একান্ত নিজের কল্যাণী জীবন। যেখানে সততাই সেরা, অনুভূতিই অগ্রগণ্য।
আজ সেই তাকে শুনতে হচ্ছে নিতান্ত তুচ্ছ বৈষয়িক কটুবাক্য। তুলনা করা হচ্ছে এমন সব মানুষদের সাথে যারা আকণ্ঠ তুচ্ছতায় নিমগ্ন, অর্থবিত্তর পিছনে হরদম ছোটাছুটি, বেকসুর আপোষ আর নির্লজ্জতায় যাদের চেহারা বদলে গেছে। কোন কোন বিকেলে যখন তাদের সাথে দেখা হয়ে যায় ব্যস্তসমস্ত হয়ে বাস থেকে নামার সময় কিংবা ছুটে রাস্তা পেরোবার পর, তখন তারা কেবল হাঁপায় আর হিসেব দেয় কোথায় কত টাকা লাভ হল। কোথায় খুইয়েছে কত টাকা। কালো ঘাম শার্টের হাতায় মুছে একটা কেমন কেমন হাসি দেয় শোভন এর দিকে চেয়ে। সেই না বলা হাসি দেখতে দেখতে শোভন বিড়বিড় করে ওঠে কবিতা,
‘বাঁ দিকের বুক পকেটটা সামলাতে সামলাতে
হায় হায় লোকটার ইহকাল-পরকাল গেল।
অথচ আর একটু নিচে হাত দিলেই সে পেত
আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ,
তার হৃদয়।
লোকটা জানলোই না!’
চকবাজারের গলির ভেতর থেকে কেনা শক্ত বুনোটের লাল নীল সুতির গামছায় গা মুছতে মুছতে বাবা খাটের উপর বসেন। পাশে রাখা ঠান্ডা শরবতের হালকা ধোঁয়া বেরুতে থাকা গেলাসটিকে ঠক করে টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে আবার চিৎকার করে ওঠেন বাবা,– কী করে চলবে বল তোর জীবন? কী হলি এত পড়ালেখা করে, চিপা গলির মাস্টার! দিনরাত ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর। তাও যদি ভালো একটা স্কুলে হত, রাজ্যের ফকিন্নি টকিন্নি এসে ভিড় করে। আর সেখানেই মাথা গুজে পড়ে আছিস। বলি কী তোকে দেয় ওই জ্ঞানপীঠ প্রাথমিক বিদ্যালয়? দেখিস না তোর বন্ধু সোহেল কীরকম চকচকে পলিশ করার জুতো পরে হাসিমুখে সালাম দেয়। মনটা ভরে যায় দেখলে। কত বলি! ও-না, উনি সাধুবাবা। উপরি দিতে পারবেন না। আরে তেল বিনা চলে না দুনিয়া…
বাবার চিৎকার চলতেই থাকে, দেয়ালে দেয়ালে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে শেই সবগুলো কথা শোভনের মাথায় যেন ভূমিকম্প ঘটায়। প্রতিদিনের তুলনা দেয়া সফল মানুষ গুলো কেমন করে মগজের ভিতরে ঢুকে পড়ে। নাচে, হাসে, ভেংচায়। আজ এসেছে সোহেল, কমিশনারের কেমন যেন আত্মীয়। ভার্সিটির নানান কীর্তিকাহিনী শেষে ঢুকেছে মগবাজারের নামি এক স্কুলে। সবে পাশ করে বের হওয়া শোভন সেখানে সিভি দিয়েছিল। ভাইবার দিন নানা আজেবাজে প্রশ্নের পর কানে কানে শোনা গিয়েছিল লাখের সংখ্যাটি। এক এর পেছনে ছ’ ছ’টি শূন্য যেন অট্টহাসি হেসেছিল মধ্যবিত্ত কাপড় ব্যবসায়ী পিতার সন্তান শোভনের সামনে। চা খেতে খেতে সোহেল হেসেছিল তৃপ্তির হাসি– বুঝলি আটেই ম্যানেজ হয়ে গেল! সেই হাসিটুকু যেন আজকের এই বিষন্ন বিকেলে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। ‘স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়, কোন এক বোধ কাজ করে মাথার ভিতরে।’
দরজা খুলে বেরিয়ে এল শোভন। অন্দরের দগ্ধতার চেয়ে বাইরের উত্তাপই শ্রেয়। ভেতরের সংযুক্ততা হয়তো আনন্দ দেয়, নিরাপত্তা দেয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তো মানুষ বহির্মুখী। বাইরে তখন শেষ বিকেলের সূর্য মধুরং আলো ছড়াচ্ছে। সাদাটে বাড়িগুলোয় আলো ঠিকরে পড়ে কেমন আভা বেরিয়েছে। কোনো একটি তেতলায় হয়তো কারো শখের কবুতর। তাদের মালিকান রেলিংয়ে থুতনি ঠেকিয়ে তাকিয়ে আছে দূর শূন্যে। তার দৃষ্টির মানচিত্রে উড়ছে এক ঝাঁক কবুতর। সাদা কালো বাদামি নানা রঙের ক্ষুদ্র একটি ফুল যেন ঘুরে ঘুরে উড়ছে আকাশে। এই কোলাহলের শহর থেকে অনেক উপরে। নিচে হয়তো তখন কোন লোভী ব্যবসায়ী মানুষের পকেট কাটছে। হয়তো কোন অসভ্য তরুণ গিলে খাচ্ছে পাশের সিটের আড়ষ্ট তরুণীকে। হয়তো দামি রেস্তোরাঁয় নিয়ে যায়নি বলে কোনো প্রেয়সী চিৎকার করছে ফোনের ওপার থেকে – ‘ব্রেকআপ!’ আর পথে পথে ঘুরছে শোভনের মত হাজারো বেকার তরুণ, তাদের কেউ কেউ ভুল বানানে কবিতা লেখে। কেউ ফন্দি আঁটে আগামী ইন্টারভিউ বোর্ডে কী বিটকেল প্রশ্ন করা যায়। এই সব বিচিত্র ক্লেদ মেখে মেখে শোভন হয়ে ওঠে আশ্চর্য মানুষ। ‘পৃথিবীর এই ক্লান্ত এ অশান্ত কিনারের দেশে, এখানে আশ্চর্য সব মানুষ রয়েছে।’ এই আশ্চর্য মানুষেরা সব আড়ালে-আবডালে বেড়ে ওঠে। কেউ হাজার সংকট মেনে নিয়ে শুদ্ধ থেকে যেতে চায়। কেউ গুনগুন সুর তুলে নিজ হাতে উড়িয়ে দেয় পায়রা। প্রবল ডানা মেলে মেঘের দেশে উড়ে যেতে দেখে সেই সব শুদ্ধ মানুষেরা হয়তো ভাবে, হয়ে যাওয়া যেত যদি পাখি। কিন্তু হায়! ‘যে জীবন ফড়িংয়ের দোয়েলের, মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা।’
★ ★ ★
‘আরে চাপেন না, হা কইরা আকাশ দেখনের কি আছে?’
হাঁটতে হাঁটতে শোভন চলে এসেছে একটি হাসপাতালের সামনে। সবুজ রঙের একটি সিএনজি অটোরিক্সা তার সামনে দাঁড়িয়ে। ভেতর থেকে নামল এক তরুণ দম্পতি। অল্পবয়সী মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা। হয়ত চেকআপের জন্য এসেছে। হালকা রঙের পাঞ্জাবি পরা ছেলেটির মাথায় একরাশ এলোমেলো চুল। হালকা নীল রঙের ফ্রেম কেমন ঝলকে ঝলকে উঠলো। ভাংতি টাকা ঢোকাতে ঢোকাতে একবার তাকাল শোভনের দিকে। ভেতর থেকে একটি ফর্সা হাত এসে জড়িয়ে ধরলো ছেলেটির হাত। মেয়েটির মুখ কেমন লাজরাঙা কোমল, যেন নিজের ভেতরে বেড়ে ওঠা প্রাণটি নিয়ে সে বিশেষ বিব্রত। ছেলেটি কী একটা কথা বিড় বিড় করে বলতেই মেয়েটি হেসে ফেলল। আগে থেকে বেধে রাখা কাঁধ আর একটু গাঢ় করে ধরে নিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে যেতে লাগল ভেতরের দিকে। ছেলে মেয়ে দুটি নিজেদের কত ভালোবাসে। নিজেদের জীবনের সবটুকু রূপরস দিয়ে গড়ে তুলেছে চারপাশ। পুরুষের দাঢ়্য আর নারীত্বের কোমলতা দিয়ে যেন বানিয়ে নিয়েছে এক সুখের বাগান। আজ এরা কত গভীরভাবে পরস্পর যুক্ত। এই সম্পর্কের উপরে আসছে আরেকটি বাঁধন। সেই সন্তানকে এরা রক্ত পানি করে গড়ে তুলবে, হাসবে, খেলবে, আদর করবে। যত্নআত্তি আর আহলাদ দেখে মনে হবে যেন তিনজনে একটি প্রাণ, একই হৃদয়। যেন বাঁধন ছেঁড়ার নয়।
তারপর একদিন এই সন্তান বড় হবে। বেরিয়ে আসবে পৃথিবীর পথে। ঘরের সংযুক্ততা হয়তো তাকে নিরাপত্তা দিয়েছিল, কিন্তু তার কাছে এই সেকেলে বন্ধন ভালো লাগবে কেন। বাইরের উত্তাপ যার গা ছুঁয়ে গেছে, অন্দরের তাপ তো সে অস্বীকার করবেই। সে বুঝে গেছে ততক্ষণে, মানুষের আটকে থাকলে চলে না। বেরিয়ে আসতে হয় সব বাধন ছিন্ন করে নতুন অজানা পৃথিবীর দিকে। যেখানে হয়তো তার পরিচিত পরিপার্শ্ব নেই, চেনা জানা নিরাপত্তা বলয় নেই। তাতে কি! মানুষের নিয়তিই তো একাকীত্ব। যার আত্মীয়-স্বজন নেই সে যেমন একা, তেমনই যার চিন্তার সারথি নেই সে তো আরও একাকী। এ যেন এক চারদেয়ালের মাঝে আটকে থাকা, যে দেয়ালের ওপারে শত শত মানুষের বাস। কিন্তু সেই বোধের সীমানার বাইরে পা রাখতে পারছে না।
তাতে অবশ্য দুঃখ পাবার কিছু নেই, মানুষ নিত্যদিনের ব্যস্ততা দৌড়ঝাঁপ এর মাঝেও একাকীই৷ রাতের আধারে নিজের একান্ত বিছানায় আপন আলয়ে যেমন একা, প্রবল ভিড়ের মাঝে চিড়েচ্যাপ্টা মানুষও একা। প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা চেতনা নিয়ে বেঁচে থাকে। হয়তো একা একটি দ্বীপে থাকার মতো সন্ন্যাসী সবাই হতে পারে না, কিন্তু ছুটে চলা রাজপথে যখন জীবন যুদ্ধে পরাজিত মানুষ শেষ আশ্রয় ধরার মতো বাসের হাতল ধরতে চায়, সেই প্রতিযোগী মানুষও তো একা। সামান্য কতটুকু পথ, সেইটুকু খানিকটা আরামে যাওয়ার জন্য ধুলো মলিন, পোকায় কাটা, তেল চিটচিটে একটি সিটের জন্য যখন মানুষ তার দাঁতালো চেহারা বের করে তোলে, সেই লোভী মানুষও তো একা। এই একাকীত্বই মানুষের পরিণতি, একাকীত্বই চরম সত্য।
২.
দেখতে দেখতে কেমন একটা ভিড়ের মধ্যে পড়ে গেল শোভন। কাছেপিঠে কোথাও বাজনা বাজছে, খুব রগুড়ে কোন হিন্দি গান। অল্প বয়সী কটা ছেলে মেয়ে ভিড় করে সেলফি তুলছে, একজনের হাতে একটি ক্যামেরা, বাজ পড়ার মতন আলোর ঝলক বেরিয়ে আসছে ওখান হতে। প্রসাধন চর্চিত জ্যান্ত পুতুলের ভিড় ওর কাছেই সবচেয়ে বেশি। সে বেচারারও পোয়াবারো। বেশ ভাব নিয়ে ক্লিক করছে, পছন্দ না হলে মুখ ভ্যাংচাচ্ছে। পোজ ঠিক করার ছলে গালে ঘাড়ে হাত রাখছে মেয়েদের, লোভী চোখে চোখে ওষ্ঠ কামড়ে ধরে আছে। ঘেন্নায় শোভন মুখ ফেরালো। সে আসলে দাঁড়িয়ে পড়েছে একটি কমিউনিটি সেন্টারের সামনে। ভেতরে চলছে অনুষ্ঠান আর সামনের পার্কিং লটে চলছে দেখানেপনার হাট বাজার। উচ্চস্বরে হাসির শব্দে সচকিত হয়ে ওঠে কান। তীব্র সুবাসে মাথা ঘুরে উঠতে চায়। জেল্লাদার পোশাক, ঝাঁ-চকচকে গাড়ি দেখে কেমন অবিশ্বাস্য লাগে। অথচ একটু খেয়াল করলেই এই ভিড়ের মাঝে এমন চরিত্রে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়, যে কিনা এই ভিড় হুল্লোড়ের বাইরে। ওই তো সাদা শাড়ি পড়া এক তরুণী, সাদামাটা সাজগোজ, একটি জটলার মধ্যে দাঁড়িয়ে বারবার ঘড়ি দেখছে। এখন সন্ধ্যা ছয়টা। সাজগোজের অপ্রতুলতা, মোটা ফ্রেমের ঘড়ি, ফ্ল্যাট জুতো আর কেমন উদাস হয়ে যাওয়া চেহারা সব মিলে মনে হওয়া খুব স্বাভাবিক হয়তো মেয়েটি চাকরিজীবী। এই শহরে রোজকার টিকে থাকার লড়াইটি তাকে একলাই চালাতে হয়। হয়তো এই নগরীর কোন ফ্ল্যাটে তার ছাত্রের বাসা। সন্ধ্যা হলে ক্লান্তিতে ঢুলতে ঢুলতে সে বীজগণিতের সূত্র আওড়ায়। সেই সঙ্গে হয়তো আওড়ায় মাসের রুমভাড়া, চালের বস্তা, মাছ মাংস ডিম এর হিসেব।
চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে নিজের মনেই হেসে ওঠে শোভন। রাস্তার এপারে বসে দূরে ওই মেয়েটিকে দেখা যায় কি না যায়। তার জন্য সে কেমন ব্যথিত হয়ে উঠেছিল। সে কে তার? কেমন সেধে সেধে তার নিজের ভাবনাগুলো অন্যের উপর চাপিয়ে দিচ্ছিল। রোজ সন্ধ্যায় ঢুলতে ঢুলতে অংক কষে, বসে বসে হিসাব করে, এ তো সে নিজেই। অবশ্য তার হিসেবটা ঠিক চাল তেল নুনের না। বই আর ছোটবোনের সাধ-আহলাদ মেটানোতেই সীমাবদ্ধ। নতুন আসা কোন বিদেশী বই এর নাম হয়তো চুপিচুপি উকি দেয় তার মাথায়। হঠাৎ মনে পড়ে, সেদিন একটি দুর্বোধ্য নামের ফরাসি পারফ্যুম চেয়েছিল। এইরকম আরো কিছু বিলাসী দ্রব্যের হিসেব হয়তো সে করে।
সে যে বাসা থেকে সব ছেড়েছুরে বেড়িয়ে এসেছে, সেই সব ভুলে গিয়ে পরিবারের সুখ স্মৃতিগুলো মনে পড়ছে এখন। বেতন পাওয়ার পর দিন চুপি চুপি শরৎ রচনা কিনে রেখে এসেছিল বোনের ঘরে। কলেজ থেকে ফিরে ঢেকে রাখা কাগজটি সরাতেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠেছিল ও। স্বর্ণরেণুকার মতো ছড়িয়ে থাকা সূর্যের কিরণ ওর ওই খুশি খুশি হাসিমাখা মুখে আভা বুলিয়ে যাচ্ছিল। আর সেই আনন্দিত, তৃপ্তিতে নত আবার প্রাপ্তিতে উজ্জ্বল মূর্তিখানি পর্দার আড়াল হতে দেখছিল শোভন। উপহারের কথাগুলো পড়ে উঠবার ফাঁকে এক লহমায় দেখে নিয়েছিল পর্দার আড়াল হতে এই আবিষ্কারের অভিসার দেখা বড় ভাইটিকে। প্রবল আবেগে সেই কলেজ কলেজে গন্ধমাখা সাদা জামা সমেত জড়িয়ে ধরেছিল শোভনকে। বিনুনির আলতো ছোঁয়া আর তরতাজা খানিকটা সম্ভাষণ, এই প্রাপ্তির কথা মনে হয়ে এই ভিড়াক্রান্ত মেকি প্রেমে সয়লাব বিবাহ উৎসবকে বড় ফিকে মনে হয় শোভনের কাছে। তবে কি সে তার পরিবারকেই ভালোবাসে? শত গঞ্জনা আর অপ্রাপ্তির মাঝেও কি তবে এই পরিবারেই আশ্রয়? কোনটা সত্য, তার এই রাগে বেরিয়ে আসা, নাকি সেই খুশিতে জড়িয়ে ধরা?
এ আনন্দ আর খুশি কদিনের। দুদিন বাদেই কলেজ পেরুলেই বিয়ের ঢাকঢাক-গুড়গুড় শুরু হয়ে যাবে। দু তিন বছরের মাথায় বিয়ে হয়ে গেলে তো গেল। তারপর বাড়িতে থাকবে কেবল মায়ের নির্লিপ্ততা আর বাবার গঞ্জনা। একাকী নিঃসঙ্গ রুচিহীন একঘেয়ে জীবনে বেঁচে থাকা। কার্নিশে একটি বিড়াল কয়েকটি ছানা ফুটিয়েছিলো। মাসখানেক দিন-রাতের সংসার দেখা যেত তাদের। কী সুন্দর চিন্তাহীন নিস্তরঙ্গ জীবন! আদুরে খুনসুটি, খাওয়া, ঘুম। আলতো নরোম দেহে সকালের সোনালী রোদ মেখে নিয়ে ছানাগুলো যখন অবাক দৃষ্টিতে পৃথিবীর দিকে চেয়ে থাকত, শোভনের মনে হতো, নিজের জীবনটা কিরকম বিপরীত মেরুতে দেখ! একঘেয়ে নিয়ম করে সকাল আসে, দুপুর হয়। ছোট ছোট শিশুদের নিয়ে দিনমান সে চেঁচায়। মাসে দু’মাসে একবার নির্মল আনন্দ আসে জীবনে। মাঝে মধ্যে যে বৈচিত্রের হাতছানি সামনে পরে, সেসব দুর্ভাগ্যজনকভাবে হয় তার সাধ্যের বাইরে, নয়ত রুচির দেয়াল সামনে এসে দাঁড়ায়। সেই আদুরে বিড়াল ছানার পায়ে যেমন দাঁতাল পিঁপড়া কামড়ে ধরে থাকে রসালো মাংসের আশায়, তেমনি সংসারের প্রয়োজন তার জীবনকে আঁকড়ে ধরেছে। কীসের আশায় সে ফিরবে সেই চার কামরার ফ্লাটে, সেই ধূসর দুঃখ মাখা দেয়াল ঘেরা ঘরে। কেন?
সন্ধ্যার মুখে বড় ব্যস্ত রাজপথ। তাড়াতাড়ি হুড়োহুড়ির ভিড়ে কান পেতে কিছু শোনাই দায়। এমন ছুটে চলা ব্যস্ততার মাঝেও একাকী বসেছিল শোভন। যাত্রী ছাউনির নিচে আজকাল যাত্রী দাঁড়ায় না, বাসই থামে না। তাই নিশ্চিন্তে ভবঘুরের একান্ত ঘরসংসার বসে যায় সেখানে। ভাত তরকারি রান্না হয়। তেলতেলে টাকমাথায় শিশুরা হুড়োহুড়ি করে। এইসব বিচিত্র জীবনচর্যার মাঝে ব্যাঘাত ঘটিয়ে বেজে উঠল শোভনের সেলফোন। যন্ত্রটি সাথেই থাকে তবে যন্ত্রণা দেয় কম। নামের জায়গায় ভাসছে সারার ছবি। মুচকি হেসে ফোন ধরল শোভন। ইদানিং হঠাৎ হঠাৎ কোন নিরব সন্ধ্যায় মেয়েটি ফোন করে অর্থহীন নানা কথা জিজ্ঞেস করে। কি পড়ছে আজকাল, কে ভালো কে মন্দ এইসব নিয়ে হাসি মুখে তর্ক করে। বান্ধবহীন একলা শোভন মন খুলে কথা বলে সেইসব সন্ধ্যায়। কখনো বিদ্যুৎ চলে গিয়ে চারপাশ আঁধারে ঢেকে যায়। চারদিকের কোলাহল মিটে গিয়ে তৈরি হয় এক অপরূপ নৈঃশব্দ। ইথারের বাধা পেরিয়ে সারা কে তখন মনে হয় এই পাশেই কোন একটি চেয়ারে মুখোমুখি বসা। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে! উৎসাহী গলায় জানতে চাইল সারা– কি করছো? শোভন একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘পথে পথে হাঁটছি, দেখছি জন্ম প্রেম আনন্দ।’
‘আনন্দ দেখবার কি আছে, চাহিদা বাড়বে কেবল!’
‘হাহ, মানুষের চাহিদা তো চিরকালের, শান্তি চাই, সুখ চাই, অর্থ চাই। চাই চাই চাই।’
‘এত শত চাহিদার ভিড়ে আমি কিছুই চাই না শোভন!’
‘তবে কেন রোজ রোজ বলো, ‘কি করছো?’ অন্তত জানতে তো চাও এই অপদার্থ টি কেমন আছে।’
‘জানতে চাই, কারণ আমি জানি তুমি অপেক্ষা করে আছো এই জিজ্ঞাসার।’
‘অপেক্ষা তো চিরকালই মানুষ করছে, শিশুরা যৌবনের, যুবকেরা অর্থের, বৃদ্ধেরা মৃত্যুর।’
‘ভুল! মানুষের চির অপেক্ষা কেবল প্রেমের, শান্তির। ত্যাগে কেবল বিরহ, বিরহে আসে ক্ষয়। পূর্ণতা; সে তো গ্রহণে আর প্রাপ্তিতে।’
উড়াল সেতুর উপর থেকে রাতের শহরের দিকে চাইল শোভন। সারি সারি বাড়ি গুলোয় জ্বলে উঠেছে বাতি। সাদাটে সেই আলোজ্বলা শহরকে মনে হচ্ছে বিরাট কোন মৌচাক। যার প্রতিটি জানালায় জীবনের আলোড়ন। প্রতিটি আলো যেন একেকটি বাতিঘর। জীবিকার তাগিদে সতত ছুটে চলা মানুষ সন্ধ্যায় সেই বাতিঘরে জ্বলে ওঠা বাতি দেখে বন্দরে ভেড়ে। যেখানে অপেক্ষা করে আছে প্রেম, বসে আছে শান্তি তার শীতল পাখা মেলে।
ফিরতি পথে হাঁটছে শোভন, আজ সন্ধ্যায় শোভনের বাতিঘরে আলো জ্বলছে।
*সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও জীবনানন্দ দাশের লেখা কয়েকটি লাইন গল্পে ব্যবহৃত হয়েছে।