পাশ ফিরতে পারছি না, হাত তুলতে গেলাম হাত তোলা যাচ্ছে না– যেন বিশাল আকৃতির এক ইস্পাত তাবিজ বাঁধা হাতে। কেবল হাত নয়, হাত-পা-মাথা শরীরের কোন অংশই নাড়াতে পারছি না। কথা বলতে গেলাম জিভ নড়ে না, স্বর ফোটে না, অসহনীয় অবস্থা। মস্তিষ্ক তার মালিককে নাকি দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে চায়, কিন্তু কই মুক্তি তো পাচ্ছি না, হাজার চেষ্টা করেও চিৎকার দূরের কথা সামান্য আওয়াজও ফোটাতে পারছি না। কী হয়েছে তা অনুধাবন করব সে শক্তিও নাই, এক জগদ্দল পাথর পুরো অস্তিত্বকে দাবিয়ে রেখেছে।
সর্বশক্তি প্রয়োগে একসময় সফল হলাম। নড়ে উঠল দেহ আর ধীরে ধীরে সম্বিৎ ফিরে পেলাম, বাইরে রোদ ঝলমল জগত সংসার। রাতে কি জানালা বন্ধ করা হয়নি! জানালায় বৃষ্টিধোয়া রোদেরা হুটোপুটি খেলে আবার জানালা গলে ফিরে গেছে কিন্তু আমার নিদ্রা ভঙ্গ হয়নি। এখন জল বিয়োগে সাড়া দিতে নিদ্রা ভঙ্গ হলেও হ্যাংওভার কাটেনি। উঠতে ইচ্ছে করছে না আবার না উঠলেও নয়। শরীর ঝিমিয়ে যাচ্ছে… চোখ মুদে আসছে… তলিয়ে যাচ্ছি…।
আচমকা, তলপেটের চাপের সাথে সাথে মস্তিস্কে এক ঝাঁকুনি এসে প্রগাঢ় তন্দ্রা কেটেই গেল। রাতের সবকিছু এক এক করে দৃশ্যায়ন হতে লাগল… মুহূর্তে হ্যাংওভার কেটে গেল, ঘুমকাতরতা দূর হলো। এবারে ঝটিতে উঠে ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে উন্মাদ হয়ে গেলাম। হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলাম টেবিল, ড্রয়ার, ডিভান, বই, ল্যাপটপ, ক্যানভাস।
ব্রাশ বুলাচ্ছি… লেমনগ্রিন চিকন ব্রাশের শেষ টান চলছে। হাতে সময় নেই, মস্তিষ্কে ছবি ছাড়া আর কিছু নেই। ইজেলের সামনে দাঁড়িয়ে কেবল হাত চালাই। ফুলে ছাওয়া ছাতিম গাছের নিচে দাঁড়ানো সদ্য তারুণ্যে পা রাখা এক তরুণী। স্ফীত নগ্ন বক্ষে এক থোকা ছাতিম, আরেকহাত উপরে ঝুলন্ত ফুলের থোকার দিকে বাড়ানো, ধনুকের ছিলার মতো টানটান, ছাতিম ফুলই উর্বশীর আব্রু আড়াল করেছে, ক্ষীণ কটিদেশে গভীর নাভীর নিচ থেকে স্বল্প বসন ঝুলছে। পাশেই কাঁচা, আধাপাকা আনারস ক্ষেত। ক্যাপশন “বক্ষপুটে ছাতিম” এই ছবি ডেলিভারি দিতে হবে। তবে গত সপ্তাহে একটা ছবি করে বড্ড তৃপ্তি পেয়েছিলাম। সেটির ক্যাপশন ছিল “বৃষ্টি বালিকা”।
আমি শিল্পী। মানুষের চাহিদামত, বায়নামত ক্যানভাসে ব্রাশ টানি। নিজের মনমতো কিছু করার সুযোগ সময় নেই। গ্রাসাচ্ছাদনের পরিপাটি ব্যবস্থা না থাকলে বাজারী শিল্পী হয়েই জীবন পার করতে হয়– এ নিগুঢ় সত্যকে মেনে নিয়ে যাপন করছি বরাদ্দ সময়। রাত বা দিন, গ্রীষ্ম বা শীত, ঈদ বা পুজো, পুর্ণিমা-অমাবস্যা সব একই আমার কাছে।
বাইরে দরজায় টুকটুক, শ্রবণে মৃদু টোকা দিলেও মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছে না, আবার আমার এখানে সচরাচর কেউ আসে না, কারো আসার কথাও নয় ঘড়ির দিকে তাকাই খাবার নিয়ে ছেলেটার আসার সময় এখনও হয়নি। কাজেই ছবির উপরে একাগ্রতা চলতে থাকে তাছাড়া একেবারে শেষ সময় অন্যদিকে মন দেয়া সম্ভব নয়।
কিন্তু এবারে মনে হচ্ছে দরোজা কপাট ভেঙ্গে ফেলছে… ক্যানভাসের উপর চোখ রেখে ব্রাশটা হাতে নিয়ে নব ঘুরাতে না ঘুরাতে আমাকে ঠেলে আগন্তকের প্রবেশ। এবং হতবাক আমাকে সরিয়ে সে নিজেই লক করে দিল দরোজা।
বাইরে যে তুমুল ঝড়বৃষ্টিতে জগত ভেসে যাচ্ছে তা টের পাইনি। আমার মাথায় ছবি আর মেজাজে ওমর খৈয়াম কাজেই টের না পাওয়াই স্বাভাবিক। আগন্তকের শরীর বেয়ে জল পরছে টুপটাপ। কথা না বলে ওয়াশ রুমটা আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলাম। সেও দেরি না করে ত্বরিত ঢুকে গেল। সিগারেটে টান দিচ্ছি, ধোঁয়ার রিং বানিয়ে সেদিকে তাকিয়ে ভাবার চেষ্টা করছি ঘটনা কি! তবে যাই-ই হোক, আমাকে খুব একটা স্পর্শ করছে না। পেছনে অস্পষ্ট উপস্থিতি, ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখি জল টল মুছে আমারই পাজামা আর টিশার্ট পড়ে এসেছেন উনি। তেমন কোন জড়তা নেই। চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকালাম–
অবলীলায় বলল– “ভয় পাবেন না, ভোর হলেই আমি চলে যাব। ওরা আমায় তাড়া করেছে। আপনি আপনার কাজ করুন, কেবল একটু চায়ের…”
আঙুল তুলে চায়ের ব্যবস্থা দেখিয়ে দিলাম। মনে হচ্ছে “বক্ষপুটে ছাতিম” ক্যানভাস ছেড়ে সশরীরে উপস্থিত। আসলে কি তাই! কেউ কি এসেছে! নাকি বিভ্রম! হেলুসিনেশন! হ্যাঁ এটা হেলুসিনেশন ছাড়া আর কিছু নয়। রাত জেগে কাজ করার ফল! অতি পানীয়ের ফল! এদিকে আগন্তকের উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ কুহকের মতো মায়া ছড়াচ্ছে এই বৃষ্টিবদ্ধ চার দেয়ালের মাঝে। তার গভীর দুচোখের শান্ত গভীরতা কেবল ডুবে যাবার কথা মনে করিয়ে দেয়।
বুঝলাম ভোর হলে কেউ চলে যাবে। আমাকে ছবি শেষ করতে হবে। বিভূঁইয়ে মেয়েকে, আরেক শহরে মেয়ের মাকে টাকা পাঠাতে হবে। শ্রমিকের থামার কোন সুযোগ নাই! সিগারেট ফেলে ক্যানভাসে ঝাঁপিয়ে পড়লাম রঙ, রঙ, রঙ ফুটে উঠছে এক বিমূর্ত যৌবন… সবুজ হলুদ আনারসের ঝোপ… আনারসের গায়ে অসংখ্য চোখ… চোখ…
প্রলম্বিত একটা ঘোর কাটলে বুঝলাম রাতের গায়ে গভীরতা, নিজ শরীরে শ্রান্তি, পেটে ক্ষিদা। ছেলেটা কখন খাবার দিয়ে গেছে। কেউ একজন খাবার কিংবা আমার অপেক্ষায় আছে বুঝতে পারলাম, অচেনা নারীকে ইশারায় খাবার দেখালে সে খুব দ্রুত দুজনের জন্য বেড়ে ফেলল। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। ছবি শেষ। কাজেই খাবারে মন দিলাম, বুঝলাম পেট একেবারে গড়ের মাঠ হয়ে আছে। খাবার শেষে সব একদিকে সরিয়ে রাখল।
খাওয়া শেষে আমার পান আছেই। কারো উপস্থিতি তো আর ব্যতিক্রম ঘটাতে পারে না। তলানিটুকু শেষ করে আমি আবার ক্যানভাসের দিকে তাকালাম– নাহ্ কাজটা চমৎকার হয়েছে, দেহমনে কাজের সন্তষ্টি ছড়িয়ে যাচ্ছে। ঘুরে বসে আগন্তকের দিকে তাকালাম, আরে! সে দেখি এঁটো থালা বাটি সরিয়ে টেবিলটাও মুছে নিয়েছে। নির্জন কক্ষ, দুজন মুখোমুখি, গভীর দুঃখে দুঃখী বা সুখি… হবার কথা। কিন্তু আমি নিজে থাকি এক ঘোরের মাঝে, থাকি একলা পাহাড়ের মতো বিষন্নতায়, একাকী চিলের বিষন্নতায়… তাছাড়াও ব্যাপারটা ঝামেলার মনে হচ্ছে। না জানি কী আবার ঘটবে!
সে কোথায় ঘুমাবে? চারপাশে তাকিয়ে দেখি প্যাস্টেল, এক্রেলিক, অয়েল কালার, বিভিন্ন মাপের তুলি, ইজেল, ব্রাশ, তারপিনের বোতল, কাপড়ের রোল, বোর্ড, অয়েল পেপার, বালতি দিয়ে এঘর-ওঘর ভরা। ওঘরে একটা বিছানা আছে বটে, কিন্তু তার উপর আমার জামা কাপড় আর বিশাল ছবির ফ্রেম স্তুপ করা। জানি না সে কোথায় ঘুমাবে!
আমি রঙিন তরলে ডুবে যেতে থাকি… আশপাশ ভুলে গিয়ে। সবকিছু ভোলার এই এক মন্ত্র আমার জানা।
অতঃপর এই এত বেলায় আমার ঘুম ভাঙল। গতকাল ছবির পেমেন্ট পেয়েছি সে টাকাটা এই টেবিলের উপরেই ছিল। কিন্তু এখন নেই। মোবাইলটাও দেখছি না। আশ্চর্য যাকে আশ্রয় দিলাম সে কি এমন করল! না করারই বা কী আছে! তাকে চিনি না, জানি না… এমন বোকামি কেউ করে! ঘর থেকে বের করে না দিয়ে ভুল করেছি! ভুল করলাম! মানুষকে বিশ্বাস করাই সবচেয়ে বড় ভুল। বিশ্বাস বলে জগতে কিছু আছে নাকি! আছে কেবল চাপে ফেলে বা ঘাড় ধরে কিছু আদায় করা।
উফ! কী যে ডিসগাস্টিং!
পাশের ঘরে গিয়ে ল্যান্ড ফোনের রিসিভার তুললাম, থানায় একটা ফোন করে দেই, নাম্বার ডায়াল করতে গিয়ে হাত থেমে গেল পুলিশকে কী বলব! আমার অভিযোগ কী! গতরাতে এক অচেনা নারী আমার ঘরে ছিল, সে আমার টাকা নিয়ে পালিয়েছে!
– তার নাম কী?
– জানি না।
– তার ঠিকানা?
– জানি না।
– কোনো ফোন নাম্বার?
– জানি না… তাকে চিনি না… আগে কখনও দেখিনি…
– যাকে চেনেন না সে আপনার সাথে রাতে একঘরে ঘুমালো? কাল রাতে কি পানের পরিমাণটা…
কেমন হাস্যকর শোনায় না! ফোন রেখে চুপ করে বসে রইলাম। দুটা কাজের পেমেন্ট পেয়েছিলাম, আজকে মেয়ের ওখানে পাঠাবার কথা। বিছানার দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে গেল। আমার কাপড় চোপড় সব কিছু পরিপাটি, ভাঁজ করে রাখা। জায়গা মতো বালিশ রাখা। ঘরের সব জায়গায় নারী হাতের নিপুণ স্পর্শ। উঠে গিয়ে টানটান বিছানায় নিজেকে ধপাস করে ছেড়ে দিলাম। এপাশ ওপাশ করছি, অস্থির লাগছে, ছটফট, হাতে কিছু ঠেকল… বালিশের নিচে… আরে! এইত মোবাইল ফোন! ঝটিতে উঠে বসে বালিশ সরাতেই ফোন এবং ফোনের নিচে টাকার বান্ডিল। ত্রস্ত তুলে দেখি একটা চিরকুট।
ছোট্ট দুটো লাইন–“জানি, কোনো অনুভূতির গভীর থেকে আমি এই আশ্রয়টুকু পাইনি, তারপরও এই পাওয়াটুকু আমার জন্য ভীষণ জরুরী ছিল। আপনাকে ধন্যবাদ।”