হালকা সেজেগুজেই বের হলাম বাসা থেকে।কলেজে প্রোগ্রাম আছে কিনা আজ।কিন্তু অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থেকেও গাড়ি পাচ্ছিলাম না।পায় হেটে ১০ মিনিটের রাস্তা তাই হেটেই রওনা দিলাম কলেজের উদ্দেশ্যে।হাটতে হাটতে কলেজের কাছেই চলে এসেছি প্রায় আর কয়েক কদম বাকি।ওই টুকু দূর থেকেই দেখতে পেলাম একটা ছেলে হাতে বোধহয় গিফট বক্সের মত কিছু একটা নিয়ে কলেজ গেইট এর সামনে পায়চারি করছে ভিতরে ঢুকার জন্য।কিন্তু দারোয়ান দিচ্ছেনা কিছুতেই। আমার কিছুটা কৌতুহল হল। তাই এগিয়ে গেলাম তৎক্ষনাত। গেইটের সামনে এসে পিছন থেকে বললাম
-এক্সকিউজ মি,মে আই হেল্প ইউ।
ছেলেটা তখনই ফিরে তাকালো আমার দিকে।একি!! ওর মুখটা দেখে আমার ভিতটায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল।খানিক্ষনের জন্য স্টাচু হয়ে গেলাম আমি।এ আমি কাকে দেখিছি এতো বছর পর!! কল্পনাও করতে পারিনি কখনও এটা,এ যে তুর্য।আমার সেই ছোট্ট বেলার অতীত।আমার প্রথম ভালবাসা,প্রথম ভাললাগা। আমার ছয় বছর আগের অতীত।সবে মাত্র ক্লাস সেভেন এ পড়ি।এক প্রাইভেট স্যারের ব্যাচে আমাদের দেখা।আমি আগে থেকেই পড়তাম,তুর্য এসেছিল পরে।ও তখন ইন্টারে পরতো।
আমাদের দেখা এই কথাটি বললে ভুল হবে কারন একমাত্র আমিই শুধু ওকে প্রতিদিন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম।কি জানি একটা ফিল হত নিজের মাঝে বুজতে পারতাম না ঠিক।কারন খুব ছোট ছিলাম।কিন্তু এটা জানতাম যে একদিন ওকে না দেখতে পেলে দিনটা ভাল কাটতো না আমার।অদ্ভুত দোটানায় পরে গিয়েছিলাম,কি হচ্ছে আমার সাথে।অনুভূতির মাঝে পরে গিয়ে দুই লাইন কথা ও লিখে ফেলেছিলাম ওকে নিয়ে নিজের প্রিয় ডায়রিটায় যেইদিন বেষ্টু আমার ডায়রিতে লেখা গুলো দেখে ফেলেছিল ইসস কি পরিমান লজ্জা যে পেয়েছিলাম।
অন্য একটা ছেলের নাম নিজের ডায়রিতে কেন লিখেছি তার উত্তর সেদিন আমি দিতে পারিনি। কারন কেন যে লিখেছি ওই নামটা আমার ডায়রিতে তা তো আমি নিজেই বুঝতে পারিনি ঠিক।কিন্তু বড় হতে হতে আস্তে আস্তে বুঝতে পেরেছিলাম ঐ ফিলিংসটা আসলে কিসের।এমনকি এখনো কোন কাপলকে দেখলে ওর কথা মনে পরত আমার।H.S.C দেয়ার পর তুর্য চলে যায় ব্যাচ থেকে।থেকে যাই আমি। কৌশলে স্যারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তুর্যের কথা কিন্তু স্যার কোন হদিস দিতে পারে নি।আর দেখা হয়নি আমাদের।প্রথম প্রথম অনেক খারাপ লাগত আমার,পরে সয়ে গেছে।কিন্তু এই ছয় বছরে একটা বারের জন্যও ওর মুখটা ভুলতে পারিনি আমি…
-এই যে হ্যালো,কোথায় হারিয়ে গেলেন কিছু বলছেন না যে!!???
-ও হ্যা বলুন(তুর্যের তুরিতে ধ্যান ভাঙ্গলো আমার)
-বলছিলেন না যে হেল্প করবেন।হ্যাঁ,আমাকে একটু হেল্প করবেন প্লিজ!..
-কি সমস্যা আপনার,কাউকে খুজছেন?
-আপনাদের দারোয়ান আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না,ওমেন কলেজ বলে।আচ্ছা এই গিফট টা (হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে) একটু পৌছে দিতে পারবেন,তহলে কৃতঙ্গ থাকবো
-কার কাছে?
-আমার জিএফ এর কাছে।
তুর্যের শেষ কথাটা আমাকে পাথরের মত স্তব্দ করে দিল।তুর্যের জিএফ!!।কিন্তু খুব বেশি অবাক হলামনা।কারন সময়টা আর আমার সেই ছয় বছর আগের ক্লাস সেভেনে আটকে নেই।অনুভব করলাম আমার ছোখ ভিজে আসছে।অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম
-আমি কেন,আপনি নিজের হাতেই দিয়ে আসবেন আপনার ভাগ্যবতীকে
-আসলে এর মধ্যে কিছু চুরি আর ফুল আছে।আপনাদের কলেজে তো আজকে প্রোগ্রাম।ও আজকে শাড়ি পরেছে তাই কিনে আমলাম গিফট গুলো।নিজের হাতে দেয়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু দারোয়ান বেটা তো আমাকে বুঝছেনা
-আমি দেখছি দাড়ান
দাড়োয়ান কাকুর সাথে আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের ভাল বন্ধুত্ব আছে তাই রাজি করাতে বেশি অসুবিধা হয়নি।তবে কথা দিয়ে আসতে হয়েছে উনার চাকুরী যেন না যায় সেটা দেখার দায়িত্ব আমার।আজ কলেজে প্রোগ্রাম আছে বলেই তুর্যকে ভিতরে ঢুকাতে পারলাম ক্লাস আওয়ার হলে জীবনেও সম্ভব হত না এটা
-থ্যাংকস এ লট।আমার এই উপকার টুকু করার জন্য।আপনি না থাকলে আজ আমি ভিতরেই আসতে পারতাম না।আর ওকে খোপায় ফুল আর হাতে চুড়ি পরা অবস্থায় দেখা হত না(ভিতরে ঢুকেই তুর্য আমাকে বলে উঠলো)
-না না।এটা কোন ব্যাপার না। এতো ফর্মালিটিস দেখানোর প্রয়োজন নেই।its ok..তো এখনো দাড়িয়ে কেন? যান,ভাগ্যবতীকে উপহারটা দিয়ে আসুন।
-হাহা আপনার বলা ভাগ্যবতী শব্দটা অনেক নাইস।ও নয় বরং ওকে পেয়ে আমিই নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।
-বাহ!!! ওয়ান্ডার ফুল
-কিছুটা :)। কিন্তু আমি যে ফাস্ট ইয়ারের ক্লাসটা চিনি না।
-হুম,বুঝলাম।আমার সাহায্যের একাউন্টটা তাহলে এখনো ক্লোজ হয়নি তাইতো,চলুন আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।
– হাহাহা আপনি তো খুব মজা করে কথা বলতে পারেন দেখছি(যেতে যেতে)
কিছু বললাম না শুধু মৃদু হাসলাম।দুজনেই হাটছি কোম কথা নেই।অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করছে আমার মাঝে।মনে হচ্ছে অনেক দিন ধরে হাটছি দুজনে।এই ভাবেই তো একসাথে পথ চলতে চেয়েছিলাম তোমার সাথে তুর্য।কিন্তু অধিকারটা আজ অন্যকারো। কিছু বলছিনা।শুধু মনে মনে ভাবছি ওর জিএফ তাহলে ফাস্ট ইয়ারে পড়ে!..হঠাৎ তু্র্যই নিরবতা ভাঙ্গালো
-আচ্ছা আপনি কিসে পড়েন?
-আপনার ভাগ্যবতীর ঠিক এক ব্যাচ সিনিয়র
-হাহা আপনি সত্যিই মজার মানুষ
-যেমনটা মনে করেন।আপনি কিসে?
-অনার্স থার্ড ইয়ার।ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট
-ওহ ভাল তো(বলে দাড়িয়ে গেলাম)
-আরেহ থমকে গেলেন কেন!!
-এসে গেছি(আঙ্গুল দিয়ে ক্লাস রুমটা দেখিয়ে বললাম)
-ওহ আচ্ছা বুঝতে পারিনি :D। thanks again
-আরেহ এতোবার করে ধন্যবাদ দেয়ার কিছু নেই।its ok. welcome. ঘুরে দাড়ালাম চলে যাওয়ার জন্য পিছন থেকে আবার তুর্যের ডাক
-আচ্ছা একটা কথা বলবো, অনেক্ষন ধরে বলতে চাচ্ছিলাম।
-আবার কোন সাহায্য লাগবে?জিএফ কে ঢেকেও এনে দিতে হবে নাকি। এইবার বললাম সরি কারন আমি ওকে চিনিনা।
-আরেহ না নাঐসব কিছু নয়।
-তাহলে!??
-বলতে চাচ্ছিলাম যে আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে আমার।কোথাও দেখেছি কি আপনাকে??মনে করতে পারছিনা। কোথায় দেখেছি বলুন তো!!!?
-(প্রচন্ড রাগ হচ্ছিল।নিজের উপর নাকি তুর্যের উপর বুঝতে পারছিনা)কোথাও না।
এইবার আর সহ্য করতে পারলাম না।ঘুরে হাটা ধরলাম।চোখ দিয়ে গড়িয়ে জল পরছে গালে।যাক তোমার তাহলে এইটুকু মনে আছে আমাকে বলো।ছয় বছর আগের মানুষটাকে ছয় বছর পরে এসেও চেনা চেনা লাগাটাও অনেক বড় ব্যাপার। কিন্ত এতো এতো গুলো বছর পরেও তুমি আমার আছে শুধু চেনা চেনা লাগা নও,বরং সম্পূর্ণ পরিচিত।এ কেমন ভাগ্যের খেল,এমনটা হওয়ার তো কথা ছিলনা।পিছন থেকে শুনতে পেলাম-“আরেহ শুনুন,শুনুন এই যে হ্যালো শুনুন”বলে কিছু শব্দ ভেসে আসছিল।আর ফিরে তাকানোর প্রয়োজন মনে করলাম না।এটা কেমন পরিস্থিতির মুখে পরলাম আজ আমি।যত বয়স বেড়েছিল আমার তত বেশি করে তোমায় বুঝেছিলাম আমি।তত বেশি এই না দেখা তোমার চেহারাটা স্পষ্ট হয়েছিল আমার কাছে।
সৃষ্টিকর্তার কাছে শুধু চাইতাম যেন সেই ছোট বেলার ভালবাসাটাকে ফিরিয়ে দেয় আমাকে এই বড় বেলায়,নয়তো একটাবার যেন তুমি আমার সামনে এসে দাড়াও।সামনে এসেতো দাড়ালে ঠিকই কিন্তু অন্য একটা জিবন নিয়ে।অথচ এভাবে তো তোমাকে দেখতে চাইনি আমি। তোমাকে দেখে আজ সর্বোচ্চ খুশি হয়েছিলাম আমি কিন্তু তোমার ভাগ্যবতীকে দিয়েই সব শেষ হয়ে গেল আমার।তুমু কি জানো এই ভাগ্যবতী শব্দটা আমি নিজের নামে ব্যবার করি ডায়রিতে তোমার পাশে।ছয় বছর আগের বড় করে লিখা তোমার নামটা আমার ডায়রিতে এখনো জ্বলজ্বল করছে সেটা তুমি কখনো জানতে পারবেন প্রায় গেইটের কাছেই চলে আসলাম এমন সময় ফোন বেজে উঠলো
-হ্যালো(আমি)
-কিরে তুই কই নিধি,কলেজে আসিস না ক্যান এখনও(বেষ্টু ফারিয়া)
-এসেছি,কিন্তু আবার চলে যাচ্ছি।আমার আসায় থাকিস না প্রোগ্রাম ইনজয় কর
-মানে কি,এই তুই কই বলতো আর তোর গলাটা এমন শুনাচ্ছে কেন,মনে হচ্ছে যেন কাদঁছিস…
-ও কিছুনা।রাখছি বাই
-এই হ্যাাালল….
ফারু পুরো কথা শেষ না করতেই কেটে দিলাম লাইটা।কলেজ থেকে বের হয়ে আসলাম।সম্ভব না আজকে আর প্রোগ্রামে উল্লাস করা,কারন আনন্দ গুলো কিছুক্ষণ আগে খুন হয়ে গেছে..তুর্যের কথা ভাবছি।তুর্য তোমার সাথে হাটা এই ৫মিনিটের সময়টুকুই হাজার বছরের পথ চলা হয়ে থাকবে আমার কাছে।আমও ভুলবোনা এটা কখনওএখন শুধু প্রার্থনা থাকবে একটাই তোমার সাথে যেন আমার দ্বিতীয়বার দেখা না হয়,সহ্য করতে পারবোনা তাহলে।তোমার পরে আর কেউ আসেনি আমার জীবনে।পরবর্তী পুরো জীবনটাতে তুমিই আমার গল্পের নায়ক হয়ে রইবে তবে আজকের দেখা তুমি নও।ছয় বছর আগের দেখা সেই ছেলেটি হয়েই থাকবে তুমি।আমার জীবনের শেষ গল্পের সেই ছেলেটি।