অপরাহ্ণ থেকেই আদনানের মেজাজ যেন তাড়া খাওয়া শজারুর পুচ্ছ।
দুপুরে কামরান সাহেবের সঙ্গে আদনানের মায়ের কথা কাটাকাটি হয়েছিল, কথা কাটাকাটির সময় মায়ের মুখটা মলিন দেখাচ্ছিল, দুপুরে খাওয়ার সময় আদনানের সঙ্গে মা ভালো করে কথাও বলেননি-এ জন্য ওর মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে। সন্ধ্যার পর থেকে ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ পড়ছে কিন্তু কোনোভাবে মনোযোগ দিতে পারছে না। মাছ ধরতে গিয়ে বুড়ো কী কী করেছিল তাও সে ঠিকমতো মনে করতে পারছে না। এমন আর কোনো দিন হয়নি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে বইটি পড়লেও একবার উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে দূরের আকাশের দিকে নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে নীল আকাশে সোনালি বুটির তারা গুনেছে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা রোদে পোড়া সেভেন-আপ বোতলের মতো ট্রাফিক পুলিশ এবং নিচের রাস্তায় পেন্সিলের মতো মানুষগুলোকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বিছানায় শুয়ে বইয়ের পাতায় চোখ রেখেছে কিন্তু বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টায়নি। নির্জন এই ফ্ল্যাটটিতে আদনান যখন একপ্রকার অসহিষ্ণু অস্থিরতায় মাকড়সার জালে জড়িয়ে যাওয়া মাছির মতো জড়িয়ে যাচ্ছিল তখন রুমে তালা দিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল।
ঘড়িতে ঘণ্টার কাঁটা রাত দশটার দাগে মৃদু কম্পমান।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে আদনান আকাশ-ধরা ফ্ল্যাট বাড়িটির দিকে তাকালো। রাস্তার বাতি নিভে গেছে একটু আগে, অন্ধকার, ফ্ল্যাট বাড়ির ভেতর থেকে জেনারেটরের কৃপায় আলোর স্রোত নেমে এসে অন্ধকারে মিশেছে। আদনান নিজের রুমের দিকে একবার তাকালো। সে-রুমের ভিতর থেকে ফিনকি দিয়ে আলো বের হচ্ছে জানালার কাচ বিঁধিয়ে। নিজের রুমের দিকে তাকিয়ে একবার সে ভাবল-তিন বছর হলো এই ফ্ল্যাটটি কেনা হয়েছে। এর আগে তারা গুলশানে ভাড়া করা বাড়িতে থাকত। আরও আগে তাদের অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। তখন থাকত আদনানের নানির বাসায়। তখন আদনানের মায়ের সঙ্গে মামাদের সর্বক্ষণই ঝগড়া হতো– কেন হতো তা আদনান একটু ভাবতে চেষ্টা করেও এগোতে পারেনি। তারও আগে আদনানের মায়ের সঙ্গে বাবার ছাড়াছাড়ি হয়েছে। বাবা-মায়ের কেন ছাড়াছাড়ি হলো তাও আদনান ভাবতে চেষ্টা করল একবার কিন্তু পরক্ষণেই থেমে গেল। সে তখন অবুঝ।
আদনানের ভাবনায় ছেদ পড়ল। আদনান একটু সামনের দিকে এগিয়ে আবার দাঁড়াল। তার মনে হলো মায়ের সঙ্গে নানির সম্পর্ক ভালো নেই– কেন নেই তাও আদনান ভাবতে গিয়ে থেমে গেল। সংসার-জীবনের জটিল রহস্যের গিঁট সে খুলতে পারে না। কী করেই বা পারবে? সে তো বই ছাড়া এ-জীবনে আর কোনো কিছু বুঝতে চেষ্টা করেনি। মাও তাকে বইয়ের বাইরে কিছু কিছু দেখতে দেয়নি । মিথস্ক্রিয়া ছাড়া সমাজ-জীবনের জটিল রহস্য বুঝবে কীভাবে? স্কুল আর বাসা ছাড়া তাকে কোনো দিন কোথাও নিয়ে গেছেন বলেও মনে হয় না।
একটু উত্তর দিকে এগিয়ে গেল আদনান। এখানে ধুমল অন্ধকার। একটা ছোট বস্তি। বস্তির পাশ দিয়ে চলে গেছে একটা কানাগলি। বস্তির ভ্যাপসা গন্ধ আদনানের ভালো লাগেনি। তবু এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াল সে। বস্তিতে এক নারী এক পুরুষে তুমুল ঝগড়া হচ্ছে। মেয়েটি বলছে, ‘তুমি তো একটা মিনতি, তুমি আমারে ভাত-কাফর দিবা কেমনে?’ পুরুষটি বলল, ‘চুপ কর হারামজাদি’– কথা শেষ; মনে হলো চুলের মুঠি ধরে পিঠে কিল-ঘুষি লাগাচ্ছেন দেদারছে। মিনতি শব্দটি শোনার পর আদনানের স্মৃতিতে মা-বাবার ঝগড়ার দৃশ্যটি আবির্ভূত হলো। আদনান ওর বাবার মুখটা মনে করার চেষ্টা করল, সেলুলয়েডে নেগেটিভ হয়ে চোখে ভাসল। নিরীহ গোছের একজন কলেজশিক্ষক, খুব নম্র প্রকৃতির, সাদাসিধে, একটা শার্ট ও একটা কালো প্যান্ট সব সময় পরত, মা তাঁর সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া করত। কী নিয়ে ঝগড়া করত তা আদনানের মনে পড়ছে না। তবে মা তাঁকে প্রায়ই বলত, ‘তোমার চেয়ে একটা মিনতিও বেশি রোজগার করে।’ বাবা তখন আনত চোখে মাটির দিকে চেয়ে থাকত। মা তখন বলত, ‘একটা মিনতির সাথে কথা বলতেও ইচ্ছে হয় না।’ এরপরও বাবা রাগ করত না। মাঝে মাঝে বলত, ‘ছেলেটার সামনে এমন করে বলো না।’ মা তখন আরও রেগে যেত, কোনো কোনো দিন বাবা বাসা থেকে বের হয়ে যেত।
বস্তির কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে আদনানের আর ইচ্ছে হলো না। সে কানাগলি দিয়ে আরও নিবিড় অন্ধকারে মিশে যাওয়া রাস্তা ধরে পুব দিকে এগিয়ে গেল। এই জায়গাটাতে এখনো বসতি গড়ে ওঠেনি। গাছ-গাছালিতে ছাওয়া। অনেক দূরে চলে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে আদনানের। বাসার গণ্ডি থেকে সে আর কোনো দিন এর আগে বের হয়নি। এত বিস্তৃত পৃথিবী ছেড়ে একটা রুমে কেন এত দিন বন্দি হয়ে ছিল ভেবে ভেবে নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য নিজেকেই ভর্ৎসনা করতে ইচ্ছে হলো আদনানের। এখানে দাঁড়িয়ে অন্ধকারের রূপ খুঁজতে চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ পরই কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ পুবের আকাশে উঁকি দিল। অন্ধকার কিছুটা কেটে গেল। এই বয়সেও আদনান খোলা আঙিনায় দাঁড়িয়ে খোলা আকাশে এমন সুন্দর চাঁদ কোনো দিন দেখেনি… কথাটা ভাবতেও লজ্জা হচ্ছে ওর। সে মুগ্ধ হয়ে ভাঙা বাতাসার মতো চাঁদটার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। মনে মনে বলল, ‘আসছে ডিসেম্বরে বেড়াতে বের হব। পাহাড়, আকাশ, সমুদ্র দেখতে যাব অনেক দূরে। কিছুদিনের জন্য হারিয়ে যাব সেখানে, যেখানে অসীম নীল আকাশ উপুড় হয়ে পড়ে আছে নিঃসীম সমুদ্রের বুকে। এক রাত সারা রাত চেয়ে চেয়ে দেখব পূর্ণিমার জোছনা।’
আদনানের অনেক দূর হেঁটে যেতে ইচ্ছে হলো। ঝিরঝির বাতাসের পরশে তার শরীর-মন সতেজ হয়ে উঠল। আরও কিছুটা দূর এগিয়ে গিয়ে আদনান হঠাৎ হোঁচট খেল। একটা গাছের আড়ালে অন্ধকারে একজন মানুষ কী যেন করছে। আদনান ওকে বুঝতে গিয়ে দেখতে পেল– একজন নয় দুজন। এক নর এবং এক নারী, দুজন মিশে এক হয়ে আছে। আদনান মনে মনে বলল, ‘এটিই কী তাহলে দুই পিঠের জানোয়ার।’ প্রাণের নিগূঢ় শেকড়ে একটু নাড়া দিয়ে গায়ে শিহরণ তুললেও অযাচিত এই দৃশ্যটি দেখে সে রাস্তায় থু থু ছিটাল। মনে মনে বলল, ‘কুকুর দিয়ে ওদের কামড়ানো হলে ভালো হতো।’
আরও দূরে কোথাও যেতে ইচ্ছে হলেও আর যেতে পারল না আদনান। সে ফিরে এল সেই ডাস্টবিনটার কাছাকাছি। ডাস্টবিনের উৎকট গন্ধ আদনানকে অস্বস্তিতে ফেলে দিলেও এখানেই সে দাঁড়াল। এই গন্ধের মধ্যে একপ্রকার মাদকতা আছে– আদনান ভাবল। হঠাৎ মায়ের কথা মনে হওয়াতে সে মনে মনে বলল, ‘মা এত দেরি করছে কেন?’
আজ দুপুরের একটু পরে মা বাইরে গেছে। প্রায় সময় বাইরে যায়, কখন বাইরে যায়, কখন আসে তা অবশ্যই আদনান খোঁজ রাখে না। মাকে খাওয়ার সময়টাতে পাওয়া গেলে অন্যসময় মায়ের উপস্থিতি সে এতটা বোধ করে না। মায়ের হাতে খেতে না পারলে তার যেন ক্ষিধেই মেটে না– এজন্যই খাওয়ার সময় মায়ের উপস্থিতিটা এত বেশি মনে হয়। কামরান সাহেবের সঙ্গেই মা বাইরে গেছে– কিন্তু এত রাত কেন হচ্ছে? এত রাত তো আর কোনো দিন হয় না। এই প্রশ্নটা তাকে টেঁটাবিদ্ধ করেছে।
আদনানের আজকে হঠাৎ করেই কারও সঙ্গে একটু কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কার সঙ্গে কথা বলবে, কী কথা বলবে সে চিন্তা করে মেলাতে পারে না। সে তো কারও সঙ্গে কথা বলে না, এমন কি ক্লাসেও ওর কোনো বন্ধু নেই। এজন্য ক্লাসের ছেলেমেয়েরা তাকে ‘উদ্ভিদ’ ডাকে। শুধু নায়না ডাকে ‘সেগুন’। নায়না কেন তাকে ‘সেগুন’ ডাকে তাও তার জানতে ইচ্ছে হয়নি কোনো দিন।
মায়ের জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে আদনান। এক সময় ক্ষোভে-ক্রোধে সামনের স্তূপাকৃতির ছেঁড়া কাগজগুলোতে আনমনা হয়ে সে লাথি মারল। কৃষ্ণপক্ষের মলিন চাঁদের আলো আরও একটু পাখা মেলেছে। পথবাতিগুলোরও পুরো যৌবন। নিয়নবাতি বলেই অনেকটা সময় নেবে জ্বলতে। আদনান আনমনা হয়েই মাটির দিকে তাকালো এবং তখনই চোখে পড়ল লাথি দেওয়া ছেঁড়া কাগজের টুকরোগুলোর মাঝ থেকে বের হয়ে এসেছে একটা ছবির নিম্নাংশ। নাভিমূল থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত। আদনান ছবির খণ্ডাংশটি কুড়িয়ে নিয়ে ঝাপসা আলোতে দেখল এক সুন্দরী নারীর ছবি। বস্ত্রহীন। আদনানের রক্তপ্রবাহ সঞ্চালিত হলো দ্রুত বেগে। এতো দিন শীতল এই ছেলেটির শরীর হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল, জেগে ওঠল জৈবিক অস্থির তাড়নায়। উত্তেজনায় সারা শরীর কাঁপতে লাগল। এ যুগের কলেজপড়–য়া ছেলেমেয়ে এমন ছবি দেখেনি তা বিস্ময়ের ব্যাপার হলেও আদনান কোনো দিন এমন ছবি দেখেনি, তা নিরেট সত্য। সে ছবিটা বুক পকেটে রেখে দ্রুত বাসায় ফিরে এলো।
ঘড়ির ঘণ্টার কাঁটা এগারোটার দাগের ওপর দাঁড়াল।
ছবিটি দেখে আদনান অসহনীয় যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উঠল। একসময় সে বিছানায় শুয়ে ছবির খণ্ডাংশটি বের করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। ছবিটির দিকে তাকাতেই সে অজানা শিহরণে আদনান কেঁপে উঠল। ছবির নিবিড় আলিঙ্গন আদনানকে টেনে নিল অসহ্য ঘনিষ্ঠতায় এক ‘আনন্দময় নরকের’ দিকে। সে এলোমেলো হয়ে গেল। চোখের পলক পড়তে লাগল দ্রুত। একসময় খণ্ডিত ছবিটির কেন্দ্রস্থলে সে যখন ওষ্ঠাধর স্পর্শ করাল তখন তৃণাবৃত ব-দ্বীপের মোহিনী শক্তির আবেষ্টনে ও মগজে অনুভূত হলো দুর্নিবার-অসংলগ্ন উন্মাদনা বরফাবৃত মজ্জা গলে অশান্ত হয়ে নেমে এল শিরা-উপশিরা বেয়ে শরীরের কোষে কোষে। মুহূর্তের মধ্যে আদনান বেসামাল হয়ে পড়ল এবং সে মাতালের মতো বাথরুমে ঢুকে জঙ্ঘায় প্রস্রবন ঘটাল। আদনানের জীবনস্পন্দন এক সীমাহীন আনন্দে নেচে উঠল, যে আনন্দ সে আর কোনো দিন অনুভব করেনি।
সে জীবনের এ উচ্ছলতাকে অনুভব করতে লাগল রঙিন গ্লাস ভিতর দিয়ে।
শ্রান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল আদনান। এই মুহূর্তে পৃথিবীর সুন্দরকে ভাবতে তার ভালো লাগছে। ক্লাসমেট নায়নাকে নিয়ে ভাবতে লাগছে। নায়না কেন তাকে ‘সেগুন’ ডাকে-এর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাকে খতিয়ে দেখতে ভালো লাগছে। নায়নার শরীরের সুন্দরগুলোকে ভাবতে ভালো লাগছে। সে মনে মনে বলল, ‘নায়নাকে কাল জিগ্যেস করব তুমি আমাকে সেগুন ডাক কেন?’
এতক্ষণ পর সে দুই প্রকার ক্ষুধা অনুভব করতে লাগল।
আবার দরজায় তালা দিয়ে বাইরে নেমে এলো আদনান। ওর ইচ্ছে হলো অপূর্ণাঙ্গ অসুন্দর ছবিটির পূর্ণাঙ্গতা দিয়ে অসুন্দরতা দূর করার জন্য। পরিপূর্ণ ছবিটির চোখকাড়া সুন্দরের খোঁজে আবার ডাস্টবিনের কাছে ছেঁড়া কাগজগুলোর পাশে চলে এল। সেই দলা পাকানো ছেঁড়া কাগজগুলোর ওপর হামাগুড়ি দিয়ে হাতড়ে বেড়াতে লাগল ছবির বাকি অংশ। এখন আর পায়ে লাথি দিতে ইচ্ছে হলো না। আদনানকে রাস্তায় এমন হামাগুড়ি দিয়ে হাতড়াতে দেখে এক পথিক জিগ্যেস করল, ‘কী খুঁজো খোকা?’
আদনান অপ্রস্তুত ও লজ্জিত হয়ে বলল, ‘না, কিছু না।’
পথিক আবার জিগ্যেস করল, ‘দামি কিছু হারিয়েছে?’
আদনান একটু ক্ষোভ প্রকাশ করে বলল, ‘হ্যাঁ, অনেক দামি।’
পথিক এবার মাথা নুয়ে আদনানের দামি জিনিসটি খুঁজে দেওয়ার জন্য ঢেঁকির মতো মাটির সমাস্তরাল হয়ে ছেঁড়া কাগজের টুকরাগুলোর দিকে চোখ রাখল। লোকটির কাণ্ড দেখে আদনানের মাথায় রক্ত উঠে গেল। সে রাগত স্বরে বলল, ‘আমার জিনিস আমাকেই খুঁজতে দিন। আপনাকে খুঁজতে হবে না।’
লোকটি ভড়কে গেল। কোনো কথা না বলে অকৃতজ্ঞ এই ছেলেটির দিকে ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে সামনের দিকে চলে গেল লোকটি।
আদনান পাগলের মতো হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছে ছবির বাকি অংশটি পাওয়ার জন্য। একসময় পেয়েও গেল। কিন্তু তাতেও মুখমণ্ডল নেই। গলা থেকে নাভিমূলের কাছাকাছি অংশ। রাস্তার ঝাপসা আলোতে ছবিটির গতিপ্রকৃতি তেমন বোঝা না গেলেও আদনান বুঝতে পেরেছে এটি সুদৃশ্য সৌষ্ঠব সুডৌল বুকের ছবি। এমন অসহ্য ভয়ঙ্কর সুন্দরের দিকে সে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। ছবিটি পকেটে ঢুকিয়ে সে আবার পাগলের মতো খুঁজতে লাগল অবশিষ্ট অংশটুকু। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর আদনান পেয়েও গেল। রাস্তার আলো আবার নিভে গেল। ঝাপসা মুখায়বটি ভালো করে দেখতে পেল না আদনান। সে দ্রুত নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল। রাস্তার বাতি নিভে গেলেও তার রুম থেকে বিকীর্ণ হচ্ছে জেনারেটরের দেয়া আলো।
আদনান নিজের রুমে গিয়ে ছবির খণ্ডাংশগুলো টেবিলের ওপর রেখে জোড়া দিল। পূর্ণাঙ্গ সুন্দর ছবিটির দিকে তাকিয়ে তার চোখ থেকে বের হতে লাগল রোধিরানল। সে দ্বিতীয় বার তাকাতে পারল না ছবিটির দিকে। মাথায় আগুন ছড়িয়ে পড়ল মুহূর্তের মধ্যে। নিজের রুম ছেড়ে পাগলের মতো দৌড়ে ঢুকে পড়ল মায়ের রুমে। মায়ের রুমে কখনো ঢুকেছে বলেও মনে হয় না। মা তাকে এমনভাবে রাখত যেন আদনান সে রুমে না যায়। আদনান কাববোর্ডের দরজাটা খুলে ফেলল হেঁচকা টান দিয়ে। কব্জা ভেঙে কাববোর্ডের দরজা ফাঁক হতেই তার চোখ বিস্ফারিত হলো সবেগে। বিদেশি দামি মদের বোতল, আরও…। আদনান চোখ ফিরিয়ে নিল সেখান থেকে। আদনান হতভম্ব, কিছুই ভাবতে পারছে না সে। রাগে-উত্তেজনায় মায়ের বিছানাটাও তছনছ করে দেখল, মানুষকে এলোমেলো করার মতো অনেক কিছুই রয়েছে বিছানার নিচে। আদনানের চোখ বেয়ে পানি ঝরতে লাগল। সে অস্ফুট উচ্চারণে বলল, ‘এই ফ্ল্যাট, এই গাড়ি, এই ফার্নিচার তাহলে কি এভাবেই কেনা হলো? আমাকে তাহলে কি এ কারণেই আড়াল করে রাখা হলো পৃথিবীর আলো-বাতাস থেকে? আমাকে কোনো মানুষের সঙ্গে কি তাহলে এ কারণেই মিশতে দেয়া হতো না?’ আদনানের হঠাৎ মনে হলো– কামরান আঙ্কেলের সঙ্গে সকালে যে কথা কাটাকাটি হয়েছিল সেটা একটা ছবির প্রসঙ্গই ছিল। আদনান আবার মনে মনে বলল, ‘আরও তো কত আঙ্কেল আসে– তারা কি তাহলে এ কারণেই আসে?’ একবার চিৎকার করতে ইচ্ছে করলেও সে চিৎকার করতে পারল না। বুকের ভেতরে জেগে ওঠা উন্মত্ত বাতাবর্ত তার চিৎকারের ভাষা টুকরো কাগজের মতো উড়িয়ে নিয়ে গেল।
আদনান নিজেকে আর সংবরণ করতে পারেনি। সে নিজের রুমে এসে টেবিলের পাশে দাঁড়াল। টেবিলে এখনো ছবিটি পড়ে আছে। সে কাঁপতে লাগল এই অসহ্য ভয়ঙ্কর সুন্দরের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ তার চোখে পড়ল টেবিলের এক কোণে পড়ে আছে একটি জ্যামিতিবক্স। সে বক্স থেকে কাঁটা কম্পাসটি বের করল সজোরে। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে আদনান কাঁটা কম্পাসের দুই প্রান্ত দু’চোখ ঢুকিয়ে দিল হাসতে হাসতে। তার চোখ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে ছবিতে কিছুটা লেগে বাকি রক্ত টেবিলের নিচে গড়িয়ে পড়ল।
আদনান আস্তে আস্তে বলল, ‘আমাকে অন্ধকার দাও। পৃথিবীর সব আলো মুছে দিয়ে আমাকে ব্ল্যাকহোলের নিরেট অন্ধকার দাও।’ আদনান পাগলের মতো হাসতে লাগল। তার হাসি ফ্ল্যাটটিকে কাঁপিয়ে তুলল।
কিছুক্ষণ পর আদনানের মা অন্যদিনের মতোই বাসায় এসে ঢুকল তালা খুলে। এসেই নিজের রুম না ঢুকে কিচেনে ঢুকল। তাড়াতাড়ি টেবিলে খাবার দিয়ে ডাক দিলেন, ‘আদনান খেতে এসো।’ ছেলের আসার দেরি দেখে একটি চেয়ারে বসে কপালের ঘাম মুছল শাড়ির আঁচল দিয়ে। চোখ বন্ধ করে কী যেন ভাবল। আবার ডাক দিল, ‘আদনান এসো বাবা, ভাত খাবে।’ আদনান কোনো শব্দ করল না। মা প্লেটে ভাত নিয়ে মাখাতে মাখাতে আদনানের রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘মায়ের সঙ্গে রাগ করেছিস? একটা কাজে আটকা পড়েছিলাম, রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যাম… কী করব বাবা?’ এগিয়ে গেল আদনানের খুব কাছে। আদনান দু হাত দিয়ে দুটি চোখ চাপা দিয়ে বসে আছে স্থাণুর মতো। ওর হাত ভিজে গেছে রক্তে। মা তাকিয়ে দেখল টেবিলে জোড়া লাগানো যে ছবিটি পড়ে আছে সেটি লাল রক্তে ভেসে যাওয়া যেন লাল রঙের একটি শাড়ি পরা– ছবিটি আগের চেয়ে আরও অনেক বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে।