নেতার ছায়াসঙ্গী

নেতার ছায়াসঙ্গী

হরফ আলি ঘরে ফেরামাত্র বউ কৈফিয়তের সুরে জিজ্ঞেস করে, ‘আইজগে কিছু করতে পারিছো। নাকি সারাদিন নেতার পিছে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ায়্যাই শেষ। কামের কাম কিছু হয় না। শুধু মাঝে মাঝে তোমার নেতা কাউয়ার ভাত ছিটানোর মত দুই-চাইরটা পয়সা ছিটায়্যা দ্যায়, তাই লিয়ে ঘরে আসো। জমিজিরেত ভালভাবে চাষবাস করলে এ্যার চাইতে বেশি আয় বরকত হতো।’

‘ঘ্যা ঘ্যান করিস না। চুপ কর শালি! নেতার সাথে থাকা কী কম মরদের কাম। নেতা যে আমাক বিশ্বাস করে, মাঝে মাঝে নিজে থাইক্যাই ফোন করে, এইডা কী কম কথা মনে করিস।’

‘মেয়েডা যে আজ চার-পাঁচ বছর ধইরা মেট্রিক পাশ কইরা বইসে আছে, দিনকে দিন আইবুড়া হয়্যা যাচ্ছে, সেই খেয়াল আছে! কতবার কইছি নেতাক কয়্যা একটা চাকরির ব্যবস্থা কর, চাকরি হলেই বিয়্যা হয়্যা যাবি।’

‘এবার নেতা রাজি হইছে। কইছে ঢাকায় আমার বাসায় পাঠায়্যা দ্যাও। সামনে সামনে থাকলে সবসময় তার চাকরির কথা মনে হবি। তাছাড়া তোমার ভাবি তাক্ শিখায়া পড়ায়া চাকরির পরীক্ষার জন্য রেডি করবি।’

হরফ আলির মেয়ে হেনা রাজধানীতে নেতার বাসায় যায়। একজন অনাহুত সোমত্ত মেয়ে দেখে প্রথমদিনই নেতার স্ত্রী খেঁকিয়ে ওঠে, ‘এদিক-ওদিক চারদিক মাইরেও তোমার মন ভরে না। গ্রাম থেকে একটা সহজ সরল মেয়েকে নিয়ে আসছো।’

‘মেয়েটার চাকরির দরকার। এমনি এমনি তো চাকরি হয় না। কয়দিন তোমার সেবা শুশ্রষা করুক, ঘরের কাজ কাম করাও, তারপর দেখি, কী করা যায়।’

হেনাকে বেশিদিন নেতার বাসায় সেবা যত্নের কাজ করতে হয়নি। আসার পনের/বিশ দিনের মাথায়ই প্রাইমারি স্কুলে দপ্তরি পদে চাকরিটা হয়ে যায়। পদটি ছিল সম্পূর্ণ নেতার এখতিয়ারভুক্ত। এজন্যে সহজেই হেনার চাকরিটা মেলে। চাকরি পাওয়ার মাস খানেকের মাথায়ই গাঁয়ের মোটামুটি সচ্ছল পরিবারে তার বিয়েটা হয়ে যায়।

কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হরফ আলি এখন নেতা এলাকায় এলে আরও বেশি পিচুটির মত লেগে থাকে। নেতার আঞ্চলিক ছায়াসঙ্গী। খাসলোক। তার সুপারিশে নেতার দ্বারা যে দু’একজনের উপকার হয়নি তা নয়। নেতা হরফ আলির অনেক কথারই গুরুত্ব দেয়।

আসলে গোড়ার দিকে নেতার অবস্থা হরফ আলির চাইতে আরও দীর্ণ-বিদীর্ণ ছিল। পড়ন্ত সত্তর দশকে শত্রুমুক্ত দেশের প্রথম আঞ্চলিক জননেতা যদি বাজারের জনতা রেস্টুরেন্টে চা খেতে না আসত, তাহলে আজকে তার এই অবস্থানে হয়ত আসাই সম্ভব হত না। এখনকার আলোচ্য নেতা জমশের আলি তখন জনতা হোটেলে বেয়ারার কাজ করত। তার সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ বাড়ন্ত চেহারা, স্পাইকি চুল, গোলাকার ভরাট চোখ, বুদ্ধিদীপ্ত সাহসী আচরণ, ঝাঁঝাল কন্ঠস্বর, জোরে কথা বলতে গেলে বামগালের কোনা দিয়ে ঈষৎ থুতু বেরিয়ে পড়া দেখে তৎকালীন জননেতার পছন্দ হয়ে যায়। জননেতা ভাবেন, এই ছেলেটিকেই আমার দরকার। এই ছেলেই হবে আমার ভবিষ্যৎ মাসলম্যান। এই ছোঁড়াটাকে লাই দিলে দুনিয়া উল্টে দেবে। যেই ভাবা সেই কাজ।

জমশের আলি হয়ে গেল সেই জননেতার তল্পিবাহক। বডিগার্ড এবং ছায়াসঙ্গী। নেতা যেখানে, জমশেরও সেখানে। দিনে দিনে সেই জননেতা হয়ে গেলেন জমশের নির্ভরশীল। লেখাপড়ায় এইট পর্যন্ত হলেও জমশের আলির মাথার কলকব্জাগুলো ছিল ধারাল ছুরির মত। উপস্থিত যে কোন কাজ সহজেই ট্যাকল দিতে পারত। আশির দশকের গোড়াতেই শুরু হয় দেশে মার্শল ল। সময় আসে সুযোগকে কাজে লাগানোর।

জমশের আলির দুরদর্শিতা ছিল প্রখর। সে বুঝত এই কুয়াশা কেটে একদিন সুদিন আসবে, দেশে আবার ভোট হবে, আবার নেতা নির্বাচিত হবে। তল্পিবাহক হয়ে থাকতে আর কাঁহাতক ভাল লাগে। তাই একদিন চিকিৎসার নামে ভারত চলে যায়। একসময় সবার অজ্ঞাতে দেশে ফেরে। নিজকে আড়াল করার জন্যে অবস্থান গ্রহণ করে গোপন স্থানে। ওৎ পেতে থাকে শিকারির মত। জননেতার নাড়ী-নক্ষত্র সবই তার জানা আছে। বৃষ্টিভেজা একরাতে এসে সহযোগীর সহায়তায় সেই জননেতাকে ডেকে তোলে। ড্রয়িংরুমের দরজা খুলতেই মুখে কাল কাপড় বাঁধা অবস্থায় দুজন আচমকা ঘরে ঢোকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন লোহার রড দিয়ে জননেতার মাথার ওপর আঘাত করে অপরজন তৎক্ষণাৎ সোফার বালিশ নিয়ে জননেতার মুখে চেপে ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করে। তারপর নির্বিঘ্নে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে।

দেশের অবস্থা প্রায় এক দশক পরই স্বাভাবিক হয়ে যায়। জমশের আলি দেশে ফেরে। জননেতার মৃত্যুর খবরে বুক চাপড়ে আর্তনাদ করতে থাকে। সহযোগীদের সামনে আফসোস করে মনের ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে, নেতা হত্যার প্রতিশোধ নেবো, ঘাতক যদি মাটির নিচেও থাকে তাও খুঁজে বার করবো। মৃত জননেতার জন্যে বিভিন্ন জায়গায় শোকসভার আয়োজন করে। এতে সে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এভাবে গণসংযোগে জনগণের মাঝে ব্যাপকভাবে সাড়া পড়ে যায়। তারপর ভোটের সময় এলে জমশের আলি মনোনয়ন সংগ্রহে সমর্থ হয়। ভোটে জয়যুক্ত হয়। এখন সেই আঞ্চলিক নেতা।

নেতা হওয়ার পর একবছরের মাথায় তার গাড়ি বাড়ি সব হয়ে যায়। আর এসময় তার আত্মীয়স্বজন ডালপালা গজিয়ে ওঠে। সকল পরিজনই ক্রমশ সচ্ছল এবং মালদার হতে থাকে। আতি নেতা, পাতি নেতা হয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার গ্রহণ করে। আঞ্চলিক নেতা জমশের আলি এখন লংবডি ল্যান্ড ক্রুজার জিপে চড়ে বেড়ায়। যার মূল্য দশটা জনতা হোটেলের সমান।

হরফ আলি নেতাকে জিজ্ঞেস করে, ‘সামনে ইলেকশন। আপনে তো এলাকায় মাসে একবারও আসতে চান না। নিজের দরকার নাহলে কখনো আসেন না। মানষে তো আপনাক ভোট দিব্যার চাইব না।’

‘আরে গাধা এতদিন আমার সাথে থাইক্যা এই শিখলি। ভোট কি মানষে আমাক দ্যায়! দ্যায় মার্কায়। তুই মনোনয়ন লিয়ে আয়, তুইও নেতা হবি।’

‘আগামী ইলেকশনে আমি যে কমিশনারে দাঁড়াবো, এইডা আপনের মনে আছে তো।’ বলে হরফ আলি এখনই নেতার কাছ থেকে নিশ্চয়তা পেতে চায়।

‘তুই অবশ্যই কমিশনার হবি। আমার জন্যেই তোক্ কমিশনার বানাবো। এইডাও রাজনীতির অনেক খেলের এক খেল, এইডা তুই বুঝবি না।’

‘কিন্তু এবার টিভিতে যে সাংবাদিকরা দেখাচ্ছে, পাবলিকের কাছে মাইক ধরে বলছে, আপনি কী ধরণের লোককে ভোট দিবেন। শুনে মানষে যে কচ্ছে, সৎ, যোগ্য আর উপযুক্ত প্রার্থীকে ভোট দিব।’

‘ঐগুলা টিভিতে প্রতিবারই দেখায়, পাবলিক ঐসব কয় আর ভোট দ্যায় মার্কায়। মার্কা লিয়ে অযোগ্য, অসৎ, লম্পট যেই দাঁড়াক. সেই নেতা হয়। দেখলি না পদ্মার ওপার দলের হেডনেতা দুইবার জামানত হারাল, তারপর মার্কা লিয়ে যেই দাড়াল, সাথে সাথে ভোটে জয়লাভ- এখন তো সে দেশের বড়নেতা।’

‘পেপারেও তো ঐরম লেখে।’

‘পেপার কাটতির জন্য ঐরম লেখে আর সব নেতারই পেপার-টিভি আছে।’

‘আপনের তো তৃণমুলের কোন নেতাকর্মীর সাথে কোন সম্পর্ক নাই।’

‘সম্পর্ক রাখলেই বিপদ। সবকিছুতেই ভাগ চাই। সম্পর্ক রাখলে কী আর ঢাকায় বাড়ি-গাড়ি, এলাকায় জমিজিরেত করতে পারতাম। আমার এলাকার পাবলিক তো মার্কার পাগল। একবার ঢাকা থাইক্যা মার্কা আনতে পারলে খেল খতম। সবসময় মনে রাখবি, মানুষ মানুষকে ভোট দ্যায় না,ভোট দ্যায় মার্কায়।’

নেতা সকল সময় রাজধানীতে বাস করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এলাকায় আসেন কদাচিৎ। এলাকায় এলেই হরফ আলি তার পেছনে লেগে থাকে একজন বিশ্বস্ত ছায়াসঙ্গী হিসেবে। গতকাল নেতা এলাকায় এসেছেন একটা জমির রেজিস্ট্রেশন করতে আর বাজারে ভাতিজার জুতার দোকান এবং পৌর এলাকায় একটা গণ টয়লেট উদ্বোধন করতে। সকাল থেকে হরফ আলি নেতার সাথেই ছিলেন। হঠাৎ হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে নেতাকে বলে, ‘জমশের ভাই, দশটা বাজে, এগারটায় বাজারে একটা জুতার দোকান উদ্বোধন করার জন্য যাওয়া লাগবি।’

‘আরে বলদ, তোক্ কয়বার কইছি, সবসময় লেটে গেলে দাম বাড়ে। যদি জাস্ট টাইমে যাই, তাহলে তারা ভাববি, নেতার আর কোন কাম নাই। ঠিকসময় গেলে দাম কইম্যা যায়। বুঝলি,ভাস্তের দোকান তো তাই একঘন্টা পরে যাব। নাহলে দুই তিন ঘন্টা পরে গেনুনি।’

আলতাফ মিয়ারা নদীর ঘাটে বটতলায় বসে নিত্যকার মত গালগপ্প মারছিল। তাদের ভেতর একজন বলছিল, ‘হরফ আলি এখন নেতার ডানহাত বামহাত। তৃণমূলে কারো সাথে নেতার কোন সম্পর্ক নাই। ঐ একজনকে দিয়েই নেতা এলাকার খবরাখবর নেয়।’

অপরজন বলে ওঠে, ‘সে শুধু নেতার বামহাতের কামডাই বেশি বেশি করে। খালি বাহ্য করার পর পানি ঢালে না। আজেবাজে সবকামই তার কাম। কোন্ জাগায় কাকে নিয়োগে কত টাকা দিতে হবে, এইসবই হরফ আলির কাম।’

নেতা দুদিন আগেই এলাকায় আসেন। আগামীকাল ঢাকায় ফেরার কথা। কিন্তু আজকে তার ঠাসা প্রোগ্রাম ছিল। অন্তত তিন জায়গায় সভা সমাবেশে যেতে হয়েছে। তারপর দু’জায়গায় ফিতে কেটে উদ্বোধন করে সন্ধের পর বাসায় এসে ক্লান্তিতে কাহিল। বিশ্রাম এবং বিনোদন প্রয়োজন। মফস্বল পৌর শহরের দোতলা বাসায় একাই থাকেন এবং সাথে থাকে দেহরক্ষী কাম ছায়াসঙ্গী হরফ আলি আর বাসার দুজন বিশ্বস্ত নিরাপত্তাকর্মী। নেতার নির্জীবতা দুর করার জন্যে নিকটেই নিরঞ্জনের নারকোটিক্সের দোকান। সেখান থেকে দু’বোতল বিদেশি মাল আনে হরফ আলি। মাল খেয়ে টাল না হয়ে একটু চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। তারপর নেতার হাবভাব ইঙ্গিত দেখে বুঝতে পারে হরফ আলি। তখন সে তার চাগার দেয়া লালসার আধার জোগাতে ছোটে। পূর্ব নির্ধারিত না হলে আচানক এমন চাহিদা পূরণ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। শহরে বিভিন্ন স্তরে ভেনাসের নাগাল পাওয়া গেলেও মফস্বলে সেটা নিরুপিত না থাকলে নাকাল হতে হয়। তবুও তার পরিসরে খুঁজতে থাকে, হেথায় খোঁজে, হোথায় খোঁজে– কোথাও পাওয়া যায় না। কিন্তু নেতার তো চাই। না হলে পৌর কমিশনার হওয়া অধরা-ই থেকে যাবে। শেষে মনেপড়ে, নিজপত্নীর কথা। বাড়ি এসে ঐ ব্যাপারে স্ত্রীর কাছে সহযোগীতা করার কথা জানালে স্ত্রী রেগেমেগে অগ্নিশর্মা হয়ে ফোঁস করে ওঠে, ‘ওই ঢ্যামনা, বিজন্মা বলিস কী! তোর এত বড় সাহস।’ বলেই হাতের কাছে সুপারি কাটা জাঁতি ছিল, তাই দিয়েই মাথার ওপর জোরসে এক ঘা বসিয়ে দেয়। আর যাবে কোথা। পাকা লোহার তৈরি জাঁতির বাড়ির চোটে প্রমিজিং কমিশনার হরফ আলির মাথা কেটে ফেটে রক্ত দর দর করে গড়িয়ে পড়তে থাকে। আর সেসময় তার স্ত্রী স্বামীর জখম নিরাময়ের জন্যে মরিয়া হয়ে তাকে নিয়ে ডাক্তারখানায় ছোটে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত