কালো আর সোনালি শিংমাছের ব্যাগ

কালো আর সোনালি শিংমাছের ব্যাগ

আজ কি হাটবার! বাজারে এত লোকের ভিড়! তিনি বাজারের ঠিক মাঝপথ দিয়ে হাঁটছেন। ভিড় ঠেলে যেতে তার সমস্যা হচ্ছে। দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে হাঁটতে ভালো লাগার কথাও না। এভাবে না হেঁটেও তিনি পারছেন না। তার দুই হাতেই দু’টি চটের ব্যাগ। ভেতরে জ্যান্ত শিংমাছ। ছালার ভেতর থেকে কাঁটা বেরিয়ে আছে। পায়ে লাগলে চামড়া তো ছিঁড়বেই প্রচণ্ড জ্বালাপোড়াও করবে। মাছগুলো ভেতরে নড়ছে, মোচড়াচ্ছে। এ অবস্থায় নিজেকে বাঁচিয়ে হাঁটতে গেলেও সমস্যা। অন্য যে কারো পায়েও আঁচড় লাগতে পারে। নিজেকে এবং সবাইকে বাঁচিয়ে পথচলা কঠিন। তিনি এখন তা টের পাচ্ছেন।

বাম হাতের শক্তি কম অথচ এই হাতের ব্যাগটা বেশ টান টান লাগছে। মাছগুলো বড় বেশি মোচড়াচ্ছে। একেবারে তরতাজা। আরো কয়েকদিন জিয়ল রেখে খাওয়া যাবে। এই ব্যাগের শিংমাছগুলো একেবারে কুচকুচে কালো। মোটাতাজা। স্বভাব মাগুর মাছের মতো। ঘন ঘন হা করে। মুখও অনেক বড়। কে জানে মাগুরের প্রজাতি থেকেই হাইব্রিড কি না। ডান হাতের ব্যাগের হাতলটা এখন একটু শিথিল লাগছে। মনে হচ্ছে মাছগুলো নরম হয়ে এসেছে। কতদিন ধরে জিইয়ে রাখা হয়েছে কে জানে! মাছওলারা তো ভালো বলবেই। বোধ হয় বাড়ি যেতে যেতে মাছগুলো মারা যাবে। আর জিয়ল রাখা যাবে না।

ডান হাতের ব্যাগের শিংমাছগুলো উজ্জ্বল সোনালি রঙের। সাধারণত এমন সোনালি মাছ হয় না। এ যেন স্বর্ণকারের দোকান থেকে সোনা দিয়ে বানানো মাছের জীবন্ত ভাস্কর্য। এ মাছগুলো দেখেই ভালো লেগেছে। তবে পকেটে সামান্য টাকা ছিল বলে কেনার ইচ্ছা ছিল না। দোকানি অতি অল্প দামে তাকে দিয়ে দিল যে!। মাছগুলো দেখে ভালো লেগেছে। খেতেও নাকি ভালো লাগবে। রেখে রেখে অনেকদিন খাওয়া যাবে। দোকানিদের কথা বিশ্বাস হয় না। প্রত্যেকেই যেন যার যার পেশার স্বপক্ষে মিথ্যা কথা বলার অধিকার রাখে।

মাসের শেষের দশদিনে প্রতিটি টাকা ব্রিটিশ পাউন্ডের মতো মূল্যবান। আর সেই দশদিনের আজ ষষ্ঠদিন। পকেটে টানাটানি। বউকে বলেছিল একটা চাকরি বাকরি জোগার করার চেষ্টা করতে। বউ বলে তার বংশে কেউ রুজি করতে ঘরের বাইরে যায়নি, যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ঘরের ভেতর অবশ্য সে সেলাইয়ের কাজ করার চেষ্টা করে। তেমন কাজ পায় না। তার কাছে কাজ আসেও না। আসবেই কেন? হয়তো কাস্টমারদের কাছে তার কাজ ভালো লাগে না। না লাগার পেছনে অন্যতম কারণ হল, সে কারও কাছে কাজ শেখেনি। আজকাল দর্জিবিজ্ঞানের কোর্স করা খুবই সহজ। সামান্য খরচে পাড়ায়-মহল্লায়-স্কুলে করানো হয়। দূরে হলে যাতায়াতের ভাড়া এবং সময় দুটিই নষ্ট হয়। এখানে সবই বাঁচে তাতেও তার বউ গেল না। সারাদিন শুধু টেলিভিশন নিয়ে পড়ে থাকা। হিন্দি ও বাংলা সিরিয়াল দেখা। টিভির সামনেই তার খাওয়া-দাওয়া। প্রায়ই দেখা যায় খাওয়া শেষ; হাতে এঁটো শুকিয়ে গেছে কিন্তু ধুতে যেতে ইচ্ছা করে না। যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা-দৃশ্য চোখের আড়াল হয়ে যায়। জীবনে আর পাওয়া যাবে?

এখন আর বউকে কিছু বলাও যায় না। সাতমাস চলছে। সন্তান ঘরে এলে যে কী অবস্থা হবে! ভাবতেই মাথা ঘোরে। ডাক্তার বলে প্রেসার লো হয়ে যাওয়া। যদি মেয়ে হয় তো খরচ বেশি হবে– সবাই ভয় দেখাচ্ছে। সে সব বাড়তি খরচ সামলাবে কেমন করে! একটা অস্থায়ী চাকরিতে তার দিন কাটছে। দূরের জেলায় গেলে বেশি বেতনের চাকরি হয়তো পাওয়া যাবে। কিন্তু বাসাভাড়া, অফিসে যাতায়াত ও অন্য খরচে পোষাবে না। তারচেয়ে নিজ বাড়িতে থেকে এই সামান্য বেতনে যাও চলতে পারছে। কারো কাছে হাত না পাতলেও তাদের কাছাকাছি থাকলে মনে সাহস থাকে। দূরে গিয়ে পড়ে থাকলে ভয়ও বাড়বে। বাড়ির সামান্য জায়গায় নিজহাতে কয়েকটা পেঁপে, বেগুন, লাউগাছ লাগিয়েছে। কিছু কিছু ফলন হয়। তাই সবজির বাজার মাঝে মাঝে করলেও চলে।

অনাগত দিনগুলোর কথা ভাবতেই চোখে পানি এসে যায়। তার অভাবের দিনগুলোতে সন্তান আসছে ঘরে। বামহাতের ব্যাগে কালো শিংমাছগুলো প্রচণ্ড মোচড় দিয়ে উঠল। হঠাৎ ব্যাগটা হাত থেকে পড়ে গেল। এই ভিড়ের মধ্যে নুইয়ে ব্যাগটা আবার হাতে তুলে নিতে কষ্ট হল। ভালো যে– মাছগুলো ভেতর থেকে বেরিয়ে যায়নি! যদি বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ত সে আর মাছগুলো ধরে ভেতরে ভরতে পারত না। জীবন্ত শিংমাছকে সে ভয় পায়; এ মাছ ধরার কৌশল সে আয়ত্তে আনতে পারেনি।

মাছ বাজার শেষে তরকারির বাজার। এরপরে মুদি দোকানের সারি। এরপরে লেপ-তোশক-তুলার দোকান বা তুলাপট্টি। এর পরে মনোহারি দোকানের সারি। মনোহারি দোকানগুলোর পরে ওষুধের দোকান। এগুলোর পরে স্টেশনারি দোকান। স্কুলরোডের মোড়। বই-খাতার দোকান। কাপড়পট্টি এরপরে দরজিপট্টি। রাস্তা যেন ফুরায় না। মুড়ি-চিড়া-গুড়ের দোকানের সারি বা মিঠাইপট্টি। পাইকারি দোকানের সারি। এখানে সোল এজেন্টদের চার শাটারের বিশাল বড় বড় দোকান। স্বর্ণকারের দোকানগুলো অবশ্য বাজারের উল্টাদিকে। একেবারে ব্যাংকগুলোর পরে। কাঠপট্টি আর ফার্নিচার স্টোরগুলোও সেখানে। রড-সিমেন্টের দোকানও সেখানে।

বাজারটা যেন শেষ হচ্ছে না। বাঁশের ডালা-কুলা-ডুলা আর পলো-টাপা-চালনির দোকান। রিকশা-সাইকেল পার্টসের দোকান।

ডানহাতের ব্যাগটা এখন আর শক্ত মনে হচ্ছে না। মনে হয় মাছগুলো মারা গেছে। যায় যাক এখন আর কী করা! সবগুলো কুটে লবণ দিয়ে নয়তো জ্বাল দিয়ে রাখতে হবে। পাশেরবাড়ি ফ্রিজে রাখতে চাইবে তার বউ। সে নিষেধ করে দিয়েছে। কারো বাড়ি গিয়ে প্রতিদিন বিরক্ত করার দরকার নেই। কষ্ট করে যদি সেকেন্ডহ্যান্ড একটা ছোট ফ্রিজ কিনতে পারে! সে অবশ্য অনেকদিন পরের কথা। সামনে বড় খরচ ডেলিভারির-ডাক্তারের। এখন তো ওষুধের খরচ আছেই। তখন বড়মাপের খরচ; সবাই বলে জীবনের সবচয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যয়ের কাল। তার আশা ডেলিভারি নরমাল হবে। যদি নরমাল না হয় সিজারিয়ান করাতে হবে। সেখানে অনেক টাকার হিসাব। ডাক্তারেরা নাকি অপ্রয়োজনে সিজার করাতে চায়। নগদ আয়ের আশায় রোগীর স্বজনদের কলজে শুকিয়ে যাওয়া ভয়ের কথা বলে। বাচ্চা উল্টে আছে, নাড়ি পেঁচিয়ে আছে কত কী! কার সাধ্য তখন স্বাভাবিক থাকবে? এটাই তো ডাক্তারেরা চায়। এরপরে নার্স-আয়াদের বকশিস। আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি মিষ্টি পাঠানো। ডেলিভারি পরবর্তী ওষুধ-ডাক্তার। আত্মীয়-স্বজনদের ডেকে খাওয়ানো। কত কী!

না এখন সে এসব ভাবতে চায় না। ব্লাডপ্রেসার বেড়ে যাবে। যদি রাস্তায় পড়ে যায়! এখন পর্যন্ত এ অবস্থা হয়নি। কিন্তু হতেও তো পারে। দ্রুত বাসায় যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু পথ যেন ফুরাচ্ছে না। এত সব চিন্তার ভার সে বহন করতে পারে না।

সাইকেল পার্টসের দোকানগুলোর পরে কামারের দোকান। দোকানের সামনে পোড়া কয়লার স্তূপ। এর পরে তুষ-কুঁড়া-খইলের দোকান। পা যেন আর চলছে না। অডিও-ভিডিও-সিডি-ক্যাসেট-মাইকের দোকান। গান বাজছে। পুরনো হিন্দি গান, “তেরা জেব রহে না খালি ও ও ও।” হাঁটতে হাঁটতে দোকানগুলো পেরিয়ে গেলেও গান শোনা যাচ্ছে। ঐ গানটা শেষ হওয়ার পরে আরেকটা শুরু হয়েছে “ও দূর কে মুসাফির, হামকো ভি সাথ লে লে রে, হাম রহে গয়ে অকেলে।” এ গানটা শুনলে আগে চোখে পানি এসে যেত। এখন আর আসে না। তার অনুভূতি কি নষ্ট হয়ে গেছে! শুকিয়ে গেছে চোখের পানি!

বাজারের শেষের দিকে চলে এসেছে। এখানে রাস্তার পারে আর দোকান নেই। নদীভাঙ্গা-উদ্বাস্তু মানুষদের বসত ঘরের সারি। ঘরগুলোর চালে পলিথিন আর চাটাই, বেড়াগুলো বাঁশ ও চাটাইয়ের। রাস্তামুখি ঘরের ভেতরকার সবকিছুই দেখা যায়। এসব ঘরের লোকদের মানসম্মান যেন ঐ খোলা দরজার মতোই। হঠাৎ বাম পায়ে কালো শিং মাছের কাঁটার আঘাত লাগল। ছিঁড়ে গেছে বোধ হয়। পেছনে ঘুরে ঘাড় নিচু করে দেখতে গিয়ে তিনি পড়ে গেলেন মাথা ঘুরে। হাত থেকে মাছের ব্যাগগুলো পড়ে গেল। ডানহাতের ব্যাগের সোনালি মাছগুলো মরে গেছে বলে বের হল না। বাম হাতের ব্যাগ ছিঁড়ে তরতাজা কালো শিং মাছগুলো বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। ভয়ংকরভাবে কিলবিল করতে থাকল।

তিনি উঠে সেগুলো ধরার শক্তি পেলেন না। পড়েই রইলেন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত