বাসর ঘরে বসে বসে নিজের স্বামীর প্রেমের গল্প শোনা খুব একটা সহজ নয়। তবুও সেদিন আমি শুনেছিলাম। একবছর আগে রাশেদের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। রাশেদ আমার থেকে ৬ বছরের বড়। আমি তখন সবে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছি।।বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই হয়েছে। রাশেদের বাবা মা আমাকে পছন্দ করে পুত্রবধূ করে ঘরে এনেছেন। অনেক স্বপ্ন নিয়ে শশুর বাড়ি এসেছিলাম, কিন্তু প্রথম রাতেই আমার হাসবেন্ড আমাকে নিজের প্রেমের গল্প শুনিয়েছিল। সেদিন মনে মনে খুব কষ্ট পেলেও রাশেদকে কিছুই বুঝতে দেইনি। খুব মনোযোগ দিয়ে ওর কথা গুলো শুনেছিলাম।
ও তখন সবে মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছে। তখন প্রত্যূষা নামের একটা মেয়ের সাথে ও রিলেশনশীপে জড়িয়ে যায়।মেয়েটা তখন ক্লাস টেনে পড়ত। মেয়েটা হিন্দু ছিল। রাশেদ ওকে এতটাই ভালবাসতো যে একদিনও ওকে না দেখে থাকতেই পারতনা। ও প্রায়ই প্রত্যূষা আপুদের বাড়ির সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকত শুধু একবার দেখার জন্য।প্রত্যূষা আপু ও সুযোগ পেলে বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে রাশেদকে দেখা দিয়ে যেত।এভাবেই সময় কাঁটতে থাকে। রাশেদ এইচ.এস.সি পাশ করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়। তখন রাশেদ ঢাকায় চলে যায়। প্রত্যূষা আপু ও তখন কলেজের ছাত্রী। পরাশোনার জন্য তারা দুইজন দুই জায়গাতে থাকার কারণে তাদের দেখা কম হত একেবারেই তবুও তাদের প্রেম খুব সুন্দর ভাবেই চলছিল। নানা ব্যস্ততার পর সারাদিন পর আপুর সাথে একটু কথা বলে রাশেদ যেন শান্তি ফিরে পেত।।
যাই হোক, প্রত্যূষা আপুর এত কথা আমি জানি যে গুছিয়ে বলতে গেলে উপন্যাস লিখা হয়ে যাবে। ওনার প্রসংশা শুনতে শুনতে আমি হাঁপিয়ে গেছিলাম।। তাও রাশেদকে কিছুই বুঝতে দেইনি, যে আমার কষ্ট হয়। রাশেদ একটা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার। ও যতক্ষণ বাসায় থাকেনা প্রায় ততক্ষনই আমি কান্না করি। কিন্তু ও তো এটাও জানতনা যে আমি কষ্ট পাই। আসলে চাইলে হয়তো ওকে ছেড়ে যেতেই পারতাম, বা ওর সাথে ঝগড়া করতে পারতাম, কিন্তু কি লাভ হতো? নিজের স্বামীর সাথে যুদ্ধ করব অন্য একটা মেয়ের জন্য? তাছাড়া রাশেদের মনে অনেক কষ্ট জমে আছে। আমি ওর পাশে না থাকলে আর কে থাকত? ও যেমনি হোক বিয়ে করা বর আমার। কেন জানি ওকে খুব ভালবেসে ফেলেছিলাম।।
যাই হোক, অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে রাশেদ প্রত্যূষা আপুকে যদি এতই ভালবেসে থাকে তাহলে আমাকে বিয়ে কেন করল? কারণ প্রত্যূষা আপু সুইসাইড করেছিল।। রাশেদ তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। একদিন হঠাৎ প্রত্যুষা আপু রাশেদকে ফোন করে বলে- রাশেদ আমাকে তো তুমি অনেক ভালবাস তাইনা? আমার একটা কথা রাখবে?
– এইভাবে কেন কথা বলছ প্রত্যূষা? অবশ্যই শুনব। কি হয়েছে বল আমাকে
– – রাশেদ, তুমি আমাকে আগামী ১০ দিন একবারো ফোন করবেনা। ১০ দিন আমাকে ভিক্ষা দাও।।
এরপর রাশেদের কোন কথাই আপু শোনেনি।। রাশেদও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। রাশেদ অবশ্য ১০ দিন ধৈর্য্য ধরতে পারেনি। ৮ দিন অনেক কষ্টে পার করার পর ফোন করে প্রত্যুষা আপুকে পায়নি। তার বোনের কাছে তার মৃৃত্যু সংবাদ পেয়েছে। কিন্তু আপু কেন এরকম করল এইটা রাশেদ কোনভাবেই জানতে পারেনি। এরপর রাশেদ অনেক দিন স্বাভাবিক হতে পারেনি। এমনকি রাশেদ বিয়েও করতে চায়নি।ওকে জোর করে আমার সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর এই কথাটা রাশেদ আমাকে অনেকবার বলেছিল। অনেক কিছু সহ্য করেছি। আমাদের ঘরে দেওয়ালে প্রত্যূষা আপুর ছবিটার দিকে যতবারই চোখ পড়ত ততবারই নিজেকে অস্তিত্বহীন মনে হত। রাশেদের মানিব্যাগে ও আপুর ছবি ।
রাশেদ মনে হয় কখনোই আমার দিকে ভাল করে তাকায়নি, কারণ ও সবসময় ওর এক্স এর সৌন্দর্য নিয়েই ব্যস্ত ছিল৷। একদিন তো আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলল ও কেন চলে গেল? ও চলে গেল বলে গেলনা কেন?
এইভাবেই ৬ মাস কেটে গেলো আমার সংসার।আমি বুঝতে পেরেছিলাম মানসিক ভাবে আমি অনেক ভেঙে পড়েছি।একদিন হঠাৎ আমাদের বাসায় পপি আপু বেড়াতে আসে। ও আমার চাচাতো বোন। আমার থেকে ৪ বছরের বড় কিন্তু আমরা খুব বেশি ক্লোজ। আপু আমার ঘরে ঢুকেই প্রত্যূষা আপুর ছবির দিকে তাকিয়েই বিস্ময়ে আমাকে প্রশ্ন করল, প্রত্যুষার ছবি এখানে কেন?
আমি অবাক হয়ে বললাম তুমি চেনো আপুকে? পপি আপু আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, ও তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড সুমনের গার্লফ্রেন্ড ছিল।তাছাড়া ও আমার ব্যাচেরই ছিল। আমি আরো অবাক হয়ে গেলাম।। আপুর কাছ থেকে শুনলাম প্রত্যূষা আপু একটা খারাপ ছেলের খপ্পরে পড়েছিল।আপুর নাকি একসাথে ৩ -৪ তা রিলেশন ছিল। আর ফিজিকাল রিলেশন ও ছিল। এসব নিয়েই কেউ একজন আপুকে খুব বাজে ভাবে হুমকি দিচ্ছিল। আর এসবের কারণেই সে সুইসাইড করেছিল।
– পপি আপুর কথা শুনে খুব বেশি কষ্ট পেলাম। রাশেদ এসব জানতে পারলে অনেক কষ্ট পাবে।পপি আপুর জোরাজুরিতে আপুকে সব শেয়ার করতে হলো। আপু আমাকে অনেক উপদেশ দিল যাতে আমি রাশেদকে সব বলি,,, আরো অনেক কথা বলেছিল যে একটা বাজে মেয়ের জন্য তোর বর তোকে সারাজীবন অবহেলা করে যাবে? একটা সময় আপু এটাও বলল যে সেই নাকি রাশেদের সাথে কথা বলবে।। কিন্তু আমি বারণ করেছিলাম। আপুর পা ধরতে বাকি রেখেছিলাম।।বলেছিলাম – রাশেদ ওকে খুব ভালবাসে। ও জানলে খুব কষ্ট পাবে। তাছাড়া একটা মেয়ে এতদিন হল মারা গেছে তার চরিত্র নিয়ে কথা বলে কি লাভ? আর আমি রাশেদকে বড্ড ভালবেসে ফেলেছি। ওর কষ্ট সহ্য হবেনা। একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে৷ আল্লাহ আছেন। সেদিন রাতে রাশেদ আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব শব্দ করে কেঁদেছিল। আমি ভেবেছিলাম ও হয়তো আবার প্রত্যূষা আপুকে মিস করছে।
এর ৬-৭ দিন পর দেখলাম দেওয়ালে প্রত্যুষা আপুর ছবিটা খুলে রাশেদ আমাদের বিয়ের ছবি লাগিয়েছে। ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারিনি।। রাশেদকে প্রশ্ন করায় সে বলেছিল মনে হয় ভূল সুধরানোর সময় এসেছে।আমি মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ বলে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়েছিলাম।বিষয়টা নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করিনি। আর এরপর থেকে রাশেদের মধ্যে অনেক চেঞ্জ দেখেছি। ও আমার ছোট খাট গুণ গুলো খেয়াল করতে শুরু করেছে।। অনেক সময় আমার দিকে উদাস হয়ে এক মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থেকেছে৷ ঘুরতে নিয়ে গেছে, কারণে অকারণে উপহার দিয়েছে।অফিস থেকে এসেই আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে, আমি অনুভব করেছি ওর ভালবাসার উষ্ণতা। এর মধ্যে একদিন ওর মানিব্যাগে দেখলাম আমার ছবি। প্রত্যুষা আপুর ছবিটি কবে সরিয়ে ফেলেছে আমি জানিনা।
এইভাবে খুব সুন্দর ভাবে দিন চলছিল। কিন্তু এর মধ্যে একবারও ও আমাকে ভালবাসি কথাটা মুখে বলেনি।
এইভাবেই দিন যেতে থাকল। গতকাল রাতে ঘুমিয়ে গেছিলাম। হঠাৎ রাশেদ আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে প্রথম বলল- দীপা, তোমাকে খুব ভালবাসি৷ আর তোমাকে অনেক শ্রদ্ধা করি।। আমার কপাল আমি তোমার মত এত বড় মনের একজনকে জীবনে পেয়েছি। সেদিন যদি তোমার আর পপি আপার কথা গুলো না শুনতাম তাহলে হয়তো বুঝতেই পারতামনা ভালবাসা কি? তারপর রাশেদ আমার গালে, কপালে আরো অনেক চুমু দিল।
আমি ঘুমের ভান করে সব কথা শুনলাম। আমার আর বুঝতে বাকি রইলনা যে রাশেদ সেদিন সবই শুনেছে। আর তারপর নিজের ভূল গুলো শুধরে নিয়েছে। আমাকে ভালবেসেছে।এটাই বা কম কি? আমি ঘুমের ভান করে রাশেদের আদর অনুভব করলাম।
রাত কেটে গেলো। আজকের সকালটা একদম আলাদা ছিল। নিজেকে এত সুখি আগে কখনও মনে হয়নি। আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী।। রাশেদ অফিসে যাবার আগে আমাকে রেডি হয়ে থাকতে বলেছিল। আজ ঠিক ৪.৩০ এ ও আসবে আমাকে বাইরে নিয়ে যাবে। এখন বাজে ৩.৪৫। আমি কখন থেকে রেডি হয়ে বসে আছি। সময় কাটছেনা। আজ অপেক্ষা করতেও অসম্ভব ভাল লাগছে৷