নিয়তির সাত রং

নিয়তির সাত রং

হাতে মৃদ্যু ব্যাথা লাগতেই আমি কুকড়ে উঠি৷ চোখ কচলে পাশে থাকায়৷ মালিহা ফোকলা দাঁতে হাসি দেয়৷ আমিও মৃদ্যু হাসি৷ মালিহা আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে৷ এটা রোজকার রুটিন৷ পিচ্চিটা প্রথমে রুমে ঢুকে আমার নাকে-মুখে তার তুলতুলে ছোট ছোট হাতগুলা দিয়ে হাত বুলোবে৷ ঐ হাতের পরশে আমার ঘুম ভাঙা দূরে থাক৷ উল্টো ঘুমটা গাঢ়ো হয়ে আসতে চায়৷ তখন সে একটু রাগে৷ তারপর কুট করে হাতে কামড় বসিয়ে দেয়৷ ঘুম ভাঙার জন্য এটুকুই যথেষ্ট আমার৷ চুলে বিলি কেটে আমি জিজ্ঞেস করি,

-খেয়েছো?”

মালিহা না সূচক মাথা নাড়ায়৷ আমি জানি আমাকে ছাড়া ও সকালে কিছু মুখে দেয় না৷ ওর আম্মু খাওয়াতে চাইলেও খায় না৷ আপা মাঝেমধ্যে আমাকে হেসে বলে,

-আমিও মরে গেলেও চিন্তা নেই৷ আমার মেয়েটা তুই পালতে পারবি৷” আপার কথা শুনে আমি মন খারাপ করি৷ আপা বুঝতে পারে সেটা৷ আমার কান টেনে বলে,

-মজা করেছি পাগল৷”

এই শহরে আমি ছিলাম চালচুলোহীন এক নিঃস্বঙ্গ প্রাণী৷ আমার ইচ্ছের প্রসারণও খুব একটা ছিল না৷ আমার যে ক’জন বন্ধু-বান্ধব ছিল৷ তাদের স্বপ্ন ছিল, লাইফ স্যাটেল করবে, সুন্দর একটা বৌ হবে৷ গাড়ি, বাড়ি আর হানিমুন হবে দেশের বাইরে৷

আড্ডায় যখন ভবিষ্যতের কথা উঠতো৷ যে যার স্বপ্নের কথা বলার পর আমার বলার পালা আসতো৷ আমি সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে বলতাম, তোদের যে কারো মালাকানাধীন বিল্ডিংয়ের ছাদের কোণের এক রুমের বাসাটা হবে আমার৷ সারাদিন উদ্দেশ্যহীনের মতো ঘুরবো৷ সন্ধ্যা হলেই জ্যোৎস্নার আলোতে বিড়ির ধোঁয়া উড়াবো৷ ও হ্যা! আমাকে কিন্তু ফ্রিতে থাকতে দিবি বুঝলি!” সবাই হো হো করে হেসে উঠতো৷ আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম৷ তারপর দৃষ্টিটা নামাতাম৷ আমার চোখ পড়তো দু’টো গভীর চোখের নজরে৷ মেয়েটার নাম নিশি৷ আমাদের ফ্রেন্ডসার্কেলের৷ যথেষ্ট সুন্দরী৷ আমার খুব একটা মেশা হয়না মেয়েটার সাথে৷”

তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকলো৷ সবাই যে যার মতো৷ বন্ধুদের ফ্ল্যাটে ফ্রী থাকার চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলেছি৷
একটা চাকরীর খোঁজে৷ খেয়ে পড়ে বাঁচার মতো চাকরি৷ এক রুম বাসা ভাড়া আর একপ্যাকেট বিড়ি টানার মতো বেতন হলেই হবে৷” বেগ পেতে হলোনা খুব একটা৷ লেখাপড়া জিনিসটার দাম এখনো ততটা কমেনি৷ যতটা আমরা বলি৷ দরকার ছিল সার্টিফিকেটের৷ বেতনটাও খারাপ না৷ ভালো একটা রুমের বাসা পাওয়া যাবে৷ সিগারেটের ব্যাপারটা হিসেবের দরকার নেই৷ দিব্যি চলবে৷” চাকরির সুবাদে আমার পরিচয় হয়েছিল সাদিক ভাইয়ের সাথে৷ আমি বুঝি মানুষটা প্রচন্ড ভালো মনের৷ আমার পাশের ডেস্ক এর মানুষটা৷ আমার সাথে বড়-ছোট ভাইয়ের মতো হয়ে গিয়েছিল৷ পরিচয়ের কয়েক দুপুর পেরোতেই আমাকে একদিন হুট করে বলল,

-কিরে তুই লান্ঞ্চ আনিস না?”

সাদিক ভাইয়ের কথায় আমি মৃদ্যু হাসি৷ সাদিক ভাই কপট রাগ দেখিয়ে বলে, জোক্স বলেছি নাকি?” আমি মাথা নাড়ায়৷ আমার পুরোটা বলি আমি৷ সাদিক ভাই আমার হাতটা খপ করে ধরে বসায় তার পাশে৷ হট পট থেকে ভাত আর তরকারী বের করে দু’ভাগ করে৷ আমার রুচি নেই৷ তবুও সাদিক ভাই গেলায় জোর করে৷ শাসনটা আমার ভালো লেগেছে৷ এই জীবনে আমাকে কেউ কোনোদিন শাসন করেনি৷ তবুও আমি শাসনের আড়ালে থাকা ভালোবাসাটা বুঝি৷” একদিন হুট করে সাদিক ভাইকে বলি,

-ভাই আমাকে এক রুমের বাসা খুঁজে দিবেন?” সাদিক ভাই চোখ নাচিয়ে বলে, এখন কয় রুমের বাসায় থাকিস?”

-সাবলেট থাকি৷”

জবাব দেই আমি৷ পরদিন সকালে সাদিক ভাই আমার সামনে হাজির হয় হাসিমুখ নিয়ে৷ আমার কাঁধ চাপড়ে বলল, বাসা পেয়েছি৷ আজ রাতেই চলে আসিস৷” আমি সাদিক ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞতা জানালাম৷ আমার গোজগাছের ঝামেলা নেই৷ যা ছিল গুছিয়েই সাদিক ভাইয়ের কাছে হাজির হলাম সন্ধ্যা পেরোতেই৷ চায়ের পর্ব শেষ করেই বললাম,

-এবার যাওয়া যাক?” সাদিক ভাই উঠে দাঁড়ালো৷ দরজা লাগিয়েই সাদিক ভাই উপরের সিড়ি বেয়ে উঠা শুরু করে৷ আমি ঠায় দাঁড়িয়ূ থাকি৷ খানিকবাদেই সাদিক ভাই পেছনে ফিরে বলল,

-কিরে উঠ৷”

আমিও পেছন পেছন উঠি৷ রুমটা দেখেই আমার মনটা ভালো হয়ে গেল নিমিষেই৷ আমি সাদিক ভাইকে আবারো কৃতজ্ঞতা জানায়৷ সাদিক ভাই বলল, ব্যাচেলর ভাড়া দিতে চায় না বাড়িওয়ারা৷ তুই আমার ছোটভাই বলে নিয়েছি৷” আমি আবারো ধন্যবাদ দেই৷ সাদিক ভাই আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, মিথ্যে বলেছি? তুই তো আমার ছোট ভাই এই৷” সাদিক ভাই নিচে নামে৷ আমি বসে রইলাম৷ খানিক বাদে দরজায় ঠুকঠুক শব্দ৷ দরজা খুলে দিই আমি৷ সাদিক ভাইয়ের সাথে আরো দু’জন৷ সাদিক ভাই পরিচয় দেয়, তোর ভাবী আর ভাতিজি বুঝলি৷ পিচ্চিটার দিকে হাত মেলে দিতেই কোলে উঠলে বসলো৷ আমি তুলতুলে গালটাতে চুমু দিয়ে সাদিক ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,

-ভাগ্নী আর আপা আমার৷ তুমি মিয়া দুলাভাই আমার৷” সাদিক ভাই হাসে হো হো করে৷ হাসিয়ে থামিয়ে বলল,
-এতোদিন তো ভাই ডাকতি৷ আজ দুলাভাই বানালি হঠাৎ?”
-শালা-দুলাভাই মিলে বিড়ি টানা যায়৷ বড় ভাইয়ের সামনে ওসব করা যায় নাকি?” পাশ থেকে আপা বলে উঠল,
-দু’টোকে এক রশিতে বেঁধে পেটাবো বুঝলি৷”

হাসির রোল পড়ে আমার ছোট্ট রুমটাতে৷ তারপর থেকেই ভালোবাসার শুরু৷ আমার অতীতটা আমার ভেতরে খুঁড়ে না আর৷ আমার জীবনটা চাকরি আর মালিহা নামক পিচ্চিময় হয়ে উঠলো৷ তারপর একটা ব্যস্ত দিন শেষে শেষবিকেলে মালিহার কাছে ফেরার তাড়া৷ পেছন থেকে একটা নারীকন্ঠ৷ আমি থমকে দাঁড়াই৷ সেই গভীর চাহনীর দু’টো চোখ৷ আমি প্রথম চাহনীতেই বুঝতে পারি মেয়েটা নিশি৷ তবুও না চেনার ভান করি৷ নিশি সামনে এগিয়ে আসে গুটি পায়ে৷

-চিনতে পেরেছিস?” আমি হ্যা বোধক মাথা নাড়ি৷
-কিভাবে?” পাল্টা প্রশ্ন করে নিশি৷

-চোখ দু’টো৷”

কফি খাওয়ার আবদার করে নিশি৷ আমিও সায় দেই৷ মুখের পর্দাটা খুলল নিশি৷ আগের চেয়ে নাদুস নুদুস হয়েছে একটু৷ চেহারায় মায়া বেড়েছে খানিকটা৷ আমি লুকিয়ে তাকায়৷ আবার চোখ সরিয়ে ফেলি৷ নিশির সাথে আমার আগের জড়তাটা এখনো কাজ করছে৷ কফির মগে চুমুক দিয়ে নিশি বলল,

-কি করছিস এখন?”
-এইতো চাকরি৷ যেমনটা আমি চেয়েছিলাম তেমনটাই চলছে৷ তোর?
-চলছে৷ তবে যেমনটা চেয়েছিলাম৷ তেমনটা হয়নি!”
-কেমনটা চেয়েছিলি?”

আমি জিজ্ঞেস করি৷ নিশি ধীরে সুস্থে ঊত্তর দেয়ার প্রস্তুতি নেয়৷ আমার ফোনটা বেজে উঠে৷ ঘড়ির দিকে তাকালাম৷ ১০মিনিট পেরিয়ে গিয়েছে৷ পিচ্চিটার স্বভাব হয়েছে৷ একটু এদিক ওদিক হলেই আপার কাছ থেকে ফোন নিয়ে নিজেই কল করে বসে৷” আমি “আসছি” বলেই ফোনটা রেখে দেই৷ নিশি জিজ্ঞেস করে,

-কে?
-আমার মেয়ে!”

নিশি মৃদ্যু হেসে বলল, বাহ মেয়েও আছে৷” আমি হাসি৷ উঠার তাড়া দেই৷ আর কথা হয়নি আমাদের৷” আজকাল হুটহাট নিশিকে মনে পড়ে আমার৷ পরক্ষণেই ভাবি, আমার কী আছে? আমি কে?” যদি চালচুলোহীন না হতাম৷ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিনই নিশিকে বলে বসতাম,

-আমার হবি?”

রুমের দরজায় ঠুকঠুক শব্দ হয়৷ আমি মালিহার দিকে তাকায়৷ পিচ্চিটা ঘুমিয়ে পড়েছে আমার বুকে৷ এটাও রোজকার নিয়ম৷ আমি জাগাতে এসে সে ঘুমিয়ে পড়ে৷ দরজার ওপারে আপা দাঁড়িয়ে৷ সেটা আমি খুব জানি৷ রুমে ঢুকেই রুম গোছানো শুরু করবে৷ আর আমাদের অলসের সর্দার বলে ঝাড়বে খানিকক্ষণ৷ আমি মালিহাকে যত্ন করে শোয়ায়৷ দরজার ওপাশের চেহারাটা দেখে আমার আকশ থেকে পড়ার অবস্থা৷ নিশি মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে৷ নাকটা হালকা লাল হয়ে আছে৷ ভয়ংকর চোখে তাকায় আমার দিকে৷ আমি আস্তে করে বললাম,

-তুই?” নিশি জবাব দেয়না৷ ধাক্কা দিয়ে সরায় আমাকে৷ রুমের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বলল,
-এই গরুর গোয়ালে রাখবি আমাকে?” আমি মাথা নাড়ায়৷ মালিহা মেয়েটা টুপ করে নিশির কোলে উঠে বসে৷ আমি ভ্রু কুচকিয়ে মালিহাকে বলি,

-চিনো?” মালিহা মাথা নাড়ায়৷
-কে?
-খালামণি!” আমি নিশির দিকে তাকালাম৷ নিশি রাগ দেখিয়ে বলল,
-মিথ্যে বলেছিলি কেন?
-কখন?
-সেদিন৷
-মালিহা আমার মেয়ের মতো৷” জবাব দেই আমি৷ মালিহাকে পাশে বসিয়ে নিশি আমার সামনে এসে মিনমিন করে বলল,
-এতো অমানুষ ক্যান তুই?
-কেন?
-তুই জানিস একটা মেয়েটা তার আশপাশের অনেক কিছুই সহজে অনুভব করতে পারে?

যত সহজে অনুভব করে ততটা সহজে বলতে পারে না৷ আমি জানি তুই চালচুলোহীন ছিলি৷ তাই ভালোলাগাটা বলতে পারিসনি৷ তবুও আমি চেয়েছিলাম তোকে৷ কিন্তু বলতে পারিনি৷” তুই সেদিন কফিশপে যখন বললি “আমার মেয়ে” আমার ভেতরটা মুচড়ে উঠেছিল বুঝলি৷ তবুও তোর চোখে আমাকে পাওয়ার উচ্ছাসটা আমি দেখেছি৷ আজ আপার ফ্যামিলি ফটোতে তোকে দেখেই ছুটে এসেছি বুঝলি ছেলে৷ উপরে একজন আছে বুঝলি৷ উনি কাউকে নিরাশ করেন না৷

তারাতারি চলে আয়৷ বিরিয়ানী রেঁধেছি৷ তুই না বললেও আমি জানি এটা তোর প্রিয়৷” মালিহাকে কোলে নিয়ে একরকম উড়ে গেল নিশি৷ আমি ধীরপায়ে ছাদের কোণটাতে গিয়ে দাঁড়ায়৷ কালরাতের আধপোঁড়া সিগারেটটা শেষ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বললাম “জীবন তুমি নিয়তির সাত রং”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত