নায়ক

নায়ক

গ্রামের নাম সুয্যুখোলা। দু-চার ক্লাস লেখাপড়া জানা মানুষজন কাগজে-কলমে লেখার সময় লেখে সূর্যখোলা। এই সুয্যুখোলা গ্রামের প্রান্তে বন-বনানীর মাথা ফুঁড়ে সূর্য ওঠে বেশ খানিকটা দেরিতে। আবার সূর্য ডোবার আগেই আঁধার ঘনিয়ে আসে। নিকষ কালো অন্ধকার। সেই ঘনঘোর অন্ধকারে চেনা জানা মানুষগুলোই যেনবা পরস্পরের অচেনা হয়ে যায়। সবার চোখেমুখে চেপে বসে চাপ চাপ গাঢ় অন্ধকার।

কিন্তু সহসা গতকাল আমেনার চোখে এই অন্ধকার ফিকে হয়ে আসে। নারী অধিকার নিয়ে ডালপালা ছড়ানো নানান কথা এর আগেও অনেক শুনেছে। সপ্তাহান্তে গ্রুপ মিটিংয়ে প্রশিকার রাবেয়া আপা বক্তৃতা শুরু করলে কেউ কেউ বিশাল আকৃতির হা করে হাই তোলে বটে, আবার অনেকে জেগেও ওঠে। নড়ে চড়ে বসে। কিছুতেই তবু ভেতরের অন্ধকার ঘোঁচে না। উপজেলার নারী সমাবেশ থেকে ফেরার পর কোথা থেকে যেন এক ফালি আলোর ঝিলিক এসে আমেনার সমগ্র চেতনা জুড়ে প্রবাহিত হয়। সারা শরীর তার কেঁপে উঠে। রাত গভীর হয়, আলোর রেখাটি ধীরে ধীরে এঁকেবেঁকে একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষের আদল নেয়। হৃষ্টপুষ্ট তাগড়া জোয়ান। উজ্জ্বল, ধারালো দুটি চোখ। গাল জুড়ে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। দুহাতের তালুতে চোখ রগড়ে আমেনা আবার তাকায়। চোখের পাতা বন্ধ করে আবার মেলে ধরে। কুড়ি বছর আগের সেই চেহারা। শক্ত চোয়াল, কপালের উপর চুল ঝুলিয়ে টেরি কাটা। বিয়ের পর বেশ ক’বছর লোকটা ভীষণ সৌখিন ছিল। আমেনার জন্যে কতোদিন চুলের ফিতা, পুঁতির মালা এনে দিয়েছে। মোমেনা জন্মাবার পর ফিতা-মালা-ঝুমঝুমিতে ছোট্ট দুটি হাত ভরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এতদিন পর এসব সাতকাহনের গাওনা কেন মনে আসছে! মোমেনার বাপ তো আজ তার কেউ নয়! সমাজের গণ্যিমান্যি মানুষের মধ্যে খবির মুন্সী সেই কবে জানিয়ে দিয়েছে-মোতালেব তার কেউ নয়, আরো দশ জন পরপুরুষের মতোই পরপুরুষ। রীতিমতো উদাহরণসহ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে সেদিনের মজলিশকে বুঝিয়ে দিয়েছে– এক কোপেই যদি গাছ কাটে, তা হলি আর তিন কোপের দরকার কী বোলো! যুক্তি গভীরতা বুঝে সবাই চুপ করে থাকলেও মোতালেব ঘাড় গোঁজ করে উঠে দাঁড়ায়। হাতের মুঠোয় হাত কচলে দাবি জানায়-আমি তো রাগের মাথায় একবার মাত্র…। মুখের বাক্য তার শেষ হয় না। খবির মুন্সী হাতের বাঁকা লাঠি উঁচিয়ে বলে– আরে বেতমিজ, রাগের মাথায় বিষ খালি কি ঐ বিষি কাজ করবে না? এ্যাঁ? রাগ পইড়ি গেলি তোর বিষ নাইমি যাবে? গর্ধভ কোথাকার! এরপর গমগমে ভাষায় কোরানের আয়াত আবৃত্তি করে উপস্থিত সকলের চোখে চোখে একবার তাকায়। তারপর আরো একটি উদাহরণ দেয়ার লোভ হয় তার। অনির্দিষ্ট কাউকে উদ্দেশ্য করে বলে-মনে কর, আড়াই পোঁচে মুরগি জবাই করার নিয়ম আছে। কিন্তু তুমি এক পোঁচেই মাথাডা নামিয়ি দিলি ধড় থিকি। তা হলি সেই মুরগি কি বাঁচপে, না মরবে? এই অকাট্য উদাহরণের মর্ম বুঝে সবাই মাথা হেঁট করে থাকে। কেবল ভেতরে ভেতরে তড়পায় মোতালেব। অন্তরের তড়পানিতে অস্থির, আবার উঠে দাঁড়ায়। চোখের তারায় গনগনে জিজ্ঞাসা– আমার পরিবার…? খবির মুন্সীর হুঙ্কারে তলিয়ে যায় তার কণ্ঠ, পরিবার? কার পরিবার? আমেনা এখন তোর কেউ নয়। ওর দিকে হাত বাড়ানো মহাপাপ। সেই পাপের শাস্তি ভয়ানক! সাবধান!

কল্পিত সেই ভয়ানক শাস্তির ভয়েই হোক আর অন্য কোনো কারণেই হোক, কঠোর সাবধান বাণী উচ্চারিত হবার পর মোতালেব কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ে খবির মুন্সীর পায়ের কাছে। সংখ্যায় অল্প, কিন্তু পাকাপোক্ত দাড়ির গোছায় হাত বুলাতে বুলাতে মুন্সী তার কণ্ঠ খানিকটা কোমল খাদে নামিয়ে এনে বলে,

– সুতো কাটা ঘুড়ির জন্যি মন ক্যামুন করে, নাকি রে মোতালেব? তুই তো আর ছেইলি মানুষ না, বুইঝি দ্যাখ, ঐ ঘুড়ি উড়তি উড়তি গিয়ি পড়ে গাছের ডালে, বন বাদাড়ে। কাঁটার খোঁচায় ছিঁড়ি একাকার। নিবি তোর ছিঁড়া ঘুড়ি?

মোতালেব নিরুত্তর। খবির মুন্সীর এই উপমাখচিত কথার মারপ্যাঁচ সে বোঝে না, অথবা বুঝলেও এক্ষেত্রে কী উত্তর দেয়া তার কর্তব্য সেটা নির্ণয় করতে পারে না। সে এদিকে ওদিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। খবির মুন্সী উপমার কারুকার্য ছড়ায়– মেয়ে মানুষ হলো কাঁচের গেলাস, হাত ফসকে পড়লেই সর্বনাশ। তুই কি নিবি সেই ভাঙা গেলাস? নিবি বোল? কতটা বুঝে আর কতটা যে না বুঝে কে জানে, মোতালেব ঘাড় ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়। সম্মতি জানাবার এই ভঙ্গি দেখে জমায়েতের অনেকেই খ্যাক খ্যাক করে হেসে ওঠে। কিন্তু সেই কুৎসিত হাসির তরল প্রবাহ দীর্ঘক্ষণ গড়িয়ে যেতে না দিয়ে খবির মুন্সী হুঙ্কার ছাড়ে-খামোশ! কোনো দ্রুতযানে হঠাৎ হাওয়া ব্রেক কষার মতো সম্মিলিত হাসির কোরাস ঐখানে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর ভারি গলায় আদেশ হয়– এ্যাই নূরাল, রব্বানী, যা; হাবাগোবাকে ধইরি নিয়ি আয়।

এরপরের সম্ভাব্য দৃশ্য প্রায় সকলেরই জানায়। সুয্যুখোলার মানুষ এ ধরনের নাটক বহুবার দেখেছে। নাটকে অন্যান্য পাত্রপাত্রীর পরিবর্তন হলেও খবির মুন্সী এবং হাবাগোবার ভূমিকা সর্বদা অপরিবর্তনীয়। হাবাগোবার প্রকৃত নাম শুকুর আলী। গায়ের রং কালো মিশমিশে। বেঁটেখাটো নাদুস নুদুস বিশাল ভুঁড়িসর্বস্ব দেহ। মাথায় চুল নেই। মুখে অবিরল ধারায় লালা গড়াচ্ছে। অস্পষ্ট উচ্চারণে যা দু-চারটি কথা বলে তা খবির মুন্সীর মতো গুটিকতক লোক ছাড়া কেউ বিশেষ বোঝে না। সুয্যুখোলায় এ ধরনের মজলিশ বসলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার ডাক পড়ে। তবে শুকুর আলী নামে নয়। পিতৃদত্ত ঐ নাম অনেক আগেই হাবাগোবা চরিত্রের আড়ালে হারিয়ে গেছে। পাশের গ্রাম মদনাডাঙ্গাতেও নাকি একবার তার ডাক পড়েছিল। ধর্মীয় অনুশাসন এবং সামাজিক বিধান রক্ষার স্বার্থে হিলা বিয়ের বর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয় তাকে। ঐ তো মোটে কদিনের সংসার! যার জিনিস সে-ই ফেরত নেবে, সে কেবল ঐ কদিনের পাহারাদার। কষ্ট হলেও লাল গড়ানো মুখে হাসি ফুটিয়ে সে দায়িত্ব পালন করে যায়। দশ জনে তাকে মান্য করে দায়িত্ব দিলে সে প্রত্যাখ্যান করে কী করে! অবশ্য রাত বিরাতে প্রায়ই খবির মুন্সীরা এসে তার দাম্পত্য জীবনের খোঁজ খবর নিয়ে যায়। লোকে বলে, মদনাডাঙ্গার বৌটাকে সে নাকি ভালোবেসে ফেলেছিল, অন্যান্য বৌগুলোর মতো এক কথায় তাকে ছাড়তে চায়নি। এ নিয়ে খবির মুন্সীর সঙ্গে তার এক রকম খিটিমিটিও নাকি হয়েছিল। কিন্তু সে অত্যন্ত ক্ষণিকের বিসংবাদ। এরপরও ডাক পড়লেই সে চলে আসে। তাকে ডাকতে যাওয়া এবং মজলিশে এনে হাজির করার ব্যাপারটা উৎসবের মতো হয়ে দাঁড়ায়। ডেকে আনার দায়িত্ব দেয়া হলো নূরাল এবং রব্বানীকে, কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল সমাজ উদ্ধারের এই মহৎ কাজে ছেলেবুড়ো আরো অনেকেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পিছনে এক দঙ্গল মানুষের মিছিল নিয়ে লালা গড়াতে গড়াতে জমায়েতে হাজির হলো হাবাগোবা। বাড়ি থেকে বেরুনোর সময় উৎসাহী জনতার চাপে তাকে টুপিটা মাথায় দিতেই হয়। কিন্তু খবির মুন্সীর দেয়া লাল পাঞ্জাবিটা কিছুতেই গায়ে দেবে না। শীত গ্রীষ্ম নির্বিশেষে উদোম গায়ে থাকতেই সে পছন্দ করে। জনতার চাপে কখনো কখনো পাঞ্জাবিটা এ কাঁধ থেকে ও কাঁধে চালান করে দিয়ে স্বস্তি খোঁজে। সেদিন এই কাঁধ পাল্টানোর খেলার এক পর্যায়ে হাবাগোবার হাত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। হাত থেকে টুপ করে খসে পড়ে লাল পাঞ্জাবি। মোতালেবের চোখের অগ্নিগোলক থেকে সে চোখ সরাতে পারে না। কিন্তু মোতালেবই হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করে-এই হিলা বিয়ের প্রয়োজন নেই। সে মোমেনার মাকে আর ফিরিয়ে নেবে না।

এ ঘোষণা শোনার পর উপস্থিত মজলিশ বড্ড হতাশ হয়; একটি রগরগে বিবাহদৃশ্য দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় এবং আলোচনার গতিমুখ পাল্টে যায়।

সত্যিকারের কথায় সেদিনের এ ঘোষণায় আমেনারও বুক ভেঙ্গে যায়। দীর্ঘ ষোল-সতের বছরের দাম্পত্য জীবনে সে মোতালেবকে যেটুকু চিনেছিল, তাতে বুকের খুব নিভৃত গভীরে একটু অন্য রকম প্রত্যাশা জেগেছিল। লোকটা একটু ঘাড় বাঁকা, গোঁয়ার প্রকৃতির বটে, কিন্তু তার ভেতরটা কচি ধানের মতো সবুজ, লকলকে। রেগে গেলে চৈত্রের মাটি ফাটা মাঠ। আমেনা বহুবার হিসেব কষে দেখছে, কথার ওপর কথা দেয়া একদম সহ্য করতে পারে না লোকটা, তখন চাঁদিতে রাগ চড়ে যায়। রাগের মাথায় ঐ বেফাঁস কথাটা একবার বলে ফেলার পর, বেশ খানিক পর তার মন হয়ে যায় সবুজ ধানের ক্ষেত। যেন বা কচি পাতাগুলো বারবার নুয়ে পড়ে। সারারাত ঘুরে ফিরে একই প্রশ্নে দগ্ধায় মোমেনার মা, তুই আগ করিসনি তো! রাগ করবে কি, সন্ধ্যে বেলায় নতুন মেয়ে জামাই এসেছে, তাদের সামনে লোকটার আদিখ্যেতা দেখে সে শরমে মরে যায়। আমেনার দোষ বলতে, এই মেয়ে জামাইকে দাওয়াত দিয়ে বাড়ি আনার কথাটা সে অসময়ে তুলেছিল। পাড়ায় রোগ বালাই ঢুকেছে, সবার ঘরে ঘরে মোরগ মুরগি মরতে শুরু করেছে। জামাইয়ের জন্যে আগলে রাখা লাল মোরগটার কখন কী হয় বলা যায়! শেষকালে জানের পস্তানির একশেষ! সেই তড়াশে আমেনার এতো আকাবাকি। কিন্তু মোতালেব এতো জানপস্তানির খবর জানে না। আব্দুল বারেক অত্যন্ত ভালো ছেলে এ বিষয়ে তার ভিন্নমত নেই। কোনো দাবি দাওয়া ছাড়াই নিজে যেচে মোমেনাকে বিয়ে করেছে, এ জন্যে আনন্দে কৃতজ্ঞতায় মোতালেবের বুকের ভেতরটা সেই প্রথম থেকেই একেবারে নুয়ে আছে। বাড়িতে জামাই এলে সেও খুব খুশি হয়। এপাড়া ওপাড়া বিয়ে, যখন খুশি ওরা আসবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাই বলে কি যখন তখন মেয়ের বাড়ি যাওয়া যায়! অথচ মোতালেব ঘাড় বাঁকা করে সেই জবাবই দেয়– অতোই যদি জান পোড়ে তো দৌড়ি গিয়ি দেইখি আয় গা না! কথার পিঠে কথা বাড়ে, সেই কথায় কথায় আবার রাগ চড়ে। অথচ সেই মোতালেবই বেলা ডোবার আগে আগে পশ্চিম পাড়ায় গিয়ে মেয়ে জামাই ডেকে আনে। তাতেও তার অন্তরে স্বস্তি হয় না, মেয়ে জামাইয়ের উপস্থিতিইে খুনসুটি করে, ঘুরে ফিরে একই কথা শুধায়– আগ করিসনি তো!

সেই পলিমাটি মাখা মানুষটি কিনা প্রকাশ্য জমায়েতে জানিয়ে দেয়– আমেনাকে সে আর ফিরিয়ে নেবে না! আমেনা তখন কোথায় যায়? কার কাছে দাঁড়ায়? দুই কূলে তার কে আছে? নিরাশ্রয়ের আশ্রয় হয়ে দাঁড়াতে চায় খবির মুন্সী। কিন্তু আমেনার তখন বমির উদ্রেক হয়। মুখে আঁচল চেপে কোনো মতে এক বস্ত্রে সে উদ্ভ্রান্তের মতো পথে বেরিয়ে পড়ে। পায়ে পায়ে গ্রাম্য পথে ধুলো উড়িয়ে এগিয়ে চলে, কিন্তু কোথায় তার গন্তব্য জানে না। একবার তার মোমেনার মুখ মনে পড়ে। কিন্তু সে পশ্চিমপাড়ায় কিছুতেই যাবে না। এ পোড়ামুখ কচি মেয়েটাকে কিছুতেই দেখাবে না। আকাশের ক্ষীণকায় চাঁদ মেঘে ঢাকা পড়েছে। চারিদিকে গা ছমছমে অন্ধকার। সেই নিকষ অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে আমেনা চলে আসে সুয্যুখোলার শেষ প্রান্তে, মাঠপাড়ায়। লতায়পাতায় জড়ানো পিতৃবয়স্ক খালাতো ভাই শামু ঘরামির বাড়িতে ওঠে। এই লোকটিই ছিল তাদের বিয়ের ঘটক। সেই বিয়ে ভেঙে যাবার পর আবার তার কাছেই আশ্রয় নিতে হয়। কিন্তু মোমেনার বাপ সে কথা জানল কী করে! সে কি তবে তক্কে তক্কে ছিল! নাকি এই তার ধারণা হয়েছে যে আমেনার দৌড় এই ঘরামি বাড়ি পর্যন্তই! রাত নিশুতি হবার পর সুয্যুখোলা গ্রাম যখন নিঝুম নিস্তব্ধ, সেই মধ্যরাতে মোতালেব এসে হাজির শামু ঘরামির বাড়ি। মোতালেবের প্রস্তাব শুনে নিরেট অন্ধকারও বুঝিবা খানখান হয়ে ভেঙে পড়ে। আমেনাকে নিয়ে সে রাতের অন্ধকারেই গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে, দূরে কোথাও, এই তার ইচ্ছে। শামু ঘরামির তালাক খাওয়া মেয়ে আকলিমা এ সময় অকারণে হু হু করে কেঁদে ওঠে। কান্না শুনে তার ছেলেমেয়ে দুটি জেগে উঠে চেরাগের আলোয় ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়। আমেনা চেতনাশূন্য হয়ে বসে থাকে। শামু ঘরামি শক্ত গলায় সিদ্ধান্ত জানায়-এ হয় না মোতালেব। সমাজ আছে, পাগলামি করিস নি। যা ওঠ, বাড়ি যা। মোতালেব বেপরোয়া হয়ে ওঠে– সমাজের মুখে আমি মুতি। আমার বৌ আমি নেব, তুমাদের সমাজে থাকবো না শামু ভাই। এই সমাজের নাড়ি নক্ষত্রের খবর ভালো জানে শামু ঘরামি। নিজের মেয়ে সামান্য ঠুনকো অজুহাতে একঘরে হয়েছে, তালাক খেয়ে বাপের বাড়ি এসেছে, মোতালেবের পাগলামিতে সে কেন সায় দেবে! অবশেষে মোতালেব নাছোড় হয়ে বায়না ধরে, সে আমেনার মুখ থেকেই শেষ কথা শুনতে চায়। কিন্তু আমেনার তখন কী যে হয়! কণ্ঠে কোনো কথা ফোটে না। এমন কি কাঁদতেও পারে না। আকলিমা তাকে জড়িয়ে ধরে। মোতালেব মুখ খিস্তি করতে করতে করতে বেরিয়ে যায়– তুই তা হলি ঐ হাবাগোবার সাথেই ঘর কর গা মাগি। এই তোর মনে ছেল! ছি!

মোতালেব চলে যাবার পর আমেনা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। ঐ সংক্ষিপ্ত উচ্চারণের ‘ছি’ ধ্বনিটুকুই খুব বড় হয়ে বুকে বাজে। রাতের শেষ প্রহরটুকু সে বুক ভাঙ্গা কান্নায় অবগাহন করে। রাতের ঘোমটা চিরে ধীরে ধীরে দিনের রেখা যতোই পরিস্ফুট হয়, তার বুকের গভীরে জমে ওঠা কান্নার ভার ততই হালকা হয়ে আসে। এক সময় মনে হয়– ঐ কুৎসিত হাবাগোবার সঙ্গে হিলা বিয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যেই তা হলে মোমেনার বাপ প্রকাশ্য জনসমক্ষে তাকে ফিরিয়ে নিতে অসম্মতি জানিয়েছে! ভেতরে ভেতরে কৃতজ্ঞতায় নুয়ে আসে সারা অন্তর। কিন্তু রাতের আঁধারে আবার এ কেমন আহ্বান! ভেতরে বাইরে তার এ কী গোলকধাঁধা!

অচেনা এই গোলকধাঁধা থেকে প্রতিদিন মুক্তির উপায় খুঁজেছে আমেনা। পোষা পাখির যেমন খাঁচা থাকে, আমেনার তেমন কোনো দৃশ্যমান খাঁচা নেই। তবু হাজার পাখা ঝাপটানিতেও সে মুক্তির পথ খুঁজে পায় না। কতদিন মনে হয়েছে, মোমেনার বাপ যদি আরো একবার ঘুরে আসত! হোক না রাতের আঁধারে! তবু তার চোখের গভীরে চেয়ে দেখত-সত্যিই সে কী চায়! এক বিছানায় শুয়ে কত নির্ঘুম রাতে মনে হয়েছে, আকলিমাকেই মনের কথা খুলে বলে। সম্পর্কে মেয়ে হলেও সমবয়সী বলে কতো রকম কথাই তো হয়! কিন্তু জিভের ডগায় আড়ষ্ঠতা এসে দাঁড়ায়। বলা হয় না কিছুতেই। এক সময় আকলিমা তাকে সমিতি করতে শেখায়। ব্র্যাক-প্রশিকার মেয়েদের সমিতি। ঋণ দেয়া নেয়া, হাঁস-মুরগি পালনের তদারকি করতে সপ্তাহান্তে রাবেয়া আপা আসে মোটর সাইকেল হাঁকিয়ে। মিটিংয়ে বসে কতো রাজ্যের কথা বলে। নারী অধিকার নিয়ে তার বিপুল উৎসাহ। খবরের কাগজ থেকে খুঁটে খুঁটে এই সব খবর এনে সমিতির মেয়েদের শোনায়। অতিশয় সুখাদ্য গ্রহণের মতো গ্রামের সাধারণ মেয়েরা সেই খবর হা করে গেলে। কিন্তু আমেনার তখন মোতালেবের মুখ মনে পড়ে যায়।

গতকাল উপজেলা শহরের নারী সমাবেশে গিয়ে আমেনার চক্ষু চড়কগাছ। এতোগুলো মেয়েমানুষ সে একত্রে কখনো দেখেনি। সুয্যুখোলার কুড়ি জন এক জায়গায় গুছিয়ে বসেছে, রাবেয়া আপা একবার এসে দেখেও গেছে। আশপাশের দুতিন গ্রামের বেশ কয়েকজনকে সে চিনতে পারে, কিন্তু আর সবাই অচেনা। মাইকে কান ফাটানো বক্তৃতা হয়, তার সব কথা সে বুঝতেও পারে না। কিন্তু একটা জায়গায় এসে তার কান খাড়া হয়ে যায়–ফতোয়াবাজির বিরুদ্ধে নাকি হাইকোর্ট কিসের রায় দিয়েছে। দীর্ঘ দিনের নারী আন্দোলনের বিরাট বিজয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে মাইলফলক… ইত্যাদি ইত্যাদি। বিপুল করতালিতে বক্তার কণ্ঠস্বর ডুবে যায়। এতো সব ভারি কথার অনেকটাই আমেনা বুঝে ওঠে না, কিন্তু এই সব কথা শুনতে শুনতে তার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে এবং এক সময় মোতালেবের মুখ মনে পড়ে যায়।

উপজেলা থেকে ফেরার পথে মোমেনাকে এক নজর দেখে যেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু সঙ্গে অনেক মানুষ বলেই যাওয়া হয় না। পথে আসতে আসতে হাইকোর্টের রায়ের নানা রকম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হয়। যাদের জানা আছে তারা নওগাঁর আজিজুল হাজী এবং তার যোগ্য পুত্রের ফতোয়াবাজির কেচ্ছাটাও শুনিয়ে দেয়। এখন বাপ বেটা দুজনেই নাকি জেলহাজতে সরকারি খানা খাচ্ছে। আমেনা জানেই না– এই সব নিয়েও কাগজে খবর হয়। শুনতে শুনতে মনে হয়– খবির মুন্সীর নামেও যদি একটা মামলা হতো!

কিন্তু বাস্তবে আদৌ সে রকম হয় না। বন বনানীর প্রান্ত ছুঁয়ে সূর্য মাথার উপর উঠে গেলেও সুয্যুখোলা গ্রামের অন্ধকার নিঃশেষে ঘুঁচতে চায় না। বয়সের ভারে খবির মুন্সীর শরীর জঈফ হয়ে এলেও তার ফতোয়াবাজির জোশ মোটেই কমেনি। বিন্দুমাত্র ছলছুতো পেলেই তা ফিনকি দিয়ে ওঠে। অমাবশ্যা রাতের অন্ধকারে আমেনা যখন নতুন আলোর ঝিলিক আবিষ্কার করে বিছানায় উথালপাথাল তড়পায়, তখন তারই আত্মজা মোমেনাকে ডানা গুটিয়ে পা দিতে হয় খবির মুন্সীর ফাঁদে। কী তার অপরাধ? পান থেকে চুন খসলেই সুয্যুখোলার মেয়েদের অপরাধ হয়। মোমেনার অপরাধ পাহাড়প্রমাণ। ঘরের বৌ, পরের সঙ্গে কিসের আশনাই! কলেজ পড়ুয়া মামাতো দেবরের সঙ্গে কিসের এতো ফুসুরফাসুর, রং রোশনাই? সমাজের চোখ নাই? আব্দুল বারেকের অভিযোগ থাক বা না থাক, সমাজ এ সব নষ্টামি সইবে কেন? খবির মুন্সীর সোজাসাপ্টা ঘোষণা– একেই বলে জেনা। আর এ অপরাধের সাজা হচ্ছে পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদ- কার্যকরের উদ্যোগ নেয়া হয়। এ সময় মানববৃত্তের ভিড় ঠেলে উদ্ভ্রান্তের মতো আমেনা এসে আছড়ে পড়ে খবির মুন্সীর পায়ের কাছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় খবির মুন্সী। সোজা আব্দুল বারেকের কাছে এসে লাঠির খোঁচা দিয়ে বলে– বাঙ্গালকে হাইকোর্ট দ্যাখাবি শালা! যা, তোর খানকি বৌকে নিয়ি আয়।

এ আদেশ পালনে বারেককে একেবারে নিস্পৃহ দেখে খবির মুন্সী গলার স্বর এক পর্দা নামিয়ে এনে বারেকের কাঁধে হাত রাখে এবং জোরে ধাক্কা দিয়ে বলে-এই সমাজে বইসি তুই হারাম খাবি, এ্যাঁ? ঐ ছিনাল নিয়ি ঘর করা আর হারাম খাওয়া এক কথা। তুই তা হলি হারাম খাবি? বারেক কোনো জবাব না দিয়ে একবার কেবল চোখ তুলে তাকায়। খবির মুন্সী তখনই দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় কৌতূহলী জনতার দিকে এবং হঠাৎ কী মনে করে তার পূর্ব ঘোষিত শাস্তির কিঞ্চিৎ সংশোধনী পেশ করে– পাথর নিক্ষেপের দরকার নেই। এক শ’ ঘা দোররা মারলেই হবে। যা, তোর বৌকে নিয়ি আয়। হাইকোর্ট দেখুক।

যেন বা দণ্ড অনেক লঘু করা হয়েছে, বারেক এইবার খুশি হয়ে তার বৌকে ধরে এনে তুলে দেবে এই নিবীর্য জনতার হাতে, সবাই সেই রকমই আশা করে। কিন্তু বারেক মোটেই নড়ে না। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ আগে অত্যন্ত নিম্নকণ্ঠে একবার হাইকোর্টের ফতোয়াবিরোধী রায়ের কথা উঠেছিল বটে, কিন্তু খবির মুন্সীর বজ্রনির্ঘোষ ধমকানির স্রোতে তা তক্ষুণি তলিয়ে যায় এবং কে এ প্রসঙ্গের উত্থাপনকারী তাও আর নির্ণয় করা সহজ হয় না। এতক্ষণে টের পাওয়া যায়, ঐ প্রসঙ্গটি একেবারে নিঃশেষে তলিয়ে যায়নি! লাঠির খোঁচাতেও বারেককে নড়ানো যাচ্ছে না দেখে ফরমান এবং কালু খলিফার উপর আদেশ হয় মোমেনাকে ধরে আনার জন্যে। হুকুম তালিমের উদ্দেশ্যে তারা অতি দ্রুত পা বাড়ায়। কিন্তু সহসা কোত্থেকে মোতালেব এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়। এই সুয্যুখোলা গ্রামের অতি সাধারণ মানুষ মোতালেব। একদিন এ রকম নাটকে সেও নায়কের ভূমিকা পালন করেছিল। সেদিনের নায়ক হয়েছিল পর্যুদস্ত এবং পরাজিত। প্রকৃতপক্ষে আজ তার চেহারায় এসেছে নায়কোচিত তীক্ষ্ম ধার। সিদ্ধান্তে অবিচল, উন্নতশির। সোজা সে মানববৃত্তের মাঝখানে এসে দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করে– আমার বৌ, আমার মেয়ি নিয়ি আমি সংসার করবো। দেখি কে ঠ্যাকায়।

ক্ষীপ্র গতিতে ভূলুণ্ঠিত আমেনার হাত ধরে টেনে তোলে মোতালেব। থরথর করে কেঁপে ওঠে আমেনার সারা শরীর। সে চোখ তুলে তাকাতে পারে না। আব্দুল বারেক এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলে, আম্যু তুমাদের সঙ্গে যাব। এ সময় আমেনা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। কিন্তু মোতালেব নায়কোচিত ভঙ্গিতে স্ত্রী এবং জামাতাকে দুই হাতে শক্ত করে ধরে কৌতুকামোদী অসভ্য বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসে। পা বাড়ানোর সময় এক দলা থুতু ছুঁড়ে দেয় আসরের মাঝখানে। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে– কেউ কোথাও প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের সূচনা করে না। অনেকেই মঞ্চ ছেড়ে মোতালেবের প্রস্থান করার দৃশ্যটুকু চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে; কেউ কেউ আবার খবির মুন্সীর নাকের ডগায় পড়ে থাকা থুতুর দলা পরখ করে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত