যে ছেলেটি জীবনানন্দ হতে চেয়েছিল

যে ছেলেটি জীবনানন্দ হতে চেয়েছিল

অর্পিতাকে ভালোবেসেছিল গৈরিশ, বাবু গৈরিশ চন্দ্র দাশ। যে জীবনানন্দ দাশ হতে চেয়েছিল; এখনও চায় বলে হনহন করে হেঁটে চলেছে রেললাইনের পাশ দিয়ে। সোজা কথায়– আত্মহত্যা করতে চলেছে গৈরিশ।

অর্পিতাকে ভালোবেসেছিল গৈরিশ। তাদের পরিচয় হয়েছিল পিঠা উৎসবে। গেল শীতে তাদের উপজেলা পরিষদ আয়োজিত পিঠা উৎসবে স্টল নিয়েছিল অর্পিতার মামী। মেলার মেইনগেট দিয়ে ঢুকে ডানদিকে একটু এগোলে চোখে পড়ত সাত নম্বর স্টল– পিঠাপুলি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার ছাত্র গৈরিশ, দুচোখ ভরা জীবনানন্দ হওয়ার স্বপ্ন। দেশের নামী লিটলম্যাগ ও জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকী পাতাগুলোয় তার কবিতা নিয়মিত ছাপা হয়। দুটি কবিতার বই বের করে ঢাকা ও কলকাতা থেকে ছোটোমোটো দুটি পদকও পেয়ে গেছে ইতোমধ্যে। এই গৈরিশ-সেই গৈরিশ শীতের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে এসে পিঠামেলায় গিয়েছিল বন্ধুদের সাথে। মেলায় শখবতী ইউএনও-পত্নী নিজে একটা স্টল দিয়েছিল ‘বাংলার পিঠা’ নামে– এক নম্বর স্টল। সেই স্টলে যেন ঢল নেমেছিল মানুষের। বেচা-বিক্রি আর প্রদর্শনী হচ্ছিল হরদম। গৈরিশ আলাভোলা টাইপের যুবক, সে ভালোবাসে হেমন্ত ও নির্জনতা, নৈঃশব্দ ও মৌনতা– জীবনানন্দের মতো। সেকারণে প্রথমেই স্টলটি এড়িয়ে গেল। পরেরগুলোতে ভীড় নেহায়েৎ কম ছিল না বটে, তবে অন্তত স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে দুটো পিঠার সাথে সেলফি তোলার সুযোগ ছিল– মানুষ সেই সুযোগটা নিচ্ছিল। গৈরিশের সেলফি বিষয়ক মাথাব্যাথা নেই, সে আপন মনে কেবল পিঠা দেখছিল। বাড়িতে কুটুম ছিল, কলকাতা থেকে মেয়েকে নিয়ে ছোট মাসি এসেছেন বহুদিন পর। কিছু বাহারি পিঠা কিনে নিয়ে মাসি অথবা মাসতুতো বোনকে খাইয়ে বেশ একটা তাক লাগিয়ে দিতে মন চাইছিল! মেয়েটা আর্টিস্ট– মানে সেখানে এক আর্ট কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। দারুণ আঁকার হাত, দেখলে তাজ্জব বনে যেতে হয়। গৈরিশ লেখালিখি করে, যাবতীয় আর্টস দেখলে তার আনন্দ হয়। তাই সে মাসতুতো বোনটার প্রতি এক ধরণের আকর্ষণ বোধ করে। এটা ঠিক প্রেম বা ভালোলাগা জাতীয় কিছু নয়– অবন্তিকে সে নিজের বোনের চোখে দেখে। তবু সহোদর-সহোদরা নয় এমন কাউকে ভাই-বোন ডাকলেও বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যে সহজাত আকর্ষণ কাজ করে তেমন।

গৈরিশ মেলায় এগুতে এগুতেই সাত নম্বর স্টল পিঠাপুলির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। এই স্টলে যৎকিঞ্চিত ভীড় ছিল বিধায় গৈরিশের সরে পড়ার কথা। কিন্তু তাকে সে সুযোগ দেয়নি অর্পিতা। মামীর সাথে পিঠা বিক্রি করছিল মেয়েটা। তাকে একনজর দেখতেই গৈরিশের বুকের ভেতর বিনবিন করে ওঠে। প্যাঁচানো গোলাপের মতো সুন্দরী এক তরুণী। অর্পিতা তখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী। তার রূপের ছটা এতটা আহামরি নয় যে একনজর দেখলে আর চোখ ফেরানো যাবে না। বরঞ্চ প্রথম দেখাতে আপনি কোনো বিশেষত্বই খুঁজে পাবেন না। কিন্তু চোখ নামিয়ে নেবার কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারবেন, তাকে আরেক নজর দেখার প্রয়োজন আছে। এবং আরেক নজর দেওয়ার পর আপনার বুকের ভেতর বড়সড় বুদবুদের মতো একটা দীর্ঘশ্বাস জন্মাবে। আপনি যেন সৌন্দর্যের একটা আভা বের হতে দেখবেন তার মুখমণ্ডল থেকে। সেই আভা ক্ষণিকের মধ্যে মিলিয়ে যাওয়ার মতো নয়। এই কারণে যতবারই চোখ নামিয়ে নেবেন দেখবেন ততবারই চোখ চলে যাচ্ছে। এজন্য প্রথমেই প্যাঁচানো গোলাপের উপমাটা দিয়েছিলাম, যার সৌন্দর্য এক ধাক্কায় বুঝে ওঠা যায় না, খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ধীরে ধীরে পরিস্ফুটিত হয়।

এই অর্পিতার সাথে একটু কথা বলার সুযোগ পাওয়ার জন্য বহুক্ষণ একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিল গৈরিশ। বহুক্ষণ হাসিমুখে টুকটাক দরদাম করে পিঠা বিক্রি করল মেয়েটা। মাঝে মধ্যে তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে যেন আশ্বস্তই করতে চাইল গৈরিশকে। এজন্যই গৈরিশ সেদিন এতটা সময় ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছিল। রাত দশটার দিকে যখন স্টলের ঝাঁপি লাগিয়ে দেওয়া হবে তখন বাকি থাকা সব পিঠা কিনে নিল গৈরিশ। সে একা থাকায় এবং পরিবেশ ফাঁকা থাকায় অর্পিতা ও তার মামীর চোখ পড়ল তার দিকে; কথা হলো, পরিচয় হলো। তাদের গন্তব্য একই দিকে ছিল বলে গৈরিশ সে রাতে তাদেরকে বাসা পর্যন্ত রেখে আসার সুযোগ পেয়েছিল। অর্পিতা লজ্জায় সিঁটিয়ে ছিল পুরোটা রাস্তা, তার মামী বকবক করছিল গৈরিশের সাথে। এরপর বাকি দুইদিনও তাদেরকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় পালন করেছিল গৈরিশ। ক্যাম্পাসে ফিরে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই গৈরিশ আবিষ্কার করল সে অর্পিতাকে ভালোবেসে ফেলেছে। আবার গ্রামের বাড়িতে গেল সে। অর্পিতাকে দেখতে গেল তার মামীর বাড়িতে। তাকে দেখে খুশি হলো অর্পিতার মামী, বসতে দিল; নাস্তা দিল। ছোটবেলা থেকেই অর্পিতা মামার বাড়িতে পড়াশোনা করে। ক্লাস করে বাড়িতে এসে দেখল গৈরিশ বসে আছে। যা বোঝার বুঝে গেল মেয়েটি। এবং বুঝিয়েও দিল নির্বাক মুচকি হাসিতে। সেই থেকে শুরু, দুই বছর প্রেমের পর দেওয়াল হয়ে দাঁড়াল গৈরিশের ধর্ম ও ক্যারিয়ার। বিয়ে হয়ে গেল অর্পিতার– স্বামীসোহাগী বউ হয়ে চলে গেল ডেনমার্কে।

অর্পিতাকে ছাড়া জীবনটা অর্থহীন মনে হলো গৈরিশের। অবশেষে সে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিল। এমন জায়গায় গিয়ে কাজটা করতে হবে যে কেউ জানবে না, চিনবে না কোথাকার কোন অর্বাচীনের লাশ। বাড়িতে থাকা মা-বাবা, ছোট বোনটাও জানবে না তার আত্মহত্যার খবর। একটা চিরকুটে লিখে দিয়ে যাবে–

আমাকে খুঁজো না আর

আমি যাব বনে অথবা সাগর রোমন্থনে,

অতিক্রান্ত সন্ধ্যার পরও ফিরব না ঘরে অবশেষে,

পাখির কুজনভরা তোমাদের গ্রামদেশে।

মা কাঁদবে, বাবা কাঁদবে, বোন কাঁদবে। ক্যাম্পাসে খোঁজ লাগাবে, থানায় জিডি করবে। কিন্তু সবাই ভাববে খেয়ালি ছেলেটা জীবনানন্দের মতো নির্জন থাকতে চেয়েছিল, হয়ত লুকিয়ে আছে কোনো অজানা নিরুদ্দেশে। একদিন এই যুবকের অভিমান পড়ে গেলে নিশ্চয় ঘরে ফিরবে। এক বুক আশা নিয়ে বেঁচে থাকবে ঘরের মানুষ। এই আশাটুকু কেড়ে নিতে চায় না বলেই গৈরিশ ঘর ছাড়ার সময় চিরকুটটা রেখে গেল বালিশের ওপরে কলম চাপা দিয়ে– কোনোভাবেই যেন বাড়ির মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে না যায়।

রাত পোহানোর পর ভোর হতেই ঘর ছাড়ল গৈরিশ। চট্টগ্রামের বাস ধরল। সন্ধ্যায় বাস থেকে নেমে পাশের একটা সস্তা হোটেলে রাতটা কাটিয়ে দিয়ে পরদিন সকালে পেটভরে নাস্তা করে ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশনের কাছে চলে এলো একটা সিএনজিতে করে। স্টেশন থেকে সামনের দিকে এগুতে থাকল নিরুদ্দেশের মতো। কিছুক্ষণ হাঁটার পর সামনে একটা লেভেল ক্রসিং পড়ল। আশপাশ দিয়ে ব্যস্ত লোকজন চলাফেরা করছে। পাশে একটি চায়ের স্টল। গৈরিশের মনে পড়ে গেল চার বছর আগের স্মৃতি। চার বছর আগে এখানে এসে থেকেছিল ক’টা দিন। তখন তার পিসতুতো ভাই পীযূষ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, থাকত এই স্টেশনের অদূরের মেয়র গলিতে। শাটল ট্রেনে চেপে ক্লাস করতে যেত ক্যাম্পাসে। ভার্সিটি অ্যাডমিশন দিতে এসে এখানে উঠেছিল গৈরিশ। মেসে সকালের রান্না হত না, পীযূষদার সাথে এই স্টলে এসে চা-পরোটা খেয়েছিল সে। লোকটার চায়ের হাত অসাধারণ। আত্মহত্যার আগে এক কাপ চা খেয়ে নিলে মন্দ হয় না। পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার আগে যথাসাধ্য ভোগ করে নেওয়াটা রীতিসিদ্ধ।

“আসসালামু আলাইকুম মামা! ভালো আছেন?” চায়ের দোকানদারকে সালাম দিল গৈরিশ।

তাকে দেখে লোকটা চোখ কুঁচকে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করল। মুখে বললো, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আঁই গম আসি।“

গৈরিশ একটু মজা করার লোভ সামলাতে পারল না, “আমাকে চিনতে পেরেছেন? চার বছর আগে আমার কাজিনের সাথে চা খেতে আসতাম? তার নাম পীযূষ।“

“পী-যূ-ষ! ও পীযূষ!” লোকটার কথার ধরণ দেখেই গৈরিশ বুঝলো সে চিনতে পারেনি, পারার কথাও না। লোকটা হাতের ইশারায় গৈরিশকে বসার জায়গা দেখিয়ে দিল। ছোট্ট স্টলটা তখন লোকে গিজগিজ করছে। গৈরিশ একটা নোংরা টেবিলের সামনে বসতেই একটা ছোট ছেলে টেবিল মুছে দিল।

লোকটা চিৎকার ওয়েটারকে আদেশ দিল, “জব্বার ইন্দি ওগগুয়া চিনি ছাড়া লেবু চা দে।“

চমকে উঠল গৈরিশ। তাকে বললো, “মামা, আপনি কীভাবে বুঝলেন যে আমি চিনি ছাড়া লেবু চা খাই?”

“হাঁচা কই না হিয়ান কন?”

“হ্যাঁ, ঠিকই তো। কিন্তু আপনি মনে রাখলেন কী করে?”

হা হা করে পান খাওয়া দাঁতে হাসল স্টলমালিক। বললো, “আত্তে মনত রাখন পরিবু।”

বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই গৈরিশ দেখল তার সামনে ধোঁয়া ওঠা চা হাজির। চা খেয়ে বিল মিটিয়ে স্টল-মালিকের সাথে কয়েকটি সৌজন্যমূলক বাক্যালাপ শেষে বেরিয়ে এলো গৈরিশ। লাইনের পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগল আবার। একসময় পেছন থেকে কানে এলো হুইসেলের ক্ষীণ আওয়াজ। লাইনে কান পাতল সে। থরথর কাঁপুনির সাথে গমগম আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, তার মানে এই লাইন দিয়েই আসছে ট্রেন। পেছনে তাকিয়ে সে দেখল দানবসদৃশ ট্রেনটা ধীরে ধীরে দিগন্ত ফুঁড়ে দৃশ্যমান হচ্ছে, হিসহিস করে ফুঁসছে অজগর সাপের মতো। দ্রুতই বড় হচ্ছে ট্রেনটার আকার। চট করে প্ল্যান এঁটে ফেলল গৈরিশ। সে যদি এখনই লাইনে শুয়ে পড়ে তাহলে লোকোমাস্টার দূর থেকে ব্রেক কষে ফেললে ট্রেনটা এই পর্যন্ত আসার আগেই থেমে যাবে। কাজেই জীবনানন্দের মতো কাছাকাছি ট্রেনটা এসে পড়লে ঝাঁপ দিতে হবে। যদিও তিনি ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন নাকি আত্মাহুতি দিয়েছিলেন তা এখনও অনির্ণিত। মুহুর্তে গৈরিশের চোখের সামনে ভেসে উঠল জীবনানন্দের শেষ দিনটির ছবি– তাঁকে নিয়ে পড়াশোনা করে পাওয়া তথ্যগুলো তার মানসপটে যে ছবিটির জন্ম দিয়েছিল।

বেচারা জীবনানন্দের সাথে তাঁর স্ত্রী লাবণ্য গুপ্তের ছিল গঞ্জনার সংসার। সেদিন ‘জলখাবার ও জুয়েল হাউজ’ এর সামনে দিয়ে রাস্তা অতিক্রম করছিলেন কবি। দুই হাতে ছিল দুই থোকা ডাব। চলন্ত ডাউন বালিগঞ্জ ট্রামটির স্টেশনে পৌঁছতে তখনো প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ হাত বাকি। হঠাৎ করে মরিবার হলো তার সাধ– জীবনানন্দ আচমকা ট্রাম লাইনটা অতিক্রম করতে গেলেন। কোনো দিকে না তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে কী যেন ভাবছিলেন। অবিরাম হুইসেল বাজিয়ে, গলা ফাটিয়ে বারবার সরে যেতে বলছিল ট্রাম ড্রাইভার। দুইপাশে চিৎকার করে তাকে সরতে বলছিল তামাম জনতা। কিন্তু কিছুই পৌঁছল না কবির কানে। অবশেষে ট্রামটা প্রচণ্ড বেগে ধাক্কা মারতেই কবির দেহটা কাউক্যাচারের ভেতর আটকে গেল। অতি কষ্টে টেনে হিঁচড়ে বের করা হলো তাঁর ভাঙাচোরা দেহ। ছুটে এলো চূণীলাল, স্টেশন সংলগ্ন চায়ের দোকানের মালিক, ছুটে এলো উদ্বিগ্ন জনতা। কবিকে টেনে হিঁচড়ে ক্যাচার থেকে বের করে ভর্তি করা হলো শম্ভূনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার নবম দিনে চিরহেমন্তের দেশে পাড়ি জমান কবি।

এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি!

রক্তফেনা-মাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মত ঘাড় গুঁজি

আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার;

কোনোদিন জাগিবে না আর।

‘কোনোদিন জাগিবে না আর

জাগিবার গাঢ় বেদনার

অবিরাম-অবিরাম ভার

সহিবে না আর–’

জীবনানন্দ কি আত্মহত্যা করেছিলেন? দুর্ভেদ্য রহস্যের মতো এই প্রশ্ন বারবার জেগে ওঠে গৈরিশের মনে।

“যেই ঘুম ভাঙ্গেনাকো কোনদিন ঘুমাতে ঘুমাতে/ সবচেয়ে সুখ আর সবচেয়ে শান্তি আছে তাতে” কিংবা “কোথায় রয়েছে মৃত্যু? কোনদিকে? খুঁজি আমি তারে,” এমন পঙ্‌ক্তি দেখে সন্দেহ জাগে, ঘনীভূত হয়। গত একশ বছরে কলকাতায় ট্রাম দুর্ঘটনায় নিহত লোক মাত্র একজন– কবি জীবনানন্দ দাশ। জীবনানন্দের মৃত্যু আত্মহত্যা নাকি দুর্ঘটনা এই প্রশ্নের উত্তর ইতিহাসের বয়ামে তোলা থাক, গৈরিশ ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করে কবি আত্মহত্যা করেছিলেন। সেও এই মুহুর্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁকে অনুসরণ করার।

লাইনের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাঁকা চোখে পেছন দিকে তাকাল গৈরিশ। ট্রেনটা এবার অনেক কাছে চলে এসেছে। ক্রমাগত হুইসেল দিচ্ছে সতর্ক করার জন্য। এই সময় ঝাঁপিয়ে পড়লে লোকোমাস্টার ব্রেক কষলেও ট্রেন থামার আগেই তার গায়ের ওপর দিয়ে চলে যাবে। এবং সেই কারণে লোকোমাস্টার ট্রেন থামাবেও না। অতএব, নিশ্চিত মৃত্যুর স্বাদ নেওয়ার এই তো সুযোগ। সশব্দে জীবনানন্দের কবিতা আবৃত্তি করতে গিয়ে মৃত্যুর ঘ্রাণ পেল গৈরিশ, মৃত্যুর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করল। কোনো ভয়-ডর নেই, শুধুই ভালোবাসা।

চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বথের কাছে

একগাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা একা;

যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের– মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা…

ততক্ষণে লাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়েছে গৈরিশ। অমনি হুড়মুড় করে ট্রেনটা গৈরিশের সামনে চলে এলো।

শাট্‌ শাট্‌…ঝিক ঝিক…পোঁ-ও-ও…

রকেটের বেগে একের পর এক বগি জায়গাটা অতিক্রম করে চলে গেল। বিশাল ট্রেনটি দিগন্তে মিলিয়ে যেতেই আবার ঝিমিয়ে পড়ল রেললাইন।

গৈরিশের দেহটা ততক্ষণে…

***

লোকটা চিৎকার করে ওয়েটারকে আদেশ করল, “জব্বার, ইন্দি ওগগুয়া চিনি ছাড়া লেবু চা দে।“

চমকে উঠল গৈরিশ। তাকে বললো, “মামা, আপনি কীভাবে বুঝলেন যে আমি চিনি ছাড়া লেবু চা খাই?”

“হাঁচা কই না হিয়ান কন?”

“হ্যাঁ, ঠিকই তো। কিন্তু আপনি মনে রাখলেন কী করে?”

হা হা করে পান খাওয়া দাঁতে হাসল স্টলমালিক।

ট্রেনটা গৈরিশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগ মূহুর্তে তার মনে পড়েছিল কিছুক্ষণ আগে স্টলমালিকের সাথে কথোপকথনের দৃশ্য। অর্পিতাকে হারিয়ে এই পৃথিবীতে নিজেকে একজন নগণ্য মানুষ জ্ঞান করেছিল গৈরিশ। কিন্তু একজন চায়ের দোকানী তার চিন্তার গতিপথ বদলে দিয়েছে। চারবছর আগে তার দোকানে ক’টা দিন চা খেয়েছিল সে, তাতেই দোকানী তার রুচি-অভিরুচি স্মরণ রেখে তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে তার চোখে গৈরিশ তুচ্ছ নয়।

কিছুক্ষণ আগে আত্মহত্যার জন্য গৈরিশের রেললাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাওয়া এখন শুধুই স্মৃতি। কারণ গৈরিশের দেহটা ততক্ষণে… উঠে দাঁড়িয়ে ধীর পদে হাঁটা শুরু করেছে। এখনই বাস ধরে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেবে সে, জীবনটাকে নতুন করে গড়তে।

চায়ের দোকানীর মুখটি মনে আসতেই ট্রেনের চেয়ে দ্রুতবেগে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছিল গৈরিশ। ত্বরিৎবেগে লাফ দিয়ে লাইনের ওপারে মুখ থুবড়ে পড়েছিল পাশের ঘেসো মাটিতে। তারপরই হড়হড় করে জায়গাটি অতিক্রম করে ট্রেন। সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ের জন্য সে বেঁচে যায় ট্রেনে কাটা পড়ার হাত থেকে।

ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক ট্রাম দুর্ঘটনায় জীবনানন্দের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু গৈরিশ তা পারল কৈ? জীবনানন্দ হওয়াটা সোজা কিছু নয়– অবশেষে হৃদয়াঙ্গম করতে পারল সে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত