হরিজন

হরিজন

১.
গগণ সাধুর ঘরে ঢুঁকে মাথার উপর থেকে গামছাটা সরালো। তারপর সেটা দিয়ে গা মুছলো। গত দুদিন ধরে একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। আষাঢ় না আসতেই বৃষ্টির অত্যাচার শুরু হয়েছে এবার। হরিজন পল্লীটা বর্ষাকালে বিশ্রী রূপ ধারণ করে। একে তো ঘিঞ্জি পরিবেশ, তার উপর কাদা, পানিতে গু-মুত মিশে একাকার। এতে অবশ্য পল্লীর কারো কোনো সমস্যা হয় না। মেথরদের আবার ময়লা-আবর্জনায় এলার্জি থাকে নাকি!

– কই গো সাধু, এতো অন্ধকার কেন ঘর তোমার? হাঁক ছাড়ে কাশীরাম।

– তা সন্ধ্যার পরে অন্ধকার হবেনা তো কি হবে শুনি?

কাশতে কাশতে জবাব দেয় গগণ সাধু। একটা ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে হ্যারিকেন ধরালো সে।

– মাল বের করো সাধু। আগে গলা জুড়াই ।

– আগে বাকি শোধ কর। তাছাড়া পাবিনা।

সাধু জবাব দেয়।

– দিচ্ছি, দিচ্ছি। টাকা আনিনি ভেবেছ? এই কাশী তোমার টাকা কবে মেরে খেয়েছে শুনি?

– তোর তো ভয়ানক নেশা কাশী ! এই বৃষ্টিতে ভিজে মাল খেতে এলি। ঘরের এক কোণা থেকে বোঁচারামের নেশাগ্রস্থ কণ্ঠ ভেসে এলো।

– তুই বা কম কিসে ? যা ইনকাম করিস সবই তো সাধুর কাছে ঢালিস।

বাংলা মালের বোতলটা হাতে নিয়ে একটা বিড়ি ধরায় কাশীরাম। একটা টান দিয়ে বলে, যাই বলো সাধুদা, শুধু বাংলা বেচেই দিব্যি লাইফ কাটিয়ে দিচ্ছ তুমি।

সাধু হাসে। কিন্তু অন্ধকারে তা দেখতে পায় না কাশী। বাংলা মদ বেচার ব্যবসাটা গগণ সাধু পৈত্রিক সূত্রে পেয়েছে। ওর বাপ পবন সাধু একসময় ব্যবসাটা করত। মদ বিক্রির সুবাদেই ওর নামের শেষে সাধু ডাকটা যুক্ত হয়েছিল। গত ত্রিশ বছর ধরে বাপের ব্যবসা ভালোভাবেই চালাচ্ছে গগণ। যৌবনে মাগির দালালিও করেছে। তবে এখন শুধু মাল বেচে। তা তার একার সংসারের জন্য আর কি খরচই বা লাগে? বউ মারা গেছে বছর দশেক হলো। একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে তারও আগে। তাই দুশ্চিন্তামুক্ত একটা জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে গগণ সাধু।

মাল খেয়ে রাত বারোটার পরে সাধুর ঘর থেকে হয়ে বের হলো কাশী। কাদার উপর থকথক শব্দ করে হাঁটছে সে। গামছাটা সাধুর ঘরেই ফেলে এসেছে। চুমকির ঘরের সামনে এসে দেখতে পেলো, কে যেন ভিতরে ঢুকছে। অন্ধকারে ঠিক চিনতে পারল না কাশী। হবে হয়তো কোনো অল্পবয়সী পরিচ্ছন্নতাকর্মী। না হয় রিক্সাওয়ালা। চুমকি এই হরিজনপল্লীর স্বীকৃত বেশ্যা। তবে এককালে মাগিটারও ঘর-সংসার ছিল। ভরা যৌবনের চুমকিকে ফেলে সোয়ামী মারা গেল ট্রাকের নিচে পড়ে। কিছুদিন পরে চুমকি হয়তো পরিচ্ছন্নতাকর্মী হত। কিন্তু এক রাতে ওর ঘরে ঢুকলো কাশী, বোঁচা আর গোপাল। ব্যস, মাগী হয়ে গেলো চুমকি। ইজ্জত তো গেছেই। পেটের দায়ে দেহটাকেই ব্যবসায় লাগালো। তাছাড়া হরিজন পল্লীর কোন মেয়েটাই বা কুমারী আছে যে চুমকি লজ্জা পাবে?

হঠাৎ-ই চুমকির জন্য মায়া অনুভব করে কাশী। সেই রাতের পরে চুমকির ঘরে আরও কয়েকবার গিয়েছে সে। তবে প্রত্যেকবার পয়সা দিয়েছে। নিজের ঘরের সামনে এসে কাশী বুঝতে পারলো, পুরোপুরি ভিজে গেছে। ওর বউ রাখী এসে গামছা এগিয়ে দিলো।

– কই ছিলা?

জানতে চায় রাখী।

– তাতে তোর কি? চুপচাপ থাক।

গা মুছতে মুছতে বলল কাশীরাম।

– গা থেকে কি বিশ্রী গন্ধ বের হচ্ছে ! নিশ্চয়ই সাধুর ঘরে ছিলা।

এবার ক্ষেপে গেলো কাশী। কষে একটা চড় মারল রাখীর গালে। বলল, চুপ করতে কইছি না মাগী?

– নিজে মালের বোতলে পয়সা উড়িয়ে আসবে আর আমি কিছু বললেই আমাকে মারবে। যত বাহাদুরি সব আমার উপর। হায়রে আমার মরদ!

আর সহ্য হলো না কাশীর। চোখ বন্ধ করে চড়-ঘুষি-লাথি মারতে শুরু করলো। তবে শত অত্যাচারেও মুখ বন্ধ হয় না রাখীর। মার খেতে খেতেই গালি গালাজ করে কাশীকে। দশ বছরের বাচ্চা মেয়েটা রোজ এমন দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত। বরাবরের মতোই চুপ করে শুয়ে থেকে ঘুমের ভান করে মনি।

মার খেয়ে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে শুয়ে পড়ে রাখী। তবে একেবারে চুপ সে কখনোই হয় না। বিড়বিড় করে কথা বলতে থাকে। বউকে মারার পর কোনোদিন আফসোস হয় না কাশীর। মেয়েছেলেকে মারের উপর রাখতে হয়। তা না হলে মাথায় চেপে বসে। নিজের বাপের কাছ থেকে এ শিক্ষা পেয়েছে কাশীরাম। ওর এত ভালো বাবাও প্রতিদিন রাতে মাকে মারতো।

– ভাত বাড়া আছে । এত মাল খাওয়ার পরে পেটে কোনো জায়গা ফাঁকা থাকলে যেন খেয়ে নেয়।

– মাগী তুই এখনো চুপ করিসনি? এবার মার শুরু করলে কিন্তু খুন করে ফেলব।

ভাতের থালায় লাথি মারলো কাশী। তারপর একটা বিড়ি ধরালো।

নারায়নগঞ্জের টানবাজার হরিজন পল্লী থেকে রাখীকে বিয়ে করে এনেছিল কাশী। কালো মেয়েটার দেহপল্লবী দেখে মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল ওর। কিন্তু রূপবতী মেয়েরা যে দেমাগি হয় এটা জানত না কাশী। জানলে কি আর এমন মুখরা মেয়েকে বিয়ে করে !

২.
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে নগরের আবর্জনা পরিষ্কারে বের হয় পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। দিনের শুরুতে এক কাপ চা না খেলে কাশীরাম কাজ শুরু করতে পারে না। চায়ের স্টলে গিয়ে চা চাইলো কাশী। অল্পবয়সী ছেলেটা আরেকটা স্টল ইংগিত করে বলল, আমার কাছে এক্সট্রা কাপ নাই দাদা। দুধের কৌটাও নাই যে তোমারে তাতে চা খাইতে দিব। ওই দোকানে যাও।

মনে মনে ছেলেটাকে অশ্লীল ভাষায় গালি দেয় কাশী। ছোকরার অবশ্য দোষ নাই। যে কাপে মেথর চা খাবে সে কাপে তো কোনো ভদ্রলোক মুখ লাগাবে না। শালার ভদ্রনোক! কত শালাকে কাশী দেখলো চুমকির ঘরে রাত কাটাতে ! মেথরের মেয়ের সাথে শোয়া যাবে, তার শরীরে চুমু খাওয়া যাবে, কিন্তু মেথরের ঠোঁট লাগা কাপে চা খাওয়া যাবে না!

দুপুরে ঘরে ফিরে কাশী দেখলো মনি বেজার মুখে বসে আছে।

– কি হয়েছে মনি? জানতে চাইলো কাশী।

বৃত্তান্ত শোনার পর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার। মনির স্কুলের হেডমাস্টার নাকি আজ থেকে ওকে স্কুলে যেতে নিষেধ করেছে। মেথরের সন্তান পরিচয় কীভাবে জানি ফাঁস হয়েছে। স্কুলের অন্য ছাত্র-ছাত্রীর বাপ-মা চান না তাদের সন্তান মেথরের সন্তানের সাথে পড়ুক। নিচু জাতের মানুষ হওয়ার অপরাধে নানা রকম লাঞ্ছনা কাশী সারাজীবনই সহ্য করে এসেছে। খুব বেশি পাত্তা দেয় না ও এসবকে। কিন্তু আজ মনির ব্যাপারে যা ঘটলো তার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না সে। মেথরপল্লীর আলোর মেলা স্কুল থেকে ফাইভ পাশ করে পল্লীর তিনটা মেয়ে ভর্তি হয়েছিলো হাই স্কুলে। কিন্তু মেথর পরিচয় আবিষ্কার করে ওদের তিনজনকেই আজ বের করে দেওয়া হয়েছে স্কুল থেকে। বাপুজি গান্ধী দলিত সম্প্রদায়কে সম্মান করে হরিজন বলে ডাকতে বলেছিলেন। কিন্তু তাতে কি? এ জাতের ব্যাপারে মানুষের মনোভাব বিন্দুমাত্র বদলায়নি। ঘৃণা ছাড়া আর কিছু করে না লোকে।

মনিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল কাশী। মেয়েকে শিক্ষিত করে তুলবে । স্কুলের আপা বানাবে। মেথর সন্তানদের পড়াশুনার দায়িত্ব নিবে মনি এক সময়। কিন্তু আজ সে স্বপ্ন অলীক মনে হচ্ছে। মনিকে কিছু বলতে পারলো না ও।

ঘর থেকে বেরিয়ে কল পাড়ে স্নান করতে গেল কাশী। সেখানে দেখা হলো অরিন্দমের সাথে। ওকে দেখেই অরিন্দম বলল, দাদা কাজের ব্যাপারে কিছু জানতে পারলেন?

– কাল আমার সাথে যাস। কর্পোরেশনে গিয়ে বাবুর সাথে কথা বলব।

খুশি মনে চলে গেল অরিন্দম। ছেলেটা বেশ কিছুদিন ধরে কাশীকে বলছে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ জুটিয়ে দেওয়ার জন্য। কী যুগ এলো! মেথরকেও মেথরগিরি করার জন্য তদবির করতে হয়!

স্নান শেষে ঘরে ফেরার সময় কাশী দেখতে পেল, চন্দন তার ছেলেটাকে ধরে মারছে। ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে বলছে, মাফ কর দিজিয়ে বাপু। আর হবি না। মাফ কর দিজিয়ে।

– কি হয়েছে দাদা? কাশী বলল।

– হারামজাদার সাহস কত! শার্টের পকেট থেকে টাকা চুরি করে। বিড়ি খাওয়া শিখেছে।

কাশী অবাক হয়। বড়জোর তেরো বছর বয়স হবে ছেলেটার। এখনি বিড়ি টানা শুরু করেছে।

পরদিন সকালে অরিন্দমকে নিয়ে বাবুর সাথে দেখা করলো কাশী। বাবু বললেন, দুই লাখ টাকা দিতে হবে। তবেই পার্মানেন্ট কাজ দিবেন।

কাশী রেগে গিয়ে বলল, দুই লাখ টাকা থাকলে কি আর এই কাজ করতে আসত বাবু?

– তাইলে যা ভাগ। হবে না কাম। কত লোক টাকা নিয়ে পিছে ঘুরতেসে আমার।

অরিন্দমকে নিয়ে বেরিয়ে এলো কাশী। তারপর একটা অশ্লীল গালি দিল।

সেই ব্রিটিশ আমলে অন্ধ প্রদেশ থেকে এদেশে কাজ করতে এসেছিল কাশীর দাদামশায়। ঊনার কাছেই শুনেছে কাশী, সে সময় নাকি পরিচ্ছন্নতার কাজ শুধু মেথররাই পেত। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে বাঙালিরা এই কাজে যোগ দিতে শুরু করে। আর ভাত মারা যায় অবাঙালিদের। অন্ধ প্রদেশ থেকে আসা মেথররা এখন বাংলায় কথা বলে। ভোটও দেয়। কিন্তু কাজ পাবার বেলায় স্থানীয় বাঙালিরাই এগিয়ে।

রাতে হরিজনপল্লীতে পঞ্চায়েতের শালিস বসে। গোপালের ঘর থেকে দশ হাজার টাকা চুরি হয়েছে। ওর সন্দেহ হয় বোঁচারামকে। চুরি ছাড়া অন্য কাজ কাম সে করে না। তাই এ পল্লীতে যে কোনো চুরির পর বোঁচারামকেই সন্দেহ করা হয়। কখনো প্রমাণিত হয়, কখনো হয় না। আজকে হাজারটা পিটুনি খাবার পরেও অস্বীকার করে বোঁচা। প্রমাণের অভাবে শাস্তি থেকেও বেঁচে যায়।

শালিস শেষে পঞ্চায়েতের কাছে অরিন্দমের কাজ না পাওয়ার কথা তোলে কাশীরাম। অনেক কথার পরে সিদ্ধান্ত হয়, হরিজন সম্প্রদায়ের সভাপতির কাছে ঘটনাটা তোলা হবে।

সবাই যার যার ঘরে ফেরে। কাশী আর গোপাল যায় গগণ সাধুর ঘরে মাল খেতে। গোপাল সাধুকে বলে, সত্যি করে বলো তো দাদা, বোঁচা আজ তোমার ঘরে আসেনি টাকা নিয়ে?

চেঁচিয়ে উঠে গগণ সাধু। হারামজাদা এক কথা কতবার বলব? আমাকে কি মিথ্যাবাদী মনে হয় তোর? বোঁচা কি চুরির টাকার ভাগ দেয় আমাকে? আমি মিথ্যা কথা বললে আজ রাত যেন আমার মরণ হয়।

৩.
দিনের পর দিন চলে যায়। হরিজনপল্লীর জীবনযাত্রা বদলায় না। সেই কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে নগর পরিষ্কারে বের হয়, সারাদিন কাজ শেষে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে হয় মদ না হয় নারী শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়ে হরিজনরা।

একদিন এক ছোকরা আর্টিস্ট এলো হরিজন পল্লীতে। গগণ সাধুকে টাকা খাইয়ে বলল, একটা মেয়ে জোগাড় করিয়ে দিতে। না, কোনো বদ মতলব নাই তার। শুধু মেয়েটাকে ন্যাংটা হয়ে শুয়ে থাকতে হবে। ছবি আঁকাবে ছোকরা।

গগণ সাধুর ঘরেই ছিলো কাশী। বলল, আমাকে একশ টাকা দিবেন বাবু। আমি আপনাকে মেয়ে জোগাড় করে দিচ্ছি।

তারপর ওকে নিয়ে চুমকির ঘরে গেল কাশী। ওর হাতে একশ টাকার একটা নোট দিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে আর্টিস্ট ছেলেটা বলল, আপনি যান। ছবি আঁকানোর সময় মানুষের উপস্থিতি আমার সহ্য হয়না।

মনে মনে ওকে গালি দেয় কাশী। অনেকদিন পর চুমকির উদোম শরীর দেখার বাসনা জেগেছিল মনে। হারামজাদা তা হতে দিলোনা। চুমকিকে নাকি পাঁচশ টাকা দিয়েছিল ছেলেটা।

কয়েকদিন পর আবার এলো সে। তবে ও একা নয়। সাথে এক বন্ধুকে এনেছে। রাখী সে সময় স্নান করে শাড়ি ব্লাউজ শুকাতে দিচ্ছিল। ওর দিকে তাকিয়ে ছোকরা কাশীকে বলে, একে চাই আমার ছবি আঁকার মডেল হিসেবে। তেড়েফুঁড়ে মারতে গেল কাশী ওদের।

হরিজনরা গরিব হলেও বড্ড উৎসবপ্রবণ। বারো মাসে ওরা তেরো পার্বণ পালন করে। দুর্গাপূজার সময় তরুণরা ঘরে ঘরে গিয়ে চাঁদা তুলে উৎসব করে। গগণ সাধু ঢাক বাজায়। বাঁশিতে সুর তোলে কাশী। গলা ছেড়ে গান গায় অরিন্দম। বাচ্চারা নাচে। পল্লীর সবাই এদিন একসাথে খায়।

দশমীর দিন রাতে মদ খেয়ে ঘরে ফিরে শুয়ে পড়েছিল কাশী। হঠাৎ কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙে ওর।

রাখী কাঁদছে কেন? আজ তো ওর গায়ে হাত তোলেনি কাশী। কিছু বুঝতে পারেনা সে। কি হয়েছে জানতে চায়।

পেট ব্যথায় মরে গেলাম গো, রাখী বলল।

উহ আহ শুরু করে রাখী। কাশীর একটু ভয় হয়। বলে, কি না কি খেয়েছিস। চুপ করে শুয়ে থাক। ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু রাখীর ব্যথা সারে না। রোজ রাতে মরাকান্না শুরু করে। রাগের মাথায় একদিন ওকে লাথি মেরে বসে কাশী। পরদিন তাকে নিয়ে হাসপাতালে যায়। ডাক্তার ওষুধ লিখে দেন।কিন্তু ব্যাথা কমেনা রাখীর। তাছাড়া ওর শরীরও ভেঙে পড়েছে। খুব রোগা লাগছে। আবার ওকে নিয়ে হাসপাতালে গেল কাশী। ডাক্তার এবার বেশ কিছু টেস্ট করান। পরে কাশীকে ডেকে বলেন, অবস্থা তো সিরিয়াস। অনেক আগে ডাক্তার দেখানো দরকার ছিল। এখন অপারেশন না করালে রুগী বাঁচবে না।

রাখীকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো। মনির স্কুলে যাওয়া বন্ধ হলো। রান্নাবান্নাসহ ঘরের অন্যান্য কাজ মেয়েটাই করে। রাখীর অপারেশনের জন্য অনেক টাকা লাগবে।

একদিন নারায়ণগঞ্জ গেল কাশী। রাখীর বাপ ভাইয়ের কাছ থেকে যদি কিছু পাওয়া যায়। তবে তাদের অবস্থাও তো কাশীর মতই। হাজার দুয়েক টাকা নিয়ে ঘরে ফিরল সে।

এরই মধ্যে চন্দনের ছেলেটাকে একদিন পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। ইয়াবা ব্যবসা শুরু করেছিল নাকি ছেলেটা। ওকে ছাড়িয়ে আনার কোনো চেষ্টাই করলো না চন্দন।

নিজের বউ এর চিন্তায় মরছে কাশী। তাই ওকে আর কাজের কথা বলে না অরিন্দম। কাজ কামও ঠিকমতো করতে পারছে না কাশী। গগণ সাধুর ঘরেও আর মাল খেতে যায়না সে। টাকা জোগাড়ের টেনশনে হাত পা হিম হয়ে এসেছে ওর। হরিজনপল্লীর পঞ্চায়েত কিছু টাকা জোগাড় করলো পল্লীর সব ঘর থেকে। তবে তা সামান্যই।

সারাদিন হাসপাতালের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে কাশী। কিন্তু রাখীর কাছে যাওয়ার সাহস হয়না ওর। রাখী বুঝে গেছে, আর বাঁচবে না। সেদিন কাশীকে বলেছিল, আমি তো আর থাকছি না। মনিকে মানুষ কইরো তুমি। আর পারলে আরেকটা শাদি কইরো।

– চুপ কর মাগী। সারাক্ষণ মাথায় খালি ফালতু চিন্তা-ভাবনা।

একথা বলে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে এসেছিল কাশী। রাখীকে বাঁচাতে পারবে না এটা ভাবতেই নিজেকে অপদার্থ মন হয় ওর। হাই স্কুলের মাঠে বসে অনেকক্ষণ কি জানি ভাবে কাশী। তারপর উঠে দাঁড়ায়। হাসপাতালে ফিরে ডাক্তারের কাছে যায়। একটা প্রস্তাব রাখে সে।

৪.
অপারেশনের ব্যবস্থা হয়ে গেলো রাখীর। শুক্রবারে ছুরির নিচে যাবে ও। বাপ আর ভাই দেখতে এসেছে ওকে। মনিকেও দেখতে পেল। কিন্তু কাশীর কোনো খবর নাই। বাবা বললেন, সে গেছে টাকার ব্যবস্থা করতে।

দুদিন পর কাশী এলো ওর কাছে। কপালে হাত রেখে বলল, অপারেশনটা হলেই সুস্থ হয়ে যাবি তুই।

আবার চলে গেল লোকটা। নার্স আপা এসে বললেন, খুব কপাল নিয়ে জন্মেছিস তুই রাখী। তোর স্বামীর মতো মানুষ হয় না। তা না হলে নিজের কিডনি বিক্রি করে বউ এর চিকিৎসা কে করবে এই যুগে?

বাকরুদ্ধ হয়ে যায় রাখী। চোখ বন্ধ করে সে। ওর মাথার মধ্যে শুধু ঘুরপাক খায় কাশীর গালিগালাজ– চুপ কর মাগী, আর একটা কথা বললে তোর একদিন কি আমার একদিন। কাশীর মারপিটের শব্দও শুনতে পায় রাখী। মদ খেয়ে এসে বেদম পেটাচ্ছে ওকে।

জ্ঞান হারিয়ে ফেলে রাখী।

চোখ মেলে কাশীকে দেখতে পেল ও। ওর দিকে তাকিয়ে হাসল লোকটা। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর মুখ খুলতে পারল রাখী। বলল, কেন করলা এইডা? ওর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।

কিছু না বলে হাসল ওর স্বামী।

– আমার হাতটা একটু ধরবা?

ধরলো কাশী।

– আমার কপালে একটা চুমু খাবা?

খেলো কাশী।

– তোমার ঠোঁটদুটা আমার মুখের কাছে আনবা?

মৃদু হেসে ঠোঁট নামিয়ে আনলো কাশী। নিজের দুর্বল ঠোঁট দিয়ে স্বামীর ঠোঁট স্পর্শ করে রাখী। পরম মমতায় ওর চুলে হাত বুলায় কাশী। ওরা অনুভব করে ভালোবাসা। এই ভালোবাসার শক্তির কাছে দুনিয়ার যাবতীয় রোগ-ব্যাধি, বিপদ-আপদ তুচ্ছ। কাশীর কাছ থেকে রাখীকে আলাদা করবে কে? সেই সাধ্য ভগবানেরও নাই।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত