অযাচিত এবং কারো প্রথম ইচ্ছে

অযাচিত এবং কারো প্রথম ইচ্ছে

১.
মোটা কাঠটা ঠিক কোন গাছের ছিল মনে হয় কেউই তা বলতে পারবে না। কিন্তু কোনো মজবুত কাঠ যে ওটা অবশ্যই ছিল সেটা একেবারে হাঁড়ে হাঁড়ে টের পেয়েছিল মানিক। আর ঐ খুঁটিনাটিগুলো খুব বেশিই হয়ে গিয়েছিল কিনা, সেটাও ভাবতে চাচ্ছে না সে কিছুতেই। কারণ ওদের সম্পর্কের দিনগুলি ছিল বেশ মধুর, বেশ আনন্দঘন। অবশ্য এদিক থেকে খেয়াল করলে অনেকেই ওদের ‘হ্যাপি কাপল’ বলতেও দ্বিধাগ্রস্ত হয়নি। ওরা কখনো রাস্তার পাশে বসে বসে বাদাম চিবোত না যে, এলাকার অচেনা মানুষগুলো দেখলে বলবে, “এরা এত্ত নির্লজ্জ কেন? একটু আড়ালে গেলেই তো পারে!” এসব ভাবতে ভাবতে মানিক কখনো কখনো খুব অসহায়বোধ করে নিজের ভেতর। কিন্তু কী এমন হলো! একটু একসাথে একঘরে থাকার পরিণাম যে এমন হবে ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবেনি মানিক। আর এমন হওয়ার কথাও ছিল না!

মসজিদের এক কর্ণারে চুপচাপ বসে মানিক। প্রতিদিন এভাবেই বসে থাকে। আগে বসত না। কিন্তু এখন বসলে উঠতে চায় না! এটাকে ঠিক অভ্যেস বলে না, বাধ্য হয়ে গুটি মেরে থাকা বলে। কেউ কিচ্ছু জিজ্ঞাসা করছে না। শাস্তিটা ঠিক রাসূলের যুগে ইচ্ছাকৃত যুদ্ধে না যাওয়ার মত হচ্ছে! বসে থাকা মানিকের সাথে কথা বললে মরার পরে শাস্তি দু’দিন বেড়ে যাবে, কারো কারো ধারণাতে এমন উদ্ভট বিষয়টাও কাজ করছে। এটা অবশ্য কিছু মানুষের আড়চোখে তাকানো দেখে অনুমান করছে ও। বিষয়টা যেন ‘যার যার কাজ সে নিজেই দেখবে, আমি তার কে’ এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এটা শুধু তার বেলাতেই হচ্ছে কেন? ওপাড়ার ধোপা চৈতন্য যখন পূজার টাকা দিতে না পারাতে এদিকের মুসলিম পাড়ায় এসে বসত, তখন তো অনেকেই কাছে গিয়েছে। কুশল বিনিময়, আর্থিক সহায়তাও করেছিল অনেকে।

মানিক শুধু ফরজ নামাজটুকু পড়ে। বাকি আগে-পরের নামাজের সময়ে চুপচাপ বসে থাকে। রিফাত চাচার রাগি রাগি চেহারার দিকে বার কয়েক তাকালেও সেই তাকানো কখনোই স্থির হতে চায় না। বা বলা চলে পারে না। আচ্ছা, কারও মেয়ের সাথে একটু প্রেম-টেম হওয়ার মানেই কি তার দিকে আর তাকানো যাবে না! এমন সব উল্টাপাল্টা ধ্যান-ধারণা মস্তিষ্কে আওড়াতে আওড়াতে, অনেক দিনের আধোয়া টুপিটা পকেটে পুরতে পুরতে পেছনে আসতে গিয়ে একজনের নামাজের সামনে দিয়ে চলে আসে মানিক। সেদিকেও কোনো মানুষের বা মানিকের নিজেরও কোনো খেয়াল ছিল বলে মনে হচ্ছিলো না! জুতা পরার আগে দরজার সামনে রাখা যে পাপোশ রয়েছে তার উপর দাঁড়াতেই আনমনে পাঁ ঘষতে লাগল। যদি একটু ধুলাবালি মসজিদের ফ্লোর থেকে পায়ে লাগে সেটা মসজিদেই থাকুক। অযথা বাইরে এসে ওরা কী করবে! হঠাৎ ঝটকা টান দেয়া মানুষটার মুখাবয়ব তৎক্ষণাৎ দেখতে চেয়েও দেখেনি মানিক। একটু অবাক হয়েছে এই ভেবে যে এই আধো দুপুর কিংবা আধো বিকেলে আমাকে আবার কে ডাকে? যমের মত টানতে টানতে যখন পিলারের পাশে রাখা চেয়ারটিতে বসলো, লোকটি তখনই কেবল হঠাৎ জ্বলে ওঠা লাইটের মতো চোখ ধাঁধিয়ে উঠল মানিকের সামনে। প্রতিদিন অসময়ে নামাজ পড়া এই লোকটি মানিকের বাবা। অনেক বলে বলেও টাইম মতো নামাজে কখনোই আনতে পারেনি মানিক। আর সেই টাইম মেইনটেন না করা বাবাই কিনা কলার ধরে চেয়ারে বসিয়েছে মানিককে! একটা অশুভ গণ্ডগোলের আভাষ-অনুভূতি পঞ্চইন্দ্রিয় বলে দিচ্ছে।

ছোট বাচ্চাদের সামনে নিয়ে পড়ানোর সময় টিচারদের হাতে যেমন আধা হাতের একটা বেত থাকে, কালু মিয়া হাতে একটা ছুতরা নিয়ে যাদুকরদের মতো চোখের সামনে বনবনিয়ে ঘোরাচ্ছে। ব্যাপারটা প্রথম প্রথম কেউ বুঝবে না। বেশ অস্বস্তিকর।

–এটা নামাজির সামনে কেন দেয়া হয় জানো?
ছেলের উত্তর ছিল, হ্যাঁ, জানি।

–আচ্ছা, তাহলে তোমার এটাও জানার কথা যে, যদি কেউ কোনো নামাজির সামনে ছুতরা বা অন্যকিছু ছাড়া অতিক্রম করে তাহলে তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত!

হ্যাঁ, জানি।

এই কথাতেও সম্পূর্ণ সায় দিয়েছিল কালু মিয়ার একমাত্র ছেলে। তাহলে সামনে দিয়ে হেঁটে চলে গেলে কেন? বলে দুটো বাড়িও দিয়ে দিলেন শক্ত পিঠে। কিন্তু কোনো অপরাধবোধ যে তার ছেলের ভেতরে জেগে উঠেছে ব্যাপারটা এমন নয়। সুস্থির বালকের মতো বাইরে চলে গেল কালু মিয়ার বড় ছেলে মানিক।

২.
–আজ একটু এসো তো, তোমার সাথে খুব জরুরি কথা আছে।

–কী কথা, এখনি বলো। আমি শুনছি তো।

–না, মোবাইলে বলা যাবে না। এসো, তারপরে বলব।

বারোশো মডেলের নোকেয়া সেট নিয়ে সে সময় যে কোনো লোকই ধনির মতো বুক ফুলিয়ে হেঁটে বেড়াত, এটা সবার জানা। অবশ্য ব্যাপারটা বুক ফুলিয়ে চলার মতই। কিন্তু মানিক এগুলো পারে না, মোবাইলটা সবসময় একটু লুকিয়েই রাখত। এর কারণ কী, কখনো নিজেও মনে করতে পারেনি। পকেটে একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো ভরে রুমাদের বাড়ীর দিকে পা বাড়িয়েছে সে। নতুন কোনো মানুষ নয়া কোনো এলাকায় পা রাখলে যেমন হাবভাব, মানিকের চলাতে তেমন নতুনত্বের ছাপ ছিল। আর খুঁতখুঁতে মানুষদের ওগুলোই হয়তো বেশি চোখে পড়ে। সামনে আসা খালি বোতলটাকে লাথি দিতে দিতে রুমাদের বাসার সামনে গিয়ে থামে। সাথে বোতলটাও স্বস্তি পায়। আচ্ছা, বোতলের কি কোনো সুখ কিংবা শান্তি বলতে কিছু আছে?

এখানেও এক ঝটকায় ভেতরে টেনে দরজা লাগিয়ে দেয় রুমা। ‘ভেতরে আব্বু আছেন’ বলেই মানিকের মুখে চাপ দিয়ে মাত্র বলা কথার পিঠে কথা লাগিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করা থেকেও নিষেধ করে রুমা। চোখের একটু ইঙ্গিত এর জন্য যথেষ্ট হলেও আজ প্রথম নিজের হাতটাকে মানিকের শরীর স্পর্শ করালো। হাত নামিয়ে নির্বাক বসেও ছিল কিছুক্ষণ। অযাচিত কিংবা প্রথমত সবকিছু এমন আওলা হয়। মানিক বুঝে গিয়েছে এখন আর কথা বলা হবে না। উঠে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতে যেয়েও পকেটে হাত দিয়ে থেমে গেল। তোমার পা-টা দাও তো! হাঁটু গেড়ে বসে থাকা রুমা এবার বাম পা-টাকে সমান করে দেয়। মানিক পকেট থেকে বাজারের সবচেয়ে সস্তাদরে কেনা পায়েলটাকে বের করে। রুমার পা এক হাত দিয়ে ধরার সময় মোলায়েম অন্যকিছু মনে হয় মানিকের। অনেক্ষণ ধরে রাখতে মন চাইলেও কী ভেবে দ্রুত পায়েল পরিয়ে দেয়। এখানেও অশুভ একটা ভয় কিংবা ভীতি কাজ করে তার। আচ্ছা প্রকৃতি কি সবাইকে শান্তি দিতে পারে না! একটু না একটু অশান্তি লেগেই থাকে সর্বদা। এটা কি মনুষ্য কীর্তির অনন্য কিছু!

৩.
শৈশবে অস্থিরতা লেগে থাকা সময়েই গ্রামের মক্তবে আসত সবাই। একটু কথা ফুটেছে, মাত্র হাঁটতে শিখেছে এমনও অনেকে আসত এই মক্তবে। অনেক আগ থেকেই নাকি এটা চলে আসছে। আর এখানে তো খারাপ বা অনন্যদৃষ্টির কোনো ভঙ্গিমা যুক্তও ছিল না। তাহলে ওতে আর দ্বিমত করার কোনো প্রশ্নও আসে না। সকাল সকাল মক্তবের সেই মুরব্বি হুযুর মসজিদের মাইকে ক্লাসের সময় হয়েছে বলে ঘোষনা দিত। প্রত্যেক বাড়ি থেকে তাদের বাবা-মায়েরা কাইদা আর রেহাল হাতে সন্তানদের মসজিদের পানে রওনা করিয়ে দিত।

মুরব্বি হুযুর হাতে সবসময় একটা ছুতরা নিয়ে হাঁটতেন। ছুতরা হলো নামাজি ব্যক্তিকে ডিঙ্গিয়ে যাওয়ার মাধ্যম। ওটা দিয়ে কখনো কাউকে মারতেন না অবশ্য। শুধু ভয় কিংবা শাশিয়ে পড়া মুখস্ত করিয়ে নেয়ার জন্যই তেমনটা করতেন, ব্যাপারটা এখন খুব বেশি করেই সুস্পষ্ট মানিকের কাছে।

এখন মানিক বড়। রুমার সাথে তার সাম্প্রতিক প্রেম।

মসজিদের যে সম্মানিত ইমাম ছিলেন তারই মেয়ে রুমা। মানে রিফাত চাচা।

আচ্ছা, ব্যাপারটা কি অস্বাভাবিক! কখনোই না। নিজেই নিজেকে প্রবোধ দেয় মানিক। সেদিন রুমাকে পায়েল পরিয়ে দিয়ে বের হওয়ার সময় ওকে দেখে ফেলেছিল রুমার বাবা। কাছে ডেকে লোকজন জমা করে বেশ কড়াভাবেই প্রহার করেছিল মসজিদের ইমাম সাহেব। অবশ্য কালু মিয়া নিজেই এটা করার জন্য সায় দিয়েছিল ইমামকে। ছুতরার পিটুনি যে কেমন সেদিন সেসময় না বুঝলেও পরে সময় যাওয়ার সাথে সাথে একটু একটু করে বেশ ভালোভাবেই বুঝেছিল মানিক।

শরীরে কাটাকাটা দাগ। কোথাও কোথাও রক্তও জমা হয়েছে। এই যে এখন ঠিক তার সামনে একটা প্লাস্টিক এবং একটা স্টিলের ফ্রেমে বানানো ছুতরা মসজিদে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সেটা দেখে প্রথমে একটু হাসি পরে আবার মন খারাপ করে বসে থাকে মানিক।

মসজিদের ইমাম এই এলাকা ছেড়ে চলে গেছে বেশ কয়েকদিন হলো। নতুন ইমাম নিয়োগ নিয়ে ব্যস্ত সকলেই। আচ্ছা, এই যে ইমাম নিয়োগ, দুদিন পর চলে যাওয়া; বিষয়গুলো কি মৃত্যুর মতো না। এই তো অল্প কিছুদিন বেঁচে থাকা। ইয়া বিশাল বিশাল স্বপ্ন দেখতে দেখতে অস্থির হয়ে যাওয়া আর সবশেষে অস্থিমজ্জাকে ভুলে মাটিতেই গেঁথে যাওয়া। এগুলো কি স্বাভাবিক নয়! আর সবকিছুই কি অস্বাভাবিক হতে হবে! নাহ, ব্যাপারটা এমনও নয়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত