আগুনের আলো

আগুনের আলো

সেই ব্রিটিশ আমলের একজন শিক্ষিত, চাকরিজীবীর কন্যা শারমীন বেগম। একনিষ্ঠ, সৎ স্কুলমাস্টার স্বামীর আদর্শকে সম্মান জানাতেই নির্বিবাদে গ্রামে রয়ে গেলেন কোন ধরনের উচ্চবাচ্য ছাড়া। অথচ তাঁর ভাই-বোনেরা রাজধানীতে গাড়ি-বাড়ি কিনে জাঁকিয়ে চাকচিক্যময় জীবন-যাপন করছে। পরশ পাথরের ছোঁয়ায় সাধারণ পাথরও যদি সোনায় পরিণত হতে পারে, তাহলে একজন সৎ-আদর্শবান বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের মানুষের সান্নিধ্যে থেকেও অনেকের চরিত্রে সংকীর্ণতা, লোভ, ব্যক্তিত্বের দোষ-ক্রটিও বিলীন হয়ে যেতে পারে। হ্যাঁ শারমীন বেগমও স্বামীর যোগ্য স্ত্রী হতে পেরেছেন। হতে পেরেছেন অনুকরণীয় একটি চরিত্র। না হলে সেই পাকিস্তান আমলে বিএ পাস করে কেউ আজও গ্রামে থাকে? তাও শুধু থাকা নয়, শারমীন বেগমের আলোয় শহুরে অনেক আধুনিকারই ঔজ্জ্বল্যের ঘাটতি প্রকটিত হয়ে ওঠে।

তাঁর মেধা ও মননের চর্চা কোনোদিনই থেমে ছিলো না। পুরো বাড়িটিকে তিনি লাইব্রেরি করে ছেড়েছেন। বছরে একবার কম দিনের জন্য হলেও ভ্রমণে বের হন। স্কুলের শিক্ষকতা না করেও গ্রামে তাঁর ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা নেহায়েত কম নয়, তবু তিনি একমাত্র ছেলের জন্য স্বপ্ন দেখছেন শহরের চকচকে, আধুনিকা একটি বধূর। চাকরিজীবী হলে আরো ভালো। কেউ কেউ অবশ্য বলছেন চাকরিজীবী বউ, শ্বশুর-শাশুড়িকে মান্য করবে না। না করে না করুক। কারো একপেশে অন্ধ শ্রদ্ধা তিনি চাইবেন বা কেন? শুধু ছেলের মা হওয়ার সুবাদে যারা নিজের কোনো ধরনের যোগ্যতা ছাড়াই ছেলের বউকে দাসীর মতো মনে করে তিনি তাদের দলে নন। সবকিছুর ঊর্ধ্বে তিনি মনে করেন, বউ-ই হচ্ছে বংশরক্ষার ভিত্তি। নিজের শাশুড়ির কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন সেরকম সম্মান। আজ তা পুত্রবধূকে ফিরিয়ে দিতে কার্পণ্য করবেন কেন। শারমীন বেগমকে টেক্কা দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। তিনি তাও ভালো করেই জানেন।

কিন্তু খটকাটা অন্যখানে। ছেলে তাঁর ইউনিভার্সিটি পাস করে ভালো একটি চাকরিতে ঢুকে আজো কিনা গেঁথে রেখেছে সেই মেয়েটিকে। গ্রাম্য আচরণে অভ্যস্ত কোমরে বিছা, খোঁপায় বুনোফুল পরা, কোনোরকমে পাস করে কলেজে ওঠা মেয়েটিকে? লেখাপড়া শেখাটা যে পরিবার জীবনের ব্রত নয়, বিলাসিতা হিসেবে ধরে আছে, তাদের সঙ্গেই কি শেষ পর্যন্ত তাঁর মানিয়ে নিতে হবে? বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শারমীন বেগম ছেলেকে বাগে আনার চেষ্টা করেন। পারেন না। ছেলের পছন্দ অথচ তার মা রাজি নন। শাঁখের করাত বুদ্ধিমান স্কুলমাস্টার আবুল হাসান সাহেব শ্যাম রাখবেন না কুল রাখবেন ভেবে মূক ও বধিরের ভূমিকা পালন করতে লাগলেন। এতে করে মা-ছেলের বৈরিতা থিতিয়ে এলো অল্পদিনে। তবে ছেলে এটা বুঝে গেছে মায়ের মত না পেলে হবে না।

শারমীন বেগম অনমনীয় মনোভাব নিয়ে দীর্ঘদিন পর চিঠি লিখলেন তার স্কুলজীবন থেকে ঘনিষ্ঠ এক বান্ধবীর কাছে। বান্ধবীটি শহরে থাকেন। বাড়ি-গাড়ি আছে তাঁর। স্বামী সরকারের একজন পদস্থ কর্মকর্তা। এ সময় তাকে স্মরণের কারণটি তাঁর বহুগুণে গুণান্বিতা, আধুনিক, সুশ্রী কন্যাটি। বছর চারের আগে শারমীন বেগম বেড়াতে গিয়ে কন্যাটিকে স্কুলের ক্লাসটিতে অধ্যয়নরত দেখেছিলেন। আজ আঙ্গুলের করে করে হিসাব মিলিয়ে তবেই তিনি এ চিঠি তার মাকে লিখলেন, আসার কারণ এবং বেড়াতে আসার নিমন্ত্রণ দুই-ই জানিয়ে।

উচ্চবংশীয়, অবস্থাসম্পন্ন পরিবার। একটিমাত্র ছেলে। ভালো চাকরিও পেয়ে গেছে। ধীরে সুস্থে শহরে বাড়ি-গাড়ি হবে। একসময় নিজেদের কি এসব ছিলো? স্বামী-স্ত্রীতে সবদিক ভেবে বান্ধবীটি যথাসময়ে গ্রাম দেখার ছল করে কন্যা লাবণ্যকে নিয়ে পৌঁছালেন গোপালগঞ্জের চন্দ্রদিঘলিয়া গ্রামে। এমন ডানাকাটা পরী মৃত্তিকার বুকে নেমেছে? এত কাছে, একেবারে তাদেরই বাড়িময় ঘোরাঘুরি করছে। ইন্দ্রধনু সময় বয়ে যাচ্ছে আশিকের লাবণ্যরা আসাঅব্দি। এ আবেশের রেশ শেষ হোক আশিক আর তা চায় না। এখন মা যা বলছেন আশিক তাই করছে। এমনকি আরো বেশি! ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া ভাবটি কেমন কেটে যাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে ঘাম ছুটছে যদিও। তীরবেঁধা হরিণীর মতো কাতর কে তাকে খুঁজছে, ভুলে গেছে সব। তার কাছে জীবন এখন মনে হচ্ছে যোগ-বিয়োগ ফলাফলের মতো।

বাড়ির আরো ক’জন চাচাতো ফুফাতো ভাইবোনসহ সদলবলে হেঁটে হেঁটে তার লাবণ্যকে দেখাচ্ছে গ্রামের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত, আতিশয্যে কখনো পার হয়ে যায় আরো বহুদূর। চলে যায় অন্য গ্রামের ভেতরে। ক্লান্তি নেই। পাকা রাস্তা ছেড়ে যায় সম্মোহিত ক’জন সরিষার হলুদ ক্ষেতে নামে। আলপথ ধরে হাঁটতে গিয়ে অনভ্যস্ত লাবণ্যের টলোমলো পড়ে যাওয়া থেকে কতবার আশিক রক্ষা করেছে। চলছেও তারা দু’জন পাশাপাশি, কাছাকাছি। এটুকুর জন্যেই তো মা ছুটি নিয়ে আসতে লিখেছিলেন!

আশিকের আর কোনো ভাই-বোন নেই। এমএ পাশ করেছে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে। হলে ছিলো। তবু কখনো কোনো মেয়ের সঙ্গে তেমন করে সখ্য গড়ে ওঠেনি। নিজের গো-বেচারা ভাবটির জন্য এখন সে মাকে দায়ী করে। সবসময়ে আগলে রেখেছে বলে। স্কুলশিক্ষক বাবার আচরণে পরিমিতিবোধ, গাম্ভীর্য, উত্তরাধিকার হিসেবে পেলেও তাও যেন স্বভাবে চেপেছিলো সময়ের আগেই। অন্য সবার মতো সে অবাধে, অনায়াসে কোনোদিন হৈ-চৈ করতে পারেনি। উৎফুল্ল হতে পারেনি। একটি গোলাপ ছিঁড়ে কাউকে নিবেদন তো প্রশ্নেই আসে না। এতকিছুর থেকে কিছুই না করতে পারাটাকে আজ প্রথম তার চরিত্রের ক্রটি বলে মনে হচ্ছে। গ্রামবাসীরা অবশ্য গর্ব করে পিতা-মাতার যোগ্য এ সন্তানটিকে নিয়ে।

ভিন্ন গ্রাম, অপরিচিত সব মানুষজন। তবু লাবণ্য কত সাবলীল। বাড়াবাড়ি কিছু নেই তার আচরণে। পাঁচ-ছয়জনের দলটিতে এখন লাবণ্যই অনন্য। অথচ তা কেন হবে? একদিন আশিকই তো ছিলো এদের মধ্যমণি! চেষ্টা করেও সে এ কদিনে নিজের কোনো উজ্জ্বল ভূমিকা রাখতে পারছে না। অথচ আগামীকাল সকালেই লাবণ্যরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে।

শারমীন বেগম আর তাঁর বান্ধবী হিসাব যা করেছেন একেবারেই নির্ভুল। ছেলে-মেয়ে দু’জনই ম্যাচিউরড। এখানে আসার কারণটি এ ক’দিনে নিশ্চয়ই তার দু’জনেই জেনে গেছে এবং তাদের চোখ-মুখ সে সাফল্য ঘোষণা করছে। মায়েদের মন, কোনো কিছু ঘটার আগেই তারা টের পান!

মাথার উপর পাগলকরা চাঁদ। মন কেমন করা তার আলো। শতাব্দীর শেষ পূর্ণিমার মধ্যরাতে খোলা মাঠে বাড়ির প্রায় সবার সামনে, প্রথমে শারমীন বেগম তারপর একে একে অনেকেরই অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো লাবণ্য গাইতে শুরু করলো– কেটেছে একেলা/বিরহের বেলা/আকাশ-কুসুম চয়নে।/সব পথ এসে/মিলে গেল শেষে তোমারই দু’খানি নয়নে…। মুগ্ধ স্তব্ধতায় ভিড় ফাঁকা হয়ে গেলে স্বয়ং মাস্টার সাহেব স্ত্রীর বান্ধবীটির কাছে এই প্রথম হাত জোড় করলেন, আপনার মেয়েটিকে আমার ছেলের জন্য চাই-ই চাই। আপত্তি করবেন না। আপত্তি কি আগে কারো ছিলো?

সূর্য তখনো ফোটেনি। আশিক দরজা খুলে বাইরে এলো লাবণ্যের কলহাস্যের শব্দ শুনে। বিকেল বেলার মতো রং-ধরা থোকা থোকা ডালিমের ভারে নুয়ে পড়া গাছটির তলায়, ফিকে কুয়াশায় একা দাঁড়িয়ে থাকা লাবণ্যকে দেখে আশিক এগিয়ে গেলো। এই প্রথম তার নিজের মতো করে কাউকে কিছু বলা এবং অবর্ণনীয় এক আবেশও মিশেছিলো কণ্ঠে, ‘এই কটা দিন আমার অনেকদিন মনে থাকবে লাবণ্য।’

– হ্যাঁ আমারও। জানেন জীবনে এত প্রজাপতি আমি একসঙ্গে দেখিনি। আলপথে হাঁটতে এত মজা! শিশির ভেজা ঘাসে পা ছোঁয়ানো… জীবনে এই প্রথম। মাকে অনেক ধন্যবাদ। খালাম্মাকেও। উনি না বললে তো আসাই হতো না। কৃত্রিম উচ্ছ্বাসে একটানা কথাগুলো বলে গেলো লাবণ্য।

– আর কিছুই নয়? ক্ষীণ স্বরে মৃদ্যু কৈফিয়ত তলব আশিকের।

– হ্যাঁ, এই যে সবুজ বনানী, ফসলের বিস্তৃত মাঠ, আঁকা-বাঁকা পথ। মানুষজন। গ্রামীণ কোলাহল। জানেন, একটু আগে, তখনও বেশ অন্ধকার ছিলো, ঐ যে হিজল গাছের তলা থেকে মুঠো মুঠো ফুলে ওড়নার আঁচল ভরেছিলাম। উহ্ এই ভোর আমি জীবনে ভুলবো না। জবজবে শিশির যেন হাতে লেগে আছে এখনো।

– আর… আর… আর কিছু? অসহিষ্ণু প্রশ্ন আশিকের।

– আর কিছু… কী বাকি পড়লো বলতে, বলুন?

– আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখো বলার এত আর কিছু পাও কিনা!

– আশিক ভাই, মানুষ জীবনে যাকে একবার হারায়, সমস্ত জীবন জুড়ে কেবল তাকেই খোঁজে। না পাওয়ার সে বেদনা জুড়েও থাকে এক অন্যরকম সুখ। নান্দনিক সুখ যাকে বলে, সে সুখের নেশা বড় ভয়ঙ্কর-মানুষ সব প্রাপ্তির আধার খুঁড়েও তার তাপ প্রতিনিয়িত পরখ করতে চায় এবং সেটাই মানুষের প্রকৃতি। আমর জীবন থেকে এত বড় মহিমা আমি গ্রাম্য ওই বালিকাটিকে দিতে পারবো না। ওটুকু আমারই থাক। নূপুরকে নিয়ে আপনার যে স্বপ্ন ছিলো, তাই খাঁটি করে তুলুন। যাকে আপনার ভালো লাগে ওকে তার মতো করে গড়ে নেবেন। মানুষের আচরণ পরিবর্তনশীল। নিজেকে দিয়েই বিচার করুন!

বুক পেতে আশিক যেন একটার পর একটা কারো ছুঁড়ে মারা শর গ্রহণ করছে। অথচ তাকে থামিয়ে দেয়ার শক্তি সে পাচ্ছে না। গত রাতের চাঁদের চেয়ে যার মুখের সম্মোহিত কোমলতা এ ক’দিন চুইয়ে চুইয়ে তার প্রাণস্পর্শ করে ভুলিয়ে দিয়েছে দুর্বল প্রণয়ের গৌণ রেশ, সেই কিনা এভাবে নিভিয়ে দিলো ওর প্রতি তার ছলকে ওঠা দীপ্তি। আশিক ভাবে তার আটাশ বছরের নিরেট সুখের জীবনে লাবণ্য কী একটা চিড় হয়ে থাকবে মাত্র।

হয়তো অনধিকার চর্চা বাড়তো। তবু আশিক লাবণ্যের পথ আগলে দাঁড়াবে ভেবেছিলো। কিন্তু আচমকাই নিজের মতো করে সে আশিকের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো অন্য কোথাও। বিদায়ের মুহূর্তটি পর্যন্ত আপ্রাণ চেষ্টা করেও আশিক পারলো না আর লাবণ্যের মুখোমুখি হতে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত