রেহাননামা প্রায় স্বপ্ন দেখে সে বাংলা সিনেমার মত একদিন লটারির টিকিট কেটে লাখপতি হবে।এই স্বপ্নটা তার লালিত।যদিও সে জানে ভাগ্য তার প্রতি কতটা প্রসন্ন;তবুও দ্বিধাহীন চিত্তে মনের মধ্যে সে লালন করে যদি লেগে যায়।মানুষেরই তো লাগে।তাহলে ঠিক এক দিন তারও লটারি লেগে যাবে।অনেক টাকা।সে দু’হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে নতুন টাকার ঘ্রাণ নিবে।টাকাগুলো মনে হবে ফুল;যে ফুলের গন্ধ বিচিত্র।যে ফুল তার জীবনের সব কষ্ট দূর করে দিবে।একটা পাকা দালান তুলবে;মস্ত বড় ঘর।
সেই ঘরের সামনে উঠান।উঠানে ছেলে খেলা করবে।একপাশে বসে থাকবে চেয়ার নিয়ে তার স্বামী।আহ! বুকের ভেতর থেকে বেশ জোরে ধাক্কা দিয়ে ওঠে।কী সব ভাবছে। প্রতি মাসে বাসা বাড়িতে কাজ করে যা পায় তার থেকে পাঁচটা টিকিট রেহাননামার কেনা চায়।পাঁচটা বাসায় কাজ করে।মাসে ৫টি টিকিট কেনা রীতিমত অপচয়;স্বামীর সাথে এই টিকিট নিয়ে কত ঝগড়া হয়ে গেছে।টাকা আয় করি এই আমি রেহাননামা অথচ মাস শেষে সব টাকা স্বামীর হাতে তুলে দাও।এই ব্যাপারটা খুব খারাপ লাগে।
-আমি যদি কাজ না করতাম তাহলে এই বাড়তি টাকাটা আসত না।আমি খুশি হয়ে দিলে সে নিতে পারে;দিতে চাইনা বলে মারধোর করে।
তবুও এইসব টাকা থেকে কিছু টাকা সরিয়ে টিকিট কিনে রেহাননামা।মাসের বেতন পেয়েছে আজ।মনে মনে ঠিক করে এইবার দশটা টিকিট সে কিনবে।প্রতিবার পাঁচটা করে কিনে তাই মনে হয় বাধে না।কিন্তু শুকুর মিয়ার কী কপাল।গেলবারের টিকিটে মস্ত বড় টিভি বাধছে।যে করেই হোক দশটা কাটতেই হবে;দশটা কাটলে একটা না একটা বাধবে। কিন্তু বিধি বাম! বাড়ি গিয়ে দেখে রেহাননামার ছোট ছেলেটার খুব জ্বর।পাঁচদিন চলে যায় জ্বর যে নামে না , ডাক্তার দেখায়।অনেক টেস্ট দেয়।রেহাননামা ঠিক করে এ যাত্রায় আর টিকিট কাটবে না।চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে মনে মনে ভাবে পোলাডার শরীল ভালো হলে টিকিট কেনা যাবে।
পথের ধারে লটারির টিকিট বিক্রি করে অশোক।রেহাননামা তার নিয়মিত কাস্টমার।আমরা যখন কোন নিয়মে অভ্যস্ত হয়ে উঠি;হঠাৎ সে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে আমাদের চোখে লাগে।কেমন যেন একটা আবছা বোধ ঘিরে ধরে মনের চতুর্দিক। অশোক জিজ্ঞেস করে, “কী রে রেহু,লটারির টিকিট লইবি না।” অশোক দা -“পোলাডার শরীল খারাপ, এইবার টিকিট লইতে পারুম না;সামনের মাসে দিও অশোক দা।”
-“ভাবছিলাম এইবার দশটা টিকিট লিবার পারব।”
-“রেহু তোর জন্য পাঁচটা টিকিট রাইখ্যা দিলাম,এত বছরের পুরান কাস্টমার তুই,সামনের মাসে টাকা দিস।”
-“এই নে টিকিট রাখ।”
-“অশোক দা তোমার কাছেই থাক।সামনের মাসের বেতন পাইলে টাকা দিমু নে।”রেহানামা টিকিটগুলো আর কিনে না;অশোকের হাতের মুঠোয় সেগুলো রেখে দেয়।
কয়েকদিন হল এ রাস্তা দিয়ে রেহাননামা যায় না। রেহাননামার ছেলে হাসপাতালে ভর্তি। লটারিতে প্রথম পুরস্কার চার লাখ টাকা।অশোক রেহাননামার টিকিট মিলাতে থাকে।পর পর চারটা টিকিট মেলায় আর ছিঁড়ে ফেলে।পঞ্চম টিকিটে গিয়ে জোরে জোরে নি:শ্বাস নেয়।অশোকের এক মুহূর্তে যেন পানি পান করার তীব্র বাসনা জেগে ওঠে।শরীরে ঘাম হয় ; হাত-পা কাঁপতে থাকে।হাতের মুঠোয় টিকিট ক-২৪৫৬৮৫৬৩৪৩৪৫৬।টিকিটটা মিলে যায়; নিউজ প্রিন্টের পেপারে দেয়া লটারির রেজাল্টে।খবরটি উপলব্ধি করতে বেশি সময় লাগে না।কপালের ঘাম মুছে নেয় অশোক।পুরস্কার যেন তেন নয়;একেবারে প্রথম পুরস্কার।
অশোক মনে মনে ভাবে রেনু তো টাকা দেয় নি, দিবে বলেছে তবে তো হিসেব মতে এ টাকা আমার।আমি কেন এ টাকায় রেহাননামাকে ভাগ দিব! রেহু কে বলে দিব টিকিট বাধিনি। এই টাকা পেলে তার আর লটারি বিক্রি করে বেড়াতে হবে না, বাকি জীবন বেশ আরামে কেটে যাবে।একটা মিষ্টির দোকান দিব।অশোক যেন মিষ্টির উপরে বসে থাকা মাছিটাকেও দেখতে পায়।
-ভালোয় হয়েছে রেহু এই পথ দিয়ে যায় না।
লটারির টাকা তুলে আনে অশোক।খুশিতে তার মন নাচতে থাকে কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়।টাকা তোলার পর থেকে আয়নার সামনে দাঁড়ালে মনে হয় – তুই প্রতারক। খেতে, বসতে,চলতে ফিরতে মনে হয় তুই প্রতারক।সারাদিন তুই প্রতারক বাজতেই থাকে। প্রতারক! প্রতারক!প্রতারক!
প্রচন্ড জ্বর আসে অশোকের। কয়দিন হয়ে যায় জ্বর নামে না,শুধু বাড়তেই থাকে।অশোক ধরেই নেয় এটা তার পাপের ফল।জ্বরের মাত্রা বাড়ায় হাসপাতালে ভর্তি করা অশোককে।জ্বরের ঘোরে জড়ানো গলায় ডাকে রেহু,রেহু।অশোকের এই ডাক কেউ বুঝতে পারে না! ঝাপসা চোখে অশোক দেখে হাসপাতালে রেহাননামার মত দেখতে একজন মহিলা। একটু দূরের পাশের বেডে শুয়ে, সাথে বাচ্চা একটা ছেলে।কিন্তু রেহু তো এত শুকনা নয়! অশোক রেহু রেহু করতে থাকে।একজন রেহাননামাকে ডেকে আনে। অশোক রেহাননামার হাত চেপে ধরে শক্ত করে ।
-“বোইনরে আমারে ক্ষমা করে দে, তা না হলি সাত জনমে ও আমার শাপ মোচন হবি না কলাম।”
রেহু হাত ছাড়িয়ে নিতে চায়,অস্বস্তি হয়।রেহু যত জোরে হাত গুটায় তত জোরে শক্ত করে হাত ধরে যেন অশোক। রেহাননামা কিছুই বুঝতে পারে না, শুধু বুঝে পোলার চিকিৎসায় অনেক টাকা লাগব।অশোক লোক দিয়ে টাকা গুলো এনে রেহাননামাকে দেয়।
-” তোর লটারি বাঁধছে রে রেহু।এ টাকার মালিক তুই।আমি না।আমি ভোগ করতে চায়ছিলাম;তাই তো এ দশা!”
–
-“রেহাননামা বলে না অশোক দা এতো তোমারি টাকা! আমি তো এখনো দামই দিই নি তোমার।”
দুজনের মধ্য উভয় উভয়ইকে দিয়ে দিতে চায় টাকা, অথচ দুজনেই অনেক গরীব।কী অবাক কান্ড!অবশেষে মধ্যস্থতা হয়। অশোক পঞ্চাশটি পাওনা টাকা চেয়ে নেয়। রেহাননামার ছেলের অসুখে অনেক টাকা দরকার তাই সে তিন লাখ টাকা নেয়,বাকিটাকা সে অশোক দাদার হাতে তুলে দেয়।রেহাননামা ও অশোক প্রমাণ করে দেয় এই সমাজে এখনোও তাদের মত মানুষ আছে;যাদের কাছে টাকার চেয়েও অধিক মূল্যবান হৃদয় বিদ্যমান।