প্রেম প্রেম ভাব, প্রেমের অভাব

প্রেম প্রেম ভাব, প্রেমের অভাব

মোবাইলের সুইচ অন করতেই স্ক্রিন ঝলওয়ার করে রিংটোন বেজে উঠলো। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষার হলের ধকল থেকে একটু হাঁফ ছেড়ে বাসে উঠতে যাবে, সে সময় । তবুও উঠতি কেশের এক তরুণের কাছে এই বিপত্তি কিছুই না, বরঞ্চ শুশুকের মতো খানিক লাফিয়ে ফোন রিসিভ করে বলে ওঠে– হ্যালো!

– হ্যাঁ, আমি চট্টগ্রামে এসেছি।

– কি বলো! কখন?

– এই তো, সকালে গাড়িতে উঠলাম ফেনী স্টেশন থেকে।

– চট্টগ্রাম শহরে কেউ আছে?

সুমি খানিক সময় নেয় উত্তর দিতে। তারপর ক্ষীণ স্বরে বলে– দূরসম্পর্কের এক আত্মীয় আছে মুরাদপুরে।

শাওন কিছুটা অবাক হওয়া স্বরে বললো– তুমি না বলেছিলে এখানে তোমার কোনো আত্মীয় নেই, আসতে পারবে না!

– ঐসব রাখো, এখনো আমি গাড়িতে। পৌঁছতে পৌঁছতে ঘন্টা দুয়েক লাগতে পারে। এখন তুমি কোথায়?

– পরীক্ষার হল থেকে এইমাত্র বের হলাম।

– তাড়াতাড়ি এসো, মুরাদপুরের মোড়ে দাঁড়াবো।

– আচ্ছা, ঠিক আছে।

মোবাইল প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে বাড়ির দিকে কলেজের বাসে না গিয়ে শাওন শহরগামী বাসে উঠে। মনের মধ্যে হালকা খুশির বাতাস ফরফর করে দৌড়ে। যেন বাসের জানালার দিকে রাস্তার ধারের লতাপাতায় ছোট্ট ছোট্ট প্রজাপতি। অথচ সুমির সাথে সাত মাসের মোবাইলের কথায়, একবারও আসতে পারবে বলেনি ভুলবশতও। তাই হঠাৎ এমন খবরে শাওনের দুপুরের উপোস পেট বেমালুম। একবারও মনে আসলো না কিঞ্চিৎ খটকা। এমন অসম বয়সী নারীকে সদূর ফেনী থেকে সে এনে ফেলছে চম্বুকের টানের মতো কয়েকমাসের মোবাইলের কথায়! বরঞ্চ নিজের মধ্যে খুব বাহাদুরি হাবভাব। বাসের ঝটকায় দুলতে দুলতে রসিয়ে রসিয়ে চুপচাপ হাসছে শাওন। সে নিজেকে যথার্থই ভাবে– সে বাস্তবের একটা হিরো।

স্বামী ছাড়া স্বামীর ভিটেয় মাথা গুঁজে থাকা প্রতিনিয়ত যুদ্ধজয়ের মতো। তবুও সংসারের ফাঁক ফোকরে, অবসরে শাওনের সাথে মোবাইলে কথালাপে সময় কাটে বেশ। কিন্তু সুমিকে কখনো বিশ্বাস করা হয়ে উঠে না, বরঞ্চ বিশ্বাস করতে পারে না শাওন। কেননা সে এক ঘটনা। শাওনের বড় ভাই কলিম ছিল মৌলভী ধাঁচের নম্র ভদ্র এক ছেলে। হঠাৎ সে দিন ও রাতের তফাতের মতো বদলে যায়! হঠাৎ খিটখিটে, হঠাৎ নামাজ কালাম ছেড়ে বেঁকে বসে ৯০ ডিগ্রি। প্রথম প্রথম মাকে ভয় আর ছোটদের সামনে শঙ্কাবোধ ছিল। লজ্জা ছিল তাই আড়ালে গিয়ে মোবাইলে কথা বলতো। একদিন এ পর্দাটাও কখন উঠে গেল জানলো না কেউ !

বিদেশী বাপের দেওয়া মোবাইলটা আঁঠার মতো লেগে থাকে কানে। এতো বড় ছেলেকে কিছু বলবে এমনভাবে প্রস্তুত ছিলো না শাওনের মা। পরিবারে শুধু না। আত্মীয় স্বজনও কলিমকে সমীহ করে চলতো। হঠাৎ এমন স্বভাব-চরিত্র পাল্টে যাওয়ায় সবাই ভড়কে যায়।

খাওয়া দাওয়ায় অনিয়ম আর রাতের ঘুম হারাম করে বিছানায় গুনগুন, ফিঁসফিঁস করে কথা বলাতে সবার ছোট ভাইটিও সপ্তাহখানিক থেকে কলিমের সাথে এক রুমে ঘুমাতে যায় না। একদিনতো খাবার টেবিলে সবার সামনে ওয়ানে পড়ুয়া ছোটভাইটি বলেই দিল– মা, মা বড় ভাই মোবাইলে কথা বলে বলে মোবাইলটাতে চুমু দেয়, আর জান… জান বলতে থাকে।

সবাই এ কথা শুনে হা! কলিম আধ খাওয়া ভাতের বাসন রেখে চলে গেল। এমনকি যাওয়ার সময় এঁটো হাতও ধোয়নি।

দিনদিন ঘরের সবাই অস্থির। তদোপুরি শাওনের মেজো ভাই, তার থেকে মোবাইল নাম্বারটি চালাচালি হচ্ছে। তাদেরকে এক ছোঁয়াচে ভাইরাসের মতো পেয়ে বসেছে। শাওনের মেজো ভাইয়ের বন্ধুটি একটু গুন্ডা টাইপের, না জানি মোবাইল নাম্বারটি কত শত ছেলেকে মোহের ফাঁদে আটকালো।

শাওন একরাতে ভাবে যে করেই হোক মোবাইল নাম্বারটি তাকেও নিতে হবে। সে ভাবনাতে খুব ভোরে ঘুম থেকে জাগে তা নয়, প্রতিদিন এমনিতে ভোরে উঠে। ভোরে বাসি মুখে পড়লে নাকি পড়াতে বরকত হয় এমন মুরব্বিয়ানা কথার বিশ্বাসে। পড়ার টেবিল থেকে বড় ভাইয়ের রুমে সন্তর্পণে ঢুকে বালিশের নিচ থেকে মোবাইলটি টিপে নাম্বারটা কলম দিয়ে হাতে লিখে নিল। তারপর মোবাইলটি ঠিক আগের জায়গায় বালিশের নিচে রেখে নিজের রুমে চলে আসল দ্রুত।

শাওন এসব ভাবতে ভাবতে গর্ববোধে নিজের জন্য দিলখুশ। বাসটি প্রায় পৌঁছার মুহূর্তে হঠাৎ ঘনকালো আকাশ থেকে তাগড়া বৃষ্টি।

বাসের মধ্য থেকে রিং দিল শাওন। ফোনের ওপাশ থেকে সুমির জিজ্ঞাসা– তুমি আসলে?

– হ্যাঁ, মুরাদপুরে।

– রাস্তার বা পাশে একটু পশ্চিমে হেঁটে বাঁকা গলির মুখে আসো। তুমি কোন কালারের শার্ট পড়লে?

– সাদা রঙের।

সন্ধ্যা হতে সামান্য বাকি থাকলেও মেঘ কালো ঝড়ো বৃষ্টিতে অন্ধকার নেমে গেছে ঝাঁকালো। দোকানপাটের বাতি জ্বেলে দিল। কেউ কারো দিকে চেয়ে থাকার ফুরসত নেই, অবিরাম বৃষ্টিধারা। গলির মুখে আসতে অন্ধকারে ছাতা নিয়ে এক নারী হাতের ইশারায় কাছে ডাকল। শাওনের বুঝতে বিলম্ব হলো না, সেই সুমি।

কালো বোরকা পড়া চিপচিপে গড়নের শরীর। নেকাবে ঢাকা উচ্ছল দু’চোখের সামনে এসে দাঁড়াল শাওন। ছাতার মধ্যে নিয়ে সুমি বললো– কেমন আছো?

শাওন ভেজা শার্টে অনর্থক বৃষ্টির পানি ঝাড়ছিল। চোখ বরাবর নোয়ানো চুলগুলো ঝাড়ল। নিশ্বাসপ্রশ্বাসের মৃদু ঘর্ষণে জবাব দিল– এইতো, কী বৃষ্টি হঠাৎ!

সুমি ছাতাটা ঝাঁকিয়ে বললো– দাঁড়িয়ে থাকবে? না কোথাও যাবে?

শাওন সুমির ছাতা ধরা হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় চেপে একটু টেনে বললো– চলো!

হাঁটতে হাঁটতে চিপাগলি পেরিয়ে আরেকটা গলিতে আসলো। আদিম পাহাড় কেটে তৈরি করা রাস্তা। নির্জন পথে গাছের ছায়ায় আরো নির্জনতা, বৃষ্টির শব্দই কেবল। এরকম ঘোরলাগা বৃষ্টিতে কেউ পথে নেই,হয়তো হঠাৎ কোনো পথিক ছাতা গুঁজে হেঁটে যাচ্ছে। তবে কাউকে কেউ দেখার ইচ্ছা কারো নেই। সুমি শাওনের দিকে তাকিয়ে বললো– জানো আমার বর ছিল আমার চেয়ে দুই ইঞ্চি বেঁটে।

– আর আমি?

– তুমি আমার থেকে দুই ইঞ্চি লম্বা হতে পারো।

শাওন ঠোঁট চেপে মৃদু হাসল। সুমি শাওনকে কোমর জড়িয়ে জাপটে ধরছে, ব্যতিব্যস্ত হয়ে ধুঁয়ো উঠা চায়ের মতো নিশ্বাসে নেকাব সরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বহুদিনের উপোসি চুমু দেয় ঠোঁটে। দুজনের কেউ কারো ঠোঁট ছেড়ে দেওয়ার পাত্র- পাত্রী না। হঠাৎ পিকআপের আলো সুমির চোখে ধেয়ে আসলো। তড়িঘড়ি করে ঠোঁট ছেড়ে ছাতাটা শক্ত করে ধরলো আবার দুজনের মাথার উপর। দুজন অবুঝের মতো দুজনকে চাওয়াচাওয়ি করে কাঁপতে লাগল। সুমি বলে উঠলো– তোমার কোনো পরিচিত বন্ধুর বাসা নেই এতো বড়ো শহরে?

শাওন অস্ফুট স্বরে বললো– নেই, তবে যেতে গেলে তা এখান থেকে অনেক দূরে।

সুমি যেন ভেঙ্গে পড়ছে হাঁটতে। শাওন বুঝেও না বুঝার ভান করে বলে– বাসা কি জন্য?

– তুমি বুঝো না!

শাওন এ কথার আর উত্তর দেয় না। রিক্সা আটকিয়ে বলে– উঠো, আজ যাই। মা চিন্তা করবে।

সুমি আনমনা হয়ে মাথা নাড়িয়ে রিক্সায় উঠলো। হুডটানা, সামনে প্লাস্টিকের পর্দা টাঙানো শুধু দুজনের চোখ ছাড়া কিছুও দেখা যায় না। রিক্সার হুডে ঠিক দুজনের মাথার উপর কি তুমুল বৃষ্টির বাড়াবাড়ি অথচ ভেতরে দুজন ঘেমে উঠছে! দুজনের আজ এ একটাই পৃথিবী। আলিঙ্গনে কোনো কথা নেই, বুকে হাতে শব্দ নেই, কে কাকে নিজের মধ্যে নিয়ে পুষবে পাখির মতো। বুক দুটো পিঞ্জরা বুঝি। বড় বেশি শিহরণ, বড় বেশি মায়া,বড় বেশি সুখ।

০২.

পরেরদিন শুক্রবার। পরীক্ষা নেই। গতকালের বৃষ্টিতে ভিজে শরীরে কেমন জানি ব্যথা ব্যথা। মাথার মধ্যে পাথর বসে আছে যেন। নাস্তা সেরে পরিবারের সাথে যে একটু পড়তে টেবিলে বসলো, এসময় রিংটোন বেজে উঠলো। মোবাইল কানে রাখতে কথা আসলো– বের হচ্ছো? আমি আজ একদিন চট্টগ্রাম থাকবো তারপর ফেনী চলে যাব। আসবে?

শাওন অকপটে উত্তর দিল– বের হচ্ছি এখন।

মোবাইলের ওপাশে উচ্ছ্বসিত স্বরে বললো– আমিও বের হচ্ছি।

রোদ ঝলমলে সকাল। আজ সুমির কালো বোরকাটি নেই। নীল রঙের শাড়ির সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ, এমনকি কানের দুলটিও। আজ বুঝি সর্বাত্মক প্রভিতার ডালা থেকে খুঁটে খুঁটে নিজেকে সাজালো সুমি। অসম বয়সের ফারাক হয়তো কিছু ঘুচেছে, শাওন আগাগোড়া দেখছে বারবার। চিড়িয়াখানায় ঢুকে সুমি পাহাড়ে উঠছে, পিছে পিছে শাওন। দুজন পাহাড়ের খাঁজে বসলো। ফয়ে’স লেক-এর কনসার্ট থেকে মেলোডি ধাঁচের একটি গানের আওয়াজ ভেসে আসছে বাতাসে। শাওনের মন নিবেশিত সেদিকে। সুমি আস্তে করে মাথা ঠেকে দিল শাওনের কাঁধে। শাওনের অস্বস্থি লাগছে এ প্রথম কয়েকজন ছেলেমেয়ের প্রেমজুটি চোখের সামনে ঘুরতে দেখে। সুমি বলতে থাকল– আচ্ছা আমাকে তুমি আরো আপন করে পেতে চাও না? সত্যি আমি একা থাকতে পারছি না, আমরা দুজনে কি একটা ঘর বানাতে পারি না?

শাওন চুপচাপ। হয়তো এসব কথাকে পাশ কাটাতে চাচ্ছে। পাহাড়ের উপর থেকে কয়েকজন পথচারী গলা খাঁকারি দিয়ে নিচে নেমে আসতে দেখে শাওনের মনটাতে মোচড় দিয়ে উঠলো। শাওনের মনে ভয় জমাট বাঁধে, মনে মনে ভাবে– আমাদের দুজনকে ধরে হেনস্থা করবে না তো! সুমিকে তড়িঘড়ি করে টেনে তুলে বললো– আসো ঐদিকে ঘুরি!

চিড়িয়াখানায় বানরগুলোর নাচন, ভেলকি শাওনের চটপটে মনকে দোলায়িত করে দিল। ময়ূরপুচ্ছ মেলে ধরলো তার কারিশমা। বাঘ, হরিণ ও কুমির যাই দেখছে দুজনের মন অন্তত চিড়িয়াখানায় নেই। বনের পশু পাখিকে জোর করে আটকে রাখা যায়, নিজের মনকে একেবারে নয়।

হাঁটতে হাঁটতে দুজন অবচেতনে চিড়িয়াখানার বাইরে এসে শাওন সিএনজি ভাড়া করলো। সুমির দিকে মৃদু হেসে বললো– তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাব, গাড়িতে উঠো।

সিএনজিতে বসে সুমি শাওনের বা হাত নিজের কাছে টেনে খুব আদরমাখা কণ্ঠে বললো– তুমি আমায় ছেড়ে যাবে না তো?

শাওন কথার উত্তর না দিয়ে হাতটি ছাড়িয়ে প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল নিয়ে কল করে– হ্যালো রনি, আমি তোর বাসায় আসছি।

সিএনজি ড্রাইভারের দিকে একবার চেয়ে খুব ক্ষীণ স্বরে বলে– বাসায় আর কেউ আছে?

– নাই।

– তাহলে আমি আসছি, সাথে আরেকজন আসছে।

কল কেটে স্মিত হেসে মোবাইল পকেটে ঢুকালো শাওন। নিজ থেকে এবার বা হাতটি সুমির হাতে রাখলো। দুজন আরো ঘেঁষাঘেঁষি করে বসলো। আবার বাম হাতটি ছাড়িয়ে সুমির কোমরের দিকে শাড়ির খোলা জায়গায় হাত রাখতে চেয়েও রাখলো না। কেবল পিছন থেকে হাত ঘুরিয়ে কোমরটা চেপে জড়িয়ে ধরলো। ঠিক আধ ঘন্টা পর সিএনজি থেকে নেমে ড্রাইভারকে ভাড়া দিয়ে সোজা একটি গলি পেরিয়ে মোড় ঘুরে একটি ছোট্ট পুরাতন বাড়িতে উঠলো। দ্বিতীয় তলায় ব্যাচেলরদের ভাড়া বাসা। ঢুকতেই সিঁড়ির সাথে লাগানো খোলা রুমটায় ঢুকলো। ঢুকতেই দরজা বন্ধ করে দিল শাওনের বন্ধু রনি।

ছোট খাটে গিয়ে বসলো সুমি। সোনালি নাকফুলটা চিকচিক করছে বিকেলের আলোয়। হঠাৎ কি মনে করে জানলার বাইরে একটু তাকিয়ে জানলার সাদা পর্দাটা টেনে দিল সুমি। খাটে দুই পা তুলে দুজন পাশাপাশি বসলো। জানলার পর্দা টেনে রনিকে সুমি বললো– ভাইয়া এ বাসায় আপনি একা থাকেন?

– না, আরো দুজন আছে। ওরা গ্রামে গেছে আজ শুক্রবার তো।

সুমি ঘন লিপস্টিকের ঠোঁট একটু বাঁকিয়ে বললো– ওহ্!

রনি দরজার পাশে গিয়ে শাওনকে বললো- দোস্ত দরজাটা একটু লাগা।

– কোথায় যাবি?

– একটু বস, আসছি।

দরজাটা একটু চেপে খাটে উঠে শাওন সুমির উপর হামলে পড়লো। নিবিড়তায় দুজন দুজনকে চেপে ধরলো। হঠাৎ সুমি শাওনের বা হাত নাভির কাছ থেকে সরিয়ে দিয়ে বললো– আগে বলো নি কেন ? আজ করবে, একটু প্রস্তুত হয়ে আসতাম!

শাওন নিজের মধ্যে খিচে গেল। হাত সরিয়ে বসতে রনি কয়েকটি কলা, বিস্কিট ও সেভেন আপ এনে রুমে ঢুকলো। একটা রুমে রান্নাবান্না, খাওয়া-দাওয়া ও ঘুমানো সব। জিনিসগুলো রেখে হঠাৎ রনি সুমির কাছে আসল। কি রকম ঘনকালো মুখটি ঘেমে দরদর করে, চোখের ভেতরের সাদা অংশ লাল টকটকে মোষের চোখের মতো হয়ে এল। কোনো শব্দও না করে সুমিকে ঝাপটে ধরতে চাইলো। শাওন কি করবে না করবে এসব ভাববার আগে রনিকে একটানে ধাক্কায় দরজার কাছে ফেলে দিল। রনি সেখান থেকে উঠে এসে খাটের নিচ থেকে বটকী দা দিয়ে নিজে কোপ খেতে চাচ্ছে আর বলছে, আমাকে দাও, না হয় কোপ খাবো।

এমন সমস্যায় হয়তো দুজনের কেউ পড়েনি এ ছোট্ট জীবনে। দুজনে টেনে দা-টিকে ছাড়াতে গলদঘর্ম। শাওন সুমিকে ইশারায় বললো– গুছিয়ে তুমি রুম থেকে বের হও।

অনেক ধস্তাধস্তির পর শরীর কাঁপিয়ে রনি নিস্তেজ হল। শাওন আগপিছ না ভেবে রুম থেকে বের হয়ে আবার সিএনজিতে উঠে। দুজন বড় বাঁচা বাঁচলো এমন হাঁফ ছেড়ে সিটে বসলো।

কিছু পথ দুজনে চুপচাপ। একবার শুধু শাওন থেকে শাওনের মোবাইলটি চেয়ে নিল সুমি। কি জন্য এ চাওয়া সে কথাও জিজ্ঞেস করার স্পৃহা জাগলো না শাওনের। প্রায় আধঘন্টা পর শাওন মুখ খুলল– তোমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছি জানো?

সুমি উদাস চাহনিতে জানতে চাইলো– কোথায়?

– আমার পীর মুর্শিদের কাছে।

– কেন?

– জীবনে তো অনেক গুনাহ করেছ। আমি সরাসরি বলি, তুমি অনেক ছেলের জীবন নষ্ট করেছ। আমার বড় ভাই,মেজো ভাই না শুধু এলাকার প্রায় যুবককে! কেউ তোমাকে ফেনী থেকে আনতে পারে নি। তুমি যে দুই বাচ্চার মা এটাও কেউ জানে না। আমি চ্যালেঞ্জ নিয়েছি নিজে নিজে যে করেই হোক তোমাকে দেখবোই। তুমি একজন মেয়ে হয়ে এতো ছেলের মাথা কিভাবে নষ্ট করলে!

সুমি প্রায় ধসিয়ে পড়বে এমন। তবে একটা ‘টু’ শব্দও উচ্চারণ করলো না। সিএনজি থেকে নেমে সুমি শাওনের পিছে পিছে একটা বড় ফ্ল্যাট বাড়িতে ঢুকলো। দরজায় শাওনের মা ও মেজ ভাই। শাওন তার মাকে সুমিকে দেখিয়ে বললো– এই সে সুমি, যে তোমার নম্রভদ্র বড় ছেলে ও মেজ ছেলের মাথা…।

মা সব বুঝে গেল। মায়েরা সব বোঝে। শাওন এক প্রকার সুমিকে মা ও ভাইয়ের কাছে গছিয়ে সেখান থেকে বাড়িতে চলে এলো।

তিনদিন পর গ্রামে রনির সাথে শাওনের দেখা কলেজের যাত্রী ছাউনির সামনে। তাদের সাথে আরো অনেক বন্ধু জড়ো হল। শাওন হাত নাড়িয়ে রনিকে বললো— দোস্ত কেমন আছিস?

রনি কেমন আছে এটার উত্তর না দিয়ে বলে উঠলো– তোর সুমিরে তো লাগিয়ে দিছি। গতকালও আমার রুমে আসলো। খুব জেদ দেখালি দুজনে।

শাওনের মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। রাগে অপমানে পিত্ত ফেটে যাচ্ছে বুঝি,বমি আসতে চাইলো। সে হাঁটা দিল বাড়ির পথে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত