আবোল-তাবোল

আবোল-তাবোল

উনুনের অবিচারে যখন ঘর পুড়লো আমি বাড়ি ছেড়ে যাইনি। চেনা কাঠবিড়ালিগুলো ডালের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়েছিলো কয়েকবার। মাচাঙের হাড়ি-পাতিলগুলোর আড়ালে লুকিয়ে থাকা ইঁদুরগুলো নিশ্চয় গর্ত খুঁজে পেয়েছিলো। বুঝি শেষ রক্ষা হয়নি। সিঁকিতে ঝোলা মাটির হাড়ি, মাকড়সার ঝুল, সারি বাধা পিঁপড়ের দল ওরা শতাব্দীর তারকাদের মত চিরচেনা, কিংবা অবহেলিত ভালবাসার মতো।

একদিন সাঁঝ পেরিয়ে মধুমতীর গানের আসর ছেড়ে বাড়ি ফিরেছি। পার্বতী বাউল বড্ড নেচেছিলো ঐদিন। হাত-মুখ ধুয়ে গা মোছার সময় বউ জড়িয়ে ধরে বলেছিলো, কথা দাও কখনও ছেড়ে যাবে না? আমি হেসে গড়াগড়ি খাই দশা। তাই দেখে ওর সে কী কান্না!

তিন গ্রাম দূরে ফরাশডাঙার হাট। বাজারের তালিকা হাতে রওনা দেয়ার পর পিছন থেকে বলে উঠলো, একটু দাড়াও! চোখ-মুখ লাল করে, চোখে চোখ রেখে বললো, “আর ভিতরের জা…।” কথা শেষ না হতেই ঝেড়ে দৌড়। দরজার কপাটের আড়াল থেকে মুখ লুকিয়ে বললো, কথা দাও ছেড়ে যাবে না?

ফরাশডাঙার হাট থেকে কেনা কাচের চুড়ি আর রুপোর নূপুর নিয়ে দিব্যি মনের সুখে বাড়ি ফিরছিলাম। ঝনঝন করে কানে বেজে চলেছে চুড়ি আর নূপুরের ঝঙ্কার। দূরে মাঝ বিলে সাঁঝ গড়িয়ে এসেছে। ক্লান্ত পাখিদের এখনও বহু পথ পাড়ি দেয়া বাকি। চোখের সামনে ভেসে চলেছে লাল মুখের ফিক করা হাসি। কানে গুঁজে রাখা টগর ফুলেরও বুঝি কলজে শুকিয়ে আসে ও হাসিতে। পথ ফুরায় না।

বাড়ি ফিরে দেখি অগ্নিদগ্ধ বাড়ির আধা অবশেষ জ্বলছে। কথা দেয়া হলো না যে, ছেড়ে যাবো না। বলা হলো না, ভালবাসি। হয়তো “ভালবাসি” মুখে বলতে নেই; হৃদয় দিয়ে ছড়িয়ে দিতে হয় আহাজারে, হাহাকারে।

২.
উঠোনের রোদটা পড়ে এলো। ভেজা ধানের গন্ধ নাকে সুরসুরি দিচ্ছে। লাল-কালো কুকুরটা দিন শেষে বাড়ি ফিরেছে। অপরিচিত কাউকে দেখলে চেঁচিয়ে ওঠে। বাহির বাড়িতে (রাস্তা সংলগ্ন উঠোন) ও নিজের রাজত্ব জাহির করছে। বাবা জলচকিতে বসে আছেন, বারান্দায়। ধর্ম জাল বুনে চলেছেন আপন মনে। মা পা দিয়ে ধান গোছাচ্ছেন। “কইগো, কোথায় গেলে!” ক্ষেত থেকে ফিরে কাছা ছেড়েছি মাত্র। ঘাম আর কাদায় একাকার শরীর। মা বললেন, “কইগো বউ বেটা ফিরেছে”। মেয়েটা তড়িঘড়ি করে কাছে এলো। এতক্ষণ ছেলেটাকে ঘুম পাড়াচ্ছিলো। কলপাড়ে দাড়িয়ে চাপ দিচ্ছে কলে। হাত-মুখ ধোয়া শেষে জিজ্ঞেস করলাম, “গামছা কই?” শাড়ির আঁচল এগিয়ে দিলো। প্রতিদিনই এমন করে মেয়েটা। মনে হয় ইচ্ছে করেই গামছা আনে না। মুখ মোছা শেষে খুব যত্ন করে গায়ে জড়িয়ে নেয় আঁচলটা। কলপাড় থেকে উঠোন হয়ে ঘরে যেতে যেতে কাধে হাতের স্পর্শ এসে পড়ে। পিছু ফিরতেই ঠোঁটে এসে পড়ে দ্বিতীয় ঠোঁটের স্পর্শ। আমি নির্বাক। নিস্প্রাণ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকি। ঘটনার অস্বাভাবিকতা বুঝতে সময় লাগে। আমি অন্য দুনিয়ায় চলে গেছি কখন; জানি না। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি মা-বাবার চোখে ধরা পড়লাম কিনা। এত সাহস মেয়েটার, বাব্বা!

এতক্ষণে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে সে। ঘরে ঢুকতে সাঁঝবাতি জ্বলে উঠলো। কেরোসিন পোড়ার গন্ধ নাকে আসছে। জলচকি এগিয়ে দিয়ে একটা হাতপাখা নিয়ে বসে পড়লো সামনে। পাখা এপাশ ওপাশ করছে। দুনিয়া শীতল হয়ে এলো ক্ষণিকেই। সোনালী আলোয় যেন রুপের মেলা বসেছে। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি আর ও নিচে। একটু অপ্রস্তুত মনে হচ্ছে। একটু আগের পাগলামী করা লজ্জামুখ এখনও স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি।

বিছানায় উঠে ছেলেটাকে জ্বালাতে লাগলাম। ও বলল এইমাত্র ঘুমিয়েছে ছেলেটা; জ্বাগিওনা ওকে। জানি ছেলেটা উঠলে অনেক্ষণ ধরে কাঁদবে। তবু জাগাতে লাগলাম। এবার বউ রাগরাগ ভাব দেখাতে লাগলো। থাক আজকে না হয় বাদই দিলাম।

“তুমি বস। আমি ভাত নিয়ে আসি। তরকারি হওয়া আরেকটু বাকী আছে।” রান্নাঘরে চলে গেলো বউ। এতক্ষণে সারাদিনের ক্লান্তি টের পাচ্ছি। চোখজুড়ে ঘুম সাড়া দিচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম প্রায়, এমন সময় ডাক পড়লো। “কই শুনছো! ওঠো। ভাত হয়ে গেছে।” “এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।” আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ি।

ঘুম ভাঙতে দেখি, ডান হাত মাথার নিচে রেখে, বাম হাত দিয়ে আমার বুকে ভর করে আছে মেয়েটা। আমি বললাম, “কী হলো?” “কই কিছু না তো! খাবে না?” “হুম, দাও। ক্ষিধে পেয়েছে।” ঝিঁঝিঁ পোকা আর দূর থেকে আসা শেয়ালের ডাক কানে বেজে চলেছে। সুরের জাদুকরকেও হার মানায় এ সুর। ওর চুলের গন্ধ, পাখার বাতাস আর চোখের চাহনির এখানে সেখানে হারিয়ে গেছে ক্ষুধা। “তুমি খাবে না?” “মার সাথে খাবো।” “না। আজ আমার সাথে খাবে।” বাধ্য মেয়ের মত হাত ধুল। চুপ করে বসে আছে। “কই খাও না?” “হাতে ব্যথা।” “কী হয়েছে হাতে?” ও হাত বাড়িয়ে দেয়। আমি বাম হাত ওর হাত ছুঁতে শিউরে উঠলো। চোখের কোণায় দুষ্টু হাসি। ঘটনার বৃত্তান্ত বুঝতে বাকী থাকে না। “আচ্ছা ঠিক আছে, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।” খাওয়া শেষে ওর হাত ধুইয়ে দিলাম। ও আঁচল দিয়ে আমার হাত-মুখ মুছে দিলো।

ছেলেটা আমাদের দুজনকে দুই মেরুর বাসিন্দা বানিয়ে রেখেছে; মায়ের গায়ের ওপর হাত দিয়ে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। রাতেরা গাঢ় হয়; তারাদের তেজ বাড়ে। ঘড়ির কাঁটার আওয়াজও কানে লাগে। চোখের পাতা ক্লান্তিতে অবসন্ন।

ঘুম ভেঙে গেলো। মাঝরাত। মিটমিট করে জ্বলতে থাকা হারিকেনের সলতেটা নিভিয়ে দিলাম। পশ্চিমের জানালা খোলা। চাঁদের উজ্জ্বল আলো এসে পড়ছে প্রেয়সীর মুখে। আমি বাম হাত মাথার নিচে দিয়ে আধশোয়া হয়ে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। চাঁদের মিটিমিটি আলোয় জ্বলছে ও মুখ। ও মুখের দিকে তাকিয়ে আমি হাজার রাত পার করে দিতে পারবো। আমার ভালবাসারা দিব্যি জমে থাকতে পারবে ও চোখের ভাজে। ঘুমের ভান করে একটা হাত মেলে দিলাম ওর কোমরে। ও ঘুমের ঘোরেই আমার হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। সে হাত থেকে হাত ছাড়ানোর সাহস আমার নেই!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত